রঙের ভিন্ন ভুবনে চলে গেলেন কাইয়ুম চৌধুরী by ড. মুস্তফা মজিদ
মাটি
ও মানুষের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আর আমাদের মাঝে দৃশ্যমান নেই। চলে গেলেন
অজানা গন্তব্যে। তবে সংস্কৃতমনা বাঙালির অন্তরে মহীয়ান থাকবেন অনেক কাল।
‘আমার একটি কথা আছে’- কথাটি কী? বলা হল না! আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শকের সামনে হঠাৎই ঢলে পড়লেন তিনি। যেন একটি কম্পমান বটবৃক্ষ ভূমিতে গড়িয়ে পড়ল। আর এই তো ৩০ নভেম্বর ২০১৪ রোববার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে- উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চতুর্থ দিনের উদ্বোধনী মুহূর্তে। এ দেশ এ জাতি হারাল শুধু একজন খ্যাতিমান শিল্পীকেই নয়, হারাল একজন সজ্জন উচ্চমার্গের বিনয়ী ভদ্র ভালো মানুষকে। তার জন্ম ৯ মার্চ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ। এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎ নির্মাণে তাৎপর্যময় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম কাইয়ুম চৌধুরী। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পরবর্তী পূর্ববঙ্গে শিল্পের পথ-পরিক্রম সহজ কাজ ছিল না।
কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পচর্চায় বাঙালি মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। নতুন রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে শত প্রতিকূলতার মাঝে ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার যে ক’জন সহযাত্রী নিয়ে যে আর্ট কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন তার গোড়ার দিকে শিক্ষার্থী ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। আর সে সময়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান প্রমুখ। দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন মর্তুজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ অন্যতম।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউটে ফাইন আর্টসে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি। চারুকলার পাঠ ছিল তার শিল্পী হওয়ার ভিত- নতুন পথ-পরিক্রমার অভিলাষী অভিজ্ঞান অর্জন। তিনি যুক্ত হলেন শিল্পের সন্ধানে কণ্টকময় সুন্দরতম অভিযাত্রায়। যুক্ত হলেন নানা ব্যবহারিক কাজে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়- আর শুরু করলেন বইয়ের বর্ণময় প্রচ্ছদ অংকন ও সচিত্রকরণের কাজ।
এসব কাজে তার সুবিধা ছিল যে তিনি যেমন ছিলেন সাহিত্য-পিপাসু, অন্যদিকে সঙ্গীতশ্রোতা আর বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র-প্রেমী। একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক সুবাতাসের ছোঁয়ায় তার পরিমণ্ডল বাহিত হতে লাগল।
ইতিমধ্যে সতীর্থ চিত্রকর ছাড়া তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে জসীমউদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, কানাইলাল শীল, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, ফজলে লোহানী, ফয়েজ আহ্মদ, জহির রায়হান, এসএম পারভেজ, সমর দাস, আলাউদ্দিন আলি-আজাদ, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে জয়নুল আবেদিনের নির্দেশে তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যে চারজন ছাত্রী ভর্তি হন তাদের মধ্যে তাহেরা খানম অন্যতম। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তাহেরা খানমের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহিত জীবনে আমৃত্যু ৫৪ বছর তাহেরা খানম ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী- শিল্প সৃষ্টির অনুপম অনুপ্রেরণাকারিণী। আর এই বছরই আর্ট কলেজ ছেড়ে যোগ দেন কামরুল হাসানের পরিচালনায় গঠিত ডিজাইন সেন্টারে। এক বছরের মাথায় ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন অবজারভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে। তখন ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার ছাড়া সিনেমা সাপ্তাহিক চিত্রালী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের নব নব নির্মাণে এবং এক সৃজনশীল ভুবনে।
একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তার সহ-শিক্ষার্থী শিল্পী বন্ধুরা যখন দ্রুতলয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন- নানা আয়োজনে প্রদর্শনী করছেন, কেউ কেউ বিদেশে গেছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে আর দেশে ফিরে উদ্যোগী হচ্ছেন নব নব সৃষ্টির উল্লাসে তখন তুলনামূলকভাবে কাইয়ুম চৌধুরী ব্যস্ত বই-পুস্তকের প্রচ্ছদ অংকনে আর পত্র-পত্রিকায় সচিত্রকরণে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ সন্ধানী প্রকাশনীর যাত্রা করলে জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থ দিয়ে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ অংকন শুরু হয় এবং প্রকাশনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
তেমনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার যাত্রা শুরু করলে কাইয়ুম চৌধুরী মাওলা ব্রাদার্সের প্রায় সব প্রকাশনার প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আজীবন এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সৌকর্য বৃদ্ধির কাজ করে গেছেন। ইতিমধ্যে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বার্ডস বুক প্রকাশনা সংস্থা শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে সৃজনশীল সুকুমার কলার অভিনব স্বাক্ষর রাখলেন। কাইয়ুম চৌধুরী এর পর ধীরে ধীরে প্রকাশনা জগতের যে পুরনো ধারা সেই ধারার পরিবর্তনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিলেন। আর এর ব্যতিক্রমে তিনি প্রচ্ছদে মূর্তচিত্রের বিপরীতে বিমূর্ত ও অর্ধ-বিমূর্ত ধারা যোগ করলেন এবং বহুবর্ণের মিলন ঘটালেন। যা অভিনব এবং শিল্প বিচারে যেমন উচ্চাঙ্গের তেমনি জনপ্রিয়তারও তুঙ্গেও বটে।
১৯৫৯ ও ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে রেলওয়ে টাইম টেবিলের প্রচ্ছদ একে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। সবচেয়ে বিস্ময়কর ও আনন্দদায়ক ঘটনাটি ঘটে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীতে কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্ম প্রথম পুরস্কার লাভ করে। টেলিগ্রামে এই খবর আসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছে। কাইয়ুম চৌধুরী শ্বশুরালয় থেকে রাত বারোটায় বাসায় ফিরলে শিল্পাচার্য সে খবর তার প্রিয় ছাত্রকে জানান ওই গভীর রাতে।
পাকিস্তানজুড়ে বাঙালি শিল্পীদের যে উত্থান সেই উত্থানে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কাইয়ুম চৌধুরী আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম সম্মাননা লাভ করেন। তিনি এবং শিল্পী আমিনুল ইসলাম ইরানের পঞ্চম তেহরান বিয়েনালে সর্বোচ্চ রাজকীয় দরবার পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কারের অর্থ মূল্য ১০,০০০ তোমান বা প্রাচীন পারস্য স্বর্ণমুদ্রা যার তৎকালীন মূল্যমান ১০,০০০ দিনার।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকর্মের মূল্যায়ন করেছিলেন চিত্রকর, শিল্পকলার শিক্ষক ও শিল্প সমালোচক বুলবন ওসমান। তিনি কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্প-বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি বর্ণনা করেন এভাবে : ‘কাইয়ুম আধুনিক চিত্রকলার পদ্ধতিগত সমস্যা, পরিবেশনা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। তাই মটিফ হিসেবে তার চিত্রে লক্ষ্মীর সরা, পাখা, শাড়ির পাড়, শীতলপাটি, শিকে, কাঁকই, কুলো, হাঁড়ি, বাঁশ-বেতের বিভিন্ন ঝাঁপির নকশা জায়গা করে নেয়।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন?
এর উত্তর দ্বিধারা। প্রথম কাইয়ুম চান তার চিত্রে এই অঞ্চলের পরিচয় যেন মেলে। সে বলে, এই অঞ্চলের জলবায়ু-রৌদ্রে আমি বেড়ে উঠেছি। এর একটা প্রবল প্রভাব আছে আমার ওপরে। এর আনুগত্য স্বীকার করতে গিয়ে কাইয়ুম লোকজ মোটিফ ব্যবহার করেছেন। বাংলার লোকশিল্প তার নদী-মাতৃকতা ও কৃষিনির্ভর সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পাক-ভারতের বহু অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে ওঠার আগেই অস্ট্রিক জাতিরা এখানে সভ্যতার ধারা গড়ে তোলে। সেই তখন থেকে সৃষ্ট বাংলার লোকশিল্পের একটা বিশিষ্ট রূপ আছে যা ভারতের অন্য অংশে নেই। এর তাঁতশিল্পের নকশা, বাঁশ-বেতের কাজ, মৃৎশিল্প নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠে। তাই এই মোটিফ ব্যবহার করে কাইয়ুম এই অঞ্চলের চরিত্র দান করেছেন।
দ্বিতীয় দিক, লোকশিল্পের গুরুত্ব। লোকশিল্প বিভিন্ন দিক থেকে সার্থক। যুগের পর যুগ ব্যবহারের ফলে একটি চরম প্রকাশ, ... এর উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, এর সাবলীলতা, এর সহজ অথচ বলিষ্ঠতা, এর সংক্ষিপ্ততা, এর নকশাধার্মিতা, শুধু চোখকে তৃপ্তি দানের প্রচেষ্টা এসব গুণ লোকশিল্পকে একটি বৈভব দান করেছে। আধুনিক শিল্প যেমন কাহিনী প্রবণতার চেয়ে শিল্পবোধের দিকে জোর দেয়, সে গুণ লোকশিল্পে পুরোপুরি বিদ্যমান। তাছাড়া জরুরি হল এর বিমূর্ত প্রকাশ ও বস্তুর নির্যাসের দিকে ঝোঁকা। এসব গুণ লোকশিল্পকে দান করেছে অনন্যতা, তাই লোকশিল্প কাইয়ুমকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে, এসব কিছুর মূলে তার স্বদেশ ও স্বজাত্যাভিমান ও গৃহাভিমুখতা, গৌরবের দিক হিসেবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান : জুলাই, ১৯৭০)
১৯৭১-এর স্বাধীনতা পরবর্তী কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পসম্ভারে বস্তুনিষ্ঠতার নান্দনিকতা আরও প্রখর হয়ে ওঠে। রক্তাক্ত একাত্তর তাকে নতুনভাবে আলোকিত করে। তার ক্যানভাসে উঠে আসে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, জাতির বীরত্বগাথা। বিপুল বৈভাবে তিনি বর্ণময় রংয়ে ফুটিয়ে তোলেন প্রবল প্রতিরোধ, রক্তাক্ত প্রান্তর, দগ্ধ গ্রাম ও বন্দর রিকশা ও নৌকার গলুইয়ে মৃত্যুর লাশ, রাইফেল-পতাকায় শোভিত শোভাযাত্রা ইত্যাদি। নির্দ্বিধচিত্তে এ কথা বলা যায় যে, এ দেশে শিল্পী-সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সেই ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয়েছিল। ঊনসত্তর-একাত্তরের আন্দোলন সংগ্রামে ও যুদ্ধে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আর কাইয়ুম চৌধুরী সেই যাত্রীরই একজন ছিলেন।
প্রত্যেক শিল্পীর কোনো না কোনো অঙ্গীকার থাকে। একজন সৃজনশীল মানুষ কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক যৌক্তিক মানুষের এ অঙ্গীকার যদি না থাকে তাহলে তার সৃজনশীলতা কখনোই সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত ও প্রকাশিত হবে না। তা নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান যা-ই হোক না কেন! তবে সেই অঙ্গীকারের মূল অন্তনির্হিত বোধ হচ্ছে দেশপ্রেম।
কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যিনি অঙ্গীকারে বিশ্বাসী একজন দেশপ্রেমিক যৌক্তিক মানুষ ছিলেন। বাস্তবতা, যৌক্তিকতা এবং সত্যনিষ্ঠতাই একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে পরিগণিত করতে পারে। বিমূর্তের ভাষা সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি অতি মানবের কাছেও গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
কাইয়ুম চৌধুরী এমনভাবে ছবি এঁকেছেন যা সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য ও গ্রহণীয়। এ কথা ভুললে চলবে না যে, আদিম সমাজে অনক্ষর মানুষের ভাষা বা প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষের ভাষা ছিল ছবিই। ছবি যদি সহজবোধ্যই না হয় তবে সেই ছবি আঁকার প্রয়োজনটা কী? এ প্রশ্ন আজকের নয়, দীর্ঘকালের। তবে সহজবোধ্য ছবি আঁকা সহজ নয়। এই সহজ কাজের ধারাটি কাইয়ুম চৌধুরী একদিনে রপ্ত করেননি। দীর্ঘ পথচলা আর দীর্ঘ সাধনায় তিনি অর্জন করেছিলেন। আর তাই হৃদয়ের সব অনুভূতি ও ভালোবাসা দিয়ে নীলিমার সাত রঙ হাতের মুঠোয় রেখে তিনি ছবি এঁকেছেন। যে ছবি চলমান ভাষায় কথা বলে।
তথাকথিত শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধাদের অনেকেই কাইয়ুম চৌধুরীকে শুধু একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। অবোধের গো-বধে আনন্দের মতোই তারা বোধ হয় জানেন না যে, গ্রাফিক্স ডিজাইনের যে নান্দনিক সৌন্দর্য ও সৌকর্য তা বিশ্বব্যাপী যেমন শিল্পের ভুবনে গ্রহণীয় তেমনি কাইয়ুম চৌধুরীই এ দেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে ধারণ করে এই ধারাকে আধুনিকতার নান্দনিকতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। আবার অন্যদিকে আধুনিক চিত্রকলায় (পেইন্টিংস্) তার স্বতন্ত্র স্টাইল যে অন্য থেকে ভিন্ন এবং নান্দনিক সুকুমার কলা বৈচিত্র্যে অনন্য সৃষ্টি সে কথা বোধহয় এদের অজানা। যে স্বাতন্ত্র্যতার কারণে কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে গোটা বাংলাদেশটাই উঠে এসেছে প্রবলভাবে। যে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য গৌরবময় যুদ্ধ করেছি আমরা। তারই প্রতিচ্ছবি এসেছে অকৃত্রিমভাবে। কাইয়ুম চৌধুরী তাই মনে করতেন- গ্রাম বাংলাই আমার দেশ, গ্রামের মানুষ আমার প্রাণের মানুষ। এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, ঝোপঝাড়, মাঠ-প্রান্তর, বালুচর, নৌকা, কিষান-কিষানি, মাঝি-মাল্লা-জেলে-তাঁতি-কামার-কুমার চারপাশের গ্রামীণ জীবনচিত্রই কাইয়ুম চৌধুরীর অংকিত শিল্পের উপাদান। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এই জীবনের ছবিই আঁকেন। তাই তারই নির্মিত রাজশাহীস্থ বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের দীর্ঘকাল দেয়াল চিত্রে বা ম্যুরালে প্রাণবন্ত হয়ে আছে প্রিয় নদী পদ্মা, পদ্মার ওপারে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গ্রাম, নৌকার গলুই, বরেন্দ্র অঞ্চলের আদি ঐতিহ্য ও যুদ্ধরত তরুণের সাহসী পদসঞ্চালন।
তাই কাইয়ুম চৌধুরী একটি নাম। একজন শিল্পী। যথার্থ অর্থে একজন কীর্তিমান। যিনি অন্য অনেকের মতো চারুকলার একজন সাধারণ শিক্ষক নন। একজন অসাধারণ শিল্পী ও শিক্ষক। পুনরায় স্মর্তব্য যে, কাইয়ুম চৌধুরী সবুজ শ্যামল নদীমাতৃক বাংলার প্রকৃতি থেকে রঙ নিয়ে হৃদয়ের মাধুরী দিয়ে ছবি এঁকেছেন। যে ছবি কথা বলে। রঙের ভাষা দিয়ে তিনি এ দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, মান-অভিমান, জীবনযুদ্ধে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, দেশ বিজয় ও ভালোবাসা আর প্রকৃতির বর্ণাঢ্য গদ্য-পদ্য রচনা করে গেছেন।
তার বাড়িতে, গ্যালারিতে প্রায়শ সান্ধ্যকালীন আড্ডায়-অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না। আমরা হারিয়েছি একজন বড় মাপের শিল্পী ও অসাধারণ নিখাদ ভদ্রলোককে।
‘আমার একটি কথা আছে’- কথাটি কী? বলা হল না! আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে হাজার হাজার শ্রোতা-দর্শকের সামনে হঠাৎই ঢলে পড়লেন তিনি। যেন একটি কম্পমান বটবৃক্ষ ভূমিতে গড়িয়ে পড়ল। আর এই তো ৩০ নভেম্বর ২০১৪ রোববার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে- উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চতুর্থ দিনের উদ্বোধনী মুহূর্তে। এ দেশ এ জাতি হারাল শুধু একজন খ্যাতিমান শিল্পীকেই নয়, হারাল একজন সজ্জন উচ্চমার্গের বিনয়ী ভদ্র ভালো মানুষকে। তার জন্ম ৯ মার্চ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ। এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎ নির্মাণে তাৎপর্যময় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম কাইয়ুম চৌধুরী। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পরবর্তী পূর্ববঙ্গে শিল্পের পথ-পরিক্রম সহজ কাজ ছিল না।
কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পচর্চায় বাঙালি মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। নতুন রাষ্ট্রের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে শত প্রতিকূলতার মাঝে ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার যে ক’জন সহযাত্রী নিয়ে যে আর্ট কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন তার গোড়ার দিকে শিক্ষার্থী ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। আর সে সময়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান প্রমুখ। দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন মর্তুজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ অন্যতম।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউটে ফাইন আর্টসে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি। চারুকলার পাঠ ছিল তার শিল্পী হওয়ার ভিত- নতুন পথ-পরিক্রমার অভিলাষী অভিজ্ঞান অর্জন। তিনি যুক্ত হলেন শিল্পের সন্ধানে কণ্টকময় সুন্দরতম অভিযাত্রায়। যুক্ত হলেন নানা ব্যবহারিক কাজে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়- আর শুরু করলেন বইয়ের বর্ণময় প্রচ্ছদ অংকন ও সচিত্রকরণের কাজ।
এসব কাজে তার সুবিধা ছিল যে তিনি যেমন ছিলেন সাহিত্য-পিপাসু, অন্যদিকে সঙ্গীতশ্রোতা আর বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র-প্রেমী। একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক সুবাতাসের ছোঁয়ায় তার পরিমণ্ডল বাহিত হতে লাগল।
ইতিমধ্যে সতীর্থ চিত্রকর ছাড়া তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে জসীমউদ্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, কানাইলাল শীল, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, ফজলে লোহানী, ফয়েজ আহ্মদ, জহির রায়হান, এসএম পারভেজ, সমর দাস, আলাউদ্দিন আলি-আজাদ, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে জয়নুল আবেদিনের নির্দেশে তিনি আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন। আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যে চারজন ছাত্রী ভর্তি হন তাদের মধ্যে তাহেরা খানম অন্যতম। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তাহেরা খানমের সঙ্গে কাইয়ুম চৌধুরী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহিত জীবনে আমৃত্যু ৫৪ বছর তাহেরা খানম ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরীর ছায়াসঙ্গী- শিল্প সৃষ্টির অনুপম অনুপ্রেরণাকারিণী। আর এই বছরই আর্ট কলেজ ছেড়ে যোগ দেন কামরুল হাসানের পরিচালনায় গঠিত ডিজাইন সেন্টারে। এক বছরের মাথায় ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন অবজারভার হাউজে চিফ আর্টিস্ট হিসেবে। তখন ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার ছাড়া সিনেমা সাপ্তাহিক চিত্রালী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন গ্রাফিক্স ডিজাইনের নব নব নির্মাণে এবং এক সৃজনশীল ভুবনে।
একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তার সহ-শিক্ষার্থী শিল্পী বন্ধুরা যখন দ্রুতলয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন- নানা আয়োজনে প্রদর্শনী করছেন, কেউ কেউ বিদেশে গেছেন উচ্চশিক্ষা অর্জনে আর দেশে ফিরে উদ্যোগী হচ্ছেন নব নব সৃষ্টির উল্লাসে তখন তুলনামূলকভাবে কাইয়ুম চৌধুরী ব্যস্ত বই-পুস্তকের প্রচ্ছদ অংকনে আর পত্র-পত্রিকায় সচিত্রকরণে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ সন্ধানী প্রকাশনীর যাত্রা করলে জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ গ্রন্থ দিয়ে কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ অংকন শুরু হয় এবং প্রকাশনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
তেমনি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার যাত্রা শুরু করলে কাইয়ুম চৌধুরী মাওলা ব্রাদার্সের প্রায় সব প্রকাশনার প্রচ্ছদ ও সচিত্রকরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আজীবন এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সৌকর্য বৃদ্ধির কাজ করে গেছেন। ইতিমধ্যে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বার্ডস বুক প্রকাশনা সংস্থা শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে সৃজনশীল সুকুমার কলার অভিনব স্বাক্ষর রাখলেন। কাইয়ুম চৌধুরী এর পর ধীরে ধীরে প্রকাশনা জগতের যে পুরনো ধারা সেই ধারার পরিবর্তনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিলেন। আর এর ব্যতিক্রমে তিনি প্রচ্ছদে মূর্তচিত্রের বিপরীতে বিমূর্ত ও অর্ধ-বিমূর্ত ধারা যোগ করলেন এবং বহুবর্ণের মিলন ঘটালেন। যা অভিনব এবং শিল্প বিচারে যেমন উচ্চাঙ্গের তেমনি জনপ্রিয়তারও তুঙ্গেও বটে।
১৯৫৯ ও ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে রেলওয়ে টাইম টেবিলের প্রচ্ছদ একে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী। সবচেয়ে বিস্ময়কর ও আনন্দদায়ক ঘটনাটি ঘটে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীতে কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্ম প্রথম পুরস্কার লাভ করে। টেলিগ্রামে এই খবর আসে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছে। কাইয়ুম চৌধুরী শ্বশুরালয় থেকে রাত বারোটায় বাসায় ফিরলে শিল্পাচার্য সে খবর তার প্রিয় ছাত্রকে জানান ওই গভীর রাতে।
পাকিস্তানজুড়ে বাঙালি শিল্পীদের যে উত্থান সেই উত্থানে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কাইয়ুম চৌধুরী আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম সম্মাননা লাভ করেন। তিনি এবং শিল্পী আমিনুল ইসলাম ইরানের পঞ্চম তেহরান বিয়েনালে সর্বোচ্চ রাজকীয় দরবার পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কারের অর্থ মূল্য ১০,০০০ তোমান বা প্রাচীন পারস্য স্বর্ণমুদ্রা যার তৎকালীন মূল্যমান ১০,০০০ দিনার।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকর্মের মূল্যায়ন করেছিলেন চিত্রকর, শিল্পকলার শিক্ষক ও শিল্প সমালোচক বুলবন ওসমান। তিনি কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্প-বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি বর্ণনা করেন এভাবে : ‘কাইয়ুম আধুনিক চিত্রকলার পদ্ধতিগত সমস্যা, পরিবেশনা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। তাই মটিফ হিসেবে তার চিত্রে লক্ষ্মীর সরা, পাখা, শাড়ির পাড়, শীতলপাটি, শিকে, কাঁকই, কুলো, হাঁড়ি, বাঁশ-বেতের বিভিন্ন ঝাঁপির নকশা জায়গা করে নেয়।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কেন?
এর উত্তর দ্বিধারা। প্রথম কাইয়ুম চান তার চিত্রে এই অঞ্চলের পরিচয় যেন মেলে। সে বলে, এই অঞ্চলের জলবায়ু-রৌদ্রে আমি বেড়ে উঠেছি। এর একটা প্রবল প্রভাব আছে আমার ওপরে। এর আনুগত্য স্বীকার করতে গিয়ে কাইয়ুম লোকজ মোটিফ ব্যবহার করেছেন। বাংলার লোকশিল্প তার নদী-মাতৃকতা ও কৃষিনির্ভর সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পাক-ভারতের বহু অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে ওঠার আগেই অস্ট্রিক জাতিরা এখানে সভ্যতার ধারা গড়ে তোলে। সেই তখন থেকে সৃষ্ট বাংলার লোকশিল্পের একটা বিশিষ্ট রূপ আছে যা ভারতের অন্য অংশে নেই। এর তাঁতশিল্পের নকশা, বাঁশ-বেতের কাজ, মৃৎশিল্প নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে ওঠে। তাই এই মোটিফ ব্যবহার করে কাইয়ুম এই অঞ্চলের চরিত্র দান করেছেন।
দ্বিতীয় দিক, লোকশিল্পের গুরুত্ব। লোকশিল্প বিভিন্ন দিক থেকে সার্থক। যুগের পর যুগ ব্যবহারের ফলে একটি চরম প্রকাশ, ... এর উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার, এর সাবলীলতা, এর সহজ অথচ বলিষ্ঠতা, এর সংক্ষিপ্ততা, এর নকশাধার্মিতা, শুধু চোখকে তৃপ্তি দানের প্রচেষ্টা এসব গুণ লোকশিল্পকে একটি বৈভব দান করেছে। আধুনিক শিল্প যেমন কাহিনী প্রবণতার চেয়ে শিল্পবোধের দিকে জোর দেয়, সে গুণ লোকশিল্পে পুরোপুরি বিদ্যমান। তাছাড়া জরুরি হল এর বিমূর্ত প্রকাশ ও বস্তুর নির্যাসের দিকে ঝোঁকা। এসব গুণ লোকশিল্পকে দান করেছে অনন্যতা, তাই লোকশিল্প কাইয়ুমকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে, এসব কিছুর মূলে তার স্বদেশ ও স্বজাত্যাভিমান ও গৃহাভিমুখতা, গৌরবের দিক হিসেবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান : জুলাই, ১৯৭০)
১৯৭১-এর স্বাধীনতা পরবর্তী কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পসম্ভারে বস্তুনিষ্ঠতার নান্দনিকতা আরও প্রখর হয়ে ওঠে। রক্তাক্ত একাত্তর তাকে নতুনভাবে আলোকিত করে। তার ক্যানভাসে উঠে আসে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, জাতির বীরত্বগাথা। বিপুল বৈভাবে তিনি বর্ণময় রংয়ে ফুটিয়ে তোলেন প্রবল প্রতিরোধ, রক্তাক্ত প্রান্তর, দগ্ধ গ্রাম ও বন্দর রিকশা ও নৌকার গলুইয়ে মৃত্যুর লাশ, রাইফেল-পতাকায় শোভিত শোভাযাত্রা ইত্যাদি। নির্দ্বিধচিত্তে এ কথা বলা যায় যে, এ দেশে শিল্পী-সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সেই ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয়েছিল। ঊনসত্তর-একাত্তরের আন্দোলন সংগ্রামে ও যুদ্ধে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আর কাইয়ুম চৌধুরী সেই যাত্রীরই একজন ছিলেন।
প্রত্যেক শিল্পীর কোনো না কোনো অঙ্গীকার থাকে। একজন সৃজনশীল মানুষ কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক যৌক্তিক মানুষের এ অঙ্গীকার যদি না থাকে তাহলে তার সৃজনশীলতা কখনোই সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত ও প্রকাশিত হবে না। তা নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান যা-ই হোক না কেন! তবে সেই অঙ্গীকারের মূল অন্তনির্হিত বোধ হচ্ছে দেশপ্রেম।
কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যিনি অঙ্গীকারে বিশ্বাসী একজন দেশপ্রেমিক যৌক্তিক মানুষ ছিলেন। বাস্তবতা, যৌক্তিকতা এবং সত্যনিষ্ঠতাই একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপে পরিগণিত করতে পারে। বিমূর্তের ভাষা সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি অতি মানবের কাছেও গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
কাইয়ুম চৌধুরী এমনভাবে ছবি এঁকেছেন যা সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য ও গ্রহণীয়। এ কথা ভুললে চলবে না যে, আদিম সমাজে অনক্ষর মানুষের ভাষা বা প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষের ভাষা ছিল ছবিই। ছবি যদি সহজবোধ্যই না হয় তবে সেই ছবি আঁকার প্রয়োজনটা কী? এ প্রশ্ন আজকের নয়, দীর্ঘকালের। তবে সহজবোধ্য ছবি আঁকা সহজ নয়। এই সহজ কাজের ধারাটি কাইয়ুম চৌধুরী একদিনে রপ্ত করেননি। দীর্ঘ পথচলা আর দীর্ঘ সাধনায় তিনি অর্জন করেছিলেন। আর তাই হৃদয়ের সব অনুভূতি ও ভালোবাসা দিয়ে নীলিমার সাত রঙ হাতের মুঠোয় রেখে তিনি ছবি এঁকেছেন। যে ছবি চলমান ভাষায় কথা বলে।
তথাকথিত শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধাদের অনেকেই কাইয়ুম চৌধুরীকে শুধু একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। অবোধের গো-বধে আনন্দের মতোই তারা বোধ হয় জানেন না যে, গ্রাফিক্স ডিজাইনের যে নান্দনিক সৌন্দর্য ও সৌকর্য তা বিশ্বব্যাপী যেমন শিল্পের ভুবনে গ্রহণীয় তেমনি কাইয়ুম চৌধুরীই এ দেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে ধারণ করে এই ধারাকে আধুনিকতার নান্দনিকতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। আবার অন্যদিকে আধুনিক চিত্রকলায় (পেইন্টিংস্) তার স্বতন্ত্র স্টাইল যে অন্য থেকে ভিন্ন এবং নান্দনিক সুকুমার কলা বৈচিত্র্যে অনন্য সৃষ্টি সে কথা বোধহয় এদের অজানা। যে স্বাতন্ত্র্যতার কারণে কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে গোটা বাংলাদেশটাই উঠে এসেছে প্রবলভাবে। যে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য গৌরবময় যুদ্ধ করেছি আমরা। তারই প্রতিচ্ছবি এসেছে অকৃত্রিমভাবে। কাইয়ুম চৌধুরী তাই মনে করতেন- গ্রাম বাংলাই আমার দেশ, গ্রামের মানুষ আমার প্রাণের মানুষ। এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, ঝোপঝাড়, মাঠ-প্রান্তর, বালুচর, নৌকা, কিষান-কিষানি, মাঝি-মাল্লা-জেলে-তাঁতি-কামার-কুমার চারপাশের গ্রামীণ জীবনচিত্রই কাইয়ুম চৌধুরীর অংকিত শিল্পের উপাদান। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এই জীবনের ছবিই আঁকেন। তাই তারই নির্মিত রাজশাহীস্থ বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের দীর্ঘকাল দেয়াল চিত্রে বা ম্যুরালে প্রাণবন্ত হয়ে আছে প্রিয় নদী পদ্মা, পদ্মার ওপারে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গ্রাম, নৌকার গলুই, বরেন্দ্র অঞ্চলের আদি ঐতিহ্য ও যুদ্ধরত তরুণের সাহসী পদসঞ্চালন।
তাই কাইয়ুম চৌধুরী একটি নাম। একজন শিল্পী। যথার্থ অর্থে একজন কীর্তিমান। যিনি অন্য অনেকের মতো চারুকলার একজন সাধারণ শিক্ষক নন। একজন অসাধারণ শিল্পী ও শিক্ষক। পুনরায় স্মর্তব্য যে, কাইয়ুম চৌধুরী সবুজ শ্যামল নদীমাতৃক বাংলার প্রকৃতি থেকে রঙ নিয়ে হৃদয়ের মাধুরী দিয়ে ছবি এঁকেছেন। যে ছবি কথা বলে। রঙের ভাষা দিয়ে তিনি এ দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, মান-অভিমান, জীবনযুদ্ধে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, দেশ বিজয় ও ভালোবাসা আর প্রকৃতির বর্ণাঢ্য গদ্য-পদ্য রচনা করে গেছেন।
তার বাড়িতে, গ্যালারিতে প্রায়শ সান্ধ্যকালীন আড্ডায়-অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না। আমরা হারিয়েছি একজন বড় মাপের শিল্পী ও অসাধারণ নিখাদ ভদ্রলোককে।
No comments