বহে কাল নিরবধি-গণতন্ত্রের দুঃসময় by এম আবদুল হাফিজ
দেশে এ মুহূর্তে একটি ভয়াবহ সংকট বিরাজ
করছে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে 'কার অধীনে কিভাবে দশম সংসদের নির্বাচন হবে'- এমন
প্রশ্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব চিহ্নিত করা হলেও সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে
নিবিড় পর্যবেক্ষণে তা এ দেশের গণতন্ত্রের সংকট বলেই প্রতীয়মান হয়।
স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে চার মূলনীতির
অন্যতম বলে স্বীকৃত হলেও গণতন্ত্র এ দেশে এত বেশি বিতর্কিত হয়েছে যে
রাজনীতিকরা বিভিন্ন সময়ে যে যাঁর মতো এর সংজ্ঞায়ন করেছেন। ফলে গণতন্ত্র তার
স্বরূপই হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি সামরিক শাসক বা স্বেচ্ছাচারী নির্বাচিত
সরকারগুলোও- তারা দেশে গণতন্ত্রেরই পথে হাঁটছে এবং এর দর্শনকেই স্থায়িত্ব,
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান ও এতে স্বীকৃত অধিকারকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে
দিতেই কাজ করছে।
কিন্তু বাস্তবে আমরা কী চাক্ষুস করছি? তাতে কি দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা আছে বলে মনে হয়? এ কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হয়, গণতন্ত্রের প্রধান মুখ্য প্রতীকগুলোর কোনো অভাব এ দেশেও নেই। এখানে সংবিধান, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন- এ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা-হস্তান্তর, পার্লামেন্ট, সংসদীয় বিতর্ক- এ সবই আছে। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য এখানে মারাত্মকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের একটি বহিরাবরণ থাকলেও এবং ক্ষমতাসীনদের ললাটে গণতন্ত্রের একটি লেবেল সেঁটে দেওয়া হলেও গণতন্ত্রের সুকুমার গুণগুলো যেমন সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, ভিন্ন মতে সহনশীলতা এবং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ শাসনের প্রবণতাকে আমরা এ দেশের রাজনীতিতে সযত্নে বর্জিত হতে দেখেছি। উপরন্তু ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকাকালীন নিষ্প্র্রোয়জনীয় দাম্ভিকতা, প্রতিপক্ষের দমনপীড়ন এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রত্যাশিতভাবেই এ দেশের গণতন্ত্রকে বিপথগামী করেছে।
এই বিপথগামিতার কদর্য চিহ্ন আমরা সর্বত্রই দেখতে পাই। আজ 'কার অধীনে আগামী নির্বাচন হবে'- এ বিতর্কের সৃষ্টিও এই গণতন্ত্রের বিপথগমনের পরিণতিতে। বিষয়টি নিজেই একটি নৈরাজ্যের প্রতীক। দুঃখজনকভাবে এই নৈরাজ্যকে ঘনীভূত করে ইস্যুটিকে ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের রাজনীতি। সরকারি দলের উদ্যোগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের বিলুপ্তি ছিল অনভিপ্রেত। স্বীকার করতেই হবে যে এখন দেশে যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা, তা কিন্তু এই পদক্ষেপেরই ফসল।
অনাকাঙ্ক্ষিত সাংবিধানিক সংশোধনীটি এনে সরকারি দল বর্তমান পরিস্থিতিকে উসকে দিয়েছে। যেকোনো যুক্তিবান মানুষ স্বীকার করবেন যে এতে বিরোধী দলের রাজনীতিতে প্রসপেক্ট (Prospect) অনেক সীমিত হয়ে এসেছে এবং তাদের রাজনৈতিক পরিসর অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। সে জন্যই বিরোধী এই ইস্যুসহ আরো কয়েকটি ইস্যুতে ইদানীং অক্ষম আন্দোলনও করেছে। বিরোধী দল স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সংসদে আলোচনার জন্য এ ইস্যুতে একটি মুলতবি প্রস্তাব দিলেও অজ্ঞাত কারণে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সে জন্য অবশ্য তাদের প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামীদের জাতির সঙ্গে বেইমানির অপবাদও পেতে হয়েছে।
আসলে সরকারি দলের একেক সময় একেক স্ট্যান্ড ইস্যুটিকে ঘিরে অনেক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি সম্ভবত বুঝতেই অক্ষম যে সরকারি হুমকি-ধামকি দলটির জন্য কী বার্তা বহন করে। বিরোধী দলের জন্য সরকারি আচরণ এ দেশে বরাবরই ওপরওয়ালার মতো। ওপরওয়ালার মর্জি সব সময় সবার জন্য বোধগম্যও হয় না। তাই বিরোধী দল তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তাদের পরবর্তী চাল চালবার আগে যে বিভ্রান্ত হচ্ছে সেটা তাদের কিছু কিছু মন্তব্যে বোঝা যায়। কিন্তু বিরোধী দলকে এভাবে বোকা বানিয়ে সরকারি দলেরও কি কোনো লাভ আছে? আফটারঅল, যেই পরিচালনা করুক নির্বাচন তো একটা হতেই হবে এবং সেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে প্রয়োজন। ধরা যাক, সরকারি দল আগামী নির্বাচনেও ভূমিধস জয় পেল; কিন্তু তা বিরোধী দলের বিনা অংশগ্রহণে। সেই জয় কি আওয়ামী লীগের ধরে রাখা সম্ভব হবে?
তাই একটি সংলাপের মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বা ব্যবস্থায় নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগেরই লাভ। প্রধানমন্ত্রীসহ সব আওয়ামী নেতা তাঁদের গত চার বছরের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পারফরম্যান্সে তাঁরা তো জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই আছেন। তাই তাঁদেরই লাভ, যদি অন্যদের অংশগ্রহণে নির্বাচন করিয়ে তাঁদের জয়কে নিষ্কণ্টক করে রাখতে পারেন। তার জন্য অবশ্যই আলোচনার ভেতর দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা সর্বসম্মতিক্রমে আগেই চূড়ান্ত করে রাখা।
কোনো এক দলীয় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ আবার বিএনপিকে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের মুলতবি প্রস্তাব পাঠাতে বলেছেন। তিনি এ-ও নিশ্চিত করেছেন যে প্রস্তাবটি আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার শিকার হবে না। উল্লেখ্য যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর অনেক অনুষ্ঠানের অনেক বক্তৃতামালায় কোথায়ও সম্প্রতি এ কথাও বলেছিলেন যে সংবিধানে যেমনভাবে আছে সেই পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে- চাই তাতে বিএনপি আসুক বা না আসুক। তার পরও সৈয়দ আশরাফ কিন্তু তাঁর আশাজাগানিয়া মুলতবি প্রস্তাব পুনঃপ্রেরণের কথা বলেছেন। ধোঁয়াশাই বটে!
তবে নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামোর বিষয়টি শুধু দুই প্রধান দল নয়, সমগ্র দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্ব রাখে। উভয় তা উপলব্ধি করলেও স্ব-আরোপিত আত্মাভিমান তাদের যুক্তির পথকে রুদ্ধ করে। আমরা এমন আশা তো করতে পারি যে অবিরাম প্রচেষ্টায় দেশের গুণীজনরা রুদ্ধ পথকে উন্মুক্ত করতে পারেন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
কিন্তু বাস্তবে আমরা কী চাক্ষুস করছি? তাতে কি দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা আছে বলে মনে হয়? এ কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হয়, গণতন্ত্রের প্রধান মুখ্য প্রতীকগুলোর কোনো অভাব এ দেশেও নেই। এখানে সংবিধান, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন- এ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা-হস্তান্তর, পার্লামেন্ট, সংসদীয় বিতর্ক- এ সবই আছে। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সৌন্দর্য এখানে মারাত্মকভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের একটি বহিরাবরণ থাকলেও এবং ক্ষমতাসীনদের ললাটে গণতন্ত্রের একটি লেবেল সেঁটে দেওয়া হলেও গণতন্ত্রের সুকুমার গুণগুলো যেমন সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, ভিন্ন মতে সহনশীলতা এবং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ শাসনের প্রবণতাকে আমরা এ দেশের রাজনীতিতে সযত্নে বর্জিত হতে দেখেছি। উপরন্তু ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় থাকাকালীন নিষ্প্র্রোয়জনীয় দাম্ভিকতা, প্রতিপক্ষের দমনপীড়ন এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রত্যাশিতভাবেই এ দেশের গণতন্ত্রকে বিপথগামী করেছে।
এই বিপথগামিতার কদর্য চিহ্ন আমরা সর্বত্রই দেখতে পাই। আজ 'কার অধীনে আগামী নির্বাচন হবে'- এ বিতর্কের সৃষ্টিও এই গণতন্ত্রের বিপথগমনের পরিণতিতে। বিষয়টি নিজেই একটি নৈরাজ্যের প্রতীক। দুঃখজনকভাবে এই নৈরাজ্যকে ঘনীভূত করে ইস্যুটিকে ঘিরে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের রাজনীতি। সরকারি দলের উদ্যোগে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের বিলুপ্তি ছিল অনভিপ্রেত। স্বীকার করতেই হবে যে এখন দেশে যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা, তা কিন্তু এই পদক্ষেপেরই ফসল।
