ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপ-রাজনৈতিক দল দুর্নীতির শীর্ষে
বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো
রাজনৈতিক দল আর পুলিশ বিভাগ। তার পরই রয়েছে বিচার বিভাগ। ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত জরিপে বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য।
শুধু
বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী পরিচালিত টিআইয়ের জরিপ মতে, ২০১২ সালে গোটা
বিশ্বেই খাতওয়ারি দুর্নীতির শীর্ষে ছিল রাজনৈতিক দল। তবে বাংলাদেশে এই
অবস্থা এবারই প্রথম। এর আগে ২০১০ সালের জরিপে বাংলাদেশে দুর্নীতির ক্ষেত্রে
শীর্ষ স্থানে ছিল পুলিশ। ক্রমানুসারে দ্বিতীয় ছিল জনপ্রশাসন এবং তৃতীয়
স্থানে ছিল রাজনৈতিক দল।
তবে সারা বিশ্বে এবারের মতো গতবারও (২০১০) দুর্নীতির শীর্ষে ছিল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের ৯৩% মানুষের মতানুযায়ী এবার দুর্নীতির শীর্ষে উঠেছে রাজনৈতিক দল আর পুলিশ প্রশাসন সমান তালে। জরিপে রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিকে বৈশ্বিকভাবে ৬৫ শতাংশ মানুষ উদ্বেগজনক মনে করেছে আর বাংলাদেশে মনে করেছে ৪৫ শতাংশ মানুষ। এই জরিপ আরো বলছে, ধারণার বিচারে বাংলাদেশে দুর্নীতি সার্বিকভাবে বাড়লেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী গত দুই বছরে সরকারি সেবা খাতে ঘুষ দেওয়ার হার সামান্য হলেও কমেছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী একযোগে টিআইয়ের 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১২' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সকালে ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্টটি প্রকাশ করে এবং বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির শীর্ষ স্থানে রাজনৈতিক দলের উঠে আসা প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমাদের জরিপে রাজনৈতিক দলগুলো যে চিহ্নিত হয়েছে, তার একটা প্রেক্ষিত আছে। আমরা যখন জরিপটি পরিচালনা করি, তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা- এই ধরনের বিষয়গুলো ছিল। তারই একটা প্রতিফলন হতে পারে।'
বার্লিনভিত্তিক টিআই ১০৭টি দেশের এক লাখ ১৪ হাজার ২৭০ জনের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ওপর এই জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বয়সের এক হাজার ৮২২ জন তথ্যদাতার কাছ থেকে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগৃহীত হয়। এর ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের (বৈশ্বিক) ধারণা এবং বাংলাদেশের মানুষের ধারণার চিত্র তুলে ধরা হয়। এর আগে ২০১০ সালে এ রকম রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক দল কী ধরনের দুর্নীতি করছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো প্রশ্ন ছিল না বলে গতকালের টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। 'বাংলাদেশে টিআইবি বিরাজনীতিকরণের পক্ষে কথা বলে'- একজন সাংবাদিকের এমন কথার জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'বাংলাদেশের যত অর্জন সবক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা অবদান রাখছেন। যেহেতু তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাই মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতাগুলো আমলে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন আরো বেশি শক্তিশালী হোক, দৃঢ় হোক, দুর্নীতিমুক্ত হোক, জনমুখী হোক- এটাই আমাদের কাম্য।'
তিনি বলেন, 'আমাদের নেতারাই বিরাজনীতিকরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে বিরাজনীতিকরণের শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে দরকার স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা। মানুষ মনে করছে, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। তার মানে আমরা বলছি না, যাঁরা রাজনীতি করছেন তাঁরা সবাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।' সরকারে যাঁরা থাকেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই যদি আগ্রহী হয়, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ধারণার বিচারে জনসম্পৃক্ত ১২টি খাত/প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষস্থানে রাজনৈতিক দল ও পুলিশ প্রশাসনের পরেই রয়েছে বিচার বিভাগ (৮৯%)। এর পরে ক্রমানুসারে রয়েছে সংসদ/আইনসভা (বাংলাদেশে ৮৮%, বৈশ্বিক ৯০%), সরকারি প্রশাসন (বাংলাদেশে ৮৪%, বৈশ্বিক ৯৩%), ব্যবসা/বেসরকারি খাত (বাংলাদেশে ৮৩%, বৈশ্বিক ৯০%), স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা (বাংলাদেশে ৮১%, বৈশ্বিক ৮৭%), গণমাধ্যম (বাংলাদেশে ৬০%, বৈশ্বিক ৮৪%), শিক্ষা (বাংলাদেশে ৫৫%, বৈশ্বিক ৮৫%), এনজিও (বাংলাদেশে ৩৯%, বৈশ্বিক ৭৭%), সামরিক বাহিনী (বাংলাদেশে ৩২%, বৈশ্বিক ৭৯%) এবং ধর্মীয় সংগঠন/প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশে ৩২%, বৈশ্বিক ৭০%)।
৯০ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, বিশেষ মহল, বিশেষত রাজনৈতিক দল বা কর্মী এবং বিশেষ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দ্বারা সরকার বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে থাকে। তবে প্রভাব খাটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। সর্বোচ্চ হচ্ছে নেপাল (৯৯%)। এই ক্ষেত্রে ধারণার বৈশ্বিক হার হচ্ছে ৯৩ শতাংশ। আবার সরকারি সেবা গ্রহণে কোনো না কোনো একটি সেবা খাতে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৩৯%)। সর্বোচ্চ হচ্ছে ভারত ৫৪ শতাংশ, আর সর্বনিম্ন মালদ্বীপ ৩ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে পুলিশ, বিচার, ভূমি এবং লাইসেন্স ও পারমিট- এসব খাতের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতি বেশি; কিন্তু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিষেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি) এবং কর খাতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কম। পুলিশ- বৈশ্বিক ৩২%, বাংলাদেশে ৭২%, বিচার- বৈশ্বিক ২৫%, বাংলাদেশে ৬৩%, ভূমি- বৈশ্বিক ২২%, বাংলাদেশে ৪৪%, লাইসেন্স ও পারমিট- বৈশ্বিক ২২%, বাংলাদেশে ৩৩%, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা- বৈশ্বিক ১৯%, বাংলাদেশে ১৬%, শিক্ষা- বৈশ্বিক ১৭%, বাংলাদেশে ১২%, পরিষেবা- বৈশ্বিক ১৬%, বাংলাদেশে ১০% এবং কর- বৈশ্বিক ১৩%, বাংলাদেশে ৮%।
বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণায় বিগত দুই বছর অর্থাৎ ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। ২০১০ সালের জরিপে উত্তরদাতার এই হার ছিল ৪৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু-হলমার্ক-শেয়ারবাজার-রেল কেলেঙ্কারির ঘটনা এই ধারণার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। এই ধারণা যে অমূলক নয়, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর ফলাফলই এর প্রমাণ বলে টিআইবি মনে করে।
২০১১-২০১২ সালে দুর্নীতি বাড়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নেপাল ও পাকিস্তান; এটা ৭২ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণা।
এই জরিপে তথ্যদাতাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি আটটি খাতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষের হার কিছুটা কমেছে। খাতগুলো হলো পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, ভূমি-সেবা, লাইসেন্স ও পারমিট, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিষেবা এবং কর। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ ঘুষ কমেছে পরিষেবা অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি খাতে এবং শিক্ষা খাতে কমেছে ১৬ শতাংশ। ঘুষ প্রদানের কারণ হিসেবে ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র পথ।
মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিয়ে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির ধারণার মধ্যে ক্ষুদ্র, বৃহৎসহ সব ধরনের দুর্নীতি এবং গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞ মতামত অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা বলতে ক্ষুদ্র আকারের দুর্নীতিসংক্রান্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে বোঝানো হয়েছে। ধারণা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে জানানো হয়। তবে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েও তো কোনো ধারণা হতে পারে এমন প্রশ্নের স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
জরিপ অনুযায়ী দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপের ওপর মানুষের আস্তা কমেছে। বাংলাদেশের তথ্যদাতাদের ৩২ শতাংশের অভিমত হলো, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ অকার্যকর। ২০১০ সালের জরিপে ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করতেন দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। ২০১২ সালের জরিপে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপের ওপর আস্থা রেখেছেন মাত্র ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা।
দুর্নীতির ঘটনা জানানোর ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের ৩১.৪ শতাংশ জনপ্রতিনিধির ওপর আস্থাবান। ১৮.৮% জনের আস্থা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। দুদকের কাছে জানাতে চান ১১.৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের তথ্যদাতাদের ৯২ শতাংশ মনে করেন, সাধারণ জনগণ দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে এবং তথ্যদাতাদের শতভাগই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে আগ্রহী ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে এটাকে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক মনে করছে টিআইবি।
দুর্নীতি দূর করার সুপারিশ হিসেবে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো, নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, তথ্য অধিকার আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, আইনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবমুক্ত রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর করার কথা বলেছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিকুল হাসান ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহ্নূর রহমান। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপনির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের।
তবে সারা বিশ্বে এবারের মতো গতবারও (২০১০) দুর্নীতির শীর্ষে ছিল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের ৯৩% মানুষের মতানুযায়ী এবার দুর্নীতির শীর্ষে উঠেছে রাজনৈতিক দল আর পুলিশ প্রশাসন সমান তালে। জরিপে রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিকে বৈশ্বিকভাবে ৬৫ শতাংশ মানুষ উদ্বেগজনক মনে করেছে আর বাংলাদেশে মনে করেছে ৪৫ শতাংশ মানুষ। এই জরিপ আরো বলছে, ধারণার বিচারে বাংলাদেশে দুর্নীতি সার্বিকভাবে বাড়লেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী গত দুই বছরে সরকারি সেবা খাতে ঘুষ দেওয়ার হার সামান্য হলেও কমেছে।
গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী একযোগে টিআইয়ের 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১২' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সকালে ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্টটি প্রকাশ করে এবং বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির শীর্ষ স্থানে রাজনৈতিক দলের উঠে আসা প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমাদের জরিপে রাজনৈতিক দলগুলো যে চিহ্নিত হয়েছে, তার একটা প্রেক্ষিত আছে। আমরা যখন জরিপটি পরিচালনা করি, তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা- এই ধরনের বিষয়গুলো ছিল। তারই একটা প্রতিফলন হতে পারে।'
বার্লিনভিত্তিক টিআই ১০৭টি দেশের এক লাখ ১৪ হাজার ২৭০ জনের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ওপর এই জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বয়সের এক হাজার ৮২২ জন তথ্যদাতার কাছ থেকে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগৃহীত হয়। এর ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের (বৈশ্বিক) ধারণা এবং বাংলাদেশের মানুষের ধারণার চিত্র তুলে ধরা হয়। এর আগে ২০১০ সালে এ রকম রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক দল কী ধরনের দুর্নীতি করছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো প্রশ্ন ছিল না বলে গতকালের টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। 'বাংলাদেশে টিআইবি বিরাজনীতিকরণের পক্ষে কথা বলে'- একজন সাংবাদিকের এমন কথার জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'বাংলাদেশের যত অর্জন সবক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা অবদান রাখছেন। যেহেতু তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাই মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতাগুলো আমলে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন আরো বেশি শক্তিশালী হোক, দৃঢ় হোক, দুর্নীতিমুক্ত হোক, জনমুখী হোক- এটাই আমাদের কাম্য।'
তিনি বলেন, 'আমাদের নেতারাই বিরাজনীতিকরণের সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে বিরাজনীতিকরণের শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে দরকার স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা। মানুষ মনে করছে, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। তার মানে আমরা বলছি না, যাঁরা রাজনীতি করছেন তাঁরা সবাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।' সরকারে যাঁরা থাকেন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই যদি আগ্রহী হয়, তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ধারণার বিচারে জনসম্পৃক্ত ১২টি খাত/প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষস্থানে রাজনৈতিক দল ও পুলিশ প্রশাসনের পরেই রয়েছে বিচার বিভাগ (৮৯%)। এর পরে ক্রমানুসারে রয়েছে সংসদ/আইনসভা (বাংলাদেশে ৮৮%, বৈশ্বিক ৯০%), সরকারি প্রশাসন (বাংলাদেশে ৮৪%, বৈশ্বিক ৯৩%), ব্যবসা/বেসরকারি খাত (বাংলাদেশে ৮৩%, বৈশ্বিক ৯০%), স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা (বাংলাদেশে ৮১%, বৈশ্বিক ৮৭%), গণমাধ্যম (বাংলাদেশে ৬০%, বৈশ্বিক ৮৪%), শিক্ষা (বাংলাদেশে ৫৫%, বৈশ্বিক ৮৫%), এনজিও (বাংলাদেশে ৩৯%, বৈশ্বিক ৭৭%), সামরিক বাহিনী (বাংলাদেশে ৩২%, বৈশ্বিক ৭৯%) এবং ধর্মীয় সংগঠন/প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশে ৩২%, বৈশ্বিক ৭০%)।
৯০ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, বিশেষ মহল, বিশেষত রাজনৈতিক দল বা কর্মী এবং বিশেষ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দ্বারা সরকার বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত হয়ে থাকে। তবে প্রভাব খাটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। সর্বোচ্চ হচ্ছে নেপাল (৯৯%)। এই ক্ষেত্রে ধারণার বৈশ্বিক হার হচ্ছে ৯৩ শতাংশ। আবার সরকারি সেবা গ্রহণে কোনো না কোনো একটি সেবা খাতে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৩৯%)। সর্বোচ্চ হচ্ছে ভারত ৫৪ শতাংশ, আর সর্বনিম্ন মালদ্বীপ ৩ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে পুলিশ, বিচার, ভূমি এবং লাইসেন্স ও পারমিট- এসব খাতের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতি বেশি; কিন্তু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিষেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি) এবং কর খাতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কম। পুলিশ- বৈশ্বিক ৩২%, বাংলাদেশে ৭২%, বিচার- বৈশ্বিক ২৫%, বাংলাদেশে ৬৩%, ভূমি- বৈশ্বিক ২২%, বাংলাদেশে ৪৪%, লাইসেন্স ও পারমিট- বৈশ্বিক ২২%, বাংলাদেশে ৩৩%, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা- বৈশ্বিক ১৯%, বাংলাদেশে ১৬%, শিক্ষা- বৈশ্বিক ১৭%, বাংলাদেশে ১২%, পরিষেবা- বৈশ্বিক ১৬%, বাংলাদেশে ১০% এবং কর- বৈশ্বিক ১৩%, বাংলাদেশে ৮%।
বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণায় বিগত দুই বছর অর্থাৎ ২০১১-১২ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েছে। ২০১০ সালের জরিপে উত্তরদাতার এই হার ছিল ৪৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু-হলমার্ক-শেয়ারবাজার-রেল কেলেঙ্কারির ঘটনা এই ধারণার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে। এই ধারণা যে অমূলক নয়, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর ফলাফলই এর প্রমাণ বলে টিআইবি মনে করে।
২০১১-২০১২ সালে দুর্নীতি বাড়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নেপাল ও পাকিস্তান; এটা ৭২ শতাংশ উত্তরদাতার ধারণা।
এই জরিপে তথ্যদাতাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি আটটি খাতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষের হার কিছুটা কমেছে। খাতগুলো হলো পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, ভূমি-সেবা, লাইসেন্স ও পারমিট, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিষেবা এবং কর। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ ঘুষ কমেছে পরিষেবা অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি খাতে এবং শিক্ষা খাতে কমেছে ১৬ শতাংশ। ঘুষ প্রদানের কারণ হিসেবে ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই একমাত্র পথ।
মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দিয়ে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির ধারণার মধ্যে ক্ষুদ্র, বৃহৎসহ সব ধরনের দুর্নীতি এবং গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞ মতামত অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা বলতে ক্ষুদ্র আকারের দুর্নীতিসংক্রান্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে বোঝানো হয়েছে। ধারণা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে জানানো হয়। তবে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েও তো কোনো ধারণা হতে পারে এমন প্রশ্নের স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
জরিপ অনুযায়ী দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপের ওপর মানুষের আস্তা কমেছে। বাংলাদেশের তথ্যদাতাদের ৩২ শতাংশের অভিমত হলো, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ অকার্যকর। ২০১০ সালের জরিপে ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করতেন দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। ২০১২ সালের জরিপে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপের ওপর আস্থা রেখেছেন মাত্র ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা।
দুর্নীতির ঘটনা জানানোর ক্ষেত্রে উত্তরদাতাদের ৩১.৪ শতাংশ জনপ্রতিনিধির ওপর আস্থাবান। ১৮.৮% জনের আস্থা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। দুদকের কাছে জানাতে চান ১১.৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের তথ্যদাতাদের ৯২ শতাংশ মনে করেন, সাধারণ জনগণ দুর্নীতি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে এবং তথ্যদাতাদের শতভাগই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে আগ্রহী ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে এটাকে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক মনে করছে টিআইবি।
দুর্নীতি দূর করার সুপারিশ হিসেবে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো, নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, তথ্য অধিকার আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, আইনসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবমুক্ত রাখা, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর করার কথা বলেছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক রফিকুল হাসান ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহ্নূর রহমান। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপনির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের।
No comments