ইরান–ছয়জাতি চুক্তি সত্যিই হবে?
ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে একটি স্থায়ী সমঝোতায় পৌঁছানোর সময়সীমা শেষ হচ্ছে ২৪ নভেম্বর। এ রকম একটি চুক্তি হলে লাভ সবারই। তবে ওই সময়সীমার মধ্যে আসলেই একটি চুক্তি হবে—এমনটি মনে করছেন খুব কম লোকই। ইরানের সঙ্গে এবার পাশ্চাত্যসহ বিশ্বশক্তির সত্যিই চুক্তি হলে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে মারাত্মক সংকটগুলোর একটির হয়তো চূড়ান্ত সমাধান হবে। মূলত এ কারণেই গতকাল মঙ্গলবার অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় শুরু হওয়া ইরান ও ছয় বিশ্বশক্তির (নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য ও জার্মানি, যারা পি ৫+১ নামে পরিচিত) সংলাপের দিকে আগ্রহভরে চোখ রাখছে বিশ্ব। তত্ত্বগতভাবে দেখলে, উভয় পক্ষের মধ্যে একটি শক্ত চুক্তি হওয়ার মানে হচ্ছে, তেহরান এখনই বা অদূর ভবিষ্যতে কোনো পারমাণবিক বোমা বানাতে পারবে না। এ ঘটনায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে ইরানের প্রতিবেশীসহ অনেক দেশ, বিশেষ করে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের মারাত্মক হুমকি দূর হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কারোরই ইরানে হামলা চালানোর আর কোনো কারণ থাকবে না। ইসরায়েলকে আর ভাবতে হবে না যে তার অস্তিত্ব সম্ভাব্য বিপদের মুখে রয়েছে। চুক্তি হলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশগুলোতে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালাও বন্ধ হবে। ইরানের দেখাদেখি পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর জন্য সৌদি আরব বা অন্য কেউ চেষ্টা চালাবে না।
ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ৩৫ বছরের টানাপোড়েনের অবসান ঘটবে। এ ছাড়া চুক্তি হলে ইরানকে একঘরে করে ফেলা পশ্চিমা অবরোধগুলো পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে। এটি দেশটির অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। ইরানের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ খুলে যাবে। কিন্তু ভিয়েনায় উভয় পক্ষের সংলাপ কি চূড়ান্ত পরিণতি পাবে? বেশির ভাগ পর্যবেক্ষকই তেমনটি মনে করছেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি বলেন, ‘বড় বড় ফাটল এখনো রয়ে গেছে। এগুলো আমরা বন্ধ করতে পারব কি না, তা আমরা জানি না।’ ইরানিরা যা বলছেন, তার মর্মকথাও প্রায় একই রকম। যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তি ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানোর সব পথ বন্ধ করে দিতে চায়। তার মানে, তেহরানকে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মকাণ্ডের আকার উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে হবে। সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা ও সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে, যাতে করে ইরান পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেও তা করতে অন্তত যেন ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। এ ছাড়া দেশটিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কর্তৃত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় আরাক শহরে অবস্থিত ভারী পানির পারমাণবিক চুল্লিকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে করে এর প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের ক্ষমতা ব্যাপক হারে কমে যায়। বর্তমানে যে নকশার ভিত্তিতে কাজ চলছে, তাতে করে চালু হলে এই চুল্লিটি বছরে যে পরিমাণ প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করবে, তা দুটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট।
ইরান বরাবরই বলে আসছে, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির লক্ষ্য শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার। যেমন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসাকাজে ব্যবহার। তবে ইরানের নেতারা নিয়মিতভাবেই পারমাণবিক কর্মসূচির পক্ষে বক্তব্য দেন। এতে করে বিষয়টি জাতীয় চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। তাই এখন হঠাৎ করেই এ কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়াও সরকারের জন্য কঠিন একটা ব্যাপার। কট্টরপন্থী ইরানিরা এরই মধ্যে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকারকে দেশের বিজ্ঞানীদের ‘কষ্টার্জিত সাফল্য বিক্রি করে দেওয়া’র বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। ইরান চায়, তাদের ওপর আরোপিত সব অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা একবারেই প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। কিন্তু পশ্চিমারা চায়, ইরান চুক্তিতে থাকা সব ধরনের শর্ত মেনে চলছে, এটা প্রমাণ করার পরই কেবল তা হবে। ভিয়েনা সংলাপে অংশ নেওয়া মার্কিন শীর্ষ আলোচক ওয়েন্ডি শেরম্যান মনে করেন, সত্যিকারের সফলতা পেতে এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে। এখনো অনেকগুলো কারিগরি ও রাজনৈতিক ইস্যু রয়েছে, যার সমাধান আগে করতে হবে।
No comments