নতুন সামাজিক ব্যবস্থা রচনায় অর্থনৈতিক চিন্তার পুনর্বিন্যাস by ড. মুহাম্মদ ইউনূস
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি নৈতিক, সামাজিক এবং বস্তুগত ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে কাঙ্ক্ষিত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগ যে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে তার মাধ্যমে এ ভারসাম্য কিছুতেই সম্ভব হবে না। বরং এর মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলো আরও প্রকট হয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল এবং অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে, এটা আসলে নৈর্ব্যক্তিক একটা শোষণ যন্ত্র। এর কাজ হলো নিচ থেকে রস শুষে অনবরত উপরের দিকে পাঠাতে থাকা। বহু স্তরে বিন্যস্ত এই যন্ত্র ধাপে ধাপে নিচের স্তরের রস তার ওপরের স্তরে পাঠায়। এর সর্বনিচের স্তরটি সবচেয়ে বিশাল। সেখানে অসংখ্য কর্মী নিরলসভাবে বিন্দু বিন্দু করে রস তৈরি করেন। তার ওপরের স্তরটিতে তুলনামূলক অনেক কম মানুষ, কিন্তু যন্ত্রে তাদের অবস্থানের কারণে শক্তিতে তারা অনেক বলবান। তাই তারা নিচের সংগ্রহ করা রস অনায়াসে নিজের কাছে টেনে নেন। ওপরে যারা আছেন তারা খারাপ মানুষ হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে তা নয়। যন্ত্রের কারণেই মূলত এটা হচ্ছে। যন্ত্রটাই এভাবে বানানো হয়েছে। স্তরে স্তরে সাজানো মানুষগুলো নিচের স্তরের রস ওপরে টেনে নিয়ে নিচ্ছে তাদের শক্তির কারণে। এতে কেউ দোষের কিছু দেখে না। বরং ধরে নেয় যে, এটাই জগতের নিয়ম। অথচ বিষয়টা জগতের নিয়ম নয়। কিছু পণ্ডিত বসে এ রকম একটা শাস্ত্র তৈরি করে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে, ‘এটাই জগতের নিয়ম; এ নিয়ম মেনে চললে সবার জন্য মঙ্গল।’
প্রত্যেক স্তরে মানুষের সংখ্যা তার আসন্ন নিচের স্তরের মানুষের সংখ্যা থেকে অনেক কম। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আয়ত্তে রসের পরিমাণ হতে থাকবে নিচের স্তরের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ মাত্র। তাদের আয়ত্তে এত রস সংগৃহীত থাকবে যে, নিচের দিকের অর্ধেক স্তরে জমানো সব রস একত্র করলেও এই পরিমাণ রসের সমান হবে না। এর জন্য কাউকে আমরা দোষী বলতে পারছি না। কারণ শাস্ত্রে বলে দেয়া আছে এমনটিই হওয়ার কথা। এতেই সবার মঙ্গল। বলা বাহুল্য, কোন নৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ যন্ত্র তৈরি হয়নি। এ যন্ত্র মূলত তৈরি হয়েছে অর্থনীতির চাকাকে সব সময় সচল রাখার জন্য। সব সময় চোখ রাখা হয়েছে কখনও যেন অর্থনীতির চাকা কোন চোরাবালিতে আটকে না যায়। শাস্ত্রে নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের নানা অবতারণা থাকলেও বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ নেই। বাস্তবে তার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। সমাজ নিয়ে যারা চিন্ত করে তারা মাঝে মধ্যে এটা স্মরণ করিয়ে দিলে এটা নিয়ে কিছু উদ্যোগ আয়োজনের কথা বলাবলি হয়; কিন্তু দ্রুত সবাই এসব কথা ভুলে যায়। যেহেতু যন্ত্রের গাঁথুনিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি কাজেই এসব কখনও যন্ত্রের কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
যেমন ধরুন শেয়ারবাজারের কথা। বর্তমান জগতের ব্যবসার সাফল্যের মাত্রা নির্ধারণে শেয়ারবাজারের মূল্যায়নই চূড়ান্ত। কারা ব্যবসা ভাল করছে, কারা ব্যবসাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছতে পারছে সব বিষয়ে রায় দিচ্ছে শেয়ারবাজার। এই মূল্যায়নে কোথাও কোন নৈতিক বিচারের মাপকাঠি কিংবা সামাজিক বিচারের মাপকাঠি ব্যবহার হয় না। কাজেই ব্যবসার প্রধান নির্বাহীর পৃষ্টিতে এসব বিষয় পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক এবং বাড়তি ঝামেলা। উপায়ান্তর না দেখে সরকার এগিয়ে আসে নিচের মানুষকে কিছু স্বস্তি দেয়ার জন্য। সরকার ওপরের স্তর থেকে রস সংগ্রহ করে নিচের স্তরে বিলি করে তাদের করুণ অবস্থা থেকে রেহাই দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যন্ত্রের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
এ যন্ত্রকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছি বলে যন্ত্রটা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা আমাদের করেছে সেটা হলো, আমরা সবাই আমাদের অজান্তে অর্থলোভী কলের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছি। জীবনে অর্থ জমিয়ে নিচের স্তর থেকে ওপরের স্তরে যাওয়ার সাধনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে বলে মনে থাকে না। আমরা এটা জেনেই চমৎকৃত যে, যে যত উপরের স্তরে যেতে পারবে, যন্ত্রের গঠনের কারণে সে তত অল্প আয়াসে, অনেক বেশি গুণ রস সংগ্রহ করার ক্ষমতা অর্জন করবে। এমনকি সে বসে থাকলেও যন্ত্র তাকে ক্রমাগত রস জুগিয়ে দিতে থাকবে।
সামাজিক ব্যবসা
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যেটি মৌলিক গলদ বলে আমি মনে করি, সেটি হলো এমন একটি কাল্পনিক মানুষকে কেন্দ্র করে সমস্ত শাস্ত্রটিকে সাজানো হয়েছে যার সঙ্গে রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। শাস্ত্রবিদরা হয়তো নির্দোষ সরলীকরণ মনে করে এ কাজটি করেছেন। কিন্তু সেটা শাস্ত্রকে এবং এই শাস্ত্র অনুসরণকারী পুরো বিশ্বকে মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শাস্ত্রবিদরা ধরে নিয়েছেন, অর্থনৈতিক জগতে যে মানুষ বিচরণ করে সে হলো শতভাগ স্বার্থপর জীব। স্বার্থপরতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না। আমি মনে করি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সব গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি আমরা করেছি তার মূলে রয়েছে মানুষের এই খণ্ডিত রূপকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা।
অর্থনৈতিক শাস্ত্রে স্বার্থপর মানুষের জায়গায় আমি এমন একটি মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে চাইছি, যিনি একই সঙ্গে স্বার্থপর এবং স্বার্থহীন। কারণ প্রকৃত মানুষ এই দুয়ের সংমিশ্রণ। কে কত স্বার্থপর এবং কত স্বার্থহীনভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ওপর, তার সমাজ সচেতনতার ওপর, তার শিক্ষার ওপর, তার নৈতিক বিচার-বিবেচনার ওপর। একই মানুষ স্থায়ীভাবে বা সাময়িকভাবে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে, প্রচণ্ড স্বার্থপর হতে পারে অথবা দিলদরিয়া স্বার্থহীন হতে পারে অথবা একই সঙ্গে দুয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে। এ ধরনের মানুষকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা করতে হলে আমাদের দুই ধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যখন মানুষ তার স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করতে চায় এবং প্রয়োগ করতে চায় তখন সে সর্বোচ্চ মুনাফাকারী হিসেবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। যখন স্বার্থহীন হতে চায়, তখন সে এমন ব্যবসা করবে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন করার কোন ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করবে না; তার একমাত্র লক্ষ্য হবে ব্যবসায়িক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমাজের সমস্যার সমাধান করা। আমি এই ব্যবসার নাম দিয়েছি ‘সামাজিক ব্যবসা’। এ ধরনের ব্যবসা থেকে মালিক তার বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত নেয়া ছাড়া আর কোন অর্থ মুনাফা হিসেবে নিতে পারবে না। এ ধরনের এই নতুন মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক শাস্ত্র রচনা করলে সে শাস্ত্রে দু’ধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতেই হবে। একটা হবে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা, আরেকটি হবে সামাজিক ব্যবসা। তার ফলে সব পরিস্থিতিতে সকল মানুষের কাছে দুটি বিকল্প থাকবে। এ বিকল্প না থাকার কারণেই আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছি এবং প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
