একজন উপাচার্যের প্রতিকৃতি by একে এম শাহনাওয়াজ
চলে গেলেন সিদ্দিকী স্যার। আমার মানসিক অসহায়ত্ব আরেকটু বেড়ে গেল। খুব কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে আমাদের উজ্জ্বল ভাণ্ডার দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি, বড় মানুষদের সান্নিধ্য না পেলে বড় হওয়ার সাধ জাগে না। এদিক থেকে আমি ভাগ্যবান। বড় মানুষ ও পাণ্ডিত্যে উজ্জ্বল শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি শিক্ষা জীবনের নানা ক্ষেত্রে। আর এখন অসহায়ভাবে দেখছি তারা একে একে আমাকে একা করে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তিন দশকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি, তারপরও বাস্তবতা ও উপলব্ধি থেকে দেখতে পাচ্ছি অনুকরণ করার মতো বা প্রভাবিত হওয়ার মতো শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মহান শিক্ষকদের প্রভাবে আলোকিত হতে পেরেছি কিনা- এ প্রশ্নে নিজের প্রতিও আমার অনেক সন্দেহ রয়েছে। যে বড় মানুষ মহান শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেয়ে আমি ধন্য, তাদের মধ্যে ২০০৭ সালে প্রথম হারিয়েছি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিমকে। প্রচলিত অর্থে আমার সরাসরি শিক্ষক না হয়েও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস গবেষণায় যিনি হাত ধরে আমাকে পথ চিনিয়েছেন। বেশ কয়েক বছর আগে হারিয়েছি আমার শিক্ষক ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আবু ইমামকে। গত বছর হারিয়েছি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আমার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ভারতীয় ইতিহাসের গুরুনানক প্রফেসর অমলেন্দু দেকে। এই সেদিন হারালাম ইতিহাস চর্চা আর শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে আমার ভেতর নতুন উপলব্ধি তৈরি করে দেয়া জাতীয় অধ্যাপক সালাহউদ্দীন স্যারকে। গত সপ্তাহে হারালাম আমার স্কুলশিক্ষক মনোতোষ কুমার সাহা স্যারকে। প্রত্যেকেই আমার সামনে ছিলেন এক একজন আলোকবর্তিকা। আর এখন
কঠিন সমাজ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সামনে দেখি ধোঁয়াটে অন্ধকার আর পেছনে তাকিয়ে দেখি বাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কেবল আলো-আঁধারির ছায়া।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু কাছে থেকে দেখার ও পাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও ইংরেজি বিভাগ ছিল পাশাপাশি। প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম একজন ধীরস্থির আর অসম্ভব ব্যক্তিত্বের অধিকারী অধ্যাপককে। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এমন ছবিই মনে মনে আঁকতাম। কোনো অনুষ্ঠানে সিদ্দিকী স্যার আসবেন জানলে সে অনুষ্ঠানে না থাকার প্রশ্নই উঠত না। চমৎকার শব্দ চয়ন, বাক্যের গাঁথুনি ও কণ্ঠের দীপ্তি আমাদের অনেককেই তন্ময় করে রাখত।
আমার শিক্ষকতায় যোগদান উপাচার্য হিসেবে সিদ্দিকী স্যারের হাতেই হয়েছিল। এটি আমার কাছে হীরন্ময় স্মৃতি। এর অর্থ এই নয় যে, স্যার আমাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে স্মৃতিটি এতটা উজ্জ্বল। আমি বরঞ্চ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলনা করতে পারি সে সময়ের সঙ্গে বর্তমানের। একজন উপাচার্যের দূরদৃষ্টি এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে কতটা রূপান্তর হয়েছে।
আমাদের সময় শিক্ষক নিয়োগে কুরাজনীতিকরণ হয়নি। শিক্ষকরাই নির্মোহভাবে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতর থেকে কে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তা নির্ধারণ করে রাখতেন (কখনও যে এর ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়)। এ লক্ষ্যে বিবেচনায় রাখা ছাত্র-ছাত্রীকে পথনির্দেশনাও দিতেন। শিক্ষার্থী হয়তো জানতেও পারত না।
আমিও পরিচর্যা পেয়েছিলাম আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবু ইমাম স্যারের। এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাংকার বাবা অবসরে গেলেন। আমার চাকরিতে ঢোকা জরুরি। ছেলেবেলা থেকেই আমার সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় যাব না। এদিকে আমার শিক্ষকও বিষয়টি উপলব্ধি করলেন। কিন্তু উপায় ছিল না। বিভাগে প্রভাষকের পদ শূন্য নেই। আমি কিছুটা হতাশ। এ সময় হঠাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হল। খবরটি শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন আবু ইমাম স্যার। পরদিন সকালে বিভাগে আসতে বললেন। আমি যাওয়ার পর তিনি বললেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তো স্থায়ী পদ। এখানে তোমাকে যদি এডহক নিয়োগের চিন্তা করা হয় তুমি তাতে সম্মত হবে কি-না। আমি সানন্দে সম্মতি জানাই। স্যার দেরাজ খুলে একটি হলুদ রঙের খাম এগিয়ে দিলেন। খুলে দেখি নিয়োগপত্র। বাকিটা আবু ইমাম স্যারের কাছে শোনা। আমি চট্টগ্রামে চলে যাব এমন খবর উপাচার্য জিল্লুর রহমান স্যারকে টেলিফোনে জানাতেই সিদ্দিকী স্যার আবু ইমাম স্যারকে ভিসি অফিসে আসতে বললেন। সিদ্দিকী স্যার স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে আবু ইমাম স্যারকে বললেন, শাহনাওয়াজকে পড়াশুনো করিয়ে আপনারা তৈরি করলেন, এখন ওকে চলে যেতে দেবেন কেন! আমি এখনই এডহক নিয়োগপত্র দিচ্ছি, ওকে ধরে রাখার বাকি দায়িত্ব আপনার।
এখন এসব স্মৃতি খুব তাড়িত করে। এমন একজন উপাচার্যের দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেতে পাণ্ডিত্য নয়, সরকার দলের সঙ্গে প্রার্থীর রাজনৈতিক সম্পর্ক কতটা, তা প্রাধান্য পায়। আবার শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধারার উপাচার্য ও তার গ্র“প নেতা শিক্ষকদের কাছে প্রাধান্য পায় শিক্ষা গবেষণার যোগ্যতা নয়, ছাত্রজীবনে প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল আর প্রার্থী শিক্ষক হয়ে এলে তাদের কথা শুনবে কি-না- এসব প্রশ্নের উত্তর। এর সঙ্গে এখন তো শোনা যায় অর্থ-বাণিজ্যও নাকি যুক্ত হয়েছে। এই শোনা কথা সত্যি না হোক, কায়মনোবাক্যে তা-ই প্রার্থনা করি।
উপাচার্য হিসেবে শিক্ষকের অবস্থান থেকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারকে অল্পদিন দেখেছি। সেটুকুই ছিল নজরকাড়া। গ্র“প রাজনীতির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তখনও তৈরি হয়নি। এখন তো অনেক ক্ষেত্রে উপাচার্যকে বেশিরভাগ সময় ঘিরে থাকেন দলীয় শিক্ষকরা। এসবের বালাই ছিল না তখন। কোনো প্রয়োজনে দেখা করতে হলে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হতো। এখন বুঝেছি দক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসন পরিচালনা করতে এ ধরনের নিয়মের শাসন থাকা জরুরি।
