খোলা চোখে- আমেরিকায় ‘চাকা বন্ধের’ শিক্ষা by হাসান ফেরদৌস
আমেরিকার ‘চাকা বন্ধ’ থেকে একাধিক
শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, শুধু আমেরিকার জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও। পাক্কা ১৬
দিন বন্ধ থাকার পর আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ফের খুলেছে।
সরকারি
কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন ও সরকারি ঋণ গ্রহণের মাত্রা প্রশ্নে মার্কিন কংগ্রেসের
দুই কক্ষের মধ্যে দড়ি টানাটানিতে দেশের প্রায় আট লাখ সরকারি কর্মচারী কোনো
কাজকর্ম না করে স্রেফ ঘরে বসে ছিলেন।
আমেরিকা, যে নিজেকে বিশ্বে সবকিছুর সেরা বলে দাবি করে, সেখানে এই কাণ্ড দেখে বুরুন্ডি থেকে বানিয়াচং—সর্বত্র মানুষ হেসে কুটিকুটি হয়েছে।
হাস্যকর, তবে একদম অপ্রত্যাশিত নয়। আমেরিকায় রাষ্ট্রযন্ত্রের তিন শাখা—প্রশাসন, আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগ—অধিকারের দিক দিয়ে কারও চেয়ে কেউ কম নয়। একই রাষ্ট্রের সমান অধিকারভোগী অঙ্গ হওয়ায় একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা ছাড়া কোনো কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব। একই দলের অঙ্গীভূত হলে এই তিনের মধ্যে সহযোগিতার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু আমেরিকার বর্তমান সরকারব্যবস্থা বিভক্ত। প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে ডেমোক্র্যাটরা। কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটও ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু আইনসভার নিম্নকক্ষে, অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদে, রিপাবলিকানরা সংখ্যাগুরু। তাদের ভেতরে আবার অতি ক্ষুদ্র একটি কট্টরপন্থী গ্রুপ, যারা নিজেদের টি-পার্টি রিপাবলিকান বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসে, ওবামা প্রশাসনের সব ব্যাপারে তাদের তীব্র বিরোধিতা। বিশেষত, প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় ঘৃণার পর্যায়ে। ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে কোনো রকমের সমঝোতায় এরা গররাজি।
ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। সরকারের চাকা থেমে গেল ১৬ দিনের জন্য।
রিপাবলিকান দল, বিশেষত টি-পার্টি গ্রুপ ভেবেছিল তাদের একগুঁয়েমির মুখে ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে। বাজেট বরাদ্দে সম্মত হওয়ার আগে তারা গোঁ ধরে বসে, ওবামার স্বাস্থ্যবিমা আইন বাতিল করতে হবে। পুরোপুরি বাতিল করা না গেলে এই আইনের বাস্তবায়ন নিদেনপক্ষে এক বছরের জন্য বিলম্বিত করা হোক। একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ২০১১ সালে, সেবার বাজেট বরাদ্দ নিয়ে সরকারের চাকা বন্ধের আশঙ্কায় ওবামা রিপাবলিকানদের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। সেটি ছিল মস্ত বড় এক ভুল, সে কথা যেমন তিনি, তেমনি আমেরিকার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। সেবার আপস থেকে যে শিক্ষা পান, তা মাথায় রেখে সরকারি কাজকর্ম অর্থায়নের প্রশ্নে কোনো আপস করতে ওবামা এ দফায় আর রাজি হলেন না। মাথার কাছে বন্দুক রেখে রিপাবলিকানরা আলোচনার দাবি তুলবে, তা মানা তাঁর পক্ষে অসম্ভব, তিনি সোজা জানিয়ে দিলেন।
ফলে সরকারের কাজকর্ম আংশিকভাবে হলেও বন্ধ হলো। রিপাবলিকানদের গোঁয়ার্তুমির জন্যই যে এই অবস্থা, তা টের পেতে দেশের মানুষের বেগ পেতে হয়নি, ফলে সরকারের চাকা বন্ধের জন্য দোষ পড়ল রিপাবলিকানদের ওপর। এই দলের নেতা-নেত্রীরাই অভিযোগ করা শুরু করলেন, টি-পার্টি গ্রুপের না-বুঝ গোঁয়ার্তুমির জন্য এমন হাস্যকর একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু যে দেশের ভেতরে সরকারি কাজকর্মে এর ফলে ব্যাঘাত ঘটেছে তা নয়, দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়েছে। ১০ দিন যেতে না-যেতেই বোঝা গেল, দেশের মানুষ রিপাবলিকানদের ওপর বিরক্ত। দেশের মানুষ খেপে উঠছে, তা টের পেয়ে ডেমোক্র্যাটদের শর্তেই সে বন্ধ চাকা খুলে দিতে বাধ্য হলো রিপাবলিকানরা।
ব্যয় বরাদ্দ ও ঋণসীমা বৃদ্ধির প্রশ্নে দড়ি টানাটানা নিয়ে যে কেলেঙ্কারি, তা থেকে গোটা কয়েক শিক্ষণীয় উপাদান রয়েছে, যার একটির কথা বলেছেন স্বয়ং ওবামা। স্বাস্থ্যবিমার প্রশ্নে ম্যান্ডেট চেয়ে ২০১২ সালে নির্বাচন করেছেন ওবামা, তার বিরোধিতা করেছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি। সে নির্বাচনে ওবামার বিজয়ের ভেতর দিয়ে স্বাস্থ্যবিমা প্রশ্নে আমেরিকার জনগণের মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। দেশের সুপ্রিম কোর্টও এই আইনের প্রশ্নে তাঁদের সম্মতির কথা জানিয়েছেন। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওবামা তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের উদ্দেশে বলেছেন, স্বাস্থ্যবিমা প্রশ্নে দাবি তোলার অধিকার তাঁদের অবশ্যই আছে। নিজেদের যুক্তি-প্রমাণ নিয়ে তাঁরা দেশের মানুষের কাছে যান, এ নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে লড়ুন। সে নির্বাচনে জিতলে স্বাস্থ্যবিমা আইন বাতিল বা সংশোধনের পুরো এখতিয়ার তাঁদের থাকবে।
সোজা কথায়, আইন পরিবর্তনের আগে দেশের মানুষের সমর্থন চাই। আর সে সমর্থন আছে কি নেই, তা বোঝার উপায় হলো নির্বাচনে অংশ নিয়ে তা জেতা।
দ্বিতীয় শিক্ষণীয় বিষয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজের ব্যক্তিগত, দলীয় বা আদর্শগত অগ্রাধিকারের বদলে দেশের স্বার্থ মাথায় রাখা। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির বক্তব্য ছিল, স্বাস্থ্যবিমা আইন বাতিল করতে হবে, কারণ এই আইন দেশের মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী, দেশের অধিকাংশ মানুষ সে আইনের বিপক্ষে। এই কু-তর্ক জুড়ে দিয়ে তারা দেশের চাকা বন্ধ রাখে, ফলে আমেরিকার সরাসরি ক্ষতি হয় প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ধরলে তার পরিমাণ অনেক বেশি। আর আমেরিকার আন্তর্জাতিক মর্যাদা এর ফলে যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, টাকার অঙ্কে তার হিসাব অসম্ভব। দল নয়, দেশ আগে—রিপাবলিকান দল এই কথাটি ভুলে গিয়েছিল, ফলে রাজনৈতিকভাবে তাদের সমর্থন এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।
আমেরিকার চলতি রাজনৈতিক জটিলতা থেকে বাংলাদেশও ওপরের দুটি শিক্ষা নিতে পারে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আগামী নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক জোট এক মুখোমুখি সংঘাতের সম্মুখীন। নিজেদের অবস্থানের ব্যাপারে উভয় পক্ষই অনড়। সরকারের বক্তব্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনটি ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে, নতুন যে আইন হয়েছে তাতে পুরোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ আর নেই। কিন্তু বিরোধীপক্ষ নাছোড়বান্দা। তারা গোঁ ধরে আছে, অন্য
কোনো ব্যবস্থায় নয়, পুরোনো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাতেই ফিরে যেতে হবে। একমাত্র সে ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে স্বচ্ছতা অর্জিত হবে, দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষা পাবে। সরকারি দল তার অবস্থানে অনড় বুঝতে পেরে প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে একটি বিকল্প প্রস্তাব অবশ্য এসেছে, তাতেও সেই পুরোনো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাই নতুন পোশাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে। ভয়ের কথা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বনাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিতর্কে বাংলাদেশের সরকারি দল ও বিরোধী জোট লগি-বইঠা বনাম দা-কুড়াল নিয়ে যে যার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা জানিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক, বিদেশি চাপের কারণে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক হুমকির মুখে। এই অবস্থায় লাঠালাঠি শুরু হলে বারোটা বাজবে দেশের, অথচ সে দেশেরই দেখভাল করার নামে ক্ষমতা দাবি করছে দুই জোট।
বাজেট-সংকটের ছুতো ধরে রিপাবলিকান দল গোঁ ধরেছিল, স্বাস্থ্যবিমা বাতিল না হলে তারা বাজেট বরাদ্দে রাজি হবে না। ওবামা তাদের সে দাবিকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে জিম্মি করার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। শুধু তিনি নন, জিম্মি হয়েছিল পুরো দেশের মানুষ। লগি-বইঠা অথবা দা-কুড়ালের হুমকিও সে রকম ব্যাপার, এখানেও জিম্মি দেশ, দেশের মানুষ।
সংকট এখনো ‘চাকা বন্ধ’-এর পর্যায়ে পৌঁছায়নি, সুবুদ্ধির পরিচয় দেওয়ার সময় এখনো আছে। রাজনৈতিক দলগুলো সত্যি দেশের ভালো চায়, না শুধু ক্ষমতা দখল তাদের লক্ষ্য—সে কথা বোঝা যাবে এদের মধ্যে কে নিজেদের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের বদলে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments