জীবন নিয়ে যেভাবে ফিরে এলেন শারমিন by রোকনুজ্জামান পিয়াস
(স্ট্রেচারে করে এয়ারপোর্ট থেকেই হাসপাতালে নেয়া হলো শারমিনকে) ভাগ্য
বদলের আশায় লেবানন গিয়ে নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে অবশেষে ফিরলেন শারমিন
আক্তার। তবে বাড়িতে নয়। এয়ারপোর্ট থেকে তাকে সোজা নিয়ে যাওয়া হলো
হাসপাতালে। স্ট্রেচারে করে বিমান থেকে নামিয়ে তোলা হলো এম্বুলেন্সে। সে সময়
অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন তিনি। বুধবার রাতে এয়ার এরাবিয়ানের একটি
ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহ্জালাল বিমানন্দরে পৌঁছান। এর আগে নানা ঘটনার সাক্ষী
হয়ে লেবাননে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। দীর্ঘ ৬ মাস
সেখানকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। লেবাননের ভীতিকর সেসব দিনগুলোর
কথা মনে করে এখনও শিউরে ওঠেন মা-বাবা হারানো এ যুবতী। লেবাননে দেখে এলেন
বাংলাদেশী মেয়েদের দিয়ে পাতানো অনৈতিক ব্যবসার ফাঁদ। দেখে এসেছেন কিভাবে
প্রতারিত হয়ে এ পেশায় নাম লেখাচ্ছে সহজ সরল মেয়েরা। শারমিন সুকৌশলে নিজের
সম্ভ্রম বাঁচালেও দেশে ফিরতে পারেননি অক্ষত শরীর নিয়ে। কবে স্বাভাবিক জীবন
পাবেন সে নিশ্চয়তাও নেই। এদিকে কিভাবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে সে কথা
ভেবেও দিশাহারা একমাত্র আপনজন আঞ্জুমান মুফিদুলে লাশ বহনের কাজ করা দুলাভাই
কিসমত আলী। স্বামী পরিত্যক্তা শারমিন ঢাকার গে-ারিয়ায় বসবাসকালে নিপা
নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে ভাগ্য বদলাতে লেবাননে যাওয়ার
সিদ্ধান্ত নেন। নিপা নিয়মিত যাওয়া-আসা করতো লেবানন। নিপার পরামর্শ মোতাবেক
৩০শে এপ্রিল বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স বাংলাদেশ এক্সপোর্ট
করপোরেশনের মাধ্যমে লেবাননে যান। সে দেশে পা রাখার পর এয়ারপোর্ট থেকে
নিয়োগকর্তার ছেলে তাকে নিয়ে যায় বাড়িতে। সেখানে ১০০ ডলার বেতনে গৃহকর্মীর
কাজ করতে থাকেন শারমিন। এর দু’তিন পর নিপা আসে ওই বাড়িতে। তবে তখন তার নাম
আর নিপা নয়, সেখানে সে পরিচিত সুমি নামে। প্রতিদিন এসে শারমিনকে বোঝাতে
থাকে এখানে কম বেতন। অন্য জায়গায় কাজ করলে আরও বেশি বেতন পাওয়া যাবে।
প্রথমে রাজি না হলেও পরে সুমির চাপাচাপি ও ভাল বেতনের আশায় রাজি হন শারমিন।
ছদ্মবেশী সুমি তাকে নিয়ে যায় একটি সুরম্য দোতলা বাড়িতে। সেখানে শারমিনকে
রেখেই কেটে পড়ে সে। সেখানে ছিল আরও ২০ জনের মতো বাঙালি মেয়ে। প্রথমে কিছু
বুঝতে না পারলেও পরে জানতে পারেন একটি পতিতালয়ে এসে পড়েছেন তিনি। এ সব মেয়ে
সবাই দেহ ব্যবসায় জড়িত। পরদিন আঁখি নামের একটি মেয়ে বুঝিয়ে দেয় কি করতে
হবে তাকে। আঁখি ওই বাসার সর্দার ছিল। সে-ই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতো। শারমিন
এ অনৈতিক কাজে অস্বীকৃতি জানান। এজন্য তার ওপর চলে নির্যাতন। না খাইয়ে
রাখা হয় তাকে। মারধরও করতে থাকে সর্দার আঁখি। শারমিন জানান, প্রতিদিনই
রাতের বেলা বিলাসবহুল গাড়িতে করে ওই বাড়িতে আসতো লেবানিজ পুরুষরা। তারা
গাড়িতে করে একজন করে মেয়েকে নিয়ে যেতো। পরে ভোরবেলায় তাদেরকে পৌঁছে দিতো।
প্রথমে তাকেও পাঠানোর চেষ্টা করতো, কিন্তু তিনি যেতে চাননি। এ অবস্থায়
শারমিন পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন। কিন্তু আঁখির নজরদারিতে তিনি পালাতে
ব্যর্থ হন। অবশেষে সেখান থেকে পালানোর জন্য কৌশলের আশ্রয় নেন। ওই বাড়িতে ৫
দিন থাকার পর তিনি আরবীয় একজন পুরুষের সঙ্গে যেতে রাজি হন। মাইক্রোবাসে
উঠেই অনুনয় বিনয় করতে থাকেন তিনি। হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। এতে ওই
ব্যক্তির দয়া হলে সে তাকে পালিয়ে যেতে দিতে সম্মত হয়। পথেই তাকে নামিয়ে
দেয়। এ সময় মাইক্রোবাস থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে মর্মান্তিক সড়ক
দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। ওই বাসায় রেখে আসার পর থেকে কথিত সুমির সঙ্গেও
যোগাযোগ হয়নি তার। সে দেশের ফাইদা এলাকায় ওই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পর
স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে ডা. মনজের আল-হাজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। তার
দু’পায়ের হাড় তিন টুকরা হয়ে ভেঙে যায়। প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার পা
দু’টি কেটে ফেলতে চাইলেও সেখানে কর্মরত বাঙালি চিকিৎসক ডা. ওয়ালিদ হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষকে পা কেটে না ফেলার অনুরোধ করেন। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার পা
দু’টি না কেটেই দীর্ঘদিন ধরে তাদের খরচে চিকিৎসা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু শেষ
পর্যন্ত চিকিৎসা চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রায় দু’মাস ধরে বিনা চিকিৎসায়
ওই হাসপাতালের বেডেই পড়েছিলেন তিনি। এরপর ওই হাসপাতালে কর্মরত শাহিদা নামে
এক বাংলাদেশী মেয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর সরকারের প্রবাসী
কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেন
শারমিনের দুলাভাই কিসমত। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন তাকে ফেরত আনতে ২০ লাখ
টাকার উপরে খরচ পড়বে। গত ২৯শে অক্টোবর শারমিনকে নিয়ে মানবজমিন-এর প্রথম
পাতায় রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আমির উদ্দিন নামে এক বাংলাদেশী তাকে
হাসপাতালে দেখতে যান। তার খোঁজখবর নেন। শারমিন জানান, আমির উদ্দিন প্রতিদিন
খাবার নিয়ে দেখতে যেতেন। তিনি তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন দেশে ফেরত পাঠানোর
ব্যাপারে। আমির উদ্দিন একজন স্বেচ্ছাসেবী। এদিকে বুধবার রাতে বিমানবন্দর
থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। রাতেই ভর্তি করা হয়
তাকে। হাসপাতালের বেডে ঠিকমতো বসতেও পারছেন না। শারমিনের দুলাভাই আঞ্জুমান
মুফিদুলে কর্মরত মো. কিসমত জানান, জন্মের সময় শারমিনের মা মারা গেছেন। এর ৩
বছর পর মারা যান তার বাবাও। আমিই ওকে বড় করেছি। আমি ছাড়া তার কেউ নেই।
বিয়ে হলেও পরে জানা যায় তার বউ এবং সন্তান রয়েছে। পরে বনিবনা না হওয়ায় সে
বিয়েতেও বিচ্ছেদ ঘটে। শারমিনকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করায় সরকারের সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখন শারমিনকে সুস্থ
করতে অনেক টাকার দরকার। কোথায় পাবো এত টাকা কিছুই ভাবতে পারছি না।
No comments