আদর্শিকভাবে দেখলে একজন উপাচার্যের প্রথম গুণ থাকা প্রয়োজন শিক্ষাবিদ হিসেবে সহজাত পাণ্ডিত্য। যে কারণে তিনি শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় সর্বজনমান্য হয়ে ওঠেন। এরপর প্রশাসনিক দক্ষতা। বিচক্ষণতা এ ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলে। ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার প্রতি সমদর্শী ও ন্যায়নিষ্ঠ হতে পারলে প্রশাসন পরিচালনা সহজ হয়ে যায়। এসব গুণ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের মধ্যে দৃশ্যমান ছিল। প্রকৃত অর্থে একজন আদর্শ উপাচার্যের প্রতিকৃতি যেমনটি হওয়া দরকার, পুরোপুরি তেমনটিই সিদ্দিকী স্যারের অবয়বে ও তার কর্ম প্রয়াসের মধ্যে দেখতে পেয়েছি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, উগ্র রাজনীতিকরণের ঘেঁরাটোপে পরে উপাচার্য পদটি ক্রমে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো আইন, অধ্যাদেশের ভেতর ভালো বা কল্যাণ চিন্তার পাশাপাশি আইনের ফাঁক বা অমঙ্গলের ক্ষত লুকিয়ে থাকে। অসাধু ক্ষমতাধররা সেসব ক্ষত আবিষ্কার করে তাতে লাভের ও লোভের পসরা সাজায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল। এ অধ্যাদেশের ভেতরেই রয়েছে উপাচার্য নিয়োগের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। সিনেটরদের ভোটে উপাচার্য পদপ্রার্থী তিনজন নির্বাচিত হন। তাদের ভেতর থেকে পছন্দমতো যে কোনো একজনকে চ্যান্সেলর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগদান করেন। আপাতদৃষ্টিতে এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলেও এর ভেতরকার ফাঁক খুঁজে নিয়ে দলীয় সরকারগুলো দলীয় উপাচার্য নিয়োগের পথ পাকাপোক্ত করে নেয়। এর জন্য কায়দা করা আছে শুরু থেকে। কায়দাটি করা হয়েছে সিনেটর নিয়োগ ও নির্বাচনের পদ্ধতির ভেতরেই। সিনেটরদের একটি অংশ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের ভেতর থেকে, আরেকটি অংশ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত, বাকি কয়েকটি সদস্যপদ সরকার মনোনীত। কিছুসংখ্যক সিনেটর থাকেন যাদের কোনো না কোনোভাবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি একটি দায়বদ্ধতা কাজ করে। সরকার বা মহামান্য চ্যান্সেলর সরাসরি যাদের মনোনয়ন দেন, তাদের বাছাই করা হয় এমপি আর আমলাদের ভেতর থেকে। নিয়োগকর্তা হিসেবে চ্যান্সেলরের নাম ব্যবহৃত হলেও এ ক্ষেত্রে অঙ্গুলি হেলন থাকে দলীয় সরকারপ্রধানের। এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ লাভকারী উল্লিখিত সিনেটররা উপাচার্যের প্যানেলে সাধারণত সরকারি প্রেসক্রিপশন অনুযায়ীই ভোট প্রদান করে থাকেন। অন্য সিনেটরদের ভোটে পক্ষ-বিপক্ষের টানাপোড়েনে ভারসাম্য তৈরি হলেও উল্লিখিত সরকারি ভোটগুলো সাধারণত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে। এভাবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উপাচার্য প্যানেলে ভোটাভুটি হলেও প্রায়শই সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বীই নির্বাচিত হন। কখনও কখনও জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিত্ব ও পাণ্ডিত্যের বিচারে তিনজনের একজন সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হলেও দলীয় পরিচিতি ও আনুগত্য না থাকায় তিনি চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগ লাভে ব্যর্থ হন। আবার সরকারদলীয় একাধিক উপাচার্য পদপ্রার্থী নির্বাচিত হলে তাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় সরকারের বিভিন্ন মহলে। এ সময় মন্ত্রী থেকে ছাত্রনেতা পর্যন্ত সবাই জড়িত হয়ে পড়েন যার যার কাছের মানুষের পদ লাভকে নিশ্চিত করতে। ফলে দলীয় পরিমণ্ডলে অনুরাগ-বিরাগ দুই-ই বাড়তে থাকে।
উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রটি এভাবে দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণ হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ও শিক্ষার পরিবেশ নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির আধিপত্যের কারণে যেমন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তেমনি মেধা বিচারের বদলে পক্ষপাতদুষ্ট দলীয়করণের কারণে পাণ্ডিত্য ও মেধায় উজ্জ্বল অনেকেই উপাচার্য পদটির প্রতি আর এখন আকর্ষণ বোধ করছেন না। আর করলেও দলীয় পরিচিতি এবং কর্তাভজনের গুণ না থাকায় তারা নির্বাচকদের তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন।
রাজনীতিকরণের এই দুঃসহ পরিবেশ থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো মেধায়, পাণ্ডিত্যে আর দক্ষতায় একজন আদর্শ উপাচার্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কঠিন সমাজ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সামনে দেখি ধোঁয়াটে অন্ধকার আর পেছনে তাকিয়ে দেখি বাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কেবল আলো-আঁধারির ছায়া।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু কাছে থেকে দেখার ও পাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও ইংরেজি বিভাগ ছিল পাশাপাশি। প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম একজন ধীরস্থির আর অসম্ভব ব্যক্তিত্বের অধিকারী অধ্যাপককে। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এমন ছবিই মনে মনে আঁকতাম। কোনো অনুষ্ঠানে সিদ্দিকী স্যার আসবেন জানলে সে অনুষ্ঠানে না থাকার প্রশ্নই উঠত না। চমৎকার শব্দ চয়ন, বাক্যের গাঁথুনি ও কণ্ঠের দীপ্তি আমাদের অনেককেই তন্ময় করে রাখত।
আমার শিক্ষকতায় যোগদান উপাচার্য হিসেবে সিদ্দিকী স্যারের হাতেই হয়েছিল। এটি আমার কাছে হীরন্ময় স্মৃতি। এর অর্থ এই নয় যে, স্যার আমাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বলে স্মৃতিটি এতটা উজ্জ্বল। আমি বরঞ্চ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলনা করতে পারি সে সময়ের সঙ্গে বর্তমানের। একজন উপাচার্যের দূরদৃষ্টি এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে কতটা রূপান্তর হয়েছে।
আমাদের সময় শিক্ষক নিয়োগে কুরাজনীতিকরণ হয়নি। শিক্ষকরাই নির্মোহভাবে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতর থেকে কে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তা নির্ধারণ করে রাখতেন (কখনও যে এর ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়)। এ লক্ষ্যে বিবেচনায় রাখা ছাত্র-ছাত্রীকে পথনির্দেশনাও দিতেন। শিক্ষার্থী হয়তো জানতেও পারত না।
আমিও পরিচর্যা পেয়েছিলাম আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবু ইমাম স্যারের। এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাংকার বাবা অবসরে গেলেন। আমার চাকরিতে ঢোকা জরুরি। ছেলেবেলা থেকেই আমার সিদ্ধান্ত ছিল শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় যাব না। এদিকে আমার শিক্ষকও বিষয়টি উপলব্ধি করলেন। কিন্তু উপায় ছিল না। বিভাগে প্রভাষকের পদ শূন্য নেই। আমি কিছুটা হতাশ। এ সময় হঠাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হল। খবরটি শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন আবু ইমাম স্যার। পরদিন সকালে বিভাগে আসতে বললেন। আমি যাওয়ার পর তিনি বললেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তো স্থায়ী পদ। এখানে তোমাকে যদি এডহক নিয়োগের চিন্তা করা হয় তুমি তাতে সম্মত হবে কি-না। আমি সানন্দে সম্মতি জানাই। স্যার দেরাজ খুলে একটি হলুদ রঙের খাম এগিয়ে দিলেন। খুলে দেখি নিয়োগপত্র। বাকিটা আবু ইমাম স্যারের কাছে শোনা। আমি চট্টগ্রামে চলে যাব এমন খবর উপাচার্য জিল্লুর রহমান স্যারকে টেলিফোনে জানাতেই সিদ্দিকী স্যার আবু ইমাম স্যারকে ভিসি অফিসে আসতে বললেন। সিদ্দিকী স্যার স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে আবু ইমাম স্যারকে বললেন, শাহনাওয়াজকে পড়াশুনো করিয়ে আপনারা তৈরি করলেন, এখন ওকে চলে যেতে দেবেন কেন! আমি এখনই এডহক নিয়োগপত্র দিচ্ছি, ওকে ধরে রাখার বাকি দায়িত্ব আপনার।
এখন এসব স্মৃতি খুব তাড়িত করে। এমন একজন উপাচার্যের দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেতে পাণ্ডিত্য নয়, সরকার দলের সঙ্গে প্রার্থীর রাজনৈতিক সম্পর্ক কতটা, তা প্রাধান্য পায়। আবার শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধারার উপাচার্য ও তার গ্র“প নেতা শিক্ষকদের কাছে প্রাধান্য পায় শিক্ষা গবেষণার যোগ্যতা নয়, ছাত্রজীবনে প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় কী ছিল আর প্রার্থী শিক্ষক হয়ে এলে তাদের কথা শুনবে কি-না- এসব প্রশ্নের উত্তর। এর সঙ্গে এখন তো শোনা যায় অর্থ-বাণিজ্যও নাকি যুক্ত হয়েছে। এই শোনা কথা সত্যি না হোক, কায়মনোবাক্যে তা-ই প্রার্থনা করি।
উপাচার্য হিসেবে শিক্ষকের অবস্থান থেকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারকে অল্পদিন দেখেছি। সেটুকুই ছিল নজরকাড়া। গ্র“প রাজনীতির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তখনও তৈরি হয়নি। এখন তো অনেক ক্ষেত্রে উপাচার্যকে বেশিরভাগ সময় ঘিরে থাকেন দলীয় শিক্ষকরা। এসবের বালাই ছিল না তখন। কোনো প্রয়োজনে দেখা করতে হলে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হতো। এখন বুঝেছি দক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসন পরিচালনা করতে এ ধরনের নিয়মের শাসন থাকা জরুরি।
আদর্শিকভাবে দেখলে একজন উপাচার্যের প্রথম গুণ থাকা প্রয়োজন শিক্ষাবিদ হিসেবে সহজাত পাণ্ডিত্য। যে কারণে তিনি শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় সর্বজনমান্য হয়ে ওঠেন। এরপর প্রশাসনিক দক্ষতা। বিচক্ষণতা এ ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলে। ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার প্রতি সমদর্শী ও ন্যায়নিষ্ঠ হতে পারলে প্রশাসন পরিচালনা সহজ হয়ে যায়। এসব গুণ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারের মধ্যে দৃশ্যমান ছিল। প্রকৃত অর্থে একজন আদর্শ উপাচার্যের প্রতিকৃতি যেমনটি হওয়া দরকার, পুরোপুরি তেমনটিই সিদ্দিকী স্যারের অবয়বে ও তার কর্ম প্রয়াসের মধ্যে দেখতে পেয়েছি।
আমাদের দুর্ভাগ্য, উগ্র রাজনীতিকরণের ঘেঁরাটোপে পরে উপাচার্য পদটি ক্রমে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো আইন, অধ্যাদেশের ভেতর ভালো বা কল্যাণ চিন্তার পাশাপাশি আইনের ফাঁক বা অমঙ্গলের ক্ষত লুকিয়ে থাকে। অসাধু ক্ষমতাধররা সেসব ক্ষত আবিষ্কার করে তাতে লাভের ও লোভের পসরা সাজায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল। এ অধ্যাদেশের ভেতরেই রয়েছে উপাচার্য নিয়োগের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। সিনেটরদের ভোটে উপাচার্য পদপ্রার্থী তিনজন নির্বাচিত হন। তাদের ভেতর থেকে পছন্দমতো যে কোনো একজনকে চ্যান্সেলর উপাচার্য হিসেবে নিয়োগদান করেন। আপাতদৃষ্টিতে এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলেও এর ভেতরকার ফাঁক খুঁজে নিয়ে দলীয় সরকারগুলো দলীয় উপাচার্য নিয়োগের পথ পাকাপোক্ত করে নেয়। এর জন্য কায়দা করা আছে শুরু থেকে। কায়দাটি করা হয়েছে সিনেটর নিয়োগ ও নির্বাচনের পদ্ধতির ভেতরেই। সিনেটরদের একটি অংশ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের ভেতর থেকে, আরেকটি অংশ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত, বাকি কয়েকটি সদস্যপদ সরকার মনোনীত। কিছুসংখ্যক সিনেটর থাকেন যাদের কোনো না কোনোভাবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং তাদের মধ্যে দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি একটি দায়বদ্ধতা কাজ করে। সরকার বা মহামান্য চ্যান্সেলর সরাসরি যাদের মনোনয়ন দেন, তাদের বাছাই করা হয় এমপি আর আমলাদের ভেতর থেকে। নিয়োগকর্তা হিসেবে চ্যান্সেলরের নাম ব্যবহৃত হলেও এ ক্ষেত্রে অঙ্গুলি হেলন থাকে দলীয় সরকারপ্রধানের। এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ লাভকারী উল্লিখিত সিনেটররা উপাচার্যের প্যানেলে সাধারণত সরকারি প্রেসক্রিপশন অনুযায়ীই ভোট প্রদান করে থাকেন। অন্য সিনেটরদের ভোটে পক্ষ-বিপক্ষের টানাপোড়েনে ভারসাম্য তৈরি হলেও উল্লিখিত সরকারি ভোটগুলো সাধারণত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে। এভাবে তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উপাচার্য প্যানেলে ভোটাভুটি হলেও প্রায়শই সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বীই নির্বাচিত হন। কখনও কখনও জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিত্ব ও পাণ্ডিত্যের বিচারে তিনজনের একজন সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত হলেও দলীয় পরিচিতি ও আনুগত্য না থাকায় তিনি চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগ লাভে ব্যর্থ হন। আবার সরকারদলীয় একাধিক উপাচার্য পদপ্রার্থী নির্বাচিত হলে তাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় সরকারের বিভিন্ন মহলে। এ সময় মন্ত্রী থেকে ছাত্রনেতা পর্যন্ত সবাই জড়িত হয়ে পড়েন যার যার কাছের মানুষের পদ লাভকে নিশ্চিত করতে। ফলে দলীয় পরিমণ্ডলে অনুরাগ-বিরাগ দুই-ই বাড়তে থাকে।
উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রটি এভাবে দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণ হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ও শিক্ষার পরিবেশ নানাভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির আধিপত্যের কারণে যেমন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতির প্রতি উৎসাহ হারিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তেমনি মেধা বিচারের বদলে পক্ষপাতদুষ্ট দলীয়করণের কারণে পাণ্ডিত্য ও মেধায় উজ্জ্বল অনেকেই উপাচার্য পদটির প্রতি আর এখন আকর্ষণ বোধ করছেন না। আর করলেও দলীয় পরিচিতি এবং কর্তাভজনের গুণ না থাকায় তারা নির্বাচকদের তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন।
রাজনীতিকরণের এই দুঃসহ পরিবেশ থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো মেধায়, পাণ্ডিত্যে আর দক্ষতায় একজন আদর্শ উপাচার্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments