রাজনীতির নীতিকথা by সাযযাদ কাদির
দেশের রাজনীতি নিয়ে বলার কিছু নেই তেমন।
ক্ষমতাসীন মহল জানে রাজনীতির নীতি তিনটি- (১) নির্বাচিত হতে হবে, (২)
পুনঃনির্বাচিত হতে হবে এবং (৩) পাগলা হলে চলবে না, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
প্রথম
নীতি পালন করে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা, এখন দ্বিতীয় নীতি অনুযায়ী পাকাপাকি
করে ফেলেছেন পুনঃনির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা। বিরোধী জোট এ ব্যবস্থা মানবে
না- এ-ও অজানা ছিল না তাঁদের। সেজন্যও নিয়ে রেখেছেন ব্যবস্থা। নির্বাচন
বর্জন করলে কি করতে হবে, নির্বাচন বানচাল বা প্রতিহত করতে চাইলে কি
ব্যবস্থা নিতে হবে- সে সবের প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছেন তাঁরা। তাই এক চুল না
নড়ার কথা যেমন বলেন, তেমনি প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের আবেগ।
সংসদে গিয়ে বিরোধী দলকে প্রস্তাব দেয়ার কথা বললেও সেখানে গেলে বকাঝকা করে
তাঁদের বাধ্য করেন ওয়াকআউট করতে। আসলে বিরোধীরা কতখানি কি আন্দোলন-সংগ্রাম
করার মুরোদ রাখে সে সম্পর্কেও সম্যক ধারণা আছে ক্ষমতাসীনদের। তাই আইনি পথে ও
রাজপথে তাদের কখন কিভাবে সাইজ বা সিসটেম করে দিতে হবে সে-ও ভাল জানেন
তাঁরা। কাজেই যে কোনও ভাবে নির্বাচন করিয়ে নিয়ে আবার পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন
থাকার ব্যাপারে একটুও সন্দিহান নন তাঁদের কেউ। ওদিকে বিরোধীরা চলছেন তৃতীয়
নীতি অনুসরণ করে। খুবই সংযত সহিষ্ণু ভাব, মাথা একেবারে ঠাণ্ডা। পা দিচ্ছেন
না কোনও ফাঁদে, শত উস্কানির মুখে চলছেন ধীরে সুস্থে। আস্তিন থেকে বের করছেন
একেক সময় একেক তাস। তবে ট্রাম্পকার্ড কোথায়? এত অবিচলিত থাকার কারণ কি?
তাহলে কি জেনে গেছেন ক্ষমতার আপেলটি পেকে টসটসে হয়ে এমনিতেই টুপ করে খসে
পড়বে তাঁর কোলে? তবে এটুকু জেনেছেন যে তৃতীয় নীতি পালন না করলে প্রথম নীতি
বাস্তবায়নের সুযোগ আসবে না। দ্বিতীয় নীতির ব্যাপার তো আরও পরে! এবার
রাজনীতির অন্যান্য নীতি নিয়ে দু’-চার কথা। এ সব কথার অবশ্য অত ব্যাখ্যা না
করলেও চলে, লোকের মুখে-মুখে এগুলো ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। যেমন, কোনও
রাজনীতিক যদি এক কথা তিন বার বলেন তাহলে বুঝতে হবে মিথ্যা বলছেন তিনি। আরও
একটি কথা। কোনও রাজনীতিক যদি কোনও উন্নয়নকাজ সম্পর্কে কোনও পরিসংখ্যান দেন
তাহলে বুঝতে হবে হিসাবটি হয় বাড়িয়ে বলছেন তিনি - নয় ওই তথ্য প্রাসঙ্গিক নয়
এক্ষেত্রে, কারণ খোঁজ নিলেই জানা যাবে ওই কাজে কোনও ভূমিকা ছিল না তাঁর।
আরও একটি কথা। যে রাজনীতিক অন্তত চার বার বলেন পদত্যাগ করবেন না, তিনি
অবশ্যই করবেন - নিশ্চিত থাকুন। কোনও রাজনীতিক যদি কসম কেটে বলেন ‘এটা
সত্য’, তাহলে বুঝবেন সেটা সত্য নয়। আর যদি কসম কেটে বলেন ‘এটা কখনওই ঘটে
নি’, তাহলে বুঝতে হবে সেটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। আসলে রাজনীতিকরা অ্যাক্রোবেটদের
মতো। তাঁরা যা বলেন তাঁর উলটো করে বজায় রাখেন নিজেদের ভারসাম্য। মনে রাখতে
হবে রাজনীতি হচ্ছে নীতি-আদর্শের সংগ্রামের নামে কায়েমি স্বার্থের এক ভয়ঙ্কর
যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে পূর্বসংস্কারকে পরানো হয় সত্যের সাজ, আবেগকে বলা হয়
যুক্তি, কটুকাটব্যকে বলা হয় ঠিক কাজ। কারণ রাজনীতির গোলাবারুদ যখন ফুরিয়ে
আসে তখন বেরিয়ে আসে কুৎসা-নিন্দার মরচে পড়া পুরনো তোপ। ওই তোপ দাগাই হয়ে
ওঠে একমাত্র কাজ। বস্তুত রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে চরিত্র কেবল দু’টি - নায়ক ও
ভিলেন। দোস্ত ও দুশমন। এখানে সব কিছু দেখা হয় সাদা আর কালোতে ভাগ করে।
এখানে ধূসর বলে নেই কোনও কিছু। বিচার-বিবেচনা চলে সব একেবারে মোটা দাগে। আর
রাজনীতির ভাষার ভঙ্গি এমন জনমোহিনী যে তা মিথ্যাকে সত্য আর হত্যাকে
পর্যন্ত যৌক্তিক করে তুলতে চায়। রাজনীতির আর দু’টি নীতিকথা বলে শেষ করি
এবার। এক, রাজনীতিকরা সাফল্য পান ভান-ভনিতাহীন অকপট আন্তরিকতার গুণে। এই
গুণের ভানটা শিখে নিতে পারলে তাঁদের আর পায় কে! দুই, তবে শেষ পর্যন্ত
নিজেদের মিথ্যাচারই ধ্বংস ডেকে আনে রাজনীতিকদের।
sazzadqadir@rediffmail.com
No comments