ব্যাংক কি শুধু নিজের স্বার্থই দেখবে? by ড. আর এম দেবনাথ
গত সপ্তাহে যুগান্তরে ঋণের সুদের হারের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এর শিরোনাম অর্থনীতিতে সুদের থাবা : প্রধানমন্ত্রী অন্ধকারে। প্রতিবেদনটি ঋণের ওপর সুদ সম্পর্কিত। এতে ঋণের উচ্চসুদের কুফল বর্ণনা করা হয়েছে। জোর দিয়ে পাঁচটি কুফলের কথা বলা হয়েছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদে অর্থনীতির বহুমুখী ক্ষতি হচ্ছে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ক্ষতি, এতে বাড়ছে খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংখ্যা। দ্বিতীয় ক্ষতি, উচ্চসুদের কারণে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হচ্ছে। তৃতীয় ক্ষতি, বিনিয়োগে বন্ধ্যত্ব। উচ্চসুদের কারণে শিল্পায়নে মন্দা চলছে। পঞ্চম ক্ষতি, এতে কর্মসংস্থানের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
উচ্চসুদের যে পাঁচটি কুফলের কথা প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, এর সঙ্গে হয়তো আরও কুফল যোগ করা যেতে পারে। আমার লেখার উদ্দেশ্য আরও ক্ষতির দিক তুলে ধরা নয়। বরং তুলে ধরা সুদের হারের দুই পিঠের কথা। মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ আছে, তেমনি সুদের হারেরও দুটি পিঠ আছে। দেখা যাচ্ছে দুই পিঠেই সমস্যা, ভীষণ সমস্যা। এক পিঠে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা অর্থাৎ শিল্পায়ন ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পিঠ হচ্ছে ঋণের ওপর সুদের হারের পিঠ। দেখা যাচ্ছে, এই পিঠ সম্পর্কে কার্যত সব মহলেই প্রশ্ন রয়েছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন না উচ্চসুদের কারণে। দেশের চেম্বার অব কমার্স, অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের অনেকেই সুদের হার কমানোর কথা বলছেন বহুদিন থেকে। বলা যায়, এটা ব্যবসায়ীদের প্রাণের দাবি। তারা বলছেন, সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত, তার ওপর রয়েছে নানা ধরনের চার্জ, কমিশন, অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদি। এত বোঝা বহন করে ব্যবসা করা কঠিন। আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থাৎ রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। এখন বাজার অর্থনীতির জমানা। বিদেশী পণ্যে বাজার সয়লাব। এই পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্থানীয় শিল্পের টিকে থাকা মুশকিল। এ অবস্থায় সুদের হার কমানো দরকার।
অন্যদিকে সুদের হারের আরেক পিঠে রয়েছে আমানতকারীদের আমানতের ওপর সুদ। এই সুদের হার যথারীতি কমেছে। কমেছে মানে ভীষণভাবে কমেছে। যেখানে আজ থেকে এক-দুই বছর আগেও তিন মাস মেয়াদি আমানতের ওপর সুদের হার ছিল বারো-তেরো শতাংশ এবং আমানতের জন্য ব্যাংকাররা বাড়ি বাড়ি দৌড়াত, সেখানে আজ আমানতের ওপর ব্যাংক সুদ দেয় আট-নয় শতাংশ। মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিধবা ও অসহায় মহিলা, মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিুমধ্যবিত্ত, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রাপক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকেরা আজ দিশেহারা। ধরা যাক, একজন সঞ্চয়কারী সারা জীবনে ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। এতে তার অবসরকালীন সুবিধাও যোগ করা আছে। এই টাকা একটা ব্যাংকে তিন মাস মেয়াদি আমানতে রেখে তিনি দুদিন আগেও পেতেন তেরো শতাংশ হারে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ধরা যাক, ব্যাংক এর ওপর থেকে দশ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কাটে। অতএব তার বার্ষিক সুদ আয় দাঁড়াত ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এতে মাসিক আয় হয় ৪৮ হাজার ৭৫০ টাকা। সেই স্থানে আজ তার আয় কত? অবিশ্বাস্য রকমের কম। একই ৫০ লাখ টাকার ওপর এখন তিন মাস মেয়াদি আমানতে আট শতাংশ হারে সুদ-আয় হচ্ছে বার্ষিক মাত্র ৪ লাখ টাকা। এর ওপর যথারীতি দশ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কাটা যাবে। তাতে আসে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসিক মাত্র ৩০ হাজার টাকা। কোথায় মাসিক আয় ৪৮ হাজার ৭৫০ টাকা, আর কোথায় ৩০ হাজার টাকা! মাসিক আয় কমেছে ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা। আমি কিন্তু এখানে যারা ট্যাক্স দেন অর্থাৎ যারা আয়কর রিটার্ন দেন, তাদের অন্য একটি বিপদের কথা এখানে আলোচনায় আনছি না। শুধু বলছি আয় কমার দুঃখের কথা। দুঃখ দ্বিগুণ হয় যখন মূল্যস্ফীতির হিসাবে যাওয়া যায়। জিনিসপত্রের দাম কি কমেছে? রিকশাভাড়া, বাড়িভাড়া, ওষুধপত্র, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ, ফল-ফলাদি ইত্যাদির দাম কি কোথাও কমেছে? না, তা কমেনি। তাহলে কী দাঁড়াল? সঞ্চয়কারীরা ভীষণ বিপদের মধ্যে নিপতিত। তাদের চোখে-মুখে অন্ধকার। কে শোনে তাদের কথা? মন্ত্রী মহোদয়দের মধ্যে কেউ কি আছেন যিনি মধ্যবিত্তের এ ধরনের বিপদের মতোই বিপদে? মনে হয় না।
দেখা যাচ্ছে, সুদের হার দুই দিক থেকেই কাটা হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ব্যবসায় টিকতে দেয়া হচ্ছে না। আবার যারা আমানত রাখে, তাদেরও পেটানো হচ্ছে। ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানো-বাড়ানোর কথা উঠলেই মজার ঘটনা ঘটায়। তারা আমানতের ওপর সুদের হার চোখ বুজে দমাদম কমিয়ে ফেলে। অথচ তারা এই সুবিধাটা ব্যবসায়ীদের দেয় না। দেখা যায়, আমানতের ওপর সুদের হার কমানো হল ৪ শতাংশ, অথচ ঋণের ওপর সুদের হার কমানো হল বড়জোর এক বা দুই শতাংশ। এ কারণে দেখা যায় ব্যাংকগুলোর স্প্রেড (ঋণের ওপর সুদ বিয়োগ আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদ) অনেক বেশি! কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্প্রেডের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে পাঁচ শতাংশ। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া আর কেউ এই স্প্রেডের সর্বোচ্চ সীমা মানে না। এর বিচার-আচারও নেই। কেউ বেসরকারি ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংককে একটা ধমকও দেয় না। সরকারি ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কত কথা বলা হয়; কিন্তু তাদের স্প্রেড যে ৫ শতাংশের অনেক নিচে এ কথা কেউ বলেও না, লিখেও না। মজা হচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর কিছুটা সুদ বেশি দেয়ার চেষ্টা করে, আবার ঋণের ওপর সুদও কম রাখার চেষ্টা করে। ফলে তাদের স্প্রেড কম।
প্রশ্ন হচ্ছে, সুদের হারে এই অসামঞ্জস্যতা কেন? বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে। বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা সবাই ব্যবসায়ী। তাদের তো ব্যবসায়ীদের অসুবিধা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু কেন তারা সুদের হারে সামঞ্জস্য আনেন না? কেন তারা আমানতের ওপর সুদের হার কমান ভালোভাবে; অথচ সেই সুবিধাটা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দেন না? এখানে কোনো উত্তর নেই। উত্তর একটাই- মুনাফা বৃদ্ধি করা।
ঋণখেলাপি সমস্যার কথা যুগান্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঋণের ওপর উচ্চসুদের কারণে খেলাপি ঋণ (ক্লাসিফাইড লোন) বাড়ছে। মজা হচ্ছে, খেলাপি ঋণের কারণে আবার সুদের হারও বাড়ছে বা উঁচুতে থাকছে। খেলাপি ঋণ মানে ব্যাংকের ক্ষতি। এর বিপরীতে প্রফিট থেকে টাকা কেটে রিজার্ভ বা প্রভিশন রাখতে হয়। অতএব ব্যাংকগুলো বেশি বেশি প্রফিট করার চেষ্টা করে যাতে ওই প্রফিট থেকে খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করা যায়। এটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়। তবে নিশ্চয়ই বড় একটা কারণ। তাহলে খেলাপি ঋণ কমাতে পারলে সুদের হার ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুটা কমানো সম্ভব বলে দৃশ্যত মনে হয়। এর সম্ভাবনা কতটুকু? বর্তমানে যে বাজার তাতে খেলাপি ঋণ কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। ভালো খবরের পেছনে খারাপ খবর লুকিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পেয়েছে এবং পাচ্ছে। এর সুফল সাধারণ ভোক্তা বাংলাদেশীরা পাক বা না পাক, সরকারের ক্রেডিট-এর ফলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু গোমর অন্য জায়গায়। যেসব জিনিসের দাম কমেছে, সেসব জিনিসের আমদানিকারকরা এখন ব্যাংকের লোনের টাকা দিতে অপারগ হচ্ছে। এই হল ভোগ্যপণ্য ব্যবসা বা ট্রেড ফিনান্সিংয়ের অবস্থা। শিপব্রেকিং, শিপ বিল্ডিং, স্টিল মেকিং, চিনি ব্যবসা, সুতার ব্যবসা, আবাসন শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। বড় বড় ব্যবসায়ী ঋণের বোঝা টানতে পারছেন না। ঋণ পুনঃতফসিল (লোন রিশিডিউলিং) আগে হতো অনেকবার, কোনো সীমা ছিল না। এখন তিনবারের বেশি হবে না বলে বিধান করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন রিশিডিউলিং নয়, রিস্ট্রাকচারিং দরকার। অর্থাৎ সমস্যা গভীরতর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মন্দা এতদিন আমাদের ধরতে পারেনি। এখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে বলে মনে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংক তার ঋণের সুদের হার কমাবে, এ আশা ক্ষীণ।
একদিকে ব্যবসায়ীদের করুণ অবস্থা, অন্যদিকে সঞ্চয়কারীদের জীবন ধারণের সমস্যা। এর থেকে বাঁচার পথ কী? দুধরনের সমস্যা সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া দৃশ্যত অসম্ভব একটা ব্যাপার। যদি ধরা যায় ব্যবসায়ীদের কথা, তাহলে একটা পথ খোঁজা যেতে পারে। ব্যবসায়ীদের খাত ধরে ভাগ করা যায়। হিসাব করে দেখা যায় কোন খাতের ব্যবসায়ীদের সুদব্যয় (ইন্টারেস্ট) কেমন। খাতওয়ারি হিসাব করে ক্ষেত্রবিশেষে সুদ-ভর্তুকির কথা চিন্তা করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা ধরনের ফান্ড আছে। সেখান থেকে বিবেচনামতো ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যায়। অথবা সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারে। আমার মনে হয় সুদের হার যেমন ব্যবসায়ীদের একটা সমস্যা, তার চেয়েও এই মুহূর্তে বড় সমস্যা ব্যবসায় মন্দা। সরকারের উচিত এ নিয়ে এখনই ভাবতে শুরু করা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ, মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন, রেমিট্যান্স আসছে, রফতানি চলছে- এসব খবরে আত্মতুষ্টির মধ্যে থাকাটা হবে খুবই বিপজ্জনক। ব্যবসায়ীদের উচিত ব্যাংক মালিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বসা। তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াও সমস্যার একটা সমাধান দিতে পারে।
সঞ্চয়কারীদের কী হবে? তাদের সুদ আয় তো কার্যত অর্ধেক। এমন প্রচুর সঞ্চয়কারী আছেন, যাদের একমাত্র আয়ের উৎস সুদ-আয়। তারা ব্যবসা জানেন না। তাদের অনেকেরই শেয়ারবাজারে গিয়ে দৈনন্দিন ব্যবসা করার মতো যোগ্যতা-সামর্থ্য নেই। সঞ্চয়পত্র আছে। শোনা যাচ্ছে, এর ওপরও সরকারের খড়গ অচিরেই নেমে আসছে। অর্থাৎ এর সুদের হারও কমবে। তাহলে আমানতকারী সঞ্চয়কারীদের বাঁচার পথ কী? ৬-৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, আয়করের উৎপাত, ভ্যাটের উৎপাত, ওষুধপত্রের উচ্চমূল্য, যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি, শিক্ষা খরচ বৃদ্ধি- এর মধ্যে মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীর সঞ্চয় প্রবণতা থাকবে কীভাবে? তাদেরও কি ভর্তুকি দেয়া হবে? তারাও কি সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের নাগরিক হবে? জানি না, আমার কাছে উত্তর নেই। তবে বুঝি, মধ্যবিত্তই অর্থনীতির চাবিকাঠি। তারাই ক্রেতা। তাদের আয় হ্রাস পাওয়া, তাদের ওপর করের বোঝা আর যাই হোক অর্থনীতির জন্য সুখবর নয়।
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
উচ্চসুদের যে পাঁচটি কুফলের কথা প্রতিবেদক উল্লেখ করেছেন, এর সঙ্গে হয়তো আরও কুফল যোগ করা যেতে পারে। আমার লেখার উদ্দেশ্য আরও ক্ষতির দিক তুলে ধরা নয়। বরং তুলে ধরা সুদের হারের দুই পিঠের কথা। মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ আছে, তেমনি সুদের হারেরও দুটি পিঠ আছে। দেখা যাচ্ছে দুই পিঠেই সমস্যা, ভীষণ সমস্যা। এক পিঠে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা অর্থাৎ শিল্পায়ন ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পিঠ হচ্ছে ঋণের ওপর সুদের হারের পিঠ। দেখা যাচ্ছে, এই পিঠ সম্পর্কে কার্যত সব মহলেই প্রশ্ন রয়েছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছেন না উচ্চসুদের কারণে। দেশের চেম্বার অব কমার্স, অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের অনেকেই সুদের হার কমানোর কথা বলছেন বহুদিন থেকে। বলা যায়, এটা ব্যবসায়ীদের প্রাণের দাবি। তারা বলছেন, সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত, তার ওপর রয়েছে নানা ধরনের চার্জ, কমিশন, অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট ইত্যাদি। এত বোঝা বহন করে ব্যবসা করা কঠিন। আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থাৎ রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। এখন বাজার অর্থনীতির জমানা। বিদেশী পণ্যে বাজার সয়লাব। এই পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্থানীয় শিল্পের টিকে থাকা মুশকিল। এ অবস্থায় সুদের হার কমানো দরকার।
অন্যদিকে সুদের হারের আরেক পিঠে রয়েছে আমানতকারীদের আমানতের ওপর সুদ। এই সুদের হার যথারীতি কমেছে। কমেছে মানে ভীষণভাবে কমেছে। যেখানে আজ থেকে এক-দুই বছর আগেও তিন মাস মেয়াদি আমানতের ওপর সুদের হার ছিল বারো-তেরো শতাংশ এবং আমানতের জন্য ব্যাংকাররা বাড়ি বাড়ি দৌড়াত, সেখানে আজ আমানতের ওপর ব্যাংক সুদ দেয় আট-নয় শতাংশ। মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিধবা ও অসহায় মহিলা, মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিুমধ্যবিত্ত, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রাপক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকেরা আজ দিশেহারা। ধরা যাক, একজন সঞ্চয়কারী সারা জীবনে ৫০ লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। এতে তার অবসরকালীন সুবিধাও যোগ করা আছে। এই টাকা একটা ব্যাংকে তিন মাস মেয়াদি আমানতে রেখে তিনি দুদিন আগেও পেতেন তেরো শতাংশ হারে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ধরা যাক, ব্যাংক এর ওপর থেকে দশ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কাটে। অতএব তার বার্ষিক সুদ আয় দাঁড়াত ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এতে মাসিক আয় হয় ৪৮ হাজার ৭৫০ টাকা। সেই স্থানে আজ তার আয় কত? অবিশ্বাস্য রকমের কম। একই ৫০ লাখ টাকার ওপর এখন তিন মাস মেয়াদি আমানতে আট শতাংশ হারে সুদ-আয় হচ্ছে বার্ষিক মাত্র ৪ লাখ টাকা। এর ওপর যথারীতি দশ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কাটা যাবে। তাতে আসে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসিক মাত্র ৩০ হাজার টাকা। কোথায় মাসিক আয় ৪৮ হাজার ৭৫০ টাকা, আর কোথায় ৩০ হাজার টাকা! মাসিক আয় কমেছে ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা। আমি কিন্তু এখানে যারা ট্যাক্স দেন অর্থাৎ যারা আয়কর রিটার্ন দেন, তাদের অন্য একটি বিপদের কথা এখানে আলোচনায় আনছি না। শুধু বলছি আয় কমার দুঃখের কথা। দুঃখ দ্বিগুণ হয় যখন মূল্যস্ফীতির হিসাবে যাওয়া যায়। জিনিসপত্রের দাম কি কমেছে? রিকশাভাড়া, বাড়িভাড়া, ওষুধপত্র, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ, ফল-ফলাদি ইত্যাদির দাম কি কোথাও কমেছে? না, তা কমেনি। তাহলে কী দাঁড়াল? সঞ্চয়কারীরা ভীষণ বিপদের মধ্যে নিপতিত। তাদের চোখে-মুখে অন্ধকার। কে শোনে তাদের কথা? মন্ত্রী মহোদয়দের মধ্যে কেউ কি আছেন যিনি মধ্যবিত্তের এ ধরনের বিপদের মতোই বিপদে? মনে হয় না।
দেখা যাচ্ছে, সুদের হার দুই দিক থেকেই কাটা হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ব্যবসায় টিকতে দেয়া হচ্ছে না। আবার যারা আমানত রাখে, তাদেরও পেটানো হচ্ছে। ব্যাংকগুলো সুদের হার কমানো-বাড়ানোর কথা উঠলেই মজার ঘটনা ঘটায়। তারা আমানতের ওপর সুদের হার চোখ বুজে দমাদম কমিয়ে ফেলে। অথচ তারা এই সুবিধাটা ব্যবসায়ীদের দেয় না। দেখা যায়, আমানতের ওপর সুদের হার কমানো হল ৪ শতাংশ, অথচ ঋণের ওপর সুদের হার কমানো হল বড়জোর এক বা দুই শতাংশ। এ কারণে দেখা যায় ব্যাংকগুলোর স্প্রেড (ঋণের ওপর সুদ বিয়োগ আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদ) অনেক বেশি! কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্প্রেডের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে পাঁচ শতাংশ। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া আর কেউ এই স্প্রেডের সর্বোচ্চ সীমা মানে না। এর বিচার-আচারও নেই। কেউ বেসরকারি ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংককে একটা ধমকও দেয় না। সরকারি ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কত কথা বলা হয়; কিন্তু তাদের স্প্রেড যে ৫ শতাংশের অনেক নিচে এ কথা কেউ বলেও না, লিখেও না। মজা হচ্ছে, সরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের ওপর কিছুটা সুদ বেশি দেয়ার চেষ্টা করে, আবার ঋণের ওপর সুদও কম রাখার চেষ্টা করে। ফলে তাদের স্প্রেড কম।
প্রশ্ন হচ্ছে, সুদের হারে এই অসামঞ্জস্যতা কেন? বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকে। বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা সবাই ব্যবসায়ী। তাদের তো ব্যবসায়ীদের অসুবিধা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু কেন তারা সুদের হারে সামঞ্জস্য আনেন না? কেন তারা আমানতের ওপর সুদের হার কমান ভালোভাবে; অথচ সেই সুবিধাটা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দেন না? এখানে কোনো উত্তর নেই। উত্তর একটাই- মুনাফা বৃদ্ধি করা।
ঋণখেলাপি সমস্যার কথা যুগান্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঋণের ওপর উচ্চসুদের কারণে খেলাপি ঋণ (ক্লাসিফাইড লোন) বাড়ছে। মজা হচ্ছে, খেলাপি ঋণের কারণে আবার সুদের হারও বাড়ছে বা উঁচুতে থাকছে। খেলাপি ঋণ মানে ব্যাংকের ক্ষতি। এর বিপরীতে প্রফিট থেকে টাকা কেটে রিজার্ভ বা প্রভিশন রাখতে হয়। অতএব ব্যাংকগুলো বেশি বেশি প্রফিট করার চেষ্টা করে যাতে ওই প্রফিট থেকে খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করা যায়। এটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়। তবে নিশ্চয়ই বড় একটা কারণ। তাহলে খেলাপি ঋণ কমাতে পারলে সুদের হার ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুটা কমানো সম্ভব বলে দৃশ্যত মনে হয়। এর সম্ভাবনা কতটুকু? বর্তমানে যে বাজার তাতে খেলাপি ঋণ কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। ভালো খবরের পেছনে খারাপ খবর লুকিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পেয়েছে এবং পাচ্ছে। এর সুফল সাধারণ ভোক্তা বাংলাদেশীরা পাক বা না পাক, সরকারের ক্রেডিট-এর ফলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু গোমর অন্য জায়গায়। যেসব জিনিসের দাম কমেছে, সেসব জিনিসের আমদানিকারকরা এখন ব্যাংকের লোনের টাকা দিতে অপারগ হচ্ছে। এই হল ভোগ্যপণ্য ব্যবসা বা ট্রেড ফিনান্সিংয়ের অবস্থা। শিপব্রেকিং, শিপ বিল্ডিং, স্টিল মেকিং, চিনি ব্যবসা, সুতার ব্যবসা, আবাসন শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। বড় বড় ব্যবসায়ী ঋণের বোঝা টানতে পারছেন না। ঋণ পুনঃতফসিল (লোন রিশিডিউলিং) আগে হতো অনেকবার, কোনো সীমা ছিল না। এখন তিনবারের বেশি হবে না বলে বিধান করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন রিশিডিউলিং নয়, রিস্ট্রাকচারিং দরকার। অর্থাৎ সমস্যা গভীরতর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মন্দা এতদিন আমাদের ধরতে পারেনি। এখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে বলে মনে হয়। এ অবস্থায় ব্যাংক তার ঋণের সুদের হার কমাবে, এ আশা ক্ষীণ।
একদিকে ব্যবসায়ীদের করুণ অবস্থা, অন্যদিকে সঞ্চয়কারীদের জীবন ধারণের সমস্যা। এর থেকে বাঁচার পথ কী? দুধরনের সমস্যা সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া দৃশ্যত অসম্ভব একটা ব্যাপার। যদি ধরা যায় ব্যবসায়ীদের কথা, তাহলে একটা পথ খোঁজা যেতে পারে। ব্যবসায়ীদের খাত ধরে ভাগ করা যায়। হিসাব করে দেখা যায় কোন খাতের ব্যবসায়ীদের সুদব্যয় (ইন্টারেস্ট) কেমন। খাতওয়ারি হিসাব করে ক্ষেত্রবিশেষে সুদ-ভর্তুকির কথা চিন্তা করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা ধরনের ফান্ড আছে। সেখান থেকে বিবেচনামতো ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যায়। অথবা সরকার তার রাজস্ব আয় থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারে। আমার মনে হয় সুদের হার যেমন ব্যবসায়ীদের একটা সমস্যা, তার চেয়েও এই মুহূর্তে বড় সমস্যা ব্যবসায় মন্দা। সরকারের উচিত এ নিয়ে এখনই ভাবতে শুরু করা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ, মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন, রেমিট্যান্স আসছে, রফতানি চলছে- এসব খবরে আত্মতুষ্টির মধ্যে থাকাটা হবে খুবই বিপজ্জনক। ব্যবসায়ীদের উচিত ব্যাংক মালিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বসা। তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াও সমস্যার একটা সমাধান দিতে পারে।
সঞ্চয়কারীদের কী হবে? তাদের সুদ আয় তো কার্যত অর্ধেক। এমন প্রচুর সঞ্চয়কারী আছেন, যাদের একমাত্র আয়ের উৎস সুদ-আয়। তারা ব্যবসা জানেন না। তাদের অনেকেরই শেয়ারবাজারে গিয়ে দৈনন্দিন ব্যবসা করার মতো যোগ্যতা-সামর্থ্য নেই। সঞ্চয়পত্র আছে। শোনা যাচ্ছে, এর ওপরও সরকারের খড়গ অচিরেই নেমে আসছে। অর্থাৎ এর সুদের হারও কমবে। তাহলে আমানতকারী সঞ্চয়কারীদের বাঁচার পথ কী? ৬-৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, আয়করের উৎপাত, ভ্যাটের উৎপাত, ওষুধপত্রের উচ্চমূল্য, যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি, শিক্ষা খরচ বৃদ্ধি- এর মধ্যে মধ্যবিত্ত সঞ্চয়কারীর সঞ্চয় প্রবণতা থাকবে কীভাবে? তাদেরও কি ভর্তুকি দেয়া হবে? তারাও কি সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের নাগরিক হবে? জানি না, আমার কাছে উত্তর নেই। তবে বুঝি, মধ্যবিত্তই অর্থনীতির চাবিকাঠি। তারাই ক্রেতা। তাদের আয় হ্রাস পাওয়া, তাদের ওপর করের বোঝা আর যাই হোক অর্থনীতির জন্য সুখবর নয়।
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
No comments