সরলতার ধোঁকা by মাসরুর আরেফিন
এ বছরের সাহিত্যে নোবেলজয়ী হিসেবে যখন অ্যালিস মানরোর নাম ঘোষণা করা হলো, তখন ইংরেজিভাষী লেখক-পাঠকের এই বিশাল পৃথিবী একটা ঘোর লাগা অবিশ্বাসের মধ্যে পড়ে গেল যেন। আমার অবিশ্বাস ছিল মাত্র চার বছরের ব্যবধানে আবার একজন নারী লেখকের নোবেলপ্রাপ্তি নিয়ে। আমার কথা বাদ থাক, পৃথিবীর অগুনতি পাঠকের ও প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকাগুলোর অবিশ্বাসের হেতু কী ছিল? সমকালীন লেখকদের মধ্যে মানরো বিরাট খ্যাতিমান এবং তা যুক্তিসংগত কারণেই। কোনো দেশে কেউ ছোটগল্প একটু ভালো লিখলেই এমন বলা একটা ফ্যাশন যে ‘ইনি আমাদের চেখভ’। জয়েস ক্যারল, উটস, রেমন্ড কার্ভার, জন আপডাইক, রোহিনতন মিস্ত্রি, অনিতা দেশাই—আরও কত! কিন্তু অ্যালিস মানরো সত্যিই আমাদের চেখভ—মানে ইংরেজি ভাষার চেখভ। মানরোর বিখ্যাত গল্প ‘দি বেগার মেইড’-এ ‘মেটারনিখ’ (Metternich) নামটা একজন ভুলভাবে উচ্চারণ করছে শুনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলে: ‘এ ধরনের লোকজন কীভাবে তোমার বন্ধু হয়?’ তখন আমাদের চেখভের বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ে—‘দি রাশিয়ান মাস্টার’, যেখানে একটা চরিত্র ছিল যে কিনা অনবরত এক তরুণ শিক্ষককে জ্বালাত এই বলে—কেন সে ‘কখনোই লেসিং পড়েনি?’ মানুষের শূন্যগর্ভ আত্মশ্লাঘা নিয়ে কী রকম একই ধরনের খোঁচা! এই ঈদের ছুটিতে মোটামুটি ডজন খানেক গল্প পড়লাম অ্যালিস মানরোর। তাঁর সব ছোটগল্পই আসলে বড় গল্প—আয়তনে ২০ থেকে ৫০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
চেখভের কথা মাথায় এল অনেকবারই। মানরোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘দ্য বেয়ার কেইম ওভার দি মাউন্টেন’ যখন পড়ছি তখন ঝট করে মনে এল চেখভের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প ‘দ্য লেডি উইদ অ্যা ডগ’-এর কথা। সেই যে ইয়ালটায় বেড়াতে গিয়ে মস্কোর এক ভদ্রলোক পরকীয়ায় জড়াল আন্না সারগিয়েভ্নার, যে একাকী বেড়াতে এসেছিল ছোট একটা কুকুর সঙ্গে নিয়ে, স্বামীকে ফেলে। ১৯৯২ সালে আমরা যখন ভারতে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, তখন আমাদের ‘তুলনামূলক সাহিত্য’-এর পাঠ্য তালিকায় তাজা তাজা ঢোকানো হয়েছিল মানরোর নতুন গল্প ‘মেনেসেটিয়াং’—কানাডার এক নদীর নামে নাম। চিরকুমারী এক মেয়ে নায়িকা সেটির, কবি সে। এক রাতে তার বাসার বাগানে তাড়া খেয়ে আসে এক মদ্যপ মহিলা। সে ভাবে মহিলা খুন হয়েছে। সাহায্যের জন্য সে ডেকে আনে এক ব্যাচেলর প্রতিবেশীকে; দুজনের মধ্যে কিছুই ঘটে না, গল্প এগোতে থাকে; একসময় মারা যায় মেয়েটি, মেনেসেটিয়াং নদীর পানি বয়ে যেতে থাকে আর পাঠককে ঘিরে ধরে দম বন্ধ করা বিষাদ। আমাদের আবার মনে পড়ে চেখভের কথা। কিন্তু চেখভের মতো মনে হলেই বা মানরো এ যুগের চেখভ বা প্রুস্ত যা-ই হোন না কেন, তাতেই কি শুধু ছোটগল্প লিখে কারও নোবেল মিলতে পারে? এই বোরহেস-কালভিনো-রবার্তো বোলানো-উত্তর যুগে সনাতনী ঘরানার ছোটগল্প লিখে নোবেল পুরস্কার জেতা কি সম্ভব? তাই আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ছিল, বড় লেখক হলেও মানরোর জায়গা হবে নোবেল না-পাওয়া বড় লেখকদের সারিতেই, যেখানে আছেন টলস্টয়, নবোকভ, জয়েস, বোরহেস, সেবাল্ড, বার্নহার্ড এবং হ্যাঁ, চেখভ নিজেও। যাক, সে রকম কিছু হলো না।
আমরাই বরং ভুল প্রমাণিত হলাম। পুরো ঈদের ছুটিটা মানরোতে ডুবে থেকে কতবার যে মনে হলো, নোবেল কমিটি এ বছর কত সঠিক এক সিদ্ধান্তই না নিয়েছে! কী আছে মানরোর লেখায়? প্রথমেই বলতে হয়, তাঁর গল্প বলার দক্ষতার কথা। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, মানরোর সুখপাঠ্য গল্পগুলি আপনি যদি একবার পড়া শুরু করেন তো কখনোই শেষ না করে ঘুমাতে যেতে পারবেন না। বাংলায় আমাদের হুমায়ূন আহমেদ যেমন। ধরুন আপনি হুমায়ূনের ফেরা বা শ্যামল ছায়া পড়া শুরু করেছেন; এখন আপনি কি চিন্তা করতে পারেন আজকের মধ্যে বইটা শেষ না করে বাকিটা কাল পড়ার কথা? মানরোও ঠিক তাই। তাঁর গল্পগুলির স্থান ও কাল এই আমাদের আধুনিক পৃথিবীর আধুনিক যুগই, তাঁর চরিত্রগুলো আমাদের অনেক চেনা, আর যেহেতু পড়া শুরু করলে তা শেষ না করে ঘুমাতে যাওয়া যাচ্ছে না, তখন কিন্তু সব মিলে একটা ঝুঁকিসর্বস্ব প্রশ্নই মনে তৈরি হয়, মানরো কি শুধুই পাঠকের চিত্তবিনোদন? এর উত্তর—একেবারেই না। মানরোর ছোটগল্পের পৃথিবী এত ঘন বুনোটে তৈরি আর তার তলদেশ পৃথিবীর মহৎ উপন্যাসগুলির মতো এত এত গভীরে যে, আপনি শুধু পড়ার আনন্দ নিয়েই মানরো শেষ করবেন না; বরং এই বোধও আপনার মধ্যে জাগবে—আরে, ইনি তো একজন জাদুকর! আর লেখকের স্রষ্টাসুলভ অহংটুকু সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে এ লেখক আমার প্রতি এ রকম দরদ দিয়ে এমন গূঢ় সত্য কথাটা লিখলেন কী করে? অ্যালিস মানরো মানুষের প্রগাঢ়-আনন্দ দেওয়া ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলোর এক শক্তিমান রূপকার। গল্প থেকে গল্পে সেই অভিজ্ঞতাগুলোর একটা প্যাটার্নও দাঁড় করানো যায়: মোটামুটি বুদ্ধিমতী, নিম্ন-মধ্যবিত্ত অবস্থানের কোনো মেয়ে বেড়ে উঠবে কানাডার ওন্টারিওর গ্রাম্য পরিবেশে, মেয়েটার বুকে অনেক আবেগ, ঝট করে প্রেম বা যৌন অভিজ্ঞতা লাভের ফাঁদে পা দিয়ে বসবে সে, তারপর পালাবে ওই ওন্টারিওর মফস্বল থেকে; এরপর তার বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে এবং দেখা যাবে তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পেছনে আমরা তাকে বেশি দোষ দিতে পারছি না।
সাহিত্যে নোবেল ২০১৩ |
তারপর তাকে আমরা দেখব রোমান্টিক নানা অ্যাডভেঞ্চারে ব্যস্ত, নিঃসঙ্গ ও জীবনবিমুখ। একদিন সে ফিরে আসবে শৈশবের সেই ওন্টারিওতেই, কিন্তু দেখবে সবকিছু কত বদলে গেছে। আরও দেখবে কেউ তাকে এখানে আর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে না। অর্থাৎ স্বাধীন হতে চেয়ে সে বরং জীবনের বেদনাদায়ক সব বঞ্চনা ও ক্ষতিরই শিকার হলো। মোটাদাগে এই হচ্ছে মানরোভিয়ান পৃথিবী; ঘর আর স্বাধীনতার মধ্যকার রশি টানাটানি। একদিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আর অন্যদিকে এই বোধও যে, হায়, শেকড় তো মাটির অনেক গভীরে। মানরোর বিখ্যাত নায়িকারা—জর্জিয়ারা, সোফিরা বা ফিয়োনারা—সব সময়ই একরোখা, স্বপ্নচারী, আর শেকড় যেমন করে হোক ছিঁড়ে পালাতে গিয়ে রক্তাক্ত। এই রক্ত আর অশ্রুর কথা লিখতেই মানরো সিদ্ধহস্ত এবং তিনি তা লেখেনও বটে, একটাও আলগা, অসৎ, অপ্রয়োজনীয় বা নীরস বাক্য না লিখেই। ভি এস নাইপলের মতো লেখক স্বীকার করেছিলেন, ‘মানরো পড়লে মনে হয় যেন মানরোর মতো লেখা কত সহজ। কিন্তু আমি কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছি, তা অসম্ভব।’ মানরোভিয়ার পৃথিবীর ভূগোলেও আছে ওপরতলের আপাত সরলতা—তিনি অসম্ভব দরদ দিয়ে সোয়াশো’র মতো গল্পে লিখে গেছেন তাঁর মাটির মানুষদের জীবনের সাদামাটা কাহিনিগুলো, যে মাটির অবস্থান কানাডার লেক হুরোনের কাছে, এখন যাকে অনেকে ‘মানরোল্যান্ড’ও বলেন। কিন্তু ওটা তো মাত্র সরল চোখে দেখা ‘ভূগোল’। তার অসংখ্য চরিত্র মৃত্যুর পরে ছোট ছোট কবরফলক কপালের কাছে নিয়ে শুয়ে আছে ওই মাটিরই অদৃশ্য ভূগোলে। শুধু ম্যাপল বা উইলোর পাতাগুলোয় হেমন্তের রং ধরলেই কেবল আমরা শুনতে পাচ্ছি মানরোর ফিয়োনা কিংবা জর্জিয়াদের হাহাশ্বাস। এই হাহাশ্বাসগুলোই আর্কিটাইপাল অ্যালিস মানরো থিম: শ্রেণীচেতনা,
গেরস্থালি, যৌনবাসনা, পরকীয়া, বিশ্বস্ততা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যকার দ্বন্দ্ব, কামনা ও ঔচিত্যবোধের লড়াই, দায়িত্ববোধ ও স্বপ্নবিলাসিতার সংঘর্ষ। আর তাঁর শেষ তিন বইতে, বিশেষ করে টু মাচ হ্যাপিনেস (২০০৯)-এ দেখি ভায়োলেন্সের প্রগাঢ় ছোঁয়া। মানরো বাস্তববাদী ঘরানার লেখক। কিন্তু অধিকাংশ গল্পেই যেভাবে ও যেসব যুক্তিতে তাঁর চরিত্রেরা অতীতের মোকাবিলা করে, তাতে প্রায়ই একধরনের ধাঁধারও তৈরি হয়। চরম সব সংকট-মুহূর্তে মানরোর এই কুয়াশাঘেরা বাস্তবতা-প্রতিবাস্তবতার নির্মাণ প্রকরণের দিক থেকে পরাবাস্তবতাবাদী। তবে যেহেতু মানরো খুব মেপে লেখেন, কোনোকিছু খোলাসা করতে তাঁর যেহেতু মহা এক অনীহা, তাই তাঁর পরাবাস্তবতাবাদ আমাদের ফ্যান্টাসিতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না; বরং লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া সব নাট্যমুহূর্তের মুখোমুখি করে। আমি কয়েকবার পড়ার পরও বুঝিনি কেন তাঁর শেষ বই ডিয়ার লাইফ-এর ‘গ্র্যাভেল’ গল্পের বাচ্চা মেয়েটিকে বরফে ভরা গর্তে পড়ে মারা যেতে হলো, কেন তার বড়ো বোন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল কিন্তু সাহায্যের জন্য চিৎকার করল না। সে কি ভেবেছিল যে তার বাবা-মা (ঠিক বাবা নয় এই লোক, সে তার মায়ের বয়ফ্রেন্ড) দরজা আটকে সেক্স করছে, অতএব এখন ডেকে বকা খাওয়া যাবে না? কী প্রচ্ছন্ন এক ভায়োলেন্স! আর কী চমৎকার এক কলমের শক্তি যে তাঁর গল্পগুলি সারাংশ করে শোনাতে গেলে সে সব কত সেন্টিমেন্টাল কাহিনির মতো শোনায়, কিন্তু পড়তে গেলে সেগুলো কত অন্যরকম—কত নিরাসক্ত, নির্মম তাঁর ভঙ্গিমা;
আর যত পারা যায় কম বলে বরং পাঠককে জীবনের বিশালত্বের মুখোমুখি হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে কী তাঁর সুকৌশলী বাচনভঙ্গি! মানরো সম্বন্ধে শেষ কথা এটাই যে, মানরোর গল্প ভয়ংকরভাবে এ পৃথিবীর যেকোনো মানুষেরই জীবনের গল্প। অন্য অর্থে, মানুষের পক্ষে যে সবকিছু সম্ভব, সব সৌন্দর্য ও কদর্যতা যে একই মুঠির মধ্যে ধরা সম্ভব, সেই বিশাল অনুমান-অসম্ভব মানবিক সম্ভাবনাগুলোরই গদ্যশিল্পী তিনি। মানরোকে বুঝতে হলে আপনার তাঁর গল্প পড়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। ‘পৃথিবীর সব জিনিসের মধ্যে কত জটিলতা, একটা জিনিসের মধ্যে কত কত জিনিস—একদম মনে হয় যেন অনিঃশেষ’—মানরোরই কথা এটা। জীবনকে আমরা সাধারণত সাদা চোখেই দেখি বলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বুঝতে পারি না যে একটা জিনিসের আড়ালে আরও কত কত অজানা জিনিস রয়েছে—কীভাবে যৌনবাসনার পেছনে আর্তনাদ করছে পাপবোধ আর কীভাবে ঈশ্বরবন্দনার আড়ালে হয়তো উঁকি মারছে মানুষ হত্যার মতো সর্পিল স্বপ্ন। তো এই যখন অবস্থা, তখন তো অ্যালিস মানরো আপনাকে পড়তেই হবে। আর মানরোর হুমায়ূন আহমেদীয় সরলতা যেহেতু বিশাল একটি ধোঁকা, তাই তাঁর গল্প না পড়ে তাঁর গল্প বিষয়ে অন্যের লেখা আপনি যতই পড়ুন না কেন, ধোঁকার সেই পর্দাটা সরাবেন কী করে?
No comments