রাজনীতি আওয়ামী লীগের সামনে কি সব অন্ধকার? by আবদুল মান্নান
৬ জুলাই রাতে বিটিভিতে গাজীপুর সিটি
করপোরেশন নিয়ে একটি অনুষ্ঠান রেকর্ডিং শেষে বাসায় ফিরছিলাম। সাতটায় যখন
বিটিভিতে পৌঁছাই, তখন গাজীপুরের নির্বাচনের ফলাফল আসতে শুরু করেছে।
মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রের ফলাফলে দেখা গেল, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী এম এ
মান্নান আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে আছেন। বুঝতে অসুবিধা হয়
না ফলাফল কোন দিকে যাচ্ছে। তার পরও দেখি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টিভির পর্দায় গলা ফাটিয়ে বলছেন, গাজীপুরে
নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য সরকার তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নে
ব্যস্ত। রাত সাড়ে নয়টায় বিটিভি ভবন থেকে বের হওয়ার আগে জানলাম, এম এ
মান্নান ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকার জনগণ
তাঁকে তাঁদের প্রথম মেয়র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের পছন্দ ভালো হয়েছে কি মন্দ, সেই বিচারে না গিয়ে তাঁদের এবং বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন।
সোনারগাঁও হোটেলের সামনে ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম। চট্টগ্রাম থেকে একাত্তরের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার এক বাল্যবন্ধু টেলিফোনে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে জানতে চায়, ‘এবার আওয়ামী লীগ কী করবে?’ তাকে বলি, কী করে বলি, আমি তো আওয়ামী লীগের দুই টাকার সদস্যও না। বন্ধুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘তাহলে কেন আমি আওয়ামী লীগের এত “দালালি” করি?’ আমি বলি, দালালি নয়, তবে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এখনো সমর্থন করি। কারণ, বাংলাদেশে কোনো দল যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে, তাহলে সেটি আওয়ামী লীগ, তার বিকল্প তো এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। সুতরাং তাকে ঘিরে এখনো স্বপ্ন দেখি। কারণ, তাদের বিকল্প যারা আসবে বলে জনগণের ধারণা, তারা তো বছর না ঘুরতেই দেশটাকে একটি আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তান বানিয়ে ফেলতে পারে। পরদিন আমার আর এক বন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করে। কারণ, সে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছে। যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য, তার মামলায় রায় এখনো হয়নি। তার ধারণা, সরকার তলে তলে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করার চেষ্টা করছে এবং সেই কারণেই রায় দিতে দেরি করছে। তাকে বলি, রায় তো সরকার দেয় না, দেন আদালত। জবাবে সে বলে, ‘কথা একই।’ বন্ধু দেশত্যাগে ইচ্ছুক। কারণ, এমন একটা পরিস্থিতিতে সে দেশে থাকাটা নিরাপদ মনে করছে না। আমার মতামত জানতে চায়। বলি, এটা তার ইচ্ছা। আমার মতো মানুষদের তো দেশেই থাকতে হবে। কারণ, আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। চট্টগ্রাম থেকে এক কলেজশিক্ষক ফোন করে সব কটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হারের পেছনে আরেকটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। আওয়ামী লীগ সরকার নারীদের অনেক ক্ষমতা দিয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে। তাঁর মতে, সাধারণ নারীরা এতে অখুশি। কারণ, তাঁদের মধ্যে হয়তো একটা ঈর্ষাবোধ কাজ করে এবং এ কারণেই নির্বাচনের দিন নারীদের ব্যাপক উপস্থিতির অর্থ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত। বুঝলাম সেই কলেজশিক্ষক কিছুটা নারীবিদ্বেষী এবং তাঁর মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িকতার ভাবও আছে।
সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে পণ্ডিতজনেরা নানা চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নিজের কোনো চিন্তা বা বিচার-বিশ্লেষণ আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যাদের জনবিচ্ছিন্নতার রোগে পেয়ে বসে, তাদের বিপদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। অনেকে বাগদাদের বাদশা হারুন-উর-রশিদের কাহিনি পড়ে থাকবেন। রাত নামলেই তিনি ছদ্মবেশে একাকী বের হয়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন এবং বাদশা রাজ্য পরিচালনায় কেমন করছেন, তা তাদের কাছে জানতে চাইতেন। তারা রাজ্য শাসনে বাদশার ভুল-ত্রুটির কথা বললে তিনি প্রাসাদে ফিরে তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। ইসলামের প্রথম যুগের খলিফাদের সম্পর্কেও এমন কথা প্রচলিত আছে। বাস্তবে সেই পরিস্থিতি তো আর এখন নেই, কিন্তু রাষ্ট্র কেমন চলছে, তা জানার রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হাজার রকমের পন্থা-পদ্ধতি আছে। কিন্তু তা তারা কতটুকু গুরুত্বসহ কাজে লাগায়, তা গবেষণার বিষয়।
বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর পণ্ডিতজনেরা সামনের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কতটা সিট পাবে, তার হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছেন। কেউ বলেন ৩০, আবার কেউ বলেন তিন। কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, গোপালগঞ্জের সিটটাও এবার গেল বলে। মির্জা ফখরুল তো বলেই ফেললেন, দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে মানে মানে বিদায় হন। তিনি তা বলতেই পারেন। কারণ, তিনি এখন বিজয়ী দলের একজন সেনাপতি। তাঁদের বন্ধু এখন অনেক। পরাজিতদের কোনো বন্ধু থাকে না। আওয়ামী লীগেরও এই মুহূর্তে নেই। আর এটাও বাস্তব, গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগ তাদের অনেক বন্ধুকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং নতুন নতুন শত্রু সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষণও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অনেকে প্রশ্ন করেন, কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাই অনেক সময় বলি, ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নামের দলটির সরকারের মাঝে বিলুপ্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে জানতে চাই, কেমন হবে আগামী নির্বাচন? তিনি নির্বাচনবিষয়ক তথ্য গবেষণাকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর সোজাসাপটা উত্তর, কমপক্ষে দেড় শ সিটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। এই দেড় শর মধ্যে অনেক মন্ত্রীও আছেন। তিনি আরও জানান, সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে—তার কারণ প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তা নয়, আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের বিরক্তি। এর প্রধান কারণ স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে মানুষের বিরূপ ধারণা। কারণ, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁদের জনবিচ্ছিন্নতা। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, দলের সোনার ছেলেদের দুর্বৃত্তপনা। তিনি জানান, তাঁদের কাছে প্রাপ্ত এসব তথ্য তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, বাকি কাজ তাঁদের।
তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই, বর্তমান সরকার গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে যা কাজ করেছে, তা তো অন্য কোনো সরকারের আমলে হয়নি, তা কি জনগণ জানে না? তিনি জানান, জনগণ এর চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেছে, সরকারের দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু হয়নি। বলি, তা তো প্রমাণিত সত্য নয়। বিশ্বব্যাংক বলেছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দল বলেছে, পদ্মা সেতুর সব টাকা উঠিয়ে সরকার খেয়ে ফেলেছে এবং সাধারণ মানুষ তা-ই বিশ্বাস করেছে। এটা বাস্তবে সরকার বিরোধী দলের বক্তব্যেও পাল্টা কোনো জুতসই বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেনি। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রচার সেল ভীষণভাবে দুর্বল। নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করেন, এমন একটি সংস্থার একজন গবেষকের কাছে গত চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, দুই দুই হতে পারে, তবে খুলনায় পরাজয় নিশ্চিত যদিও এই শহরে বিদায়ী মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, কিন্তু পদ্মা সেতু তাঁকে ডোবাবে। তিনি জানান, ৯৬ ভাগ মানুষ মনে করে, পদ্মা সেতু না হওয়ার পেছনে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী দায়ী। সুতরাং এই সুযোগে আওয়ামী লীগকে একটা শাস্তি তো পেতে হবে। বোঝা গেল, আবুল হোসেন প্রতিদিন যতই লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন না কেন, সব বৃথা যাচ্ছে।
তাহলে আওয়ামী লীগের সামনে কি সব অন্ধকার? সম্ভবত সেটি বলার শেষ সময় এখনো আসেনি। তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই লিখেছিলাম, কিছু স্তাবকই সব বরবাদ করে দিতে পারে। হয়তো শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটতে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের শেষ চাবিটা দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে। দৃঢ় হাতে তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে থাকা চাটুকারদের অবিলম্বে বিদায় করতে হবে। জনগণের কথাকে শুনতে হবে। তিনি তো আর বাদশা হারুন-উর-রশিদ হতে পারবেন না। তবে জনগণের প্রত্যাশার কথা কীভাবে শুনবেন, তা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। শুধু উন্নয়ন করলেই অথবা সৎ থাকলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া যায়, তা বোধ হয় আর সত্য নয়। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো তার বড় প্রমাণ। সব শেষে বন্ধু ড. মুনতাসীর মামুনের একটি বহুল ব্যবহূত উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। মামুন একবার লিখেছিল, ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন করে গিয়েছিলেন।’ তার এই উক্তিটি আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়। এই মেয়াদে হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শেষ হবে না, তবে সামনে অন্য কোনো সরকার এলে যারা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে, তাদের বিচার করলেও অবাক হব না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তাঁকে তাঁদের প্রথম মেয়র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের পছন্দ ভালো হয়েছে কি মন্দ, সেই বিচারে না গিয়ে তাঁদের এবং বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন।
সোনারগাঁও হোটেলের সামনে ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম। চট্টগ্রাম থেকে একাত্তরের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং আমার এক বাল্যবন্ধু টেলিফোনে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে জানতে চায়, ‘এবার আওয়ামী লীগ কী করবে?’ তাকে বলি, কী করে বলি, আমি তো আওয়ামী লীগের দুই টাকার সদস্যও না। বন্ধুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘তাহলে কেন আমি আওয়ামী লীগের এত “দালালি” করি?’ আমি বলি, দালালি নয়, তবে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এখনো সমর্থন করি। কারণ, বাংলাদেশে কোনো দল যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে, তাহলে সেটি আওয়ামী লীগ, তার বিকল্প তো এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। সুতরাং তাকে ঘিরে এখনো স্বপ্ন দেখি। কারণ, তাদের বিকল্প যারা আসবে বলে জনগণের ধারণা, তারা তো বছর না ঘুরতেই দেশটাকে একটি আফগানিস্তান অথবা পাকিস্তান বানিয়ে ফেলতে পারে। পরদিন আমার আর এক বন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করে। কারণ, সে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছে। যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য, তার মামলায় রায় এখনো হয়নি। তার ধারণা, সরকার তলে তলে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করার চেষ্টা করছে এবং সেই কারণেই রায় দিতে দেরি করছে। তাকে বলি, রায় তো সরকার দেয় না, দেন আদালত। জবাবে সে বলে, ‘কথা একই।’ বন্ধু দেশত্যাগে ইচ্ছুক। কারণ, এমন একটা পরিস্থিতিতে সে দেশে থাকাটা নিরাপদ মনে করছে না। আমার মতামত জানতে চায়। বলি, এটা তার ইচ্ছা। আমার মতো মানুষদের তো দেশেই থাকতে হবে। কারণ, আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। চট্টগ্রাম থেকে এক কলেজশিক্ষক ফোন করে সব কটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হারের পেছনে আরেকটি নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। আওয়ামী লীগ সরকার নারীদের অনেক ক্ষমতা দিয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে। তাঁর মতে, সাধারণ নারীরা এতে অখুশি। কারণ, তাঁদের মধ্যে হয়তো একটা ঈর্ষাবোধ কাজ করে এবং এ কারণেই নির্বাচনের দিন নারীদের ব্যাপক উপস্থিতির অর্থ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত। বুঝলাম সেই কলেজশিক্ষক কিছুটা নারীবিদ্বেষী এবং তাঁর মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িকতার ভাবও আছে।
সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে পণ্ডিতজনেরা নানা চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু তা নিয়ে আওয়ামী লীগের নিজের কোনো চিন্তা বা বিচার-বিশ্লেষণ আছে বলে মনে হয় না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যাদের জনবিচ্ছিন্নতার রোগে পেয়ে বসে, তাদের বিপদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। অনেকে বাগদাদের বাদশা হারুন-উর-রশিদের কাহিনি পড়ে থাকবেন। রাত নামলেই তিনি ছদ্মবেশে একাকী বের হয়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করতেন এবং বাদশা রাজ্য পরিচালনায় কেমন করছেন, তা তাদের কাছে জানতে চাইতেন। তারা রাজ্য শাসনে বাদশার ভুল-ত্রুটির কথা বললে তিনি প্রাসাদে ফিরে তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। ইসলামের প্রথম যুগের খলিফাদের সম্পর্কেও এমন কথা প্রচলিত আছে। বাস্তবে সেই পরিস্থিতি তো আর এখন নেই, কিন্তু রাষ্ট্র কেমন চলছে, তা জানার রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হাজার রকমের পন্থা-পদ্ধতি আছে। কিন্তু তা তারা কতটুকু গুরুত্বসহ কাজে লাগায়, তা গবেষণার বিষয়।
বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর পণ্ডিতজনেরা সামনের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কতটা সিট পাবে, তার হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছেন। কেউ বলেন ৩০, আবার কেউ বলেন তিন। কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, গোপালগঞ্জের সিটটাও এবার গেল বলে। মির্জা ফখরুল তো বলেই ফেললেন, দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে মানে মানে বিদায় হন। তিনি তা বলতেই পারেন। কারণ, তিনি এখন বিজয়ী দলের একজন সেনাপতি। তাঁদের বন্ধু এখন অনেক। পরাজিতদের কোনো বন্ধু থাকে না। আওয়ামী লীগেরও এই মুহূর্তে নেই। আর এটাও বাস্তব, গত সাড়ে চার বছরে আওয়ামী লীগ তাদের অনেক বন্ধুকে দূরে ঠেলে দিয়েছে এবং নতুন নতুন শত্রু সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষণও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। অনেকে প্রশ্ন করেন, কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাই অনেক সময় বলি, ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নামের দলটির সরকারের মাঝে বিলুপ্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে জানতে চাই, কেমন হবে আগামী নির্বাচন? তিনি নির্বাচনবিষয়ক তথ্য গবেষণাকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর সোজাসাপটা উত্তর, কমপক্ষে দেড় শ সিটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। এই দেড় শর মধ্যে অনেক মন্ত্রীও আছেন। তিনি আরও জানান, সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে—তার কারণ প্রতিপক্ষের জনপ্রিয়তা নয়, আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের বিরক্তি। এর প্রধান কারণ স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে মানুষের বিরূপ ধারণা। কারণ, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁদের জনবিচ্ছিন্নতা। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, দলের সোনার ছেলেদের দুর্বৃত্তপনা। তিনি জানান, তাঁদের কাছে প্রাপ্ত এসব তথ্য তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, বাকি কাজ তাঁদের।
তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই, বর্তমান সরকার গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে যা কাজ করেছে, তা তো অন্য কোনো সরকারের আমলে হয়নি, তা কি জনগণ জানে না? তিনি জানান, জনগণ এর চেয়েও বেশি বিশ্বাস করেছে, সরকারের দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু হয়নি। বলি, তা তো প্রমাণিত সত্য নয়। বিশ্বব্যাংক বলেছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্তু বিরোধী দল বলেছে, পদ্মা সেতুর সব টাকা উঠিয়ে সরকার খেয়ে ফেলেছে এবং সাধারণ মানুষ তা-ই বিশ্বাস করেছে। এটা বাস্তবে সরকার বিরোধী দলের বক্তব্যেও পাল্টা কোনো জুতসই বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেনি। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রচার সেল ভীষণভাবে দুর্বল। নির্বাচন নিয়ে গবেষণা করেন, এমন একটি সংস্থার একজন গবেষকের কাছে গত চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, দুই দুই হতে পারে, তবে খুলনায় পরাজয় নিশ্চিত যদিও এই শহরে বিদায়ী মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, কিন্তু পদ্মা সেতু তাঁকে ডোবাবে। তিনি জানান, ৯৬ ভাগ মানুষ মনে করে, পদ্মা সেতু না হওয়ার পেছনে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী দায়ী। সুতরাং এই সুযোগে আওয়ামী লীগকে একটা শাস্তি তো পেতে হবে। বোঝা গেল, আবুল হোসেন প্রতিদিন যতই লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন না কেন, সব বৃথা যাচ্ছে।
তাহলে আওয়ামী লীগের সামনে কি সব অন্ধকার? সম্ভবত সেটি বলার শেষ সময় এখনো আসেনি। তবে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই লিখেছিলাম, কিছু স্তাবকই সব বরবাদ করে দিতে পারে। হয়তো শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটতে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের শেষ চাবিটা দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে। দৃঢ় হাতে তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে থাকা চাটুকারদের অবিলম্বে বিদায় করতে হবে। জনগণের কথাকে শুনতে হবে। তিনি তো আর বাদশা হারুন-উর-রশিদ হতে পারবেন না। তবে জনগণের প্রত্যাশার কথা কীভাবে শুনবেন, তা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। শুধু উন্নয়ন করলেই অথবা সৎ থাকলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া যায়, তা বোধ হয় আর সত্য নয়। সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো তার বড় প্রমাণ। সব শেষে বন্ধু ড. মুনতাসীর মামুনের একটি বহুল ব্যবহূত উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। মামুন একবার লিখেছিল, ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন করে গিয়েছিলেন।’ তার এই উক্তিটি আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়। এই মেয়াদে হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শেষ হবে না, তবে সামনে অন্য কোনো সরকার এলে যারা পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে, তাদের বিচার করলেও অবাক হব না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments