এপার-ওপার-পঞ্চায়েতে চিৎ না জিৎ by অমিত বসু
আম এসেছে ছয় হাজার বছর আগে। চিনতে-খুঁজতে সময় লেগেছে আরো বহু বছর।
আমজনতা আমের প্রথম স্বাদ নিয়ে ছুড়ে ফেলেছে। তেতো, কষা। এমন ফল খাওয়ার থেকে
কড়া ওষুধ গেলা ভালো।
আমের থেকে মুখ ফেরানোর পর লক্ষ
করেছে, রসালের রূপ বদলাচ্ছে। সবুজ থেকে হলুদ, নাম, চেহারাতেও মনোরমা,
শ্রীময়ী। খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরতেই পুলক। মিষ্টি রসে মুখ ভর্তি। যারা দূরে
ছিল, তারাও ছুটে এসে কেড়েকুড়ে খেয়ে খুশি। আমের আদর বর্ধমান। বিজ্ঞানীরা
বলেছেন, বাঙালিই প্রথম আম দেখেছে, চিনেছে, খেয়েছে। বাঙালি কোনো জিনিস একা
খায় না। সবাইকে দিয়ে খাওয়াটাই অভ্যাস। পরম আদরে পৃথিবীর হাতে আম তুলে
দিয়েছে তারাই। সবেতেই তাই। জন্মেই বাজার জমানো যায় না। সময় লাগে। চরিত্রের
বিবর্তনে সব কিছুই ক্রমশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ১৯৯৭-এর ১৩ আগস্ট আবির্ভূত
তৃণমূল কংগ্রেস। জননী মমতা ব্যানার্জি। প্রথমটায় কেউ পাত্তাই দেয়নি। না দল,
না নেত্রী- কাউকেই পছন্দ হয়নি। দল আছে, লোক নেই। তৃণমূল পাখার মোটরের মতো
ঘুরছে ব্লেড ছাড়াই। হাওয়া হচ্ছে না। ধীরে ধীরে মোটরও থেমে যাচ্ছে বিজলির
অভাবে। মমতা চাবি ঘুরিয়ে দম দিচ্ছেন। তাতেও দম দেওয়া পুতুলের অবস্থা। একটু
নড়েচড়েই নিথর। চূড়ান্ত অধৈর্য মমতা। দুত্তোর নিকুচি করেছে দলের, বলে একা
চলা শুরু। দলটা রইল নামকাওয়াস্তে। হিসাবে দাঁড়াল, তৃণমূলই মমতা, মমতাই
তৃণমূল। দলের নীতি-আদর্শের বালাই রইল না। পতঙ্গ যেমন অবিবেচনায় আগুনের দিকে
ধাবিত হয়, মমতাও তা-ই করলেন। ক্ষমতার গন্ধ পেলেই তিনি বিজেপি হলেও ক্ষতি
নেই। কুড়িয়ে বাড়িয়ে ক্ষমতা হাতে নেওয়াটাই প্রথম আর শেষ কথা। তিনি জানেন,
ক্ষমতা ছাড়া কেউ কেয়ার করবে না। দর বাড়াতে বিজেপির হাত ধরলেন। সবাই ছিঃ ছিঃ
করল। তাতে বয়েই গেল। মন্ত্রিত্বের চেয়ারে তো বিজেপির ছাপ থাকে না। মন্ত্রী
হয়েই লোক টানতে লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি। যার সারবত্তা শূন্য। কোনো দিন
পূরণ করা সম্ভব নয়। সেটা জেনেই মেয়াদ শেষের আগে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিল্লি
থেকে কলকাতায়। আজ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রিত্বের মেয়াদ পূর্ণ করেননি তিনি।
ঝেরেকেটে দুই থেকে আড়াই বছর থেকেছেন পাঁচ বছরের জায়গায়। যাতে অঙ্গীকার
রক্ষার ব্যর্থতার দায় নিতে না হয়। কংগ্রেস-বিজেপি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলাটা
তাঁর অভ্যাস। যাতে দাম না কমে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন মমতার বহু দিনের। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো সেটা হাতে এসেছে দুই বছর আগে। হাতে আরো তিন বছর। পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন কি না বলা মুশকিল। বারবার রেলমন্ত্রী হয়ে যেমন চূড়ান্ত ব্যর্থ। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সাফল্যের মুখ দেখেননি। কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করছেন। গোছাতে গিয়ে আরো এলোমেলো করে ফেলছেন। এতেই অভ্যস্ত তিনি। বেপরোয়া-বিশৃঙ্খল হওয়াটাই তাঁর প্রথম পয়েন্ট। লোককে বোঝাতে চান, কোনো কিছুর তোয়াক্কা তিনি করেন না। রাজ্য বেচাল হলেও তিনি চলবেন নিজের চালে। কথায় কথায় বলেন, আমি কাউকে ভয় পাই না। আমি সাহসী। সাহস থাকা ভালো, তার সঙ্গে লজ্জা থাকাটাও জরুরি। তিনি লজ্জারও ধার ধারেন না। সত্যিটাকে মাড়িয়ে মিথ্যাটাকে তুলে ধরেন।
কিছু না করেই জনসভায় বলেন, আমার ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ। ঘনিষ্ঠরা সংশয় প্রকাশ করলে তিনি সগর্বে জানিয়ে দেন, এটাই রাজনীতি। চড়া গলায় যা বলবে, লোকে তা-ই জানবে। নিজের দোষ ধামাচাপা দিতে পারবে। নইলে হাটে হাঁড়ি ভাঙবে। রাজনীতি আধ্যাত্মিক সাধনার আখড়া নয় যে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে চলতে হবে। কপটতার দাপট দেখানো যায়। অকপট হলে গলায় দড়ি। লোক বিচারের জাঁতাকলে ফেলে পিষে মারবে। এতে করেও মমতার কেরামতি ফল দিচ্ছে না। জনপ্রিয়তা জলপ্রপাতের মতো নিচে আছড়ে পড়ছে। মানুষের মনের আকাশে মেঘ হয়ে ভাসতে পারছেন না।
মানুষ না থাকলেও তার ব্যবহারটা থেকে যায়। ব্যবহারিক শোভনতা ভোলা যায় না। মমতার সেটা একেবারেই নেই। নিজে মহিলা হয়ে মহিলাদের সঙ্গে যেমন আচরণ করেন, তা শুনলে কবরে শুয়ে থাকা হিটলারও শিউরে উঠবেন। পার্কস্ট্রিট থেকে কামদুনি- একের পর এক ধর্ষণ আর খুনের ঘটনায় অপরাধীদের যথার্থ শাস্তির ব্যবস্থা করা দূরে থাক, যে প্রতিক্রিয়া তিনি দেখিয়েছেন, সাপ শুনলেও লজ্জায় ভেতরে ঢুকে যাবে। মমতার ভাগ্য ভালো, সাপ শুনতে পায় না।
এ অবস্থায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে নাভিশ্বাস উঠছে মমতার। তিনি ভালো করেই জানেন, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে জেতার কোনো চান্স নেই। অথচ জিততে তাঁকে হবেই। নইলে নিজের কীর্তি নিয়ে টানাটানি। অগত্যা শেষ অস্ত্র তিনি প্রয়োগ করেছেন। সেটাই হচ্ছে স্বৈরাচার। ভয়ে যেন ভোট দিয়েই ভুলে যায় লোকে। জেলায় জেলায় ঘুরে তিনি বলেছেন, দেখিয়ে দেব, বদলা নেব। কাকে দেখাবেন, কার বিরুদ্ধে বদলা নেবেন, স্পষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর তাঁর রাগ আছেই। নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের কাছে মুখ পুড়েছে। মীরাকে টাইট দিতে গিয়ে নিজেই জব্দ হয়েছেন। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট- সব মামলাতেই মীরার কাছে হেরেছেন। এই পরাজয়ের জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে খাক। ১৭টি জেলার নির্বাচন দুই দিনে শেষ করতে চেয়েছিলেন মমতা। মীরা সেটা টেনে নিয়ে গেছেন পাঁচ দিনে। আদালত সমর্থন দিয়েছেন। মমতা চেয়েছিলেন রাজ্যের পুলিশ দিয়েই নির্বাচন সারতে। মীরা কেন্দ্রীয় বাহিনী এনেছেন। কিছু না পেরে সেবার সাম্প্রদায়িকতার সুর বাজাতে চেয়েছিলেন। আদালতকে জানিয়েছিলেন, রমজান মাসে নির্বাচন করা ঠিক নয়। ভোট আরো পিছিয়ে দেওয়া উচিত। মৌলভিরা তাঁকে সমর্থন করেননি। তাঁরা জানিয়েছেন, রমজানে বৈধ কাজ করায় কোনো বাধা নেই। আদালত বলেছেন, কথাটা আগে বলতে পারতেন। দিন ঘোষণার পর জানাচ্ছেন কেন?
১৯৭৮ থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে নির্বিঘ্নে। এবারই গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ- এই তিন স্তরের ভোটে সন্ত্রাস ছড়িয়ে বহু জায়গায় বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন। তৃণমূলী মাস্তানিতে ভোট প্রচারেও বাধা। ভোটে মমতাকে জেতাতে পুলিশ সক্রিয়। হারলে তৃণমূল দলটাই উঠে যাবে। ২০১৪-তে লোকসভা নির্বাচনে মমতাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বেন। তাঁর এখন একটাই কথা- এভরিথিং ইজ ফেয়ার, ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন মমতার বহু দিনের। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো সেটা হাতে এসেছে দুই বছর আগে। হাতে আরো তিন বছর। পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন কি না বলা মুশকিল। বারবার রেলমন্ত্রী হয়ে যেমন চূড়ান্ত ব্যর্থ। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সাফল্যের মুখ দেখেননি। কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করছেন। গোছাতে গিয়ে আরো এলোমেলো করে ফেলছেন। এতেই অভ্যস্ত তিনি। বেপরোয়া-বিশৃঙ্খল হওয়াটাই তাঁর প্রথম পয়েন্ট। লোককে বোঝাতে চান, কোনো কিছুর তোয়াক্কা তিনি করেন না। রাজ্য বেচাল হলেও তিনি চলবেন নিজের চালে। কথায় কথায় বলেন, আমি কাউকে ভয় পাই না। আমি সাহসী। সাহস থাকা ভালো, তার সঙ্গে লজ্জা থাকাটাও জরুরি। তিনি লজ্জারও ধার ধারেন না। সত্যিটাকে মাড়িয়ে মিথ্যাটাকে তুলে ধরেন।
কিছু না করেই জনসভায় বলেন, আমার ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ। ঘনিষ্ঠরা সংশয় প্রকাশ করলে তিনি সগর্বে জানিয়ে দেন, এটাই রাজনীতি। চড়া গলায় যা বলবে, লোকে তা-ই জানবে। নিজের দোষ ধামাচাপা দিতে পারবে। নইলে হাটে হাঁড়ি ভাঙবে। রাজনীতি আধ্যাত্মিক সাধনার আখড়া নয় যে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে চলতে হবে। কপটতার দাপট দেখানো যায়। অকপট হলে গলায় দড়ি। লোক বিচারের জাঁতাকলে ফেলে পিষে মারবে। এতে করেও মমতার কেরামতি ফল দিচ্ছে না। জনপ্রিয়তা জলপ্রপাতের মতো নিচে আছড়ে পড়ছে। মানুষের মনের আকাশে মেঘ হয়ে ভাসতে পারছেন না।
মানুষ না থাকলেও তার ব্যবহারটা থেকে যায়। ব্যবহারিক শোভনতা ভোলা যায় না। মমতার সেটা একেবারেই নেই। নিজে মহিলা হয়ে মহিলাদের সঙ্গে যেমন আচরণ করেন, তা শুনলে কবরে শুয়ে থাকা হিটলারও শিউরে উঠবেন। পার্কস্ট্রিট থেকে কামদুনি- একের পর এক ধর্ষণ আর খুনের ঘটনায় অপরাধীদের যথার্থ শাস্তির ব্যবস্থা করা দূরে থাক, যে প্রতিক্রিয়া তিনি দেখিয়েছেন, সাপ শুনলেও লজ্জায় ভেতরে ঢুকে যাবে। মমতার ভাগ্য ভালো, সাপ শুনতে পায় না।
এ অবস্থায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে নাভিশ্বাস উঠছে মমতার। তিনি ভালো করেই জানেন, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে জেতার কোনো চান্স নেই। অথচ জিততে তাঁকে হবেই। নইলে নিজের কীর্তি নিয়ে টানাটানি। অগত্যা শেষ অস্ত্র তিনি প্রয়োগ করেছেন। সেটাই হচ্ছে স্বৈরাচার। ভয়ে যেন ভোট দিয়েই ভুলে যায় লোকে। জেলায় জেলায় ঘুরে তিনি বলেছেন, দেখিয়ে দেব, বদলা নেব। কাকে দেখাবেন, কার বিরুদ্ধে বদলা নেবেন, স্পষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর তাঁর রাগ আছেই। নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের কাছে মুখ পুড়েছে। মীরাকে টাইট দিতে গিয়ে নিজেই জব্দ হয়েছেন। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট- সব মামলাতেই মীরার কাছে হেরেছেন। এই পরাজয়ের জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে খাক। ১৭টি জেলার নির্বাচন দুই দিনে শেষ করতে চেয়েছিলেন মমতা। মীরা সেটা টেনে নিয়ে গেছেন পাঁচ দিনে। আদালত সমর্থন দিয়েছেন। মমতা চেয়েছিলেন রাজ্যের পুলিশ দিয়েই নির্বাচন সারতে। মীরা কেন্দ্রীয় বাহিনী এনেছেন। কিছু না পেরে সেবার সাম্প্রদায়িকতার সুর বাজাতে চেয়েছিলেন। আদালতকে জানিয়েছিলেন, রমজান মাসে নির্বাচন করা ঠিক নয়। ভোট আরো পিছিয়ে দেওয়া উচিত। মৌলভিরা তাঁকে সমর্থন করেননি। তাঁরা জানিয়েছেন, রমজানে বৈধ কাজ করায় কোনো বাধা নেই। আদালত বলেছেন, কথাটা আগে বলতে পারতেন। দিন ঘোষণার পর জানাচ্ছেন কেন?
১৯৭৮ থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচন হচ্ছে নির্বিঘ্নে। এবারই গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ- এই তিন স্তরের ভোটে সন্ত্রাস ছড়িয়ে বহু জায়গায় বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। তৃণমূল প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন। তৃণমূলী মাস্তানিতে ভোট প্রচারেও বাধা। ভোটে মমতাকে জেতাতে পুলিশ সক্রিয়। হারলে তৃণমূল দলটাই উঠে যাবে। ২০১৪-তে লোকসভা নির্বাচনে মমতাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বেন। তাঁর এখন একটাই কথা- এভরিথিং ইজ ফেয়ার, ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
No comments