অনাকাঙ্ক্ষিত সাংবিধানিক সংশোধনীটি এনে সরকারি দল বর্তমান পরিস্থিতিকে উসকে দিয়েছে। যেকোনো যুক্তিবান মানুষ স্বীকার করবেন যে এতে বিরোধী দলের রাজনীতিতে প্রসপেক্ট (Prospect) অনেক সীমিত হয়ে এসেছে এবং তাদের রাজনৈতিক পরিসর অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। সে জন্যই বিরোধী এই ইস্যুসহ আরো কয়েকটি ইস্যুতে ইদানীং অক্ষম আন্দোলনও করেছে। বিরোধী দল স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সংসদে আলোচনার জন্য এ ইস্যুতে একটি মুলতবি প্রস্তাব দিলেও অজ্ঞাত কারণে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সে জন্য অবশ্য তাদের প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামীদের জাতির সঙ্গে বেইমানির অপবাদও পেতে হয়েছে।
আসলে সরকারি দলের একেক সময় একেক স্ট্যান্ড ইস্যুটিকে ঘিরে অনেক ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি সম্ভবত বুঝতেই অক্ষম যে সরকারি হুমকি-ধামকি দলটির জন্য কী বার্তা বহন করে। বিরোধী দলের জন্য সরকারি আচরণ এ দেশে বরাবরই ওপরওয়ালার মতো। ওপরওয়ালার মর্জি সব সময় সবার জন্য বোধগম্যও হয় না। তাই বিরোধী দল তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তাদের পরবর্তী চাল চালবার আগে যে বিভ্রান্ত হচ্ছে সেটা তাদের কিছু কিছু মন্তব্যে বোঝা যায়। কিন্তু বিরোধী দলকে এভাবে বোকা বানিয়ে সরকারি দলেরও কি কোনো লাভ আছে? আফটারঅল, যেই পরিচালনা করুক নির্বাচন তো একটা হতেই হবে এবং সেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে প্রয়োজন। ধরা যাক, সরকারি দল আগামী নির্বাচনেও ভূমিধস জয় পেল; কিন্তু তা বিরোধী দলের বিনা অংশগ্রহণে। সেই জয় কি আওয়ামী লীগের ধরে রাখা সম্ভব হবে?
তাই একটি সংলাপের মাধ্যমে সবার গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বা ব্যবস্থায় নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগেরই লাভ। প্রধানমন্ত্রীসহ সব আওয়ামী নেতা তাঁদের গত চার বছরের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পারফরম্যান্সে তাঁরা তো জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই আছেন। তাই তাঁদেরই লাভ, যদি অন্যদের অংশগ্রহণে নির্বাচন করিয়ে তাঁদের জয়কে নিষ্কণ্টক করে রাখতে পারেন। তার জন্য অবশ্যই আলোচনার ভেতর দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা সর্বসম্মতিক্রমে আগেই চূড়ান্ত করে রাখা।
কোনো এক দলীয় অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ আবার বিএনপিকে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের মুলতবি প্রস্তাব পাঠাতে বলেছেন। তিনি এ-ও নিশ্চিত করেছেন যে প্রস্তাবটি আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার শিকার হবে না। উল্লেখ্য যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর অনেক অনুষ্ঠানের অনেক বক্তৃতামালায় কোথায়ও সম্প্রতি এ কথাও বলেছিলেন যে সংবিধানে যেমনভাবে আছে সেই পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে- চাই তাতে বিএনপি আসুক বা না আসুক। তার পরও সৈয়দ আশরাফ কিন্তু তাঁর আশাজাগানিয়া মুলতবি প্রস্তাব পুনঃপ্রেরণের কথা বলেছেন। ধোঁয়াশাই বটে!
তবে নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামোর বিষয়টি শুধু দুই প্রধান দল নয়, সমগ্র দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্ব রাখে। উভয় তা উপলব্ধি করলেও স্ব-আরোপিত আত্মাভিমান তাদের যুক্তির পথকে রুদ্ধ করে। আমরা এমন আশা তো করতে পারি যে অবিরাম প্রচেষ্টায় দেশের গুণীজনরা রুদ্ধ পথকে উন্মুক্ত করতে পারেন।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
No comments