প্রচলিত অর্থনৈতিক শাস্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার বাইরে ব্যবসার কোন ক্ষেত্র নেই। অর্থাৎ স্বার্থপর হওয়া ছাড়া ব্যবসা করার কোন সুযোগ নেই। স্বার্থহীনভাবে কিছু করতে চাইলে দান-খয়রাতের জগতে প্রবেশ করতে হয়। দাতব্য কর্মকাণ্ডে সমাজের অবহেলিত মানুষের অনেক উপকার হয়। কিন্তু এ সব কর্মকাণ্ড বরাবর পরমুখাপেক্ষী থেকে যায়। আত্মনির্ভর হওয়ার কোন সুযোগ এদের থাকে না। কারণ, সব সময় নতুন নতুন অর্থ সংগ্রহ করে দাতব্য কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। একবার কাজে লাগালে দানের টাকা খরচ হয়ে যায়। দানের টাকা ফেরত আসে না। সামাজিক ব্যবসা যেহেতু ব্যবসা সে কারণে টাকাটা ফিরে আসে। একই টাকাকে বারবার ব্যবহার করে ব্যবসা সমপ্রসারণ করা যায়। সামাজিক ব্যবসাকে নিজস্ব ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। সমাজের যত সমস্যা আছে সবকিছুর সামাধান সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
ব্যক্তিগত মুনাফা ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। এগুলোকে বলা হয় বিজনেস স্কুল। এই শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণ ব্যবসা-যোদ্ধারা বের হয়ে আসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন বাজার জয় করার জন্য আর কোম্পানির মালিকদের জন্য বেশি মুনাফা অর্জনের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিজনেস স্কুলে পৃথক বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজন হবে। এই শিক্ষা নিয়ে তরুণরা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের লড়াইতে নামবে। দুই ব্যবসার দুই রকমের দক্ষতার প্রয়োজন। এক ক্ষেত্রে লাগবে মালিকদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সমস্ত কলাকৌশল আয়ত্ত করা, অন্য ক্ষেত্রে লাগবে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা।
আয়-বৈষম্য
আয়-বৈষম্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী কাঠামোতে অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রথিত আছে। তার ওপর যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে উঠেছে তা এই আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি আরও জোরদার করে দিয়েছে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা সবকিছুর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ভাগ্যবানদের পক্ষে। ভাগ্যহীনদের জন্য সব দরজা বন্ধ। তাদের পক্ষে এসব দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব। কাজেই মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলবে। যে যন্ত্র ক্রমাগতভাবে নিচ থেকে রস সংগ্রহ করে ওপরে চালান দেয়ার কাজে নিয়োজিত সে যন্ত্র কখনও ওপর-নিচের আয়ের ব্যবধান ঘোচাতে পারবে না। আয়-বৈষম্য আমাদের এখন কোথায় নিয়ে এসেছে সেটা দেখলেই পরিস্থিতি বোঝা যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮৫ জন মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে, তার পরিমাণ আয়ের দিক থেকে নিচে আছে পৃথিবীর এমন অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের যোগফলের চেয়ে বেশি। অন্যভাবে তাকালেও একই পৃশ্য দেখা যাবে। আয়ের দিক থেকে উপরে আছে পৃথিবীতে এমন অর্ধেক মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র এক শতাংশ। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কি এ অবস্থার উন্নতি হবে? না, হবে না। কারণ, অর্থনৈতিক যন্ত্রটিকে কাজ দেয়া হয়েছে ওপরওয়ালাকে আরও রস জোগান দেয়ার। নিচের রস ওপরের দিকে যেতেই থাকবে। আয়-বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। নিচের তলার মানুষের মাথাপিছু যে প্রবৃদ্ধি হবে, ওপরতলার মানুষের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি যে তার থেকে বহুগুণ বেশি হবে, এটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সামাজিক ব্যবসা নিচ থেকে ওপরে রস চালান দেয়ার গতিটা কমাবে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনকে সামাজিক ব্যবসা একেবারে নিচের তলার লোকের কাছে সহজলভ্য করে দিতে পারে। ফলে তাদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ওপরের তলার অফুরন্ত সম্পদের অংশ সামাজিক ব্যবসায় নিয়োজিত হলে তাদের আরও সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা কমবে। সামাজিক ব্যবসার পরিমাণ যদি ব্যক্তিগত মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসার চেয়ে বেশি হতে আরম্ভ করে, তাহলে যত না নিচের রস ওপরে যাবে তার চেয়ে বেশি ওপরের রস নিচে আসতে শুরু করবে।
সামাজিক ব্যবসা তাত্ত্বিক কাঠামোয় একটা উল্টো যন্ত্র স্থাপন করছে। ওপরের রস নিচে আনার যন্ত্র। ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই একই মার্কেটে দু’যন্ত্র কাজ করবে। কোন যন্ত্রটির জোর বেশি হবে, সেটা নির্ভর করবে আমরা কি চাই তার ওপর। সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে, যন্ত্রের হাতে নয়। আমরা আমাদের পছন্দের যন্ত্রটা নিয়ে কাজ করব। বর্তমানে যন্ত্র একটাই। কাজেই এখানে আমাদের কোন সিদ্ধান্ত কাজে লাগে না। যন্ত্রই সিদ্ধান্ত স্থির করে দিয়েছে। আমাদের বলা হচ্ছে, এটাই একমাত্র এবং সর্বোত্তম যন্ত্র। আমরা সে কথা বিশ্বাস করে কলের পুতুলের মতো এই যন্ত্র ব্যবহার করে তথাকথিত ‘সাফল্যের’ পেছনে যথাসাধ্য দৌড়াচ্ছি। আমাদের একটু থেমে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে আমরা কি নিজের ইচ্ছা সম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ হবো, নাকি কলের পুতুল হবো? মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য জয়ী হবে নাকি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা জয়ী হবে? যন্ত্র জয়ী হবে, নাকি মানুষ জয়ী হবে?
বর্তমান যন্ত্র মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞাকে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে তাকে প্রশ্নাতীত করে রেখেছে।
স্বার্থপরতাকে একমাত্র গুণ ধরে নিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দারিদ্র্য, আয়-বৈষম্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ কিছু থেকেই বের হওয়া যাবে না। অর্থনীতিকে আবিষ্কার করতে হবে যে পৃথিবীতে ‘আমি’ ছাড়া আরও মানুষ আছে, আরও প্রাণী আছে। সবার সমবেত ভবিষ্যৎই ‘আমার’ ভবিষ্যৎ। ‘আমাদের’ ভবিষ্যৎই ‘আমার’ ভবিষ্যৎ।
জিডিপি কার কথা বলে?
স্বার্থপর পৃথিবীতে আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সাফল্যের মাপকাঠি বানাই স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদকে উঁচিয়ে ধরার জন্য। যেমন যে যত বেশি ধনী, সে তত বেশি সফল ব্যক্তি। যে ব্যবসায় যত বেশি লাভ করে, সে তত বেশি সফল। যে দেশের মাথাপিছু জিডিপি যত বেশি, সে দেশ তত বেশি উন্নত। জিডিপি দিয়ে আমরা কি জানলাম? আমাদের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন কত হয়েছে তা জানলাম। কিন্তু তাতে দেশের এবং মানুষের পরিস্থিতির কতটুকু জানা হলো? এর মাধ্যমে কি আমরা জানতে পারলাম দেশের দারিদ্র্যের পরিস্থিতি কি? হয়তো দেশে বাঘা বাঘা কিছু ধনী লোক আছে যারা জিডিপির ৯৯ শতাংশের মালিক। তাতে সাধারণ মানুষের তো ভয় পাওয়ার কথা। আনন্দিত হওয়ার তো কোন কারণই নেই। মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে হলে এমন একটা পরিমাপ বের করতে হবে, যেটা আসবে জিডিপির সঙ্গে দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বার্থহীনতা, আয়-বৈষম্য, পরিবেশ দূষণ, সবার কাছে শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, মানবিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদির পরিমাপ যুক্ত করে।
স্বার্থপর পৃথিবীতে বিশ্বায়নের যে চমৎকার সুযোগটা এসেছে সেটাও চলছে উল্টা দিকে। পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব সৃষ্টির সুযোগ না হয়ে এটা হয়ে পড়ছে বাজার দখলের লড়াই। এক রাষ্ট্রের শোষণযন্ত্র থাবা বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে আরেক রাষ্ট্রের মানুষের ওপর। বিশ্বপরিবার গড়ার জায়গায় বিশ্ব পরিণত হতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রণক্ষেত্রে।
প্রযুক্তি
যে মন ধাঁধানো, চোখ ধাঁধানো, প্রযুক্তি একটার পর একটা আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং তার চেয়ে দ্রুততর গতিতে আমাদের জীবনকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করছে, তার ফল আমাদের ওপর কেমন হবে? প্রতিদিন মনে হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের অতি পরিচিত পথে একটা অজানা চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই চমক আমাদের জীবনকে আরও উপভোগ্য করবে, সহজ করবে নাকি কারও জন্য সহজ, কারও জন্য কঠিন করবে।
আপাতপৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটা ভাল হচ্ছে। কিন্তু যদি অর্থনীতির মূল যন্ত্রটিকে ঘিরে প্রযুক্তি এগোতে থাকে, তাহলে এই নতুন প্রযুক্তি স্বার্থপরতার শক্তিকে আরও জোরদার করবে। যেহেতু স্বার্থপর পৃথিবীতে আর কিছু করণীয় দেখা যাবে না। অনেকে এই নিয়ে আপত্তি তুলবে। সমাধান হিসেবে এদিকে-ওদিকে কিছু স্বার্থহীনতার প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা হবে। নিয়মনীতি ভেঙে কেউ কেউ প্রযুক্তির শক্তি দিয়ে চাপা দেয়া স্বার্থহীনতার শক্তিকে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু মূল যন্ত্র তার কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে করে যাবে।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ পরিবর্তন আসছে বিচ্ছিন্নভাবে, মূলত খণ্ড খণ্ড স্বার্থপর লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এটা নির্র্দ্বিধায় বলা যায়, কোন বৈশ্বিক স্বপ্নকে সামনে রেখে এই পরিবর্তন আসছে না। নতুন একটা প্রযুক্তি এলে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, ইস এটাকে যদি সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তন আনার কাজে লাগানো যেতো, যদি দারিদ্র্য মোচনের কাজে লাগানো যেত, যদি পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগানো যেত। কিছু চেষ্টাও হয় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু বেশি দূর এগোনো যায় না। সবার চোখে স্বার্থপরতার চশমা লাগানো। এই চশমা ভেদ করে স্বার্থহীন উদ্দেশ্য সাধনে বেশি দূর যাওয়া যায় না। কারণ এই চশমা দিয়ে স্বার্থহীনতার রাস্তায় বেশিদূর দেখা যায় না। নবআবিষ্কৃত প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে সবাই এত ব্য স্ত থাকে যে, অন্য ব্যবহারের কথা মনেই আসে না। স্বার্থহীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে তার জন্য আনকোরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। সৃজনশীলতা আর্থিক সাফল্যের রাজপথ ধরে চলতে থাকে। এই পথে এমন কোন পথনির্দেশ দেয়া থাকে না, যার থেকে জানা যাবে প্রযুক্তিকে কোন পথে নিয়ে গেলে সব সমস্যামুক্ত নতুন এক পৃথিবী গড়া যাবে। তার চেয়ে বড় কথা পথনির্দেশ স্থাপন করবে কে? কারা ঠিক করছে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মিলিত গন্তব্য কোথায় এটা কি আমরা স্থির করে রেখেছি? যদি সেটা স্থির করা না থাকে তবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যার যার পথে এগোব, এটাই তো স্বাভাবিক এবং তাই হচ্ছে। তাই বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। জাতিসংঘ প্রণীত শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্য ছিল একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। তাই এটা সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে মানবসমাজ হিসেবে আমরা কোথায় পৌঁছতে চাই এটা ছিল তার একটা চমৎকার দিকনির্দেশনা। এর কারণে আমরা অনেক সাফল্য অর্জনও করেছি। কিন্তু প্রযুক্তি এর পেছনে এসে দাঁড়ায়নি। জানা প্রযুক্তিকে আমরা এর জন্য মাঝে মধ্যে ব্যবহার করেছি; কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারিনি। কারণ প্রযুক্তির জগৎ চলছে স্বার্থপর অর্থনীতির কড়া শাসনে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির যন্ত্রটাকে সচল রাখার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মচারী গোষ্ঠী তৈরি করা। শিক্ষা সমাপ্তির পর প্রত্যেকে একটি চাকরি পেয়ে গেলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জন হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। শিক্ষা সমাপ্তির পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরি না পেলে নেমে আসে বেকারত্বের দুর্ভোগ।
এরকম একটা অনুচ্চারিত অথচ শক্তিশালী লক্ষ্যকে ভিত্তি করে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা যুগে যুগে সৃজনশীল তরুণ সমাজকে স্বার্থপর ক্ষুদ্র চিন্তার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। তার মধ্যে প্রচলিত পৃথিবীকে গ্রহণ করার মানসিকতাকে পৃঢ়ভাবে পুঁতে দেয়া হয়েছে। তাকে অন্যের হুকুম মানার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কর্মস্থলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার মানসিকতায় তাকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন তরুণের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়া যে, মানুষের মধ্যে সীমাহীন শক্তি আছে। তার মাঝেও সে শক্তি সুপ্ত আছে। সে সুপ্ত শক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াই হলো শিক্ষার সবচেয়ে বড় কাজ। তার সকল শিক্ষা, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, সাহিত্য সবকিছুর পেছনে থাকবে তার নিজেকে জানা। অতীতে যা কিছু ভাল কাজ হয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত করা। ‘ভাল পাস করলে, ভাল চাকরি পাবে’ এই ধারণার বদলে শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দেয়া যে, সে জীবনে যা কিছু অর্জন করতে চায় তার একটা সূত্রপাত সে শিক্ষা জীবনেই করতে পারে। শিক্ষা হলো তার প্রস্তুতি। এটা তার জন্য বোঝা নয়, এটা তার সম্পদ। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে, তার সামনে একটি নয়, দুটি পথ খোলা। সে যেন বিশ্বাস করে যে, আমি চাকরি প্রার্থী নই, আমি চাকরিদাতা। চাকরিদাতা হিসেবে সে যেন প্রস্তুতি নিতে থাকে। তার বিদ্যায়তনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা যারা চাকরিদাতা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া। তাকে বুঝতে দেয়া যে, সকল মানুষই উদ্যোক্তা। এটা তার সহজাত ক্ষমতা। সাময়িকভাবে সে চাকরি করতে পারে কিন্তু এটা তার কপালের লিখন মনে করার কোন কারণ নেই। একবার কর্মচারী হলে, একবার শ্রমিক হলে তাকে সারা জীবন কর্মচারী বা শ্রমিক হিসেবে কাটাতে হবে এমন কোন ধারণা যেন তাকে দেয়া না হয়। তাকে নিজের শক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটা কাজ হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পৃথিবী গড়ার কাজে উদ্বুুদ্ধ করা। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে বর্তমান পৃথিবীটা হচ্ছে অতীতে যারা ছিল এবং বর্তমানে যারা আছে তাদের হাতে গড়া একটা বাস্তবতা। এ বাস্তবতায় যা যা দোষক্রটি আছে সেগুলো উঠতি প্রজন্মকে সংশোধন করতে হবে এবং তা সংশোধনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়টাই হলো শিক্ষাকালীন সময়। এই সময়ের মধ্যে তাদের নতুনভাবে আরেকটা পৃথিবী গড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। নতুন গড়ার ক্ষমতা তাদেরই হাতে। কিন্তু তাদের প্রস্তুত হতে হবে কোন ধরনের পৃথিবী তারা গড়তে চায় তার রূপরেখা তৈরি করার জন্য। প্রতি বছর প্রতি শ্রেণীতে তারা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে নতুন পৃথিবীর রূপরেখা তৈরি করবে। পরের বছর সেটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করবে। শিক্ষা সমাপনের আগেই আগামী পৃথিবীর একটা ছবি তার মাথার মধ্যে যেন স্থান করে নিতে পারে। একবার এ ধারণাটা মাথায় স্থান করে নিলে ভবিষ্যৎ জীবনে তার কাজের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হতে আরম্ভ করবে। মানুষ হিসেবে আমাদের গন্তব্য সম্পর্কেও তার একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে যাবে।
বেকারত্ব
বেকারত্ব মানে কি? পরিপূর্ণভাবে সক্ষম, কর্মের প্রতি আগ্রহশীল একজন মানুষ কোন কাজ না করে দিনের পর দিন সময় কাটিয়ে যাওয়া এটাই হলো বেকারত্ব। মানুষ কাজ করতে চায়, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে, তবু সে কাজ করতে পারে না কেন? আমাদের অর্থনৈতিক যন্ত্রটা এমনভাবে বানানো যে, এতে অনেকের জায়গা হয় না তাই তাদের বসে বসে সময় কাটাতে হয়। তাহলে এটা কি মানুষের দোষ, না যন্ত্রের দোষ। অবশ্যই যন্ত্রের দোষ। আমরা কি কোন দিন জিজ্ঞেস করেছি যন্ত্রের দোষে মানুষ কেন শাস্তি পাবে? কেন একজন কর্মক্ষম সৃজনশীল মানুষ এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হবে? এটা যদি যন্ত্রের দোষ হয়, তাহলে এই যন্ত্র যারা বানিয়েছে তাদের আমরা শাস্তি দিচ্ছি না কেন? আমরাই-বা নতুন যন্ত্র বানাচ্ছি না কেন? যে মানুষ মঙ্গল গ্রহে বাসস্থান নির্মাণের চিন্তায় মশগুল হতে পারে, সে মানুষ একটা উদ্ভট যন্ত্রকে বাতিল করে নতুন একটা যন্ত্র বানাতে পারছে না কেন?
পুরো জিনিসটার পেছনে আছে বর্তমান যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট মানুষের প্রতি মানুষের বাধ্যতামূলক ঔদাসীন্য। পৃথিবীতে দু’চারজন লোক নয়, কোটি কোটি লোক বছরের পর বছর বেকার। আমরা শুধু ব্যাখ্যার জাল বুনে দায়িত্ব সমাপন করে যাচ্ছি। যে অমূল্য সম্পদের আমরা অপচয় করছি, মানুষের জন্য যে সীমাহীন যন্ত্রণার সৃষ্টি করছি তা নিয়ে কারও কোন দুশ্চিন্ত আছে বলে মনে হয় না।
এক্ষেত্রে আমরা দু’টি পন্থায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করলে এর চেয়ে আরও ভাল সমাধান অন্যদের কাছ থেকে আসবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। একটা হলো, এখন বহুল পরিচিত ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা। গ্রামীণ ব্যাংক এটার জন্মদাতা। পৃথিবীজুড়ে এখন এ বিষয়ে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রথম স্তরে স্বকর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা হয়। মহিলাদের মধ্যে এটা বিরাট পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। স্বকর্ম সৃষ্টি বেকারত্ব অবসানের প্রথম ধাপ। কারও কাছে চাকরিপ্রার্থী হওয়ার দরকার কি, আমি নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করবো। এর জন্য শুধু পুঁজি দরকার। ব্যাংক ঋণ দিয়ে ব্যবসা শুরু করবো।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন। এটাও অর্থায়নের একটা পদ্ধতি। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দেয়, সামাজিক ব্যবসা তহবিল বিনিয়োগে অংশীদার হয়, ঋণ দেয়, অন্যান্য পন্থায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করে। একবার ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের অবস্থান থেকে সরে এলে কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। সামাজিক ব্যবসা তহবিলের পক্ষ থেকে একজন বেকারকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি ব্যবসায় নামো, ব্যবসার বুদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে আসো। আমরা তোমার ব্যবসায় পুঁজি দেবো। যত টাকা লাগে আমরা বিনিয়োগ করবো, তুমি ব্যবসা চালাবে। ব্যবসার মুনাফা থেকে আমাদের পুুঁজি আমাদের ফেরত দিয়ে তুমি পুরো মালিকানাটা নিয়ে নেবে।’ যেহেতু এটা সামাজিক ব্যবসা তহবিলের টাকা, সেহেতু এখানে কারও ব্যক্তিগত মুনাফার কোন লোভ নেই। শুধু তহবিলের টাকাটা তহবিলকে ফেরত দিলেই হবে।
বেকারত্ব সৃষ্টির মূল কারণ দু’টি: শিক্ষা ব্যবস্থা; যেখানে চাকরিই একমাত্র ভবিষ্যৎ, এরকম একটা ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আরেকটি হলো ব্যাংকিং বা অর্থায়ন ব্যবস্থা। ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি লাগে। বেকার বা গরিবকে পুঁজি দেয়ার জন্য কেউ অর্থায়ন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেনি, যেহেতু মুনাফা অর্জনের জন্য এর চেয়ে আরও বহু আকর্ষণীয় বিকল্প চারদিকে ছড়ানো আছে। সামাজিক ব্যবসা এটা অনায়াসে করতে পারে, যেহেতু এখানে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের কোন শর্ত নেই। এইটুকু পরিবর্তন হলে বেকারত্বহীন পৃথিবী সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব মানুষের কোন ব্যাধি নয়। এটা অর্থনৈতিক শাস্ত্রকারদের ভুলের জন্য সৃষ্ট সমস্যা।
অর্থনীতি শাস্ত্রের মধ্যে এমন কোন কথা জায়গা পাওয়ার কথা নয়, যেটা মানুষের উদ্যমকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল কাজ হবে মানুষের শক্তির স্ফুরণের জন্য পথ খুলে দেয়া, মানুষকে ক্রমাগতভাবে অধিকতর বড়মাপের হওয়ার জন্য আয়োজন করে দেয়া। কিন্তু এখন হচ্ছে তার ঠিক উল্টো। আমরা এমন শাস্ত্র বানিয়েছি, যেখানে বিশাল মাপের প্রকৃত মানুষকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি। হাতি দিয়ে আমরা মাছি তাড়ানোর কাজ করাচ্ছি।
রাষ্ট্রের ওপর স্থায়ী নির্ভরশীলতা
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো সঙ্কটাপন্ন নাগরিকদের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকায় সাহায্য করা। উন্নত বিশ্বে এই দায়িত্ব পালন করা হয় আয়হীন এবং স্বল্প আয়ের মানুষকে মাসিক ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের আরেকটি প্রধান দায়িত্বের কথা আমরা এ প্রসঙ্গে ভুলে থাকি। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা হলো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য তার শক্তি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এই সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে যদি রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতো এবং সফল হতো, তবে কোন নাগরিককে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার প্রয়োজন হতো না। এখন বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে কিছু নাগরিক যে সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতার মধ্যে, শুধু তাই নয়, বংশানুক্রমে এই নির্ভরশীলতা থেকে বের হতে পারছে না বা চাচ্ছে না। এর কারণ রাষ্ট্র এদের নির্ভরশীলতার আওতায় আনতে অতিশয় তৎপর বটে; কিন্তু এদের নির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের করে আনতে তার কোন উৎসাহ দেখা যায় না। বেকারত্বের মতো এটাও মানুষের তৈরি একটা কৃত্রিম সমস্যা। বেকারত্ব থেকে মানুষকে বের করার পদ্ধতি বের করতে পারলেই একই পদ্ধতিতে ভাগ্যহীন মানুষের জন্য নতুন ভাগ্য সৃষ্টি করে তাদের রাষ্ট্র নির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ দেয়া যায়। রাষ্ট্রনির্ভরশীল একজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রকে ওই ব্যক্তির পেছনে তার সারাজীবনে যে ব্যয় করতে হয় তার একটি ভগ্নাংশ তাকে পুঁজি হিসেবে দিলেই সে কিন্তু স্থায়ীভাবে শুধু নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়েই আসবে না, সে আরও মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, তার পরবর্তী বংশধরকে রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত রাখবে এবং সে নিজে করদাতা হিসেবে রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থ যোগান দেবে।
তাহলে এটা রাষ্ট্র করে না কেন? কারণ রাষ্ট্রকে শাস্ত্রকাররা বুঝিয়ে দিয়েছে, এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত তাদের খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে হবে। চাকরি ছাড়া গতি নেই, এই যে মন্ত্র শাস্ত্রকাররা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে এর থেকে আমরা বের হতে পারছি না। মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে আমাদের মনে অনীহা জমে গেছে।
কথাটা স্পষ্ট করার জন্য বলে রাখি, কারও মনে এমন কোন ধারণার যেন জন্ম না নেয় যে, রাষ্ট্রের সহায়তায় যারা জীবনধারণ করেন তাদের আমি অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছি। মোটেই তা চাইছি না। আমি শুধু তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিদের কথা বলছি যারা আগ্রহ করে, দরখাস্ত করে, রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা ছেড়ে এসে নিজের আয়ে নিজে চলতে চান, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির কথা বলছি। যারা এখন যে ভাবে আছেন, সে ভাবে থাকতে চান, তারা সেভাবে থাকবেন। নিজের আয়ে নিজে চলার বিষয়টি যাতে সবার কাছে আকর্ষণীয় এবং বাস্তবসম্মত করা যায় তার জন্য রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। কারণ, মানুষের জীবন পরনির্ভরশীলতার জীবন হতে পারে না। মানুষ কর্মঠ জীব। সৃজনশীল জীব। মানুষের প্রকৃতিই হলো নিরন্তর নিজেকে বিকশিত করা, নিজের সম্ভাবনার সীমারেখাকে ক্রমাগতভাবে সমপ্রসারিত করা। অলস জীবন মানুষের স্বাভাবিকত্বকে কেড়ে নেয়। পরনির্ভরশীলতা মানুষকে ক্ষুদ্র করে। তাই বেকারত্ব ও দারিদ্র্য এত অসহনীয়।
উপসংহার
প্রচলিত পুঁজিবাদী শাস্ত্র পৃথিবীর মৌলিক সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। এই কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে অগ্রসর হলে আমাদের সমস্যাগুলোর সামাধান তো হবেই না, বরং এগুলো জটিলতর হয়ে আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে। বড়মাপের প্রকৃত মানুষকে ছোট আকারের রোবট-প্রায় মানুষে পরিণত করে অর্থনীতি শাস্ত্র এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত মানুষকে তার স্বাভাবিক সত্তাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিলে বর্তমানে সৃষ্টি সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের স্বার্থহীনতাকে অর্থনীতিতে স্বীকৃতি দিতে হবে। সামাজিক ব্যবসাকে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে এই উদ্যোগ শুরু হতে পারে। সামাজিক ব্যবসাকে স্বীকৃতি দিলে অর্থনীতিতে এটা কি কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যেতে পারবে, নাকি একটা ক্ষুদ্র নামকাওয়াস্তে কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, এ নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মানুষের মধ্যে যে স্বার্থহীনতা এবং সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য কাজ করার যে প্রচণ্ড আগ্রহ ও ক্ষমতা তা দেখলে মনে হয় একবার সামাজিক ব্যবসা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলে এটা মহাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। স্বার্থপরতা ও স্বার্থহীনতার দ্বন্দ্েব স্বার্থহীনতা অগ্রগামী হবে বলে আমার বিশ্বাস। নতুন প্রজন্মের তরুণদের দেখলে, বর্তমান সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে তাদের হতাশার কথা শুনলে আমার এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।
নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সময় এসেছে। প্রযুক্তি আমাদের এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের পথ বের করতেই হবে। সামাজিক ব্যবসা আমাদের মনে আশা জাগায়। হয়তো সামাজিক ব্যবসা আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এই গন্তব্য হবে সবার জন্য ঋণ, সবার জন্য পুঁজি, সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য সুশাসন, বেকারত্বহীন, দারিদ্র্যহীন, পরিবেশ দূষণমুক্ত, যুদ্ধাস্ত্রমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, আয়ের বৈষম্যহীন এক নতুন পৃথিবী।
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে, এটা আসলে নৈর্ব্যক্তিক একটা শোষণ যন্ত্র। এর কাজ হলো নিচ থেকে রস শুষে অনবরত উপরের দিকে পাঠাতে থাকা। বহু স্তরে বিন্যস্ত এই যন্ত্র ধাপে ধাপে নিচের স্তরের রস তার ওপরের স্তরে পাঠায়। এর সর্বনিচের স্তরটি সবচেয়ে বিশাল। সেখানে অসংখ্য কর্মী নিরলসভাবে বিন্দু বিন্দু করে রস তৈরি করেন। তার ওপরের স্তরটিতে তুলনামূলক অনেক কম মানুষ, কিন্তু যন্ত্রে তাদের অবস্থানের কারণে শক্তিতে তারা অনেক বলবান। তাই তারা নিচের সংগ্রহ করা রস অনায়াসে নিজের কাছে টেনে নেন। ওপরে যারা আছেন তারা খারাপ মানুষ হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে তা নয়। যন্ত্রের কারণেই মূলত এটা হচ্ছে। যন্ত্রটাই এভাবে বানানো হয়েছে। স্তরে স্তরে সাজানো মানুষগুলো নিচের স্তরের রস ওপরে টেনে নিয়ে নিচ্ছে তাদের শক্তির কারণে। এতে কেউ দোষের কিছু দেখে না। বরং ধরে নেয় যে, এটাই জগতের নিয়ম। অথচ বিষয়টা জগতের নিয়ম নয়। কিছু পণ্ডিত বসে এ রকম একটা শাস্ত্র তৈরি করে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে, ‘এটাই জগতের নিয়ম; এ নিয়ম মেনে চললে সবার জন্য মঙ্গল।’
প্রত্যেক স্তরে মানুষের সংখ্যা তার আসন্ন নিচের স্তরের মানুষের সংখ্যা থেকে অনেক কম। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আয়ত্তে রসের পরিমাণ হতে থাকবে নিচের স্তরের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ মাত্র। তাদের আয়ত্তে এত রস সংগৃহীত থাকবে যে, নিচের দিকের অর্ধেক স্তরে জমানো সব রস একত্র করলেও এই পরিমাণ রসের সমান হবে না। এর জন্য কাউকে আমরা দোষী বলতে পারছি না। কারণ শাস্ত্রে বলে দেয়া আছে এমনটিই হওয়ার কথা। এতেই সবার মঙ্গল। বলা বাহুল্য, কোন নৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ যন্ত্র তৈরি হয়নি। এ যন্ত্র মূলত তৈরি হয়েছে অর্থনীতির চাকাকে সব সময় সচল রাখার জন্য। সব সময় চোখ রাখা হয়েছে কখনও যেন অর্থনীতির চাকা কোন চোরাবালিতে আটকে না যায়। শাস্ত্রে নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের নানা অবতারণা থাকলেও বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ নেই। বাস্তবে তার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। সমাজ নিয়ে যারা চিন্ত করে তারা মাঝে মধ্যে এটা স্মরণ করিয়ে দিলে এটা নিয়ে কিছু উদ্যোগ আয়োজনের কথা বলাবলি হয়; কিন্তু দ্রুত সবাই এসব কথা ভুলে যায়। যেহেতু যন্ত্রের গাঁথুনিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি কাজেই এসব কখনও যন্ত্রের কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
যেমন ধরুন শেয়ারবাজারের কথা। বর্তমান জগতের ব্যবসার সাফল্যের মাত্রা নির্ধারণে শেয়ারবাজারের মূল্যায়নই চূড়ান্ত। কারা ব্যবসা ভাল করছে, কারা ব্যবসাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছতে পারছে সব বিষয়ে রায় দিচ্ছে শেয়ারবাজার। এই মূল্যায়নে কোথাও কোন নৈতিক বিচারের মাপকাঠি কিংবা সামাজিক বিচারের মাপকাঠি ব্যবহার হয় না। কাজেই ব্যবসার প্রধান নির্বাহীর পৃষ্টিতে এসব বিষয় পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক এবং বাড়তি ঝামেলা। উপায়ান্তর না দেখে সরকার এগিয়ে আসে নিচের মানুষকে কিছু স্বস্তি দেয়ার জন্য। সরকার ওপরের স্তর থেকে রস সংগ্রহ করে নিচের স্তরে বিলি করে তাদের করুণ অবস্থা থেকে রেহাই দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যন্ত্রের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
এ যন্ত্রকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছি বলে যন্ত্রটা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা আমাদের করেছে সেটা হলো, আমরা সবাই আমাদের অজান্তে অর্থলোভী কলের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছি। জীবনে অর্থ জমিয়ে নিচের স্তর থেকে ওপরের স্তরে যাওয়ার সাধনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে বলে মনে থাকে না। আমরা এটা জেনেই চমৎকৃত যে, যে যত উপরের স্তরে যেতে পারবে, যন্ত্রের গঠনের কারণে সে তত অল্প আয়াসে, অনেক বেশি গুণ রস সংগ্রহ করার ক্ষমতা অর্জন করবে। এমনকি সে বসে থাকলেও যন্ত্র তাকে ক্রমাগত রস জুগিয়ে দিতে থাকবে।
সামাজিক ব্যবসা
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যেটি মৌলিক গলদ বলে আমি মনে করি, সেটি হলো এমন একটি কাল্পনিক মানুষকে কেন্দ্র করে সমস্ত শাস্ত্রটিকে সাজানো হয়েছে যার সঙ্গে রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। শাস্ত্রবিদরা হয়তো নির্দোষ সরলীকরণ মনে করে এ কাজটি করেছেন। কিন্তু সেটা শাস্ত্রকে এবং এই শাস্ত্র অনুসরণকারী পুরো বিশ্বকে মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শাস্ত্রবিদরা ধরে নিয়েছেন, অর্থনৈতিক জগতে যে মানুষ বিচরণ করে সে হলো শতভাগ স্বার্থপর জীব। স্বার্থপরতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না। আমি মনে করি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সব গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি আমরা করেছি তার মূলে রয়েছে মানুষের এই খণ্ডিত রূপকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা।
অর্থনৈতিক শাস্ত্রে স্বার্থপর মানুষের জায়গায় আমি এমন একটি মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে চাইছি, যিনি একই সঙ্গে স্বার্থপর এবং স্বার্থহীন। কারণ প্রকৃত মানুষ এই দুয়ের সংমিশ্রণ। কে কত স্বার্থপর এবং কত স্বার্থহীনভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ওপর, তার সমাজ সচেতনতার ওপর, তার শিক্ষার ওপর, তার নৈতিক বিচার-বিবেচনার ওপর। একই মানুষ স্থায়ীভাবে বা সাময়িকভাবে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে, প্রচণ্ড স্বার্থপর হতে পারে অথবা দিলদরিয়া স্বার্থহীন হতে পারে অথবা একই সঙ্গে দুয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে। এ ধরনের মানুষকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা করতে হলে আমাদের দুই ধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যখন মানুষ তার স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করতে চায় এবং প্রয়োগ করতে চায় তখন সে সর্বোচ্চ মুনাফাকারী হিসেবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। যখন স্বার্থহীন হতে চায়, তখন সে এমন ব্যবসা করবে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন করার কোন ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করবে না; তার একমাত্র লক্ষ্য হবে ব্যবসায়িক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমাজের সমস্যার সমাধান করা। আমি এই ব্যবসার নাম দিয়েছি ‘সামাজিক ব্যবসা’। এ ধরনের ব্যবসা থেকে মালিক তার বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত নেয়া ছাড়া আর কোন অর্থ মুনাফা হিসেবে নিতে পারবে না। এ ধরনের এই নতুন মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক শাস্ত্র রচনা করলে সে শাস্ত্রে দু’ধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতেই হবে। একটা হবে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা, আরেকটি হবে সামাজিক ব্যবসা। তার ফলে সব পরিস্থিতিতে সকল মানুষের কাছে দুটি বিকল্প থাকবে। এ বিকল্প না থাকার কারণেই আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছি এবং প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
প্রচলিত অর্থনৈতিক শাস্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার বাইরে ব্যবসার কোন ক্ষেত্র নেই। অর্থাৎ স্বার্থপর হওয়া ছাড়া ব্যবসা করার কোন সুযোগ নেই। স্বার্থহীনভাবে কিছু করতে চাইলে দান-খয়রাতের জগতে প্রবেশ করতে হয়। দাতব্য কর্মকাণ্ডে সমাজের অবহেলিত মানুষের অনেক উপকার হয়। কিন্তু এ সব কর্মকাণ্ড বরাবর পরমুখাপেক্ষী থেকে যায়। আত্মনির্ভর হওয়ার কোন সুযোগ এদের থাকে না। কারণ, সব সময় নতুন নতুন অর্থ সংগ্রহ করে দাতব্য কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। একবার কাজে লাগালে দানের টাকা খরচ হয়ে যায়। দানের টাকা ফেরত আসে না। সামাজিক ব্যবসা যেহেতু ব্যবসা সে কারণে টাকাটা ফিরে আসে। একই টাকাকে বারবার ব্যবহার করে ব্যবসা সমপ্রসারণ করা যায়। সামাজিক ব্যবসাকে নিজস্ব ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। সমাজের যত সমস্যা আছে সবকিছুর সামাধান সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
ব্যক্তিগত মুনাফা ভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। এগুলোকে বলা হয় বিজনেস স্কুল। এই শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণ ব্যবসা-যোদ্ধারা বের হয়ে আসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন বাজার জয় করার জন্য আর কোম্পানির মালিকদের জন্য বেশি মুনাফা অর্জনের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিজনেস স্কুলে পৃথক বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজন হবে। এই শিক্ষা নিয়ে তরুণরা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের লড়াইতে নামবে। দুই ব্যবসার দুই রকমের দক্ষতার প্রয়োজন। এক ক্ষেত্রে লাগবে মালিকদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সমস্ত কলাকৌশল আয়ত্ত করা, অন্য ক্ষেত্রে লাগবে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা।
আয়-বৈষম্য
আয়-বৈষম্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী কাঠামোতে অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রথিত আছে। তার ওপর যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে উঠেছে তা এই আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি আরও জোরদার করে দিয়েছে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা সবকিছুর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ভাগ্যবানদের পক্ষে। ভাগ্যহীনদের জন্য সব দরজা বন্ধ। তাদের পক্ষে এসব দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব। কাজেই মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলবে। যে যন্ত্র ক্রমাগতভাবে নিচ থেকে রস সংগ্রহ করে ওপরে চালান দেয়ার কাজে নিয়োজিত সে যন্ত্র কখনও ওপর-নিচের আয়ের ব্যবধান ঘোচাতে পারবে না। আয়-বৈষম্য আমাদের এখন কোথায় নিয়ে এসেছে সেটা দেখলেই পরিস্থিতি বোঝা যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮৫ জন মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে, তার পরিমাণ আয়ের দিক থেকে নিচে আছে পৃথিবীর এমন অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের যোগফলের চেয়ে বেশি। অন্যভাবে তাকালেও একই পৃশ্য দেখা যাবে। আয়ের দিক থেকে উপরে আছে পৃথিবীতে এমন অর্ধেক মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র এক শতাংশ। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কি এ অবস্থার উন্নতি হবে? না, হবে না। কারণ, অর্থনৈতিক যন্ত্রটিকে কাজ দেয়া হয়েছে ওপরওয়ালাকে আরও রস জোগান দেয়ার। নিচের রস ওপরের দিকে যেতেই থাকবে। আয়-বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। নিচের তলার মানুষের মাথাপিছু যে প্রবৃদ্ধি হবে, ওপরতলার মানুষের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি যে তার থেকে বহুগুণ বেশি হবে, এটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সামাজিক ব্যবসা নিচ থেকে ওপরে রস চালান দেয়ার গতিটা কমাবে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনকে সামাজিক ব্যবসা একেবারে নিচের তলার লোকের কাছে সহজলভ্য করে দিতে পারে। ফলে তাদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ওপরের তলার অফুরন্ত সম্পদের অংশ সামাজিক ব্যবসায় নিয়োজিত হলে তাদের আরও সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা কমবে। সামাজিক ব্যবসার পরিমাণ যদি ব্যক্তিগত মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসার চেয়ে বেশি হতে আরম্ভ করে, তাহলে যত না নিচের রস ওপরে যাবে তার চেয়ে বেশি ওপরের রস নিচে আসতে শুরু করবে।
সামাজিক ব্যবসা তাত্ত্বিক কাঠামোয় একটা উল্টো যন্ত্র স্থাপন করছে। ওপরের রস নিচে আনার যন্ত্র। ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই একই মার্কেটে দু’যন্ত্র কাজ করবে। কোন যন্ত্রটির জোর বেশি হবে, সেটা নির্ভর করবে আমরা কি চাই তার ওপর। সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে, যন্ত্রের হাতে নয়। আমরা আমাদের পছন্দের যন্ত্রটা নিয়ে কাজ করব। বর্তমানে যন্ত্র একটাই। কাজেই এখানে আমাদের কোন সিদ্ধান্ত কাজে লাগে না। যন্ত্রই সিদ্ধান্ত স্থির করে দিয়েছে। আমাদের বলা হচ্ছে, এটাই একমাত্র এবং সর্বোত্তম যন্ত্র। আমরা সে কথা বিশ্বাস করে কলের পুতুলের মতো এই যন্ত্র ব্যবহার করে তথাকথিত ‘সাফল্যের’ পেছনে যথাসাধ্য দৌড়াচ্ছি। আমাদের একটু থেমে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে আমরা কি নিজের ইচ্ছা সম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ হবো, নাকি কলের পুতুল হবো? মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য জয়ী হবে নাকি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা জয়ী হবে? যন্ত্র জয়ী হবে, নাকি মানুষ জয়ী হবে?
বর্তমান যন্ত্র মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞাকে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে তাকে প্রশ্নাতীত করে রেখেছে।
স্বার্থপরতাকে একমাত্র গুণ ধরে নিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দারিদ্র্য, আয়-বৈষম্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, পরিবেশ দূষণ কিছু থেকেই বের হওয়া যাবে না। অর্থনীতিকে আবিষ্কার করতে হবে যে পৃথিবীতে ‘আমি’ ছাড়া আরও মানুষ আছে, আরও প্রাণী আছে। সবার সমবেত ভবিষ্যৎই ‘আমার’ ভবিষ্যৎ। ‘আমাদের’ ভবিষ্যৎই ‘আমার’ ভবিষ্যৎ।
জিডিপি কার কথা বলে?
স্বার্থপর পৃথিবীতে আমরা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সাফল্যের মাপকাঠি বানাই স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদকে উঁচিয়ে ধরার জন্য। যেমন যে যত বেশি ধনী, সে তত বেশি সফল ব্যক্তি। যে ব্যবসায় যত বেশি লাভ করে, সে তত বেশি সফল। যে দেশের মাথাপিছু জিডিপি যত বেশি, সে দেশ তত বেশি উন্নত। জিডিপি দিয়ে আমরা কি জানলাম? আমাদের মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন কত হয়েছে তা জানলাম। কিন্তু তাতে দেশের এবং মানুষের পরিস্থিতির কতটুকু জানা হলো? এর মাধ্যমে কি আমরা জানতে পারলাম দেশের দারিদ্র্যের পরিস্থিতি কি? হয়তো দেশে বাঘা বাঘা কিছু ধনী লোক আছে যারা জিডিপির ৯৯ শতাংশের মালিক। তাতে সাধারণ মানুষের তো ভয় পাওয়ার কথা। আনন্দিত হওয়ার তো কোন কারণই নেই। মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে হলে এমন একটা পরিমাপ বের করতে হবে, যেটা আসবে জিডিপির সঙ্গে দেশের দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বার্থহীনতা, আয়-বৈষম্য, পরিবেশ দূষণ, সবার কাছে শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রাপ্যতা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, মানবিক অধিকার, সুশাসন ইত্যাদির পরিমাপ যুক্ত করে।
স্বার্থপর পৃথিবীতে বিশ্বায়নের যে চমৎকার সুযোগটা এসেছে সেটাও চলছে উল্টা দিকে। পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব সৃষ্টির সুযোগ না হয়ে এটা হয়ে পড়ছে বাজার দখলের লড়াই। এক রাষ্ট্রের শোষণযন্ত্র থাবা বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে আরেক রাষ্ট্রের মানুষের ওপর। বিশ্বপরিবার গড়ার জায়গায় বিশ্ব পরিণত হতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক রণক্ষেত্রে।
প্রযুক্তি
যে মন ধাঁধানো, চোখ ধাঁধানো, প্রযুক্তি একটার পর একটা আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং তার চেয়ে দ্রুততর গতিতে আমাদের জীবনকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করছে, তার ফল আমাদের ওপর কেমন হবে? প্রতিদিন মনে হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের অতি পরিচিত পথে একটা অজানা চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই চমক আমাদের জীবনকে আরও উপভোগ্য করবে, সহজ করবে নাকি কারও জন্য সহজ, কারও জন্য কঠিন করবে।
আপাতপৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটা ভাল হচ্ছে। কিন্তু যদি অর্থনীতির মূল যন্ত্রটিকে ঘিরে প্রযুক্তি এগোতে থাকে, তাহলে এই নতুন প্রযুক্তি স্বার্থপরতার শক্তিকে আরও জোরদার করবে। যেহেতু স্বার্থপর পৃথিবীতে আর কিছু করণীয় দেখা যাবে না। অনেকে এই নিয়ে আপত্তি তুলবে। সমাধান হিসেবে এদিকে-ওদিকে কিছু স্বার্থহীনতার প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা হবে। নিয়মনীতি ভেঙে কেউ কেউ প্রযুক্তির শক্তি দিয়ে চাপা দেয়া স্বার্থহীনতার শক্তিকে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু মূল যন্ত্র তার কাজ নির্দিষ্ট নিয়মে করে যাবে।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ পরিবর্তন আসছে বিচ্ছিন্নভাবে, মূলত খণ্ড খণ্ড স্বার্থপর লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এটা নির্র্দ্বিধায় বলা যায়, কোন বৈশ্বিক স্বপ্নকে সামনে রেখে এই পরিবর্তন আসছে না। নতুন একটা প্রযুক্তি এলে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, ইস এটাকে যদি সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় পরিবর্তন আনার কাজে লাগানো যেতো, যদি দারিদ্র্য মোচনের কাজে লাগানো যেত, যদি পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগানো যেত। কিছু চেষ্টাও হয় এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু বেশি দূর এগোনো যায় না। সবার চোখে স্বার্থপরতার চশমা লাগানো। এই চশমা ভেদ করে স্বার্থহীন উদ্দেশ্য সাধনে বেশি দূর যাওয়া যায় না। কারণ এই চশমা দিয়ে স্বার্থহীনতার রাস্তায় বেশিদূর দেখা যায় না। নবআবিষ্কৃত প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে সবাই এত ব্য স্ত থাকে যে, অন্য ব্যবহারের কথা মনেই আসে না। স্বার্থহীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে তার জন্য আনকোরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। সৃজনশীলতা আর্থিক সাফল্যের রাজপথ ধরে চলতে থাকে। এই পথে এমন কোন পথনির্দেশ দেয়া থাকে না, যার থেকে জানা যাবে প্রযুক্তিকে কোন পথে নিয়ে গেলে সব সমস্যামুক্ত নতুন এক পৃথিবী গড়া যাবে। তার চেয়ে বড় কথা পথনির্দেশ স্থাপন করবে কে? কারা ঠিক করছে আমাদের গন্তব্য কোথায়?
মানুষ হিসেবে আমাদের সম্মিলিত গন্তব্য কোথায় এটা কি আমরা স্থির করে রেখেছি? যদি সেটা স্থির করা না থাকে তবে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যার যার পথে এগোব, এটাই তো স্বাভাবিক এবং তাই হচ্ছে। তাই বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। জাতিসংঘ প্রণীত শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষ্য ছিল একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। তাই এটা সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে মানবসমাজ হিসেবে আমরা কোথায় পৌঁছতে চাই এটা ছিল তার একটা চমৎকার দিকনির্দেশনা। এর কারণে আমরা অনেক সাফল্য অর্জনও করেছি। কিন্তু প্রযুক্তি এর পেছনে এসে দাঁড়ায়নি। জানা প্রযুক্তিকে আমরা এর জন্য মাঝে মধ্যে ব্যবহার করেছি; কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারিনি। কারণ প্রযুক্তির জগৎ চলছে স্বার্থপর অর্থনীতির কড়া শাসনে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
শিক্ষা ব্যবস্থাকে মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির যন্ত্রটাকে সচল রাখার জন্য প্রশিক্ষিত কর্মচারী গোষ্ঠী তৈরি করা। শিক্ষা সমাপ্তির পর প্রত্যেকে একটি চাকরি পেয়ে গেলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জন হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। শিক্ষা সমাপ্তির পর একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরি না পেলে নেমে আসে বেকারত্বের দুর্ভোগ।
এরকম একটা অনুচ্চারিত অথচ শক্তিশালী লক্ষ্যকে ভিত্তি করে যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা যুগে যুগে সৃজনশীল তরুণ সমাজকে স্বার্থপর ক্ষুদ্র চিন্তার গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রেখেছে। তার মধ্যে প্রচলিত পৃথিবীকে গ্রহণ করার মানসিকতাকে পৃঢ়ভাবে পুঁতে দেয়া হয়েছে। তাকে অন্যের হুকুম মানার জন্য তৈরি করা হয়েছে। কর্মস্থলের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার মানসিকতায় তাকে দীক্ষা দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন তরুণের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে দেয়া যে, মানুষের মধ্যে সীমাহীন শক্তি আছে। তার মাঝেও সে শক্তি সুপ্ত আছে। সে সুপ্ত শক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াই হলো শিক্ষার সবচেয়ে বড় কাজ। তার সকল শিক্ষা, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, সাহিত্য সবকিছুর পেছনে থাকবে তার নিজেকে জানা। অতীতে যা কিছু ভাল কাজ হয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত করা। ‘ভাল পাস করলে, ভাল চাকরি পাবে’ এই ধারণার বদলে শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দেয়া যে, সে জীবনে যা কিছু অর্জন করতে চায় তার একটা সূত্রপাত সে শিক্ষা জীবনেই করতে পারে। শিক্ষা হলো তার প্রস্তুতি। এটা তার জন্য বোঝা নয়, এটা তার সম্পদ। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে, তার সামনে একটি নয়, দুটি পথ খোলা। সে যেন বিশ্বাস করে যে, আমি চাকরি প্রার্থী নই, আমি চাকরিদাতা। চাকরিদাতা হিসেবে সে যেন প্রস্তুতি নিতে থাকে। তার বিদ্যায়তনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা যারা চাকরিদাতা হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেয়া। তাকে বুঝতে দেয়া যে, সকল মানুষই উদ্যোক্তা। এটা তার সহজাত ক্ষমতা। সাময়িকভাবে সে চাকরি করতে পারে কিন্তু এটা তার কপালের লিখন মনে করার কোন কারণ নেই। একবার কর্মচারী হলে, একবার শ্রমিক হলে তাকে সারা জীবন কর্মচারী বা শ্রমিক হিসেবে কাটাতে হবে এমন কোন ধারণা যেন তাকে দেয়া না হয়। তাকে নিজের শক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটা কাজ হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পৃথিবী গড়ার কাজে উদ্বুুদ্ধ করা। তাকে বুঝিয়ে দেয়া যে বর্তমান পৃথিবীটা হচ্ছে অতীতে যারা ছিল এবং বর্তমানে যারা আছে তাদের হাতে গড়া একটা বাস্তবতা। এ বাস্তবতায় যা যা দোষক্রটি আছে সেগুলো উঠতি প্রজন্মকে সংশোধন করতে হবে এবং তা সংশোধনের জন্য তাদের প্রস্তুতি নেয়ার সময়টাই হলো শিক্ষাকালীন সময়। এই সময়ের মধ্যে তাদের নতুনভাবে আরেকটা পৃথিবী গড়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। নতুন গড়ার ক্ষমতা তাদেরই হাতে। কিন্তু তাদের প্রস্তুত হতে হবে কোন ধরনের পৃথিবী তারা গড়তে চায় তার রূপরেখা তৈরি করার জন্য। প্রতি বছর প্রতি শ্রেণীতে তারা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে নতুন পৃথিবীর রূপরেখা তৈরি করবে। পরের বছর সেটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করবে। শিক্ষা সমাপনের আগেই আগামী পৃথিবীর একটা ছবি তার মাথার মধ্যে যেন স্থান করে নিতে পারে। একবার এ ধারণাটা মাথায় স্থান করে নিলে ভবিষ্যৎ জীবনে তার কাজের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হতে আরম্ভ করবে। মানুষ হিসেবে আমাদের গন্তব্য সম্পর্কেও তার একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে যাবে।
বেকারত্ব
বেকারত্ব মানে কি? পরিপূর্ণভাবে সক্ষম, কর্মের প্রতি আগ্রহশীল একজন মানুষ কোন কাজ না করে দিনের পর দিন সময় কাটিয়ে যাওয়া এটাই হলো বেকারত্ব। মানুষ কাজ করতে চায়, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে, তবু সে কাজ করতে পারে না কেন? আমাদের অর্থনৈতিক যন্ত্রটা এমনভাবে বানানো যে, এতে অনেকের জায়গা হয় না তাই তাদের বসে বসে সময় কাটাতে হয়। তাহলে এটা কি মানুষের দোষ, না যন্ত্রের দোষ। অবশ্যই যন্ত্রের দোষ। আমরা কি কোন দিন জিজ্ঞেস করেছি যন্ত্রের দোষে মানুষ কেন শাস্তি পাবে? কেন একজন কর্মক্ষম সৃজনশীল মানুষ এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হবে? এটা যদি যন্ত্রের দোষ হয়, তাহলে এই যন্ত্র যারা বানিয়েছে তাদের আমরা শাস্তি দিচ্ছি না কেন? আমরাই-বা নতুন যন্ত্র বানাচ্ছি না কেন? যে মানুষ মঙ্গল গ্রহে বাসস্থান নির্মাণের চিন্তায় মশগুল হতে পারে, সে মানুষ একটা উদ্ভট যন্ত্রকে বাতিল করে নতুন একটা যন্ত্র বানাতে পারছে না কেন?
পুরো জিনিসটার পেছনে আছে বর্তমান যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট মানুষের প্রতি মানুষের বাধ্যতামূলক ঔদাসীন্য। পৃথিবীতে দু’চারজন লোক নয়, কোটি কোটি লোক বছরের পর বছর বেকার। আমরা শুধু ব্যাখ্যার জাল বুনে দায়িত্ব সমাপন করে যাচ্ছি। যে অমূল্য সম্পদের আমরা অপচয় করছি, মানুষের জন্য যে সীমাহীন যন্ত্রণার সৃষ্টি করছি তা নিয়ে কারও কোন দুশ্চিন্ত আছে বলে মনে হয় না।
এক্ষেত্রে আমরা দু’টি পন্থায় সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করলে এর চেয়ে আরও ভাল সমাধান অন্যদের কাছ থেকে আসবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। একটা হলো, এখন বহুল পরিচিত ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা। গ্রামীণ ব্যাংক এটার জন্মদাতা। পৃথিবীজুড়ে এখন এ বিষয়ে একটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রথম স্তরে স্বকর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা হয়। মহিলাদের মধ্যে এটা বিরাট পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। স্বকর্ম সৃষ্টি বেকারত্ব অবসানের প্রথম ধাপ। কারও কাছে চাকরিপ্রার্থী হওয়ার দরকার কি, আমি নিজেই নিজের কর্মসংস্থান করবো। এর জন্য শুধু পুঁজি দরকার। ব্যাংক ঋণ দিয়ে ব্যবসা শুরু করবো।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন। এটাও অর্থায়নের একটা পদ্ধতি। গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ দেয়, সামাজিক ব্যবসা তহবিল বিনিয়োগে অংশীদার হয়, ঋণ দেয়, অন্যান্য পন্থায় অর্থায়নের ব্যবস্থা করে। একবার ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের অবস্থান থেকে সরে এলে কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। সামাজিক ব্যবসা তহবিলের পক্ষ থেকে একজন বেকারকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি ব্যবসায় নামো, ব্যবসার বুদ্ধি নিয়ে আমাদের কাছে আসো। আমরা তোমার ব্যবসায় পুঁজি দেবো। যত টাকা লাগে আমরা বিনিয়োগ করবো, তুমি ব্যবসা চালাবে। ব্যবসার মুনাফা থেকে আমাদের পুুঁজি আমাদের ফেরত দিয়ে তুমি পুরো মালিকানাটা নিয়ে নেবে।’ যেহেতু এটা সামাজিক ব্যবসা তহবিলের টাকা, সেহেতু এখানে কারও ব্যক্তিগত মুনাফার কোন লোভ নেই। শুধু তহবিলের টাকাটা তহবিলকে ফেরত দিলেই হবে।
বেকারত্ব সৃষ্টির মূল কারণ দু’টি: শিক্ষা ব্যবস্থা; যেখানে চাকরিই একমাত্র ভবিষ্যৎ, এরকম একটা ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আরেকটি হলো ব্যাংকিং বা অর্থায়ন ব্যবস্থা। ব্যবসা করতে গেলে পুঁজি লাগে। বেকার বা গরিবকে পুঁজি দেয়ার জন্য কেউ অর্থায়ন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেনি, যেহেতু মুনাফা অর্জনের জন্য এর চেয়ে আরও বহু আকর্ষণীয় বিকল্প চারদিকে ছড়ানো আছে। সামাজিক ব্যবসা এটা অনায়াসে করতে পারে, যেহেতু এখানে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের কোন শর্ত নেই। এইটুকু পরিবর্তন হলে বেকারত্বহীন পৃথিবী সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। বেকারত্ব মানুষের কোন ব্যাধি নয়। এটা অর্থনৈতিক শাস্ত্রকারদের ভুলের জন্য সৃষ্ট সমস্যা।
অর্থনীতি শাস্ত্রের মধ্যে এমন কোন কথা জায়গা পাওয়ার কথা নয়, যেটা মানুষের উদ্যমকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল কাজ হবে মানুষের শক্তির স্ফুরণের জন্য পথ খুলে দেয়া, মানুষকে ক্রমাগতভাবে অধিকতর বড়মাপের হওয়ার জন্য আয়োজন করে দেয়া। কিন্তু এখন হচ্ছে তার ঠিক উল্টো। আমরা এমন শাস্ত্র বানিয়েছি, যেখানে বিশাল মাপের প্রকৃত মানুষকে সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি। হাতি দিয়ে আমরা মাছি তাড়ানোর কাজ করাচ্ছি।
রাষ্ট্রের ওপর স্থায়ী নির্ভরশীলতা
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো সঙ্কটাপন্ন নাগরিকদের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকায় সাহায্য করা। উন্নত বিশ্বে এই দায়িত্ব পালন করা হয় আয়হীন এবং স্বল্প আয়ের মানুষকে মাসিক ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্রের আরেকটি প্রধান দায়িত্বের কথা আমরা এ প্রসঙ্গে ভুলে থাকি। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা হলো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য তার শক্তি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এই সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে যদি রাষ্ট্র দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হতো এবং সফল হতো, তবে কোন নাগরিককে স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকার প্রয়োজন হতো না। এখন বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে কিছু নাগরিক যে সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতার মধ্যে, শুধু তাই নয়, বংশানুক্রমে এই নির্ভরশীলতা থেকে বের হতে পারছে না বা চাচ্ছে না। এর কারণ রাষ্ট্র এদের নির্ভরশীলতার আওতায় আনতে অতিশয় তৎপর বটে; কিন্তু এদের নির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের করে আনতে তার কোন উৎসাহ দেখা যায় না। বেকারত্বের মতো এটাও মানুষের তৈরি একটা কৃত্রিম সমস্যা। বেকারত্ব থেকে মানুষকে বের করার পদ্ধতি বের করতে পারলেই একই পদ্ধতিতে ভাগ্যহীন মানুষের জন্য নতুন ভাগ্য সৃষ্টি করে তাদের রাষ্ট্র নির্ভরশীলতার আওতা থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ দেয়া যায়। রাষ্ট্রনির্ভরশীল একজন মানুষের জন্য রাষ্ট্রকে ওই ব্যক্তির পেছনে তার সারাজীবনে যে ব্যয় করতে হয় তার একটি ভগ্নাংশ তাকে পুঁজি হিসেবে দিলেই সে কিন্তু স্থায়ীভাবে শুধু নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়েই আসবে না, সে আরও মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, তার পরবর্তী বংশধরকে রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত রাখবে এবং সে নিজে করদাতা হিসেবে রাষ্ট্রের কোষাগারে অর্থ যোগান দেবে।
তাহলে এটা রাষ্ট্র করে না কেন? কারণ রাষ্ট্রকে শাস্ত্রকাররা বুঝিয়ে দিয়েছে, এদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে না পারা পর্যন্ত তাদের খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে হবে। চাকরি ছাড়া গতি নেই, এই যে মন্ত্র শাস্ত্রকাররা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে এর থেকে আমরা বের হতে পারছি না। মানুষকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে আমাদের মনে অনীহা জমে গেছে।
কথাটা স্পষ্ট করার জন্য বলে রাখি, কারও মনে এমন কোন ধারণার যেন জন্ম না নেয় যে, রাষ্ট্রের সহায়তায় যারা জীবনধারণ করেন তাদের আমি অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছি। মোটেই তা চাইছি না। আমি শুধু তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিদের কথা বলছি যারা আগ্রহ করে, দরখাস্ত করে, রাষ্ট্রের নির্ভরশীলতা ছেড়ে এসে নিজের আয়ে নিজে চলতে চান, তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির কথা বলছি। যারা এখন যে ভাবে আছেন, সে ভাবে থাকতে চান, তারা সেভাবে থাকবেন। নিজের আয়ে নিজে চলার বিষয়টি যাতে সবার কাছে আকর্ষণীয় এবং বাস্তবসম্মত করা যায় তার জন্য রাষ্ট্রকে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। কারণ, মানুষের জীবন পরনির্ভরশীলতার জীবন হতে পারে না। মানুষ কর্মঠ জীব। সৃজনশীল জীব। মানুষের প্রকৃতিই হলো নিরন্তর নিজেকে বিকশিত করা, নিজের সম্ভাবনার সীমারেখাকে ক্রমাগতভাবে সমপ্রসারিত করা। অলস জীবন মানুষের স্বাভাবিকত্বকে কেড়ে নেয়। পরনির্ভরশীলতা মানুষকে ক্ষুদ্র করে। তাই বেকারত্ব ও দারিদ্র্য এত অসহনীয়।
উপসংহার
প্রচলিত পুঁজিবাদী শাস্ত্র পৃথিবীর মৌলিক সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারবে না। এই কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে অগ্রসর হলে আমাদের সমস্যাগুলোর সামাধান তো হবেই না, বরং এগুলো জটিলতর হয়ে আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে। বড়মাপের প্রকৃত মানুষকে ছোট আকারের রোবট-প্রায় মানুষে পরিণত করে অর্থনীতি শাস্ত্র এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত মানুষকে তার স্বাভাবিক সত্তাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ দিলে বর্তমানে সৃষ্টি সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের স্বার্থহীনতাকে অর্থনীতিতে স্বীকৃতি দিতে হবে। সামাজিক ব্যবসাকে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে এই উদ্যোগ শুরু হতে পারে। সামাজিক ব্যবসাকে স্বীকৃতি দিলে অর্থনীতিতে এটা কি কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় যেতে পারবে, নাকি একটা ক্ষুদ্র নামকাওয়াস্তে কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, এ নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মানুষের মধ্যে যে স্বার্থহীনতা এবং সামগ্রিক মঙ্গলের জন্য কাজ করার যে প্রচণ্ড আগ্রহ ও ক্ষমতা তা দেখলে মনে হয় একবার সামাজিক ব্যবসা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলে এটা মহাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। স্বার্থপরতা ও স্বার্থহীনতার দ্বন্দ্েব স্বার্থহীনতা অগ্রগামী হবে বলে আমার বিশ্বাস। নতুন প্রজন্মের তরুণদের দেখলে, বর্তমান সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ে তাদের হতাশার কথা শুনলে আমার এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।
নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সময় এসেছে। প্রযুক্তি আমাদের এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের পথ বের করতেই হবে। সামাজিক ব্যবসা আমাদের মনে আশা জাগায়। হয়তো সামাজিক ব্যবসা আমাদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। এই গন্তব্য হবে সবার জন্য ঋণ, সবার জন্য পুঁজি, সবার জন্য স্বাস্থ্য, সবার জন্য প্রযুক্তি, সবার জন্য সুশাসন, বেকারত্বহীন, দারিদ্র্যহীন, পরিবেশ দূষণমুক্ত, যুদ্ধাস্ত্রমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, আয়ের বৈষম্যহীন এক নতুন পৃথিবী।
No comments