পদকের পদাবলী ও মুক্তিযোদ্ধা সনদ by মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া
সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি সংবাদ
আমার এ লেখার উপজীব্য। প্রথমটি, সনদ নেয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায়
৫ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
দ্বিতীয়টি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত
নিয়েছে সরকার। দ্বিতীয়টির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা নির্ণয় এবং প্রকৃত
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নির্ধারণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাই কমিটিও
গঠন করা হবে। জানা গেছে, আগামী ২৬ মার্চ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ এবং ডিজিটাল
পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন করে পরিচয়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়টির আয়োজন প্রথম ঘটনাটির প্রেক্ষিতে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যতদূর
জানি, মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি করছেন এমন আরও অনেক ব্যক্তিকে
খুঁজে পাওয়া যাবে। দেরিতে হলেও সরকারের এ সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগকে সাধুবাদ
জানাই। এটা সত্য যে, সরকারের তরফ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য
নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের সনদ
সংগ্রহের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ কেউ অনৈতিক
পন্থায় বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেছেন। ৫ সচিবের সনদ
জালিয়াতির ঘটনা তারই অংশ। আমার এলাকায়ও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। যেন নতুন করে
মুক্তিযোদ্ধা জন্মাচ্ছে! দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও
মুক্তিযোদ্ধার একটি সঠিক ও স্বচ্ছ চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এ
বাস্তবতারই সুযোগ নিচ্ছে জালিয়াত চক্র।
তবে সরকার বা মন্ত্রণালয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা কতটুকু সফল হবে তা বলা মুশকিল। সিদ্ধান্তটি স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হলেও আমি সন্দিহান। কারণ সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও। তবে এটা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এমন অনেকেই সনদ পাননি। আবার কেউ কেউ ভাবতে পারেননি এই সনদ কোনোদিন কাজে লাগবে। পাঠক জেনে অবাক হবেন, আমার নিজেরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেই। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে ব্যারাক থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যুদ্ধ শেষে আবার সেনাবাহিনীতে ফিরে গেছি। শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে রণাঙ্গনে আমার ছোটভাই আবুল হোসেন ভূঁইয়াও যুদ্ধ করেছে একজন সিভিলিয়ান হয়ে, সেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ পায়নি। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। জানি না এ বিষয়গুলো মন্ত্রণালয় কীভাবে সমাধা করবে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এই সনদ নিয়ে নানা কথা শোনা গেছে। যে তালিকা হয়েছিল তার বাইরেও অনেকের প্রিয়ভাজন বা আত্মীয়তার সূত্রে অনেকেই তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। একই অভিযোগ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতা পদক নিয়েও। বিভিন্ন সময় এই পদক প্রদানের অনিয়ম নিয়ে অনেকে লেখালেখিও করেছেন।
স্বাধীনতার পর সরকার কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতা পদক দেয়া হয়। পদকগুলো হল- বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক। আমি তখন মেজর পদে ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার যশোর সেনানিবাসে। এটি ছিল ৫৫ ব্রিগেডের অধীনে। কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল এমএ মঞ্জুর। পদক ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে সেনানিবাসে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। রাগে-ক্ষোভে অনেক অফিসার এ বিষয়ে রিপ্রেজেনটেশন দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আমিও একজন। পদক না পাওয়ার বিষয়টি আমাকে সে সময় খুবই ব্যথিত করে। বিষয়টি নিয়ে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও পাঠাই। চিঠিটির একটি বাক্য ছিল এ রকম- My contribution in the War of Liberation was of no mean consequences in compared to those who are given gallantry awards. কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কেউ তখন এ ব্যাপারে কোনো সুবিচার পাইনি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকের প্রথম কয়েকজনের একজন। শুধু কুমিড়ার লড়াই নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কালুরঘাটের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র (৩০ মার্চ পাকবাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত) থেকে একটা ঘোষণা বারবার দেয়া হতো- ‘যার যার অস্ত্র নিয়ে লালদীঘি ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন।’ আমিই সেই ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া।
সেদিন পদক নিয়ে নানা ক্ষোভের কথা শুনেছি অনেকের মুখে। আবার পদক পেয়েছেন এমন অনেককে বলতে শুনেছি, আমি তো ফ্রন্টেই ছিলাম না, তারপরও পদক জুটল ভাগ্যে! শুধু পদক না পেয়েই ক্ষুব্ধ ছিলেন না, পদক পেয়েও অনেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন। আমারই এক সহযোদ্ধার ধারণা ছিল, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের তুলনায় পদকটা পেয়েছেন নিম্ন মর্যাদার। তাই তিনি নামের শেষে পদকটা ব্যবহার করতেন না। তবে মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের প্লট পেতে (পয়েন্টের কারণে) ১৯৭৮ সালে এই পদকটি তাকে সাহায্য করেছিল, পরে তিনি এটি ব্যবহার করতেন। আর যেহেতু আমি পদক পাইনি, তাই আমাকে প্লটের জন্য ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে আশুগঞ্জে যখন মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছিল, তখন আমার কোম্পানির একজন হাবিলদার ভয়ে পজিশন ছেড়ে দুই বগলে দুটি আর্টিলারি শেল নিয়ে আশুগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে সোহাগপুরে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যায়। তাকে খুঁজে বের করতে আমার তিন দিন লেগেছিল। তার উদাহরণটি টানার উদ্দেশ্য, সেও সাহসিকতা পদক পেয়েছিল। আরেকজনের কথা মনে পড়ে। সে ছিল আমার রানার। কুমিড়ার যুদ্ধে সে আমার সঙ্গে ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকায় কখনও অবতীর্ণ হয়নি। সেও পদক পেয়েছে। তাদের পদক পরা অবস্থায় দেখলে ওই স্মৃতি মনে পড়ে। আসলে গ্যালেন্টারি অ্যাওয়ার্ড দেয়ার কথা গ্যালেন্টারি অ্যাকশনের ওপর ভিত্তি করে; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ নিয়মটি মানা হয়নি।
পদক নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন এমন একজনের কথা না বললেই নয়। পদকের তালিকা যেদিন প্রকাশ করা হয়, আমি সেদিন যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে এক অফিসার পদক পেয়েছেন শুনে বিশ্বাসই করলেন না যে তাকে পদক দেয়া হয়েছে। কারণ যুদ্ধের সময় তিনি ফ্রন্টে ছিলেন না। যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি আগরতলায় অফিসিয়াল দায়িত্বে ছিলেন। পদক পাওয়ার পর ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই লজ্জায় কয়েকদিন তিনি বাসা থেকে বের হননি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা পদক প্রদান নিয়ে ক্ষোভের কথা অনেকেই তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে বা লেখায় তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি একে খন্দকারের ‘স্বাধীনতার ৪৩ বছর : ভেতরে বাইরে’ বইয়েও সাহসিকতা পদকের অনিয়মের কথা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, সরাসরি বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না, এমন কিছু ব্যক্তিকেও সাহসিকতার পুরস্কার দেয়া হয় (‘একজন জেনারেলের নীরব সাক্ষী’, প্রথম আলো, ০৯.১২.৯৯)। এ দীর্ঘ লেখায় তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সাহসিকতার এ পদক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, একজন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে আমি তা নিয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে নিয়ে যান। আমি প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদক তালিকা রহিত করার আদেশ দেন। এ রহিতাদেশ পরের দিনই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর ওই রহিতাদেশ বাতিলপূর্বক আগের পদকগুলোই বহাল রাখা হয়। পরে জেনেছি, ওই তালিকা বহাল রাখার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল থেকে জোর প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। পরে আমি যখন বাংলাদেশ আর্মির অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হই, তখন এ সংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁজে সাহসিকতা পদকপ্রাপ্ত অনেকেরই লিখিত প্রতিবেদন পাইনি। শুধু একটা নামের তালিকা ও সরকারি গেজেট ছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর বিক্রম’ পদক পেয়েছেন আজকের রাজনীতিক মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। পদক পেয়ে তিনি পদক প্রদানের অনিয়মের কথা তুলে ধরেছেন তার লেখায়। ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘গৌরবাঙ্গনে আমরা ক’জন বিদ্রোহী’ শিরোনামে এক স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে : ‘নূরকে দেখে মনে পড়ে তার সংগ্রামমুখর দিনগুলোর কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন মুখে বলল সে, স্যার জীবন বাজি রেখে কত অপারেশন করলাম আপনার সঙ্গে থেকে; কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো খেতাব পেলাম না। শেষমেশ বাড়ি যাওয়ার আগে সুবেদার মেজর পদে প্রমোশনও মিলল না। কলকাতায় বসে থেকে কতজন বীরউত্তম, বীরবিক্রম খেতাব নিয়ে গেল, এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। কথাগুলো নির্মম সত্য। চরম বৈষম্য করা হয়েছে পদক বিতরণের ক্ষেত্রে।’
পদক প্রদানের বিষয়ে এখনও আলোচনা হচ্ছে। ক’দিন আগে এক টকশোতে মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহিম বীরপ্রতীকও ক্ষোভের সঙ্গে পদক প্রদানের অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার পাশাপাশি সাহসিকতা পদকের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করলে বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করতে পারে। যারা পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের নতুন করে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। আর এটা করা হলে বঞ্চিতরাই সম্মানিত হবেন না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধও সম্মানিত হবে।
আসলে পদক দেয়ার ব্যাপারে গ্যালেন্টারি অ্যাকশনের চেয়ে স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, পক্ষপাতিত্বই বেশি কাজ করেছিল। আমাদের সেক্টর কমান্ডার সবাই ‘বীরউত্তম’ খেতাব পেয়েছেন। যেহেতু পদকের নাম ‘সাহসিকতা পদক’, তাই কোন সাহসিকতাপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য তারা ‘বীরউত্তম’ পদক পেলেন তা সবার জানা উচিত। বীরউত্তম পদক পেয়েছেন কর্নেল আবু তাহের, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য মেজর জিয়া। এছাড়া অন্য কোনো সেক্টর কমান্ডারের রণাঙ্গনে তেমন সাহসিকতাপূর্ণ অপারেশনের কথা আমার জানা নেই। খালেদ মোশাররফ কপালে শেলের আঘাত পান, কর্নেল তাহের একটি পা হারান। এই দুই বীরউত্তমই সম্মুখসমরে লড়েছেন, যার বর্ণণা বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় দেখেছি। অনেকেই জানেন, এমন কয়েকজন বীরউত্তম খেতাবধারী আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের মাটিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কারও কারও বাংলাদেশের মাটিতেও পা রাখতে হয়নি। তারা যুদ্ধ করলেন কোথায়? আর বীরউত্তম খেতাবই বা পেলেন কেন? তারপরও বলব, ‘বীরউত্তম’ খেতাবধারীরা কে কোথায় কোন লড়াইয়ে সাহসিকতার জন্য এই পদক অর্জন করেছেন তা দেশবাসীকে, নতুন প্রজন্মকে জানান। জাতির তা জানার অধিকার আছে।
পদক বা খেতাব পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমি যুদ্ধ করিনি। কিংবা যারা পদক পেয়েছেন, তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাও আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য পদক নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা। মাঝে মাঝে মনে হয়, বীরত্বের স্বীকৃতি তো পেলাম না, এমন তো হতে পারে, মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধ করেছি কি-না সেই প্রশ্ন তোলা হবে। কারণ আমার তো মুক্তিযুদ্ধের সনদও নেই।
তবে সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাই এবং তাদের মূল্যায়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা খুবই প্রশংসনীয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার অনুরোধ, নতুনভাবে মূল্যায়নের তালিকায় কোনো সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা যেন বাদ না পড়েন। তেমনিভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পদক পেয়েছেন এবং যারা পদক পাননি তাদের পুনর্মূল্যায়ন করা যায় কি-না সে বিষয়টিও বিবেচনা করা হোক।
মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া : সভাপতি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
তবে সরকার বা মন্ত্রণালয় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা কতটুকু সফল হবে তা বলা মুশকিল। সিদ্ধান্তটি স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হলেও আমি সন্দিহান। কারণ সরকারের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও। তবে এটা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এমন অনেকেই সনদ পাননি। আবার কেউ কেউ ভাবতে পারেননি এই সনদ কোনোদিন কাজে লাগবে। পাঠক জেনে অবাক হবেন, আমার নিজেরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেই। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোরে ব্যারাক থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যুদ্ধ শেষে আবার সেনাবাহিনীতে ফিরে গেছি। শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে রণাঙ্গনে আমার ছোটভাই আবুল হোসেন ভূঁইয়াও যুদ্ধ করেছে একজন সিভিলিয়ান হয়ে, সেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ পায়নি। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। জানি না এ বিষয়গুলো মন্ত্রণালয় কীভাবে সমাধা করবে।
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এই সনদ নিয়ে নানা কথা শোনা গেছে। যে তালিকা হয়েছিল তার বাইরেও অনেকের প্রিয়ভাজন বা আত্মীয়তার সূত্রে অনেকেই তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। একই অভিযোগ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতা পদক নিয়েও। বিভিন্ন সময় এই পদক প্রদানের অনিয়ম নিয়ে অনেকে লেখালেখিও করেছেন।
স্বাধীনতার পর সরকার কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতা পদক দেয়া হয়। পদকগুলো হল- বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক। আমি তখন মেজর পদে ১২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার যশোর সেনানিবাসে। এটি ছিল ৫৫ ব্রিগেডের অধীনে। কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল এমএ মঞ্জুর। পদক ঘোষণার পর বিষয়টি নিয়ে সেনানিবাসে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। রাগে-ক্ষোভে অনেক অফিসার এ বিষয়ে রিপ্রেজেনটেশন দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আমিও একজন। পদক না পাওয়ার বিষয়টি আমাকে সে সময় খুবই ব্যথিত করে। বিষয়টি নিয়ে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠিও পাঠাই। চিঠিটির একটি বাক্য ছিল এ রকম- My contribution in the War of Liberation was of no mean consequences in compared to those who are given gallantry awards. কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা কেউ তখন এ ব্যাপারে কোনো সুবিচার পাইনি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকের প্রথম কয়েকজনের একজন। শুধু কুমিড়ার লড়াই নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কালুরঘাটের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র (৩০ মার্চ পাকবাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত) থেকে একটা ঘোষণা বারবার দেয়া হতো- ‘যার যার অস্ত্র নিয়ে লালদীঘি ময়দানে ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার কাছে রিপোর্ট করুন।’ আমিই সেই ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া।
সেদিন পদক নিয়ে নানা ক্ষোভের কথা শুনেছি অনেকের মুখে। আবার পদক পেয়েছেন এমন অনেককে বলতে শুনেছি, আমি তো ফ্রন্টেই ছিলাম না, তারপরও পদক জুটল ভাগ্যে! শুধু পদক না পেয়েই ক্ষুব্ধ ছিলেন না, পদক পেয়েও অনেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন। আমারই এক সহযোদ্ধার ধারণা ছিল, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের তুলনায় পদকটা পেয়েছেন নিম্ন মর্যাদার। তাই তিনি নামের শেষে পদকটা ব্যবহার করতেন না। তবে মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসের প্লট পেতে (পয়েন্টের কারণে) ১৯৭৮ সালে এই পদকটি তাকে সাহায্য করেছিল, পরে তিনি এটি ব্যবহার করতেন। আর যেহেতু আমি পদক পাইনি, তাই আমাকে প্লটের জন্য ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে আশুগঞ্জে যখন মিত্রবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছিল, তখন আমার কোম্পানির একজন হাবিলদার ভয়ে পজিশন ছেড়ে দুই বগলে দুটি আর্টিলারি শেল নিয়ে আশুগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে সোহাগপুরে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যায়। তাকে খুঁজে বের করতে আমার তিন দিন লেগেছিল। তার উদাহরণটি টানার উদ্দেশ্য, সেও সাহসিকতা পদক পেয়েছিল। আরেকজনের কথা মনে পড়ে। সে ছিল আমার রানার। কুমিড়ার যুদ্ধে সে আমার সঙ্গে ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকায় কখনও অবতীর্ণ হয়নি। সেও পদক পেয়েছে। তাদের পদক পরা অবস্থায় দেখলে ওই স্মৃতি মনে পড়ে। আসলে গ্যালেন্টারি অ্যাওয়ার্ড দেয়ার কথা গ্যালেন্টারি অ্যাকশনের ওপর ভিত্তি করে; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ নিয়মটি মানা হয়নি।
পদক নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন এমন একজনের কথা না বললেই নয়। পদকের তালিকা যেদিন প্রকাশ করা হয়, আমি সেদিন যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে এক অফিসার পদক পেয়েছেন শুনে বিশ্বাসই করলেন না যে তাকে পদক দেয়া হয়েছে। কারণ যুদ্ধের সময় তিনি ফ্রন্টে ছিলেন না। যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি আগরতলায় অফিসিয়াল দায়িত্বে ছিলেন। পদক পাওয়ার পর ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই লজ্জায় কয়েকদিন তিনি বাসা থেকে বের হননি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা পদক প্রদান নিয়ে ক্ষোভের কথা অনেকেই তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে বা লেখায় তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি একে খন্দকারের ‘স্বাধীনতার ৪৩ বছর : ভেতরে বাইরে’ বইয়েও সাহসিকতা পদকের অনিয়মের কথা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, সরাসরি বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না, এমন কিছু ব্যক্তিকেও সাহসিকতার পুরস্কার দেয়া হয় (‘একজন জেনারেলের নীরব সাক্ষী’, প্রথম আলো, ০৯.১২.৯৯)। এ দীর্ঘ লেখায় তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সাহসিকতার এ পদক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, একজন ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে আমি তা নিয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে নিয়ে যান। আমি প্রধানমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পদক তালিকা রহিত করার আদেশ দেন। এ রহিতাদেশ পরের দিনই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর ওই রহিতাদেশ বাতিলপূর্বক আগের পদকগুলোই বহাল রাখা হয়। পরে জেনেছি, ওই তালিকা বহাল রাখার জন্য স্বার্থান্বেষী মহল থেকে জোর প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। পরে আমি যখন বাংলাদেশ আর্মির অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হই, তখন এ সংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁজে সাহসিকতা পদকপ্রাপ্ত অনেকেরই লিখিত প্রতিবেদন পাইনি। শুধু একটা নামের তালিকা ও সরকারি গেজেট ছিল।’
মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীর বিক্রম’ পদক পেয়েছেন আজকের রাজনীতিক মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। পদক পেয়ে তিনি পদক প্রদানের অনিয়মের কথা তুলে ধরেছেন তার লেখায়। ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘গৌরবাঙ্গনে আমরা ক’জন বিদ্রোহী’ শিরোনামে এক স্মৃতিচারণমূলক লেখায় বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে : ‘নূরকে দেখে মনে পড়ে তার সংগ্রামমুখর দিনগুলোর কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন মুখে বলল সে, স্যার জীবন বাজি রেখে কত অপারেশন করলাম আপনার সঙ্গে থেকে; কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো খেতাব পেলাম না। শেষমেশ বাড়ি যাওয়ার আগে সুবেদার মেজর পদে প্রমোশনও মিলল না। কলকাতায় বসে থেকে কতজন বীরউত্তম, বীরবিক্রম খেতাব নিয়ে গেল, এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। কথাগুলো নির্মম সত্য। চরম বৈষম্য করা হয়েছে পদক বিতরণের ক্ষেত্রে।’
পদক প্রদানের বিষয়ে এখনও আলোচনা হচ্ছে। ক’দিন আগে এক টকশোতে মেজর জেনারেল (অব.) ইব্রাহিম বীরপ্রতীকও ক্ষোভের সঙ্গে পদক প্রদানের অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার পাশাপাশি সাহসিকতা পদকের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করলে বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করতে পারে। যারা পদক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের নতুন করে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। আর এটা করা হলে বঞ্চিতরাই সম্মানিত হবেন না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধও সম্মানিত হবে।
আসলে পদক দেয়ার ব্যাপারে গ্যালেন্টারি অ্যাকশনের চেয়ে স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, পক্ষপাতিত্বই বেশি কাজ করেছিল। আমাদের সেক্টর কমান্ডার সবাই ‘বীরউত্তম’ খেতাব পেয়েছেন। যেহেতু পদকের নাম ‘সাহসিকতা পদক’, তাই কোন সাহসিকতাপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য তারা ‘বীরউত্তম’ পদক পেলেন তা সবার জানা উচিত। বীরউত্তম পদক পেয়েছেন কর্নেল আবু তাহের, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য মেজর জিয়া। এছাড়া অন্য কোনো সেক্টর কমান্ডারের রণাঙ্গনে তেমন সাহসিকতাপূর্ণ অপারেশনের কথা আমার জানা নেই। খালেদ মোশাররফ কপালে শেলের আঘাত পান, কর্নেল তাহের একটি পা হারান। এই দুই বীরউত্তমই সম্মুখসমরে লড়েছেন, যার বর্ণণা বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় দেখেছি। অনেকেই জানেন, এমন কয়েকজন বীরউত্তম খেতাবধারী আছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের মাটিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কারও কারও বাংলাদেশের মাটিতেও পা রাখতে হয়নি। তারা যুদ্ধ করলেন কোথায়? আর বীরউত্তম খেতাবই বা পেলেন কেন? তারপরও বলব, ‘বীরউত্তম’ খেতাবধারীরা কে কোথায় কোন লড়াইয়ে সাহসিকতার জন্য এই পদক অর্জন করেছেন তা দেশবাসীকে, নতুন প্রজন্মকে জানান। জাতির তা জানার অধিকার আছে।
পদক বা খেতাব পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমি যুদ্ধ করিনি। কিংবা যারা পদক পেয়েছেন, তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলাও আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্য পদক নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা তুলে ধরা। মাঝে মাঝে মনে হয়, বীরত্বের স্বীকৃতি তো পেলাম না, এমন তো হতে পারে, মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধ করেছি কি-না সেই প্রশ্ন তোলা হবে। কারণ আমার তো মুক্তিযুদ্ধের সনদও নেই।
তবে সরকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বাছাই এবং তাদের মূল্যায়নের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা খুবই প্রশংসনীয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার অনুরোধ, নতুনভাবে মূল্যায়নের তালিকায় কোনো সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা যেন বাদ না পড়েন। তেমনিভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পদক পেয়েছেন এবং যারা পদক পাননি তাদের পুনর্মূল্যায়ন করা যায় কি-না সে বিষয়টিও বিবেচনা করা হোক।
মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া : সভাপতি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
No comments