গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন শীর্ষক গোলটেবিল প্রতিহিংসার রাজনীতি আর নয়
প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে রাজনৈতিক
দলগুলোর মধ্যে এখনই সমঝোতা হওয়া দরকার। এ জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। তা না
হলে দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস ফিরবে না।
নির্বাচন পদ্ধতি, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি স্থিতিশীল অবস্থা দাঁড় করানো যাবে না।
প্রথম আলো আয়োজিত ‘গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় রাজনৈতিক দলের নেতা ও নানা পেশার মানুষ এই অভিমত ব্যক্ত করেন। বৈঠকে বিএনপি বলেছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতি তারা তাদের পরবর্তী নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করবে।
গোলটেবিল আলোচনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধানে এখন যেভাবে বলা আছে, সেই পদ্ধতিতে অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। তবে দুই দলই চায় নির্বাচন হোক সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সভাকক্ষে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আলোচনায় বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ও হোসেন জিল্লুর রহমান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন হামিদা হোসেন, অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, অধ্যাপক হাসানুজ্জামান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম ও নারীনেত্রী শিরীন আখতার। সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বক্তব্যের শুরুতে শামসুল হুদা বলেন, এখন ভোট জালিয়াতি করা অত্যন্ত দুরূহ। কেন্দ্র দখল বা ভোটারদের আসতে না দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এই নির্বাচন কমিশন বিগত নির্বাচন কমিশনের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। কারণ, সাংসদেরা নির্বাচনে অযাচিত প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনকালীন সরকার নির্দলীয়, না দলীয়: আলোচনার শুরুতে রেহমান সোবহান বলেন, ‘তিনটি দলের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এখানে আছেন। আমি চাইব, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় কি না, সে ব্যাপারে তাঁরা বক্তব্য দেবেন। কীভাবে দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস এনে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হতে পারে, সে ব্যাপারে তাঁরা তাঁদের অবস্থান তুলে ধরবেন।’
এরপর তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২৫ অক্টোবর থেকে সংসদ ভেঙে যাবে। তখন কোনো সংসদ সদস্য নিজ পদে থাকবেন না। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ দৈনন্দিন কাজ করবে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো চলে যাবে নির্বাচন কমিশনের হাতে। কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে সরকার এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এবং তাতে সব দলের অংশগ্রহণ চান তাঁরা।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ কারচুপির রাজনীতি করেনি। বিএনপিকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, এখন আর কারচুপি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় না। নির্বাচনে প্রভাব ফেলা যায় না।
তবে খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিএনপি এ ধরনের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করে না। বিএনপির প্রস্তাব হলো, দুটি বড় জোট আলোচনার মাধ্যমে ১০ জন নির্দলীয় ব্যক্তিকে বাছাই করবে। ওই ১০ জন একজন প্রধানকে বেছে নেবেন। বিএনপি মনে করে, এটা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সব দল সমান সুবিধা পাবে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সংবিধান সংশোধনের সময় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা আরও দুই মেয়াদের জন্য রাখার কথা ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কারণে সংবিধান থেকে তা বাতিল করা হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাই যে হবেন, তা তো বলা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল না করলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতো বলে মনে করেন জাতীয় পার্টির এই নেতা।
তিন রাজনীতিবিদের এমন অবস্থানের ব্যাপারে বক্তব্য তুলে ধরেন অন্য বক্তারা। তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, খুব দ্রুত আলোচনায় বসতে হবে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
আকবর আলি খান বলেন, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক সংকট হবে না। তবে রাজনৈতিক সমস্যা হলে ভিন্ন। দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না।
বন্ধ হোক প্রতিহিংসার রাজনীতি: বক্তারা বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের পর পরাজিত পক্ষের ওপর প্রতিহিংসামূলক আচরণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করছে। এটা বন্ধ করতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের পর প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের রাজনীতি দেখা যায়। এই ধারা কাউকে না কাউকে ভাঙতে হবে।
শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচনের পর নানা ঘটনার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ জন্য দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে অনেক সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, শেখ হাসিনা বলছেন, ওয়েস্ট মিনস্টার স্টাইলে নির্বাচন হবে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তো এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। যেখানে দুই প্রধান দলের দুই নেত্রী একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেন না, কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্কে নামেন না, সেখানে কীভাবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব? তিনি উপস্থিত তিনটি দলের নেতার কাছে প্রশ্ন করেন, এই আস্থাহীনতায় কীভাবে সরকার অন্যান্য দলকে নির্বাচনে আনবে? কী জাদু দেখাবে? তাঁর প্রশ্ন, বড় দুটি জোট বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ধরনের সমঝোতায় গিয়ে নির্বাচন করবে?
শিরীন আখতার বলেন, নির্যাতনের শিকার হন নারী ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ পরিহার করার আহ্বান জানান। নারীদের নিয়ে কটূক্তি করায় তিনি হেফাজতে ইসলামের সমালোচনা করেন।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে জাতীয় সমঝোতা ও ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তাঁর দল এ বিষয়টি নির্বাচনী ইশতেহারে আনবে।
মাহবুবউল্লাহ বলেন, বিরোধী দলের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা সরকারি দলের মাথায় আনা যাবে না। এটা ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক চিন্তা। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ করতে সামাজিক চুক্তি ও সমঝোতায় আসতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
হোসেন জিল্লুর বলেন, এখন যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁদের অনেকের বুকে প্রতিহিংসা ধিকিধিকি জ্বলছে। এর অবসান না হলে কিছুই হবে না।
হামিদা হোসেন বলেন, নির্বাচনের পর নারী ও হিন্দুদের ওপর হুমকি থাকে। এর অবসান হওয়া উচিত।
শুরু করতে হবে আলোচনা: রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এখনই প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোটকে আলোচনায় বসার তাগিদ দেন বক্তারা। তবে কেউ কেউ সংলাপ বা আলোচনার সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে শামসুল হুদা বলেন, রাজনীতিতে এখন সংকট হলো, আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে। এর সমাধান নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের হাতে নেই। এর সমাধান করতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো। এ জন্য তাদের আলোচনায় বসতে হবে। একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে অন্য দেশের কোনো কিছু অনুসরণ করতে হলে সেই দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা, বিতর্কের বিষয়টি অনুসরণ করতে হবে।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিএনপিকে বাইরে রেখে সরকারের নির্বাচনের পরিকল্পনা টিকবে না। এখন সমস্যার সমাধান হতে হবে টেবিলে। এখনই কার্যকর আলোচনা শুরু করা দরকার।
আনিসুল ইসলাম বলেন, দুই দলকে সমঝোতায় আসতে হবে। এ জন্য কথা বলা দরকার।
আসিফ ইব্রাহিম বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রতিদিনের হরতালে ক্ষতি হয় প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এগোতে পারবে না। তিনি দুই দলের ১৫ জনকে নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন এবং সেই মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের সদস্যদের কাছে সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়ার একটি রূপরেখা দেন।
মাহবুবউল্লাহ বলেন, মন খুলে আলোচনা করতে হবে। মনের মধ্যে কিছু রেখে আলোচনা হলে তা সফল হবে না।
আকবর আলি খান দলগুলোকে বসে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
হাসানুজ্জামান বলেন, যেভাবে দলগুলো চলছে সেভাবে রাষ্ট্রের রাজনীতি চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি দলের সঙ্গে আরেকটি দলের আলোচনা হওয়া দরকার।
তবে সংলাপে সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন। হোসেন জিল্লুর বলেন, সংলাপ হবে কি না সংশয় আছে। তা ছাড়া শুধু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সংলাপ হলে কোনো সমাধান আসবে না। দলগুলোকে নতুন নতুন প্রস্তাব ও চিন্তা আনতে হবে।
হামিদা হোসেন বলেন, এখানে দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করে না। গ্রামীণ ব্যাংক ও পদ্মা সেতুর মতো বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
আলোচনার শেষে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হতে হবে। সেটা করার জন্য প্রধান দুই জোটকে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে।
প্রথম আলো আয়োজিত ‘গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় রাজনৈতিক দলের নেতা ও নানা পেশার মানুষ এই অভিমত ব্যক্ত করেন। বৈঠকে বিএনপি বলেছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি না করার প্রতিশ্রুতি তারা তাদের পরবর্তী নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করবে।
গোলটেবিল আলোচনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবিধানে এখন যেভাবে বলা আছে, সেই পদ্ধতিতে অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। তবে দুই দলই চায় নির্বাচন হোক সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সভাকক্ষে গতকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত আলোচনায় বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ও হোসেন জিল্লুর রহমান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন হামিদা হোসেন, অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, অধ্যাপক হাসানুজ্জামান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম ও নারীনেত্রী শিরীন আখতার। সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বক্তব্যের শুরুতে শামসুল হুদা বলেন, এখন ভোট জালিয়াতি করা অত্যন্ত দুরূহ। কেন্দ্র দখল বা ভোটারদের আসতে না দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এই নির্বাচন কমিশন বিগত নির্বাচন কমিশনের অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। কারণ, সাংসদেরা নির্বাচনে অযাচিত প্রভাব ফেলার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনকালীন সরকার নির্দলীয়, না দলীয়: আলোচনার শুরুতে রেহমান সোবহান বলেন, ‘তিনটি দলের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এখানে আছেন। আমি চাইব, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় কি না, সে ব্যাপারে তাঁরা বক্তব্য দেবেন। কীভাবে দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস এনে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হতে পারে, সে ব্যাপারে তাঁরা তাঁদের অবস্থান তুলে ধরবেন।’
এরপর তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২৫ অক্টোবর থেকে সংসদ ভেঙে যাবে। তখন কোনো সংসদ সদস্য নিজ পদে থাকবেন না। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ দৈনন্দিন কাজ করবে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো চলে যাবে নির্বাচন কমিশনের হাতে। কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে সরকার এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এবং তাতে সব দলের অংশগ্রহণ চান তাঁরা।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ কারচুপির রাজনীতি করেনি। বিএনপিকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, এখন আর কারচুপি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় না। নির্বাচনে প্রভাব ফেলা যায় না।
তবে খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিএনপি এ ধরনের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে মনে করে না। বিএনপির প্রস্তাব হলো, দুটি বড় জোট আলোচনার মাধ্যমে ১০ জন নির্দলীয় ব্যক্তিকে বাছাই করবে। ওই ১০ জন একজন প্রধানকে বেছে নেবেন। বিএনপি মনে করে, এটা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সব দল সমান সুবিধা পাবে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সংবিধান সংশোধনের সময় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা আরও দুই মেয়াদের জন্য রাখার কথা ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কারণে সংবিধান থেকে তা বাতিল করা হয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাই যে হবেন, তা তো বলা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক বাতিল না করলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতো বলে মনে করেন জাতীয় পার্টির এই নেতা।
তিন রাজনীতিবিদের এমন অবস্থানের ব্যাপারে বক্তব্য তুলে ধরেন অন্য বক্তারা। তাঁরা আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, খুব দ্রুত আলোচনায় বসতে হবে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
আকবর আলি খান বলেন, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক সংকট হবে না। তবে রাজনৈতিক সমস্যা হলে ভিন্ন। দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না।
বন্ধ হোক প্রতিহিংসার রাজনীতি: বক্তারা বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের পর পরাজিত পক্ষের ওপর প্রতিহিংসামূলক আচরণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করছে। এটা বন্ধ করতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের পর প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের রাজনীতি দেখা যায়। এই ধারা কাউকে না কাউকে ভাঙতে হবে।
শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচনের পর নানা ঘটনার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। এ জন্য দলগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে অনেক সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, শেখ হাসিনা বলছেন, ওয়েস্ট মিনস্টার স্টাইলে নির্বাচন হবে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে তো এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। যেখানে দুই প্রধান দলের দুই নেত্রী একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেন না, কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্কে নামেন না, সেখানে কীভাবে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা সম্ভব? তিনি উপস্থিত তিনটি দলের নেতার কাছে প্রশ্ন করেন, এই আস্থাহীনতায় কীভাবে সরকার অন্যান্য দলকে নির্বাচনে আনবে? কী জাদু দেখাবে? তাঁর প্রশ্ন, বড় দুটি জোট বর্তমান পরিস্থিতিতে কী ধরনের সমঝোতায় গিয়ে নির্বাচন করবে?
শিরীন আখতার বলেন, নির্যাতনের শিকার হন নারী ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি বিরোধীদলীয় নেতাকে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ পরিহার করার আহ্বান জানান। নারীদের নিয়ে কটূক্তি করায় তিনি হেফাজতে ইসলামের সমালোচনা করেন।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে জাতীয় সমঝোতা ও ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তাঁর দল এ বিষয়টি নির্বাচনী ইশতেহারে আনবে।
মাহবুবউল্লাহ বলেন, বিরোধী দলের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা সরকারি দলের মাথায় আনা যাবে না। এটা ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক চিন্তা। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ করতে সামাজিক চুক্তি ও সমঝোতায় আসতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
হোসেন জিল্লুর বলেন, এখন যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁদের অনেকের বুকে প্রতিহিংসা ধিকিধিকি জ্বলছে। এর অবসান না হলে কিছুই হবে না।
হামিদা হোসেন বলেন, নির্বাচনের পর নারী ও হিন্দুদের ওপর হুমকি থাকে। এর অবসান হওয়া উচিত।
শুরু করতে হবে আলোচনা: রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এখনই প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোটকে আলোচনায় বসার তাগিদ দেন বক্তারা। তবে কেউ কেউ সংলাপ বা আলোচনার সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে শামসুল হুদা বলেন, রাজনীতিতে এখন সংকট হলো, আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে। এর সমাধান নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনের হাতে নেই। এর সমাধান করতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো। এ জন্য তাদের আলোচনায় বসতে হবে। একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে অন্য দেশের কোনো কিছু অনুসরণ করতে হলে সেই দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা, বিতর্কের বিষয়টি অনুসরণ করতে হবে।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিএনপিকে বাইরে রেখে সরকারের নির্বাচনের পরিকল্পনা টিকবে না। এখন সমস্যার সমাধান হতে হবে টেবিলে। এখনই কার্যকর আলোচনা শুরু করা দরকার।
আনিসুল ইসলাম বলেন, দুই দলকে সমঝোতায় আসতে হবে। এ জন্য কথা বলা দরকার।
আসিফ ইব্রাহিম বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রতিদিনের হরতালে ক্ষতি হয় প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে দেশ এগোতে পারবে না। তিনি দুই দলের ১৫ জনকে নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন এবং সেই মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের সদস্যদের কাছে সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়ার একটি রূপরেখা দেন।
মাহবুবউল্লাহ বলেন, মন খুলে আলোচনা করতে হবে। মনের মধ্যে কিছু রেখে আলোচনা হলে তা সফল হবে না।
আকবর আলি খান দলগুলোকে বসে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
হাসানুজ্জামান বলেন, যেভাবে দলগুলো চলছে সেভাবে রাষ্ট্রের রাজনীতি চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি দলের সঙ্গে আরেকটি দলের আলোচনা হওয়া দরকার।
তবে সংলাপে সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন। হোসেন জিল্লুর বলেন, সংলাপ হবে কি না সংশয় আছে। তা ছাড়া শুধু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সংলাপ হলে কোনো সমাধান আসবে না। দলগুলোকে নতুন নতুন প্রস্তাব ও চিন্তা আনতে হবে।
হামিদা হোসেন বলেন, এখানে দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করে না। গ্রামীণ ব্যাংক ও পদ্মা সেতুর মতো বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
আলোচনার শেষে আব্দুল কাইয়ুম বলেন, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হতে হবে। সেটা করার জন্য প্রধান দুই জোটকে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে।
No comments