বিশ্বায়নের কাল মিসরে ফৌজি দাপটের নেপথ্যে বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য? by কামাল আহমেদ
মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের
এতটাই মিল যে অনেকেই এতে ছয় বছর আগের বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন।
নিজ নিজ অবস্থানে অনড়, মোটা দাগে বিভক্ত দুটি রাজনৈতিক জোটের রাজপথ দখলের
প্রতিযোগিতার
মুখে বেসামরিক মোড়কের সামরিক শাসনের স্মৃতি অধিকাংশ বাংলাদেশির কাছে এখনো যথেষ্ট তাজা।
স্বৈরাচারী মোবারক শাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর সীমাহীন ক্ষমতাকে যতটা সম্ভব জবাবদিহির আওতায় আনা—সেই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহির বাইরেই থেকে গেল। গণজাগরণের সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনী মেয়েদের অনুসৃত ‘সতীত্ব পরীক্ষা’র (ভার্জিনিটি টেস্ট) প্রকাশ্য সমর্থক, তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান ও বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল এল সিসি এখন উদারপন্থী প্রগতিবাদীদের আস্থাভাজন বন্ধু। কেননা, ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট ও তাঁর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এসব উদারপন্থী আর কোনোভাবেই পেরে উঠছিলেন না।
পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্রিটেনই বলেছে যে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তারা নির্বাচিত সরকারকে পুনরুজ্জীবনের কথা না বলে প্রকারান্তরে এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৌশলে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে সবার প্রতিনিধিত্বশীল একটি বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দ্রুততম সময়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানোকে যাঁরা তাঁদের প্রধান ও পবিত্র কর্তব্য বলে প্রচার করে থাকেন, পাশ্চাত্যের সেসব দেশের দ্বিচারিতার এসব ব্যাখ্যা তাই গোঁজামিলে ভরা।
মিসরের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার কারণ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হলো এই যে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা প্রেসিডেন্ট মুরসি একদিকে যেমন দেশটির অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা না করে বরং দেশটিকে ইসলামীকরণের দিকেই বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন। অন্য আরেকটি মত হচ্ছে, ইসলামপন্থী এই গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকার কারণে ইসরায়েলের জন্য বিপদ বাড়ছে। তাদের মতে, গাজার ইসলামপন্থী হামাস গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করার যে নীতি ইসরায়েল দীর্ঘদিন অনুসরণ করে আসছিল, মোবারকের শাসনামলে সে ক্ষেত্রে যে ধরনের পরোক্ষ সহায়তা তারা পেত, মুরসির আমলে তা বদলে যায়। ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাই এ রকম সরকারের পরিবর্তনের বাসনা পোষণ করছিল।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাতিসংঘ—এই চতুষ্টয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত টনি ব্লেয়ার তাই যখন ব্রিটিশ পত্রিকা অবজারভার-এ নিবন্ধ পাঠিয়ে মন্তব্য করেন যে মিসরে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া উপায় ছিল না, তখন এই সন্দেহ আরও প্রবল হয়। কেননা, টনি ব্লেয়ারকে মুসলিম দেশগুলো কখনোই একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচনা করে না।
মিসরের এই নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে এসব কারণের প্রতিটিরই হয়তো ভূমিকা আছে। কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে। পাকিস্তানের চেয়েও বেশি করে মিসরের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি করে রেখেছে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে এরা কখনোই জবাবদিহিতে রাজি নয়।
মিসর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো এইচ এ হেইলার সিএনএনে দেওয়া বিশ্লেষণে জানান, ১৯৫২ সাল থেকে মিসরের রাজনৈতিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে সামরিক বাহিনী নামের প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সালে গণজাগরণের সময় সামরিক বাহিনী তাদেরই একজন—প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ত্যাগ করেছিল দেশ পরিচালনা থেকে নিজেদের দূরে রাখার জন্য নয়, বরং আরও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। হেইলার আরও জানান, জেনারেল তানতাওয়িকেও সেনাপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ প্রেসিডেন্ট মুরসি করেননি, সেনাবাহিনী নিজের থেকেই তা করেছে। জেনারেল এল সিসির সেনাপ্রধান হওয়া ছিল সেনাবাহিনীর নিজেদের পুনর্গঠন। তাঁর ভাষায়, সেনাবাহিনী নিজেদের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা কখনোই মুরসির নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ভাবেনি। সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পটভূমিতে প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী, জেনারেল মাহমুদ নাসর ঘোষণা দেন, সামরিক বাহিনীর প্রকল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ কখনোই অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে না। এসব প্রকল্পের আয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রকল্পেই ব্যয় করা হবে। এসব প্রকল্প হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রকল্প—ফৌজি বাণিজ্য। মিসরের ফৌজি বাণিজ্যের পরিধি কতটা বিস্তৃত, সে বিষয়ে নানাজনের নানা অনুমান। সবচেয়ে নিচের পরিমাণটি হচ্ছে, দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদনের ৮ শতাংশ, আর সর্বোচ্চ অনুমান হচ্ছে ৪০ শতাংশ।
মিসরীয় ফৌজের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে কী নেই? বিবিসির মাগদি আবদুল হাদি জানান, মিনারেল ওয়াটার থেকে শুরু করে নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী, ইলেকট্রনিকসহ বিভিন্ন রকমের ভোগ্যপণ্য তৈরির শিল্প, নির্মাণ খাতের ব্যবসা, খনিজ সম্পদ আহরণ, ভূমি উন্নয়ন, পর্যটন—সব খাতেই রয়েছে তাঁদের পদচারণ। কায়রোর পূর্বদিকে মরুভূমিতে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ‘নিউ কায়রো’, যেখানে একটি অবকাশযাপন কেন্দ্র, হোটেল ও একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। নিউ কায়রোর বিলাসবহুল ভিলাগুলোর মালিক হলেন সেনাবাহিনীর জেনারেল এবং ধনী ও ক্ষমতাধরেরা। নিউ কায়রোতে যেতে যাতে রাস্তায় তাঁদের যানজটে আটকে থাকতে না হয়, সে জন্য তাঁরা একটি পাঁচ লেনের সড়ক, একটি উড়ালসড়ক ও একটি টানেল তৈরি করেছেন। লোহিত সাগরের সৈকতের একটা বড় অংশ এবং নীল নদের তীরে পর্যটকদের আকর্ষণের বিশাল এলাকা সামরিক বাহিনীর সম্পদ।
সিএনবিসির সাবেক সাংবাদিক ব্যারি ল্যান্ডো যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টারপাঞ্চ সাময়িকীতে লিখেছেন, মিসরের সেনাবাহিনী দেশটির কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। বড় আকারের পশু খামার, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, মৎস্য খামার—সবকিছুতেই ফৌজি মালিকানা। এসব সামরিক ভূমি বিক্রির বিনিময়ে অনেক জেনারেলই বেসরকারি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার বনে গেছেন। ব্যারি ল্যান্ডো লিখেছেন, উইকিলিকসের কারণে আমরা জানতে পেরেছি যে ২০০৮ সালে কায়রোর এক কূটনীতিক ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরকে পাঠানো বার্তায় মিসরীয় সেনাবাহিনীর নানা ধরনের বাণিজ্যের বিবরণ তুলে ধরে লিখেছিলেন, মোবারকের পতন হলে তাঁর উত্তরাধিকারীকে তাঁরা ততক্ষণই মানবেন, যতক্ষণ তিনি সামরিক বাণিজ্যে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির এক প্রকাশনায় স্টিফেন এইচ গটোভিচকি লিখেছেন, তাঁর গবেষণার সময়কাল, ১৯৮৯ সালে মিসরীয় ফৌজের পরিচালনায় চালু ছিল ৩০টি প্রতিরক্ষা শিল্প বা সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা। ১৯৮৮ সালে তাদের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ডলার। ওই সব মুনাফা সামরিক বাহিনীর হিসাবে জমা হতো এবং তাতে সরকারি নিরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। সরকার তা থেকে কোনো করও পেত না।
গটোভিচকি লিখেছেন, সত্তরের দশক থেকে মিসরীয় সামরিক বাহিনী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে এবং ক্রমেই তা বিস্তৃত হতে থাকে। সামরিক বাহিনীর স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্য ছাড়াও তখনকার রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ধারণা ছিল যে সুশৃঙ্খল এবং প্রশিক্ষণ পাওয়া এই ফৌজ জাতীয় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে। আধুনিক মিসরের প্রতিষ্ঠাতা জামাল আবদেল নাসেরের সময় থেকেই সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় এমন ধারণাও চালু ছিল যে সামরিক বাহিনী এসব অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন না করলে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে এসবের নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে।
ফৌজি বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কোনো দিন সফল হবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে সংশয় অত্যন্ত প্রবল। তাঁরা এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মুরসির সংবিধান সংশোধনের সময়কার আপস রফার প্রতি ইঙ্গিত করছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে তিনি কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনতে পারেননি এবং সংশোধিত সংবিধানেও সেনাপ্রধানের জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ সংরক্ষিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর বাজেটকে বেসামরিক নিরীক্ষা থেকে রেহাই দেওয়া অব্যাহত রাখার বিষয়েও তিনি সম্মত হন।
রাষ্ট্রের ভেতরের এই ছায়ারাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সমঝোতা কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা হয়তো মুরসি কোনো দিন মুক্তি পেলে জানা যাবে। তবে গত কিছুদিনের রাজনৈতিক হাঙ্গামা ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকার পটভূমিতে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে ইসলামপন্থীরা ফৌজি সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন কি না, তাহলে তা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
স্বৈরাচারী মোবারক শাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর সীমাহীন ক্ষমতাকে যতটা সম্ভব জবাবদিহির আওতায় আনা—সেই সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহির বাইরেই থেকে গেল। গণজাগরণের সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের কৌশল হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনী মেয়েদের অনুসৃত ‘সতীত্ব পরীক্ষা’র (ভার্জিনিটি টেস্ট) প্রকাশ্য সমর্থক, তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান ও বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল এল সিসি এখন উদারপন্থী প্রগতিবাদীদের আস্থাভাজন বন্ধু। কেননা, ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট ও তাঁর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এসব উদারপন্থী আর কোনোভাবেই পেরে উঠছিলেন না।
পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্রিটেনই বলেছে যে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু তারা নির্বাচিত সরকারকে পুনরুজ্জীবনের কথা না বলে প্রকারান্তরে এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৌশলে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে সবার প্রতিনিধিত্বশীল একটি বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দ্রুততম সময়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রসার ঘটানোকে যাঁরা তাঁদের প্রধান ও পবিত্র কর্তব্য বলে প্রচার করে থাকেন, পাশ্চাত্যের সেসব দেশের দ্বিচারিতার এসব ব্যাখ্যা তাই গোঁজামিলে ভরা।
মিসরের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধ এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার কারণ সম্পর্কে যেসব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হলো এই যে মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা প্রেসিডেন্ট মুরসি একদিকে যেমন দেশটির অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা না করে বরং দেশটিকে ইসলামীকরণের দিকেই বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন। অন্য আরেকটি মত হচ্ছে, ইসলামপন্থী এই গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকার কারণে ইসরায়েলের জন্য বিপদ বাড়ছে। তাদের মতে, গাজার ইসলামপন্থী হামাস গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করার যে নীতি ইসরায়েল দীর্ঘদিন অনুসরণ করে আসছিল, মোবারকের শাসনামলে সে ক্ষেত্রে যে ধরনের পরোক্ষ সহায়তা তারা পেত, মুরসির আমলে তা বদলে যায়। ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র তাই এ রকম সরকারের পরিবর্তনের বাসনা পোষণ করছিল।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাতিসংঘ—এই চতুষ্টয়ের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত টনি ব্লেয়ার তাই যখন ব্রিটিশ পত্রিকা অবজারভার-এ নিবন্ধ পাঠিয়ে মন্তব্য করেন যে মিসরে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া উপায় ছিল না, তখন এই সন্দেহ আরও প্রবল হয়। কেননা, টনি ব্লেয়ারকে মুসলিম দেশগুলো কখনোই একজন সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচনা করে না।
মিসরের এই নাটকীয় পরিবর্তনের পেছনে এসব কারণের প্রতিটিরই হয়তো ভূমিকা আছে। কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হচ্ছে। পাকিস্তানের চেয়েও বেশি করে মিসরের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি করে রেখেছে। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে এরা কখনোই জবাবদিহিতে রাজি নয়।
মিসর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো এইচ এ হেইলার সিএনএনে দেওয়া বিশ্লেষণে জানান, ১৯৫২ সাল থেকে মিসরের রাজনৈতিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়েছে সামরিক বাহিনী নামের প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সালে গণজাগরণের সময় সামরিক বাহিনী তাদেরই একজন—প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ত্যাগ করেছিল দেশ পরিচালনা থেকে নিজেদের দূরে রাখার জন্য নয়, বরং আরও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। হেইলার আরও জানান, জেনারেল তানতাওয়িকেও সেনাপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ প্রেসিডেন্ট মুরসি করেননি, সেনাবাহিনী নিজের থেকেই তা করেছে। জেনারেল এল সিসির সেনাপ্রধান হওয়া ছিল সেনাবাহিনীর নিজেদের পুনর্গঠন। তাঁর ভাষায়, সেনাবাহিনী নিজেদের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে এবং তারা কখনোই মুরসির নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ভাবেনি। সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পটভূমিতে প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী, জেনারেল মাহমুদ নাসর ঘোষণা দেন, সামরিক বাহিনীর প্রকল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ কখনোই অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে না। এসব প্রকল্পের আয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রকল্পেই ব্যয় করা হবে। এসব প্রকল্প হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রকল্প—ফৌজি বাণিজ্য। মিসরের ফৌজি বাণিজ্যের পরিধি কতটা বিস্তৃত, সে বিষয়ে নানাজনের নানা অনুমান। সবচেয়ে নিচের পরিমাণটি হচ্ছে, দেশটির মোট জাতীয় উৎপাদনের ৮ শতাংশ, আর সর্বোচ্চ অনুমান হচ্ছে ৪০ শতাংশ।
মিসরীয় ফৌজের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যে কী নেই? বিবিসির মাগদি আবদুল হাদি জানান, মিনারেল ওয়াটার থেকে শুরু করে নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী, ইলেকট্রনিকসহ বিভিন্ন রকমের ভোগ্যপণ্য তৈরির শিল্প, নির্মাণ খাতের ব্যবসা, খনিজ সম্পদ আহরণ, ভূমি উন্নয়ন, পর্যটন—সব খাতেই রয়েছে তাঁদের পদচারণ। কায়রোর পূর্বদিকে মরুভূমিতে তাঁরা গড়ে তুলেছেন ‘নিউ কায়রো’, যেখানে একটি অবকাশযাপন কেন্দ্র, হোটেল ও একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। নিউ কায়রোর বিলাসবহুল ভিলাগুলোর মালিক হলেন সেনাবাহিনীর জেনারেল এবং ধনী ও ক্ষমতাধরেরা। নিউ কায়রোতে যেতে যাতে রাস্তায় তাঁদের যানজটে আটকে থাকতে না হয়, সে জন্য তাঁরা একটি পাঁচ লেনের সড়ক, একটি উড়ালসড়ক ও একটি টানেল তৈরি করেছেন। লোহিত সাগরের সৈকতের একটা বড় অংশ এবং নীল নদের তীরে পর্যটকদের আকর্ষণের বিশাল এলাকা সামরিক বাহিনীর সম্পদ।
সিএনবিসির সাবেক সাংবাদিক ব্যারি ল্যান্ডো যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্টারপাঞ্চ সাময়িকীতে লিখেছেন, মিসরের সেনাবাহিনী দেশটির কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। বড় আকারের পশু খামার, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র, মৎস্য খামার—সবকিছুতেই ফৌজি মালিকানা। এসব সামরিক ভূমি বিক্রির বিনিময়ে অনেক জেনারেলই বেসরকারি নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার বনে গেছেন। ব্যারি ল্যান্ডো লিখেছেন, উইকিলিকসের কারণে আমরা জানতে পেরেছি যে ২০০৮ সালে কায়রোর এক কূটনীতিক ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরকে পাঠানো বার্তায় মিসরীয় সেনাবাহিনীর নানা ধরনের বাণিজ্যের বিবরণ তুলে ধরে লিখেছিলেন, মোবারকের পতন হলে তাঁর উত্তরাধিকারীকে তাঁরা ততক্ষণই মানবেন, যতক্ষণ তিনি সামরিক বাণিজ্যে হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির এক প্রকাশনায় স্টিফেন এইচ গটোভিচকি লিখেছেন, তাঁর গবেষণার সময়কাল, ১৯৮৯ সালে মিসরীয় ফৌজের পরিচালনায় চালু ছিল ৩০টি প্রতিরক্ষা শিল্প বা সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা। ১৯৮৮ সালে তাদের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫৫ কোটি ডলার। ওই সব মুনাফা সামরিক বাহিনীর হিসাবে জমা হতো এবং তাতে সরকারি নিরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। সরকার তা থেকে কোনো করও পেত না।
গটোভিচকি লিখেছেন, সত্তরের দশক থেকে মিসরীয় সামরিক বাহিনী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে এবং ক্রমেই তা বিস্তৃত হতে থাকে। সামরিক বাহিনীর স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্য ছাড়াও তখনকার রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ধারণা ছিল যে সুশৃঙ্খল এবং প্রশিক্ষণ পাওয়া এই ফৌজ জাতীয় অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে। আধুনিক মিসরের প্রতিষ্ঠাতা জামাল আবদেল নাসেরের সময় থেকেই সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় এমন ধারণাও চালু ছিল যে সামরিক বাহিনী এসব অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন না করলে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে এসবের নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে।
ফৌজি বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কোনো দিন সফল হবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে সংশয় অত্যন্ত প্রবল। তাঁরা এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মুরসির সংবিধান সংশোধনের সময়কার আপস রফার প্রতি ইঙ্গিত করছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে তিনি কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনতে পারেননি এবং সংশোধিত সংবিধানেও সেনাপ্রধানের জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ সংরক্ষিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর বাজেটকে বেসামরিক নিরীক্ষা থেকে রেহাই দেওয়া অব্যাহত রাখার বিষয়েও তিনি সম্মত হন।
রাষ্ট্রের ভেতরের এই ছায়ারাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির সমঝোতা কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা হয়তো মুরসি কোনো দিন মুক্তি পেলে জানা যাবে। তবে গত কিছুদিনের রাজনৈতিক হাঙ্গামা ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকার পটভূমিতে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন যে ইসলামপন্থীরা ফৌজি সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন কি না, তাহলে তা কি খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments