শুধু কি বিরোধী দলই ব্যর্থ? by মেজবাহ-উ ল-আজম সওদাগর
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের হাত ধরে বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয় গ্রিসের ছোট্ট নগর রাষ্ট্র এথেন্সে। ক্লিসথেনিস রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতা বেছে নেয়ার যে নীতি, তার অবসান ঘটান এবং বিপরীতে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেয়ার অধিকার নিশ্চিত করেন। বিশ্বের ইতিহাসে ক্লিসথেনিসের এ পদক্ষেপকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার শুরু বলে ধরা হয়। রাষ্ট্রে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন ক্লিসথেনিস। গণতন্ত্রের এই শুরু থেকে তার বিকাশের এ পর্যায় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই গণতন্ত্রের মূল কথা। গণতন্ত্রে আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনা স্বীকৃত। গণতন্ত্রে পারস্পরিক আলোচনা ও পরামর্শের পর শেষাবধি সংখ্যাগরিষ্ঠের বাছাইকৃত মত গ্রহণীয় বলে বিবেচ্য হয়। আর সে কারণে গণতন্ত্রই হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে কম সমালোচিত ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য একটি শাসনব্যবস্থা, যা আজ অবধি চালু রয়েছে। মার্কিন ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা আধুনিক এই উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে মানব ইতিহাসের শেষ রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন যে, এরপর আর মানুষ কোনো রাজনৈতিক আদর্শের খোঁজে ছুটবে না। ফুকুইয়ামার এই মত বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়; কিন্তু এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে। যাহোক, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই যেখানে গণতন্ত্রের লক্ষ্য, অধিকারহীনতা সেখানে নিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্রহীনতা, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। মৌলিক অধিকার, মানবাধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে যে জবরদস্তিমূলক শাসন মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয় তাই গণতন্ত্রহীনতা। গণতন্ত্রহীনতায় জনমত ও যুক্তির কোনো প্রাধান্য নেই। এখানে যুক্তির জোরের পরিবর্তে জোরের যুক্তি অনুসৃত হয়। ফলে রাষ্ট্র পরিণত হয় মিথ্যা, অন্যায়, অবিচারের স্বর্গে।
আজকের এই লেখা বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতার প্রায়োগিক দিকের একটা বিশ্লেষণ। এ লেখায় আমি প্রশ্ন তুলব,
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন কাজ করছে কার স্বার্থে, কীভাবে ও কেন? সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করব এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন করার প্রথম পদক্ষেপটি নেয়া হয়। এরপর ৫ জানুয়ারির একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয় আর শুরু হয় জবরদস্তিমূলক শাসন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে গণতন্ত্রহীনতার পথে যাত্রা শুরুর পর দেশে খুন, গুম, দমন-নিপীড়নের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। স্বাভাবিক অবস্থায়ও দেশে খুন-গুম বেড়ে যেতে পারে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতার পথে যাত্রা শুরুর পর দেশে আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া খুন, গুম, দমন-নিপীড়নের বিষয়ে
রাষ্ট্রের অবস্থান কী?
বাংলাদেশে খুন, গুম নিয়ে যেখানে সারা দেশের মানুষসহ সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন সেখানে হতভাগ্য পরিবারগুলোকে তাচ্ছিল্য করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘আমি গুমকে গুম বলি না, হারিয়ে যাওয়া বলি। যারা গুম হন তারা আসলে হারিয়ে যান।’ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই তাচ্ছিল্য গুম, খুনের পক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে। অপহরণকারীদের জীবনকে আরও নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত র? র্যাব কর্মকর্তাদের দ্রুত গ্রেফতারে হাইকোর্ট সুয়োমোটো রুলের মাধ্যমে নির্দেশ দিলে প্রধানমন্ত্রী তাতে নাখোশ হন আর এ ঘটনায় বহুল আলোচিত সংসদ সদস্য ও সন্ত্রাসীদের গডফাদার শামীম ওসমানের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে। উল্টো প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের পাশে থাকার। এরপর দলীয় জনসভায় ওই পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বললেন, ‘ওসমান পরিবার আওয়ামী লীগের। এই ওসমান পরিবারকে, এই খান সাহেব ওসমানকে আমরা আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারব না।’ খুনি ওই র?্যাব কর্মকর্তারা কেন এখন জামাই আদরে থাকবেন না? ওদিকে গডফাদার নিশ্চয়ই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। নবীনগরের শাহনূর আলম হত্যা ঘটনায় র?্যাবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার এফআইআর করার আদেশ দেয়ার পরদিনই ৫ জুন বিচারিক হাকিম নাজমুন নাহারকে জনস্বার্থে আদালত থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়। র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা এফআইআরভুক্ত করার আদেশ দেয়ার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাক আহমেদ সাহদানী এই আদেশ দেন। নাজমুন নাহারকে আমলি আদালত থেকে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে আদেশে বলা হয়। প্রত্যাহারের এই আদেশ কার্যকর হয় ৮ জুন থেকে। এ বিষয়ে
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী খায়রুল
এনাম বলেন, বিচারককে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, তিনি মামলা গ্রহণ করার জন্য নবীনগর থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়ার কারণে প্রত্যাহারের ঘটনাটি ঘটেছে। এর বাইরে হুট করে প্রত্যাহারের আর কোনো কারণ আমরা দেখতে পাই না।
এদিকে শাহনূর আলম হত্যা মামলাটি স্থগিত করার জন্য ফৌজদারি মোশন করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে (মানবজমিন, ৬ জুন ২০১৪)। এবারও মুচকি হেসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে খুনিরা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজ নয়, দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন দুদক সরকারদলীয়দের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিচ্ছেন। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সংসদে প্রশ্ন রাখেন, দেশের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায়, বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতিবছরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এতে মাঝে মধ্যে পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এসব প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত করা হয়েছে কি? জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত পাঁচ বছরে কোনো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। আমরা সবাই জানি পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিতে কী পরিমাণ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, এ বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার অধীনে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যাওয়ায় বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয় এবং প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০১৪)। এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য প্রশ্ন ফাঁসকারীদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে নিশ্চয়ই সহায়তা করেছে। তারা আরও কনফিডেন্ট হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি ও প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেছেন, ‘বিসিএসে তোমরা লিখিত পরীক্ষাটা ভালো করে দাও, ভাইভাটা আমরা দেখব।’ অর্থাৎ ভাইভাতে কোনো মেধা বা যোগ্যতা লাগবে না, শুধু ছাত্রলীগ হলেই চলবে। আর যাদের মেধা-যোগ্যতা আছে; কিন্তু ছাত্রলীগ নয়, বিসিএসের চাকরি তাদের ভাগ্যে নেই বলেই কার্যত ঘোষণা দিলেন এই প্রভাবশালী উপদেষ্টা। এই ঘোষণায় মেধাবীরা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছে আর তাদের হতাশা দেখে ছাত্রলীগের ছেলেরা টিপ্পনি কাটছে। এছাড়া, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়া, নতুন বিতর্কিত সম্প্রচার নীতিমালা, সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করা, হাজার হাজার মানুষের নামে মিথ্যা মামলা, রিমান্ডের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতন ইত্যাদি অগণতান্ত্রিক নিপীড়ক রাষ্ট্রের আরও কিছু অনৈতিক কাজ। চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকা না, দুর্নীতিকে আমি অবৈধ মানে করি না, হরতালে রাস্তায় নামলেই গুলি করা হবে, হরতালকারীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যা
করা হবে ইত্যাদি তো আছেই। এতে যারা অবাক হন তারা বোকা। কারণ গণতন্ত্রহীনতার একটি তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক ব্যাখ্যা আছে। খুন, গুম, দুর্নীতি ইত্যাদির পক্ষে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অবস্থান গণতন্ত্রহীনতায় অবশ্যম্ভাবী। এখানে রাষ্ট্র মিথ্যা, অন্যায়, খুন, গুম ইত্যাদির পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য। গণতন্ত্রহীনতায় অগণতান্ত্রিক সরকারের টিকে থাকার এটিই প্রধান শর্ত। পানিবিহীন মাছ আর মিথ্যা, অন্যায়, খুন, গুমবিহীন একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব অকল্পনীয়।
এভাবেই গণতন্ত্রহীনতার জবরদস্তিমূলক শাসনে মিথ্যা, অন্যায়-অবিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় রাষ্ট্র নিজেই। রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে পড়ে মিথ্যাবাদী, খুনি, লুটেরা, চোর আর দুর্নীতিবাজদের। দেশপ্রেমিক বা সৎ মানুষ এখানে রাষ্ট্রের শত্র“। আর এ কারণেই টকশো আলোচকরা আখ্যায়িত হয়েছেন সিঁধেল চোর হিসেবে। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা শহীদ মিনারে হয়েছেন অবাঞ্ছিত। গণতন্ত্রহীনতায় রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মিথ্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন। মিথ্যা, অন্যায় আর নিপীড়নের আশ্রয় নিতে হবে তাকে টিকে থাকার স্বার্থেই, আর তা করতে না পারলে তার কর্ণধারদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। কিন্তু বলুন, অস্তিত্বের বিপন্নতা কে চায়? এ অবস্থায় সরকারের কাছে নির্বাচন কিংবা সংলাপ ভিক্ষা অপদার্থ কিংবা ব্যর্থদের মুখেই মানায়। মাঠে-ঘাটে দেখুন কেউ আর বলে না, এটা ব্যর্থ সরকার। সবাই বলে, ব্যর্থ বিরোধী দল, ব্যর্থ বিরোধী দল।
মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আজকের এই লেখা বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতার প্রায়োগিক দিকের একটা বিশ্লেষণ। এ লেখায় আমি প্রশ্ন তুলব,
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন কাজ করছে কার স্বার্থে, কীভাবে ও কেন? সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করব এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন করার প্রথম পদক্ষেপটি নেয়া হয়। এরপর ৫ জানুয়ারির একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয় আর শুরু হয় জবরদস্তিমূলক শাসন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে গণতন্ত্রহীনতার পথে যাত্রা শুরুর পর দেশে খুন, গুম, দমন-নিপীড়নের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। স্বাভাবিক অবস্থায়ও দেশে খুন-গুম বেড়ে যেতে পারে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গণতন্ত্রহীনতার পথে যাত্রা শুরুর পর দেশে আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া খুন, গুম, দমন-নিপীড়নের বিষয়ে
রাষ্ট্রের অবস্থান কী?
বাংলাদেশে খুন, গুম নিয়ে যেখানে সারা দেশের মানুষসহ সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন সেখানে হতভাগ্য পরিবারগুলোকে তাচ্ছিল্য করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘আমি গুমকে গুম বলি না, হারিয়ে যাওয়া বলি। যারা গুম হন তারা আসলে হারিয়ে যান।’ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এই তাচ্ছিল্য গুম, খুনের পক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে। অপহরণকারীদের জীবনকে আরও নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত র? র্যাব কর্মকর্তাদের দ্রুত গ্রেফতারে হাইকোর্ট সুয়োমোটো রুলের মাধ্যমে নির্দেশ দিলে প্রধানমন্ত্রী তাতে নাখোশ হন আর এ ঘটনায় বহুল আলোচিত সংসদ সদস্য ও সন্ত্রাসীদের গডফাদার শামীম ওসমানের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে। উল্টো প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের পাশে থাকার। এরপর দলীয় জনসভায় ওই পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বললেন, ‘ওসমান পরিবার আওয়ামী লীগের। এই ওসমান পরিবারকে, এই খান সাহেব ওসমানকে আমরা আওয়ামী লীগের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারব না।’ খুনি ওই র?্যাব কর্মকর্তারা কেন এখন জামাই আদরে থাকবেন না? ওদিকে গডফাদার নিশ্চয়ই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। নবীনগরের শাহনূর আলম হত্যা ঘটনায় র?্যাবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার এফআইআর করার আদেশ দেয়ার পরদিনই ৫ জুন বিচারিক হাকিম নাজমুন নাহারকে জনস্বার্থে আদালত থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়। র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা এফআইআরভুক্ত করার আদেশ দেয়ার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাক আহমেদ সাহদানী এই আদেশ দেন। নাজমুন নাহারকে আমলি আদালত থেকে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে আদেশে বলা হয়। প্রত্যাহারের এই আদেশ কার্যকর হয় ৮ জুন থেকে। এ বিষয়ে
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী খায়রুল
এনাম বলেন, বিচারককে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে, তিনি মামলা গ্রহণ করার জন্য নবীনগর থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়ার কারণে প্রত্যাহারের ঘটনাটি ঘটেছে। এর বাইরে হুট করে প্রত্যাহারের আর কোনো কারণ আমরা দেখতে পাই না।
এদিকে শাহনূর আলম হত্যা মামলাটি স্থগিত করার জন্য ফৌজদারি মোশন করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে (মানবজমিন, ৬ জুন ২০১৪)। এবারও মুচকি হেসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে খুনিরা। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবাজ নয়, দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন দুদক সরকারদলীয়দের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিচ্ছেন। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সংসদে প্রশ্ন রাখেন, দেশের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায়, বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতিবছরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। এতে মাঝে মধ্যে পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এসব প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত করা হয়েছে কি? জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গত পাঁচ বছরে কোনো পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। আমরা সবাই জানি পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিতে কী পরিমাণ প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, এ বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার অধীনে অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যাওয়ায় বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয় এবং প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে (প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০১৪)। এ অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য প্রশ্ন ফাঁসকারীদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে নিশ্চয়ই সহায়তা করেছে। তারা আরও কনফিডেন্ট হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতি ও প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেছেন, ‘বিসিএসে তোমরা লিখিত পরীক্ষাটা ভালো করে দাও, ভাইভাটা আমরা দেখব।’ অর্থাৎ ভাইভাতে কোনো মেধা বা যোগ্যতা লাগবে না, শুধু ছাত্রলীগ হলেই চলবে। আর যাদের মেধা-যোগ্যতা আছে; কিন্তু ছাত্রলীগ নয়, বিসিএসের চাকরি তাদের ভাগ্যে নেই বলেই কার্যত ঘোষণা দিলেন এই প্রভাবশালী উপদেষ্টা। এই ঘোষণায় মেধাবীরা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছে আর তাদের হতাশা দেখে ছাত্রলীগের ছেলেরা টিপ্পনি কাটছে। এছাড়া, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেয়া, নতুন বিতর্কিত সম্প্রচার নীতিমালা, সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করা, হাজার হাজার মানুষের নামে মিথ্যা মামলা, রিমান্ডের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতন ইত্যাদি অগণতান্ত্রিক নিপীড়ক রাষ্ট্রের আরও কিছু অনৈতিক কাজ। চার হাজার কোটি টাকা কোনো টাকা না, দুর্নীতিকে আমি অবৈধ মানে করি না, হরতালে রাস্তায় নামলেই গুলি করা হবে, হরতালকারীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হত্যা
করা হবে ইত্যাদি তো আছেই। এতে যারা অবাক হন তারা বোকা। কারণ গণতন্ত্রহীনতার একটি তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক ব্যাখ্যা আছে। খুন, গুম, দুর্নীতি ইত্যাদির পক্ষে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অবস্থান গণতন্ত্রহীনতায় অবশ্যম্ভাবী। এখানে রাষ্ট্র মিথ্যা, অন্যায়, খুন, গুম ইত্যাদির পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য। গণতন্ত্রহীনতায় অগণতান্ত্রিক সরকারের টিকে থাকার এটিই প্রধান শর্ত। পানিবিহীন মাছ আর মিথ্যা, অন্যায়, খুন, গুমবিহীন একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের অস্তিত্ব অকল্পনীয়।
এভাবেই গণতন্ত্রহীনতার জবরদস্তিমূলক শাসনে মিথ্যা, অন্যায়-অবিচারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় রাষ্ট্র নিজেই। রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে পড়ে মিথ্যাবাদী, খুনি, লুটেরা, চোর আর দুর্নীতিবাজদের। দেশপ্রেমিক বা সৎ মানুষ এখানে রাষ্ট্রের শত্র“। আর এ কারণেই টকশো আলোচকরা আখ্যায়িত হয়েছেন সিঁধেল চোর হিসেবে। দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীরা শহীদ মিনারে হয়েছেন অবাঞ্ছিত। গণতন্ত্রহীনতায় রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মিথ্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন। মিথ্যা, অন্যায় আর নিপীড়নের আশ্রয় নিতে হবে তাকে টিকে থাকার স্বার্থেই, আর তা করতে না পারলে তার কর্ণধারদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। কিন্তু বলুন, অস্তিত্বের বিপন্নতা কে চায়? এ অবস্থায় সরকারের কাছে নির্বাচন কিংবা সংলাপ ভিক্ষা অপদার্থ কিংবা ব্যর্থদের মুখেই মানায়। মাঠে-ঘাটে দেখুন কেউ আর বলে না, এটা ব্যর্থ সরকার। সবাই বলে, ব্যর্থ বিরোধী দল, ব্যর্থ বিরোধী দল।
মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments