আওয়ামী বুদ্ধিজীবীর মহাবিপর্যয়ভীতি ও মিথ্যাচার by ফিরোজ মাহবুব কামাল
রাজনৈতিকভাবে নির্মূল হওয়ার ভীতি আওয়ামী
লীগ ও তার মিত্রদের মনে যে কতটা প্রকট, সেটিরই উত্কট প্রকাশ ঘটেছে গত
১৮/০৫/১৩ তারিখে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিকে’ দেয়া ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের একটি সাক্ষাত্কারে।
প্রশ্ন, কে এই আবুল বারকাত? ইসলামের বিরুদ্ধে তার দুশমনি ও প্রতিহিংসার
দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ইসলামের শত্রুপক্ষের তিনি একজন প্রথম সারির সৈনিক। তার
লড়াই বুদ্ধিবৃত্তির ময়দানে। তার কাছে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগার ও আয়োজকরা
হলো তার নিজের ভাষার আলোকিত সৈনিক। ফলে তারা যে তার খুব কাছের লোক, সেটি
তিনি গোপন রাখেননি। তার মেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ইসলামের
বিরুদ্ধে তার মতো তার মেয়ের আক্রোশও অধিক। সম্প্রতি তার মেয়ে সে আক্রোশের
প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন সপ্তাহের আর সব দিন বাদ দিয়ে জুমার নামাজের সময় ছাত্রদের
পরীক্ষার আয়োজন করে। অবশেষে ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে তার সে ষড়যন্ত্র
বানচাল হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বাংলাদেশকে তারা যে কোন দিকে নিতে
চান—সেটি কি এর পরও গোপন থাকে?
আবুল বারকাত লেখাপড়া করেছেন সোভিয়েত রাশিয়ায়। ভারতীয় লবির অতি কাছের লোক তিনি। ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মহলের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইসলামের বিরুদ্ধে আজ বিশ্বব্যাপী যে কোয়ালিশন, তার প্রায় সবার সঙ্গেই তার গভীর সম্পর্ক। চাকরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেও তার আসল কাজটি অন্যত্র। গবেষণা ও ইভলিউশনের নামে তার একটি এনজিও আছে। সে এনজিও’র সূত্র ধরে তিনি প্রচুর অর্থ পান পশ্চিমা দাতা সংস্থাগুলো থেকে। সেই সঙ্গে আওয়ামী শাসনামলের অতিসুবিধাভোগী ব্যক্তিও। জনতা ব্যাংকের তিনি একজন কর্ণধার। আবুল বারকাতের মূল কাজটি হলো, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের নির্মূলে অন্যদের উসকানি দেয়া। তার গবেষণা ও লেখালেখির বিষয় মূলত দুটি—এক. কী করে বাংলাদেশের মাটিতে হিন্দু ও হিন্দুস্থানের স্বার্থকে বৃদ্ধি করা যায়; দুই. কী করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয়া যায়। মুজিব আমলে বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ভারত লুটে নিয়ে গেল, তা নিয়ে কিন্তু তিনি কোনো সময়ই মুখ খোলেননি। সে লুটের মধ্যে ছিল পাকিস্তান আর্মির অব্যবহৃত হাজার হাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র। ভারত বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান আর্মির কোনো ট্যাংক, কোনো দূরপাল্লার কামান ও গোলাবারুদ রেখে যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় যে কয়েকটি ট্যাংক নামানো হয়েছিল, সেগুলো এসেছিল মিসর থেকে। এসেছিল তত্কালীন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের খয়রাত হিসেবে। অথচ পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া যুদ্ধাস্ত্র তখন বাংলাদেশের মাটিতে থাকলে এরূপ খয়রাতের কি প্রয়োজন হতো?
আবুল বারকাতের ইসলামভীতি ও ইসলামবিরোধিতা
এ আবুল বারকাত কিছুকাল আগে এক বইয়ে দেখিয়েছিলেন, ইসলামী ব্যাংক কীভাবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের অর্থনীতির বিশাল ভিত গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ বেসরকারি এ ব্যাংকটিকে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক প্রতিষ্ঠানরূপে। উসকানি দিয়েছেন, এ ব্যাংককে ইসলামপন্থীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার। লক্ষ্য, এ ব্যাংকটিও পরিণত হোক সোনালী ও জনতা ব্যাংকের মতো আওয়ামী বাকশালিদের লুটপাটের অবাধ ও উর্বর ক্ষেত্ররূপে। ইসলামী ব্যাংকের অর্থে বাংলাদেশে যে কয়েক হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে বহু হাসপাতাল, বহু পশুপালন ও মত্স্যপালন প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তায় নেমেছে যেরূপ হাজার হাজার যানবাহন, সেটি তার নজরে পড়েনি। সম্প্রতি দেশের নানা স্থানে ইসলামী ব্যাংকের নানা শাখার ওপর যে হামলা হয়েছে, তার পেছনে আবুল বারকাতের মতো ব্যক্তিদের উসকানি যে সক্রিয় ছিল, তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে?
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর্যুপরি হরতালের সফলতা দেখে আবুল বারকাতের মতো ব্যক্তিদের ভয় গভীরতর হয়েছে। সে ভয় আরও তুঙ্গে উঠেছে ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের প্রায় তিরিশ লাখ লোকের লংমার্চ দেখে। এ ভয়ই তাদের মরণের ভয়। আবুল বারকাতের ভয়, বাংলাদেশ শিগগিরই তালেবান রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। তার নিজের উক্তি, ‘এখনই সমাধানে পৌঁছতে না পারলে বাংলাদেশ তালেবান রাষ্ট্র হতেই পারে। কারণ একটি বিপ্লব বা পটপরিবর্তনের জন্য কোটি কোটি লোকের প্রয়োজন পড়ে না। শতকরা দুই বা পাঁচ ভাগ কর্মী থাকলেই অনেক কিছু সম্ভব। জামায়াত-শিবিরের তো পাঁচ ভাগ সক্রিয় সমর্থক আছেই। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর একাংশ যোগ হতেই পারে। না হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ জামায়াত রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র তৈরি করেছে। আপনি আইনজীবীদের নির্বাচনগুলো দেখুন, ওরা কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।’ তবে ‘সাপ্তাহিক’-এর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে আবুল বারকাত যা বলেছেন, সেটি বস্তুত তার একার বক্তব্য নয়, বরং সেটি গোটা সেক্যুলার পক্ষের। মুখপাত্ররূপে তিনি তাদের কথাগুলোই তুলে ধরেছেন মাত্র।
যে অসুস্থতা বিবেকের
বেশি ভয়ে মানুষ পাগলের প্রলাপ বকে। এমন ভীতু মানুষের সামনে ছোটখাটো মানুষও ভয়ঙ্কর দৈত্য মনে হয়। এমন ভয়ে আক্রান্ত আবুল বারকাত। তার মুখে তাই প্রলাপও অনেক। জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সংগঠন তাই তার কাছে সাধারণ সংগঠন মনে হয়নি; মনে হয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী একটি পৃথক রাষ্ট্র! তার নিজের কথা—‘তারা সৃষ্টি করেছে মূল ধারার রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র, মূল ধারার সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার, মূল ধারার অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি।’ প্রশ্ন হলো, একটি রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়, সে জ্ঞান কি আবুল বারকাতের আছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কী—সেটি কি কখনওই তিনি একবার পড়ে দেখেছেন? রাষ্ট্র মানবসমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের যেমন নিজস্ব মানচিত্র থাকে, তেমনি সরকার, বিশাল প্রশাসন ও বিশাল বিশাল বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও থাকে। থাকে বিচারকার্য নির্বাহের জন্য আইন-কানুন ও আদালত। থাকে বেতনভোগী বিশাল সশস্ত্র সেনা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী। কিন্তু জামায়াতের হাতে এর কোনটি আছে? তাদের অফিসগুলো তো দীর্ঘকাল তালাবদ্ধ। তাদের কর্মীরা তো রাজপথে নামে খালি হাতে। তাদের রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট মানচিত্র বা সীমানাটি কোথায়? কোথায় সে রাষ্ট্রের প্রহরায় সশস্ত্র সেনাবাহিনী? কোথায় তাদের সে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন? একটি ব্যাংক, কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অর্থ কি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা? ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে এর চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠান আছে। জামায়াত যদি আলাদা রাষ্ট্র হয়েই থাকে, তবে সে রাষ্ট্রের প্রধান বছরের পর বছর শত্রুপক্ষের জেলে থাকলে সে রাষ্ট্র বেঁচে থাকে কী করে? আবুল বারকাতের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর আছে কি? অথচ এরাই আওয়ামী লীগের প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী! এককালে বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর ছিল এবং তার একটি প্রশাসনও ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে ভারতীয় বাহিনীর দখলদারির কারণে সে প্রাদেশিক সরকারের সবাই কারারুদ্ধ হয়। তখন পাকিস্তানি রাষ্ট্রও এ প্রদেশটিতে আর বাঁচেনি। এতে জামায়াত যদি রাষ্ট্রই হয়ে থাকে, তবে দলটির প্রধান ও তার কেন্দ্রীয় নেতারা কারারুদ্ধ হলে সে রাষ্ট্র বাঁচে কী করে? এসব প্রশ্ন কি আবুল বারকাতের মনে একবারও উদয় হয়েছে?
বহু মানুষ শুধু মানসিক বিকলঙ্গতা নিয়ে জন্মায় না। জন্মের পর, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রি নিয়েও বহু মানুষ পাগল হয়। আওয়ামী লীগে এমন অপ্রকৃতস্থ পাগলের সংখ্যা কি কম; বরং এ আওয়ামী পাগলদের পাগলামিটা ভিন্ন মাত্রার। কোনো বদ্ধপাগলও কি কখনও বলবে, কিছু মানুষের ঝাঁকুনিতে একটি নয়তলা বিশাল বিল্ডিং ধসে পড়বে? অথচ যিনি বলেছেন, তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আর তার নাম মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ফলে আওয়ামী লীগে এমন পাগল শুধু আবুল বারকাত একা নন। ডাকাত দলে একজনও সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি পাওয়া যাবে না আওয়ামী লীগেও। কারণ সুস্থ মানুষের সুস্থতার সবচেয়ে বড় গুণটি হলো ডাকাতিকে ঘৃণা করা। তাই ডাকাত দল গড়ে ওঠে শতভাগ অসুস্থ ও চরিত্রহীন মানুষ দিয়ে। এ অসুস্থতা দৈহিক নয়, বরং নৈতিক। তেমনি কোনো স্বৈরাচারী শাসকের দলেও কোনো সুস্থ ও চরিত্রবান মানুষ পাওয়া যায় না। মূর্তিপূজারি কাফেরদের মন্দিরে ঈমানদার খুঁজে পাওয়ার মতো সেটিও এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। কারণ সুস্থ ও চরিত্রবান মানুষ দিয়ে তো আর ফ্যাসিবাদী দল গড়া যায় না এবং তাদের দিয়ে বাকশালি স্বৈরাচার ও হাজার হাজার মানুষ হত্যার নীতিকে সমর্থন করিয়ে নেয়া যায় না।
মিথ্যা বলা যেখানে স্ট্র্যাটেজি
ইসলামের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘকালীন গণহত্যার যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত করার স্বার্থে আল কায়েদাকে একটি দানবীয় শক্তিরূপে চিত্রিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন জনগণকে আল কায়েদার ভয় না দেখালে সরকারের পক্ষে কি সম্ভব হতো তাদের পকেট থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুট করা? সম্ভব হতো কি আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের বিশাল যুদ্ধকে গ্রহণযোগ্য করা? বাংলাদেশেও তেমনি ইসলামপন্থীদের সহিংসতা নির্মূলের লক্ষ্যে ইসলামি দলগুলোকে দানবীয় শক্তিরূপে চিত্রিত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা হচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার কর্মীকে নির্মমভাবে হতাহত করাকে জায়েজ করতে তারা প্রচার করছে হেফাজতের মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররমের সামনে বইয়ের দোকানে পবিত্র কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা রাস্তার গাছ নষ্ট করেছে। শত শত মানুষ হত্যাকারী এ খুনিরা এখন গাছপ্রেমিক হয়েছে? বলা হচ্ছে, তারা নাকি ব্যাংকগুলোতে আগুন দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এক্ষেত্রে আবুল বারকাতের নিজের মিথ্যাচারটিও দেখবার মতো। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন প্রতি তিনজন ছাত্রের একজন মাদরাসার ছাত্র (যার মোট সংখ্যা হবে ৮০ লাখ)। দেশে মোট মাদরাসার সংখ্যা হবে ৫৫ হাজারের বেশি, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা। এসব মাদরাসা পরিচালনে বছরে ব্যয় হয় আনুমানিক ১,৪০০ কোটি টাকা আর মাদরাসা পাসদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭৫ শতাংশ।’ বোঝা যাচ্ছে, যেখানেই তিনি নজর দেন, সেখানেই তিনি মাদরাসার ছাত্র দেখতে পান। সে সংখ্যাও প্রতি তিনজনে একজন! ফলে সর্বত্র দেখতে পান বিপুলসংখ্যক ইসলামের ঝান্ডাবাহীদের। এটি তার মহাদুশ্চিন্তা। তার ভাষায় মহাবিপর্যয়। প্রশ্ন হলো, এমন মহাবিপর্যয়ের এত দুশ্চিন্তা নিয়ে তিনি ঘুমান কী করে? অথচ তার মনে সামান্য ঈমান থাকলে বিষয়টি ভিন্নতর হতো। কারণ যেখানেই ইসলাম, যেখানে মাদরাসার ছাত্র—তা দেখে তো একজন ঈমানদার খুশি হন। কারণ তারা তো ইসলামের সেবক। তাদের দেখে মৃত্যুর ভয় পাবে তো ইসলামের শত্রুরা। কিন্তু সেটিই হয়েছে আবুল বারকাতের ক্ষেত্রে। ইসলাম ও মাদরাসার ছাত্র দেখে তিনি ভয়ে জর্জরিত। তিনি ভয় পাচ্ছেন, ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অচিরেই দখল করে নেবে! তার ভয়, ইসলামি যুবকদের আত্মদানে। তারা কেন শহীদ হয় এবং শহীদি জজবা নিয়ে বোমায় পরিণত হয়, তা নিয়ে তার প্রচুর বিস্ময়।
আরও প্রশ্ন হলো, এসব আজগুবি তথ্য আবুল বারকাত পেলেন কোত্থেকে? বাংলাদেশের প্রতি তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন মাদরাসা ছাত্র এবং তাদের সংখ্যা ৮০ লাখ—এসব কি বিশ্বাসযোগ্য? মাদরাসার পেছনে ১৪শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়—এমন নিখুঁত হিসাবইবা কোত্থেকে বের করলেন? মিথ্যা আবিষ্কারে তাদের মগজ যে কত উর্বর, এ হলো তার নমুনা। হার্ভার্ডে বসে হাসিনাতনয় জয়ও এমন মিথ্যা আবিষ্কার করেছিলেন। সে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক অফিসার হলো মাদরাসার ছাত্র। আওয়ামী নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের ঘরে ঘরে এভাবেই মিথ্যা উত্পাদনের ফ্যাক্টরি।
নিন্দিত হচ্ছে জিহাদ ও ইসলামি রাষ্ট্র
ইসলামের শত্রুদের কাছে ইসলামি রাষ্ট্র যেমন নিন্দিত, তেমনি অপরাধ হলো সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ। আবুল বারকাত সে জিহাদকে চিত্রিত করেছেন জঙ্গিবাদরূপে। তার মতো লোকদের কাছে জঘন্য ভাষায় নিন্দিত হচ্ছে ইসলামপন্থীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেয়ার চেষ্টা। ইসলামি রাষ্ট্র তাদের কাছে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। ইসলামের বিরুদ্ধে এমন এক বিষাক্ত ঘৃণা নিয়েই তো নাস্তিক ব্লগাররা মহান আল্লাহ তায়ালা, তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.) ও রাসুল (সা.)-এর বিবিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে যাচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পর থেকে ইসলামের শত্রুপক্ষের মনে ইসলামভীতি এখন তুমুলে। তাদের বিরুদ্ধে আবুল বারকাতের অভিযোগ, ‘সুসংগঠিত জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত।’ বলেছেন, ‘তারা ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে।’ অভিযোগ তুলেছেন, ‘ধর্মভিত্তিক এ রাজনৈতিক মতাদর্শ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’
প্রশ্ন হলো, ইসলামের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করা এবং সে জিহাদে প্রাণ দেয়া এবং ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা কি এক কথা? মুসলমান হওয়ার দায়বদ্ধতা হলো, ইসলামি বিধান প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেয়া। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে না নিলে রাষ্ট্রের বুকে ইসলামের শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠা কীরূপে সম্ভব? ইসলাম তাই মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ বা মাজারে বন্দি থাকার বিষয় নয়। নবীজী তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন, সাহাবারাও নিয়েছিলেন। ইসলামের শত্রুপক্ষের অধিকৃতি হটিয়ে দখলে নেয়ার কাজটি হলো জিহাদ। এমন জিহাদে প্রাণদান হলো শাহাদত। ইসলামে তো এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মকর্ম। অথচ আবুল বারকাত এর মধ্যে দোষ খুঁজছেন। তার কথা, ইসলাম যতদিন মসজিদ-মাদরাসা, সুফিদের মাজারে বা খানকায় আবদ্ধ থাকবে, ততদিনই সেটি প্রকৃত ধর্ম। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেয়ার চেষ্টা হলেই সেটি উগ্র জঙ্গিবাদ। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়েছেন খোদ নবীজি (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনরা। প্রশ্ন হলো, তাদের তিনি কী বলবেন? আবুল বারকাতের কাছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ। অথচ মুজিব যেভাবে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করলেন, ছিনিয়ে নিলেন জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার এবং হত্যা করলেন ৩০-৪০ হাজার মানুষ, তাকে তিনি কী বলবেন? মুজিবের মতো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রমাণিত শত্রুকে তিনি বঙ্গবন্ধু বলতে পাগল! তিনি মুজিবকে এতটা মাথায় তুলেছেন তার নিজের অবস্থান গণতন্ত্র, মানবতা ও ইসলামের বিপক্ষে হওয়ার কারণে। মানবতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি বিপক্ষীয় অবস্থান থেকে তিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে গালাগাল করবেন এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নাস্তিকদের ইসলামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ ও ইসলামি নেতাদের ফাঁসির আন্দোলনকে ‘তরুণ প্রজন্মের আলোকিত আন্দোলন’ বলবেন, সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা কি বিপর্যয়?
যেখানেই ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার, সেখানেই আবুল বারকাতের মতো ব্যক্তি পশ্চাত্পদতা ও সাম্প্রদায়িকতা দেখেন; দেখেন বিপর্যয় এবং মুসলমানদের গলাকাটার মধ্যে দেখেন প্রগতি। তাই প্রচণ্ড প্রগতি দেখেছেন মতিঝিলে হাজার হাজার মুসল্লি হত্যার মধ্যে। অথচ ভারতে মুসলিম নিধন ও মুসলমান নারীদের ধর্ষণের মাঝে তিনি কোনো পশ্চাত্পদতা দেখেন না। তাই তার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদও জানান না। বহু ভারতীয় হিন্দুও ভারতে এরূপ মুসলিম হত্যার প্রবল নিন্দা জানিয়েছেন। অরুন্ধতি রায়ের মতো ব্যক্তিরা আন্দোলনেও নেমেছেন। কিন্তু আবুল বারকাতরা কি একটিবারের জন্যও নিন্দা বা প্রতিবাদ জানিয়েছেন? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাঝে যৌক্তিকতা দেখেছেন, এমনকি অনেক অমুসলমানও। আবুল বারকাতরা যে ভারতীয় হিন্দুদের চেয়েও বেশি মুসলিমবিদ্বেষী, সেটি কি এরপরও বুঝতে বাকি থাকে? এমন একটি মুসলিমবিদ্বেষ নিয়েই তিনি ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশের মুসলমানদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনকে বলেছেন পশ্চাত্মুখী। তার কথায় ‘পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে প্রথম বড় মাপের পশ্চাত্মুখী রূপান্তর (বিপর্যয়) ঘটেছে গত শতাব্দীতে—যখন ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ এলো।’ যেখানেই মুসলমানের জাগরণ ও স্বার্থ রক্ষণের বিষয়, সেটিই আবুল বারকাতের কাছে মনে হয়েছে পশ্চাত্পদতা। সে ধারণা নিয়েই তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে বলছেন সাম্প্রদায়িকতা। কথা হলো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে আজকের বাংলাদেশ কোত্থেকে আসত? সে হুশ কি তার আছে? তার আফসোস, ‘ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাজনে ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক-মানবিক ধারার সুফি-ওলামারা বাধা দিতে পারলেন না।’ অথচ মহম্মদ ঘোরির হাতে দিল্লি বিজয়েরে পর দক্ষিণ এশিয়ার বুকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক ঘটনা। মুসলমানের বিজয় ও গৌরব নিয়ে যাদের মনঃকষ্ট একমাত্র তারাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টিতে কষ্ট পেতে পারে। সে কষ্ট যেমন ভারতীয় হিন্দুরা পায়, তেমনি বাংলাদেশের বুকে তাদের প্রতিপালিত এজেন্টরাও পায়।
বাংলাদেশে আজও ইসলামপন্থীদের কেন ফাঁসিতে ঝোলানো যায়নি, তা নিয়ে আবুল বারকাতদের বড়ই আফসোস। সে কাজ সে হাসিনা শুরু করেছেন। তাতেই তার আনন্দ। তবে তার ভয় বেড়েছে ইসলামের পক্ষে গণজাগরণ দেখে। সে জাগরণের মাঝে তিনি বিপন্নতা দেখছেন। বলেছেন, ‘উগ্র জঙ্গিবাদ যে ‘আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতি’ চালু করেছে, তাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের জীবন বিপন্নপ্রায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যতই ত্বরান্বিত হচ্ছে, এ বিপন্নতা ততই বাড়ছে।’ অথচ আবুল বারকাত দেখেও দেখেন না যে, দেশে আজ প্রচণ্ড ফ্যাসিবাদী শাসন। দেশের শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে ইসলামপন্থীদের হাতে নয়, বরং আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হাতে। দেশ বিপন্ন তো হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে। দেশের স্বাধীনচেতা মানুষের পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ৩০-৪০ হাজার মানুষ আজ জেলে। ৫ মে ও ৬ মে বহু হাজার মুসল্লিকে এ ফ্যাসিস্ট সরকার নির্মমভাবে নিহত ও আহত করল। তার আগে নিহত করেছে প্রায় দুইশ’ জামায়াত শিবিরকর্মী ও সাধারণ মানুষকে। সরকারবিরোধী গণমাধ্যমগুলো একের পর এক বন্ধ করা হচ্ছে। মানুষ গুম হচ্ছে। ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্মম নির্যাতন করা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের। এরূপ ফ্যাসিবাদী নির্মমতার বিরুদ্ধে বহু বিবেকবান মানুষই প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদে সাধারণ জনগণও জেগে উঠেছে। জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া প্রতিটি মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। যখনই কোনো স্বৈরশাসক জনগণের ওপর এরূপ আঘাত হানে, তখনই জনগণ এভাবে জেগেছে। সেটি যেমন মুজিব আমলে জেগে উঠেছিল, তেমনি আজও জেগে উঠছে। এটিই একটি জীবিত জনগণের স্বাভাবিক রূপ। কিন্তু বিবেকের সে সুস্থতা কি আবুল বারকাতের মতো আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের আছে? থাকলে এ নৃশংসতার বিরুদ্ধে তা মুখে প্রতিবাদ কই? জনগণের জেগে ওঠার বিরুদ্ধে তারা এত শঙ্কিত কেন?
ফ্যাসিবাদের নাশকতা
রোগ-জীবাণুর আক্রমণে দেহের মৃত্যু ঘটে। আর ফ্যাসিবাদের আক্রমণে হাজার হাজার মানুষের দৈহিক মৃত্যুর সঙ্গে মৃত্যু ঘটে অসংখ্য মানুষের বিবেকেরও। বিপুল হারে উত্পাদিত হয় দাস চরিত্রের মানুষ। বাংলাদেশের বুকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হাতে এখানেই ঘটেছে সবচেয়ে বড় নাশকতা। তারা বহু হাজার মানুষকেই শুধু হত্যা করনি, হত্যা করেছে লাখ লাখ মানুষের বিবেকও। অন্ধ করে দিয়েছে তাদের মনও। সেটি যেমন মুজিব আমলে ঘটেছিল, তেমনি আজও ঘটছে। এতে আওয়ামী লীগ ও তার পক্ষের হাজার হাজার নেতাকর্মী আজ বিবেকশূন্য। হাসিনা সরকারের হাতে নির্মম নৃশংসভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু যেমন তাদের নজরে পড়ে না, তেমনি নজরে পড়ে না শেখ মুজিবের বাকশালি স্বৈরাচারের নিষ্ঠুরতাও। সরকারি প্রচারযন্ত্র ব্যস্ত মুজিবের সে নিষ্ঠুরতা ভুলিয়ে তাকে ফেরেশতাতুল্য হিসেবে জাহির করার কাজে। সে কাজে নেমেছেন আবুল বারকাতের মতো শত শত ব্যক্তি। সে মুজিবি নিষ্ঠুরতা যে কত নির্মম ছিল, তার বিবরণ বহু। উদাহরণ দেয়া যাক কমিউনিস্ট নেতা (সিপিবি নয়) শান্তি সেনের স্ত্রী অরুণা সেনের বিবৃতি থেকে। অরুণা সেন ও তার পুত্রবধূ রিনা সেন ও হনুফা বেগমকে রক্ষীবাহিনী কী বর্বর নির্যাতনই না করেছিল! শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, পুকুরে চোবানো, চাবুক দিয়ে পেটানো, নগ্ন অসুস্থ অবস্থায় কম্বলচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে রাখা (কথামালার রাজনীতি ১৯৭২-’৭৯/ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, তৃতীয় সংস্করণ, পৃ.৫৫)। মুজিব আমলে বাজিতপুরের ইকোটিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল আলীর ছেলে রশিদের খুনের ঘটনাটি কত নৃশংসাভাবে ঘটেছিল, সে বিবরণ দিয়েছেন আবদুল আলী এক সাক্ষাত্কারে। সেটি এরূপ : ‘আমার সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করল। আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল, ‘মাথা কেটে দে, ফুটবল খেলব।’ আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। কিন্তু অত্যাচার কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়। সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে ছেলের মাথা কেটে দিয়েছি।’ (বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মুসা, পৃ. ৬৭-৬৮)। এরূপ নির্যাতন ও এরূপ নৃশংসতা শুধু অরুণা সেন, রিনা সেন কিংবা কৃষক আবদুল আলীর ছেলে রশিদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি; ঘটেছে আরও হাজার হাজার মানুষের ক্ষেত্রে। ইদানীং একই নৃশংসতা ঘটে গেল শাপলা চত্বরে। আজও ঘটছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও শত শত জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে।
ঘরের শত্রু ও বিপর্যয়ের পথে দেশ
আবুল বারকাতের দৃষ্টিতে এ নৃশংস মুজিবই বাংলার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তার দল আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগঠন। তিনি তার বয়ানে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনরূপে ভূষিত করেছেন। অন্য কোনো দলের প্রশংসায় তিনি একটি কথাও বলেননি। কথা হলো, আবুল বারকাত কি স্বাধীনতার অর্থ বোঝেন? স্বাধীনতার অর্থ একটি মানচিত্র লাভ। বাংলার মানচিত্র কি আগেও কেউ গিলে খেয়েছিল? স্বাধীনতার অর্থ তো সাধারণ জনগণের মতামত প্রকাশ, সংগঠন গড়া, রাজনীতি করা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার পূর্ণ স্বাধীনতা, সেটি স্রেফ কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বাধীনতা নয়। শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ কি সে স্বাধীনতা জনগণকে কোনোকালেও দিয়েছে; আজও কি দিচ্ছে? বরং জনগণের সে স্বাধীনতা নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেটি যেমন একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে, তেমনি মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে। বরং আওয়ামী লীগের অপরাধ তো আরও জঘন্য। শুধু কথা বলা, দল গড়া বা রাজনীতির অধিকারই তারা হরণ করেনি; বরং কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার অধিকারও। মুজিব তার শাসনামলে হত্যা করেছেন ৩০-৪০ হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে। ৫ মে ও ৬ মে মাত্র এ দুটি দিনে মুজিবকন্যা নিহত ও আহত করেছেন হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার মুসল্লিকে। বাংলার বুকে মুসলমানের এত বড় ক্ষতি কোনো মনুষ্যজীবের হাতে কি কোনোকালেও হয়েছে? জনগণের জানমাল ও স্বাধীনতার এত বড় শত্রুকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বললে স্বাধীনতার শত্রু কে?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ও তার পরিবারের অনেকেই নিহত হয়েছেন। কিন্তু মুজিব পরিবারের সব সদস্য তার পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়ে ডাইনোসরের মতো নির্মূল হয়ে যাননি। বাংলার মানুষ তাই ডাইনোসরকে না চিনলেও মুজিব ও তার পরিবারকে চেনে। মাঝে মধ্যে ভুলে গেলেও আবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য মুজিব পরিবারের সদস্যরা এখনও বেঁচে আছেন। রাজনীতিতে বেঁচে আছেন মুজিবি নৃশংসতা নিয়ে। বাংলাদেশে জনগণের বুকে বারবার ছোবল মারছে মুজিবি বাকশাল। আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানার জন্য কি ইতিহাসের বই পাঠের প্রয়োজন পড়ে? আবুল বারকাতদের বয়ান শোনারও কি প্রয়োজন হয়? তবে তার বয়ানে যেটি প্রকাশ পেয়েছে, সেটি তার নিরেট মিথ্যাচার ও চাটুকারী চরিত্র। সেই সঙ্গে ইসলামের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রোশ। বাংলাদেশের মুসলমানের বিরুদ্ধে এরাই ঘরের শত্রু। জানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু গোখরা শাপগুলোক চিনলে চলে না, ভালোভাবে চিনতে হয় ঘরের শত্রুদেরও; চিনতে হয় বিদেশি শত্রুদেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রির চেয়েও এ জ্ঞানের গুরুত্ব অনেক বেশি। ইসলামের শুরুতে কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, কিন্তু মসজিদের পবিত্র মেঝেতে এ জ্ঞানলাভটি সঠিকভাবে হয়েছিল। ফলে ঘরের গোখরা শাপগুলো চিনতে ও নির্মূলে তারা ভুল করেননি। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটাই যথার্থভাবে হয়নি। এ কারণে নিশ্চিত হয়নি দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও গৌরব। মানুষ তাই হাজারে হাজার লাশ হচ্ছে, গুম হচ্ছে, ধর্ষিতাও হচ্ছে এবং দেশ ধেয়ে চলেছে মহাবিপর্যয়ের দিকে।
আবুল বারকাত লেখাপড়া করেছেন সোভিয়েত রাশিয়ায়। ভারতীয় লবির অতি কাছের লোক তিনি। ঢাকায় অবস্থানরত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী মহলের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইসলামের বিরুদ্ধে আজ বিশ্বব্যাপী যে কোয়ালিশন, তার প্রায় সবার সঙ্গেই তার গভীর সম্পর্ক। চাকরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলেও তার আসল কাজটি অন্যত্র। গবেষণা ও ইভলিউশনের নামে তার একটি এনজিও আছে। সে এনজিও’র সূত্র ধরে তিনি প্রচুর অর্থ পান পশ্চিমা দাতা সংস্থাগুলো থেকে। সেই সঙ্গে আওয়ামী শাসনামলের অতিসুবিধাভোগী ব্যক্তিও। জনতা ব্যাংকের তিনি একজন কর্ণধার। আবুল বারকাতের মূল কাজটি হলো, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের নির্মূলে অন্যদের উসকানি দেয়া। তার গবেষণা ও লেখালেখির বিষয় মূলত দুটি—এক. কী করে বাংলাদেশের মাটিতে হিন্দু ও হিন্দুস্থানের স্বার্থকে বৃদ্ধি করা যায়; দুই. কী করে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেয়া যায়। মুজিব আমলে বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা ভারত লুটে নিয়ে গেল, তা নিয়ে কিন্তু তিনি কোনো সময়ই মুখ খোলেননি। সে লুটের মধ্যে ছিল পাকিস্তান আর্মির অব্যবহৃত হাজার হাজার কোটি টাকার যুদ্ধাস্ত্র। ভারত বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান আর্মির কোনো ট্যাংক, কোনো দূরপাল্লার কামান ও গোলাবারুদ রেখে যায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় যে কয়েকটি ট্যাংক নামানো হয়েছিল, সেগুলো এসেছিল মিসর থেকে। এসেছিল তত্কালীন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের খয়রাত হিসেবে। অথচ পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া যুদ্ধাস্ত্র তখন বাংলাদেশের মাটিতে থাকলে এরূপ খয়রাতের কি প্রয়োজন হতো?
আবুল বারকাতের ইসলামভীতি ও ইসলামবিরোধিতা
এ আবুল বারকাত কিছুকাল আগে এক বইয়ে দেখিয়েছিলেন, ইসলামী ব্যাংক কীভাবে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের অর্থনীতির বিশাল ভিত গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ বেসরকারি এ ব্যাংকটিকে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক প্রতিষ্ঠানরূপে। উসকানি দিয়েছেন, এ ব্যাংককে ইসলামপন্থীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার। লক্ষ্য, এ ব্যাংকটিও পরিণত হোক সোনালী ও জনতা ব্যাংকের মতো আওয়ামী বাকশালিদের লুটপাটের অবাধ ও উর্বর ক্ষেত্ররূপে। ইসলামী ব্যাংকের অর্থে বাংলাদেশে যে কয়েক হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে বহু হাসপাতাল, বহু পশুপালন ও মত্স্যপালন প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তায় নেমেছে যেরূপ হাজার হাজার যানবাহন, সেটি তার নজরে পড়েনি। সম্প্রতি দেশের নানা স্থানে ইসলামী ব্যাংকের নানা শাখার ওপর যে হামলা হয়েছে, তার পেছনে আবুল বারকাতের মতো ব্যক্তিদের উসকানি যে সক্রিয় ছিল, তা নিয়ে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে?
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর্যুপরি হরতালের সফলতা দেখে আবুল বারকাতের মতো ব্যক্তিদের ভয় গভীরতর হয়েছে। সে ভয় আরও তুঙ্গে উঠেছে ৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের প্রায় তিরিশ লাখ লোকের লংমার্চ দেখে। এ ভয়ই তাদের মরণের ভয়। আবুল বারকাতের ভয়, বাংলাদেশ শিগগিরই তালেবান রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। তার নিজের উক্তি, ‘এখনই সমাধানে পৌঁছতে না পারলে বাংলাদেশ তালেবান রাষ্ট্র হতেই পারে। কারণ একটি বিপ্লব বা পটপরিবর্তনের জন্য কোটি কোটি লোকের প্রয়োজন পড়ে না। শতকরা দুই বা পাঁচ ভাগ কর্মী থাকলেই অনেক কিছু সম্ভব। জামায়াত-শিবিরের তো পাঁচ ভাগ সক্রিয় সমর্থক আছেই। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর একাংশ যোগ হতেই পারে। না হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ জামায়াত রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র তৈরি করেছে। আপনি আইনজীবীদের নির্বাচনগুলো দেখুন, ওরা কত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।’ তবে ‘সাপ্তাহিক’-এর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে আবুল বারকাত যা বলেছেন, সেটি বস্তুত তার একার বক্তব্য নয়, বরং সেটি গোটা সেক্যুলার পক্ষের। মুখপাত্ররূপে তিনি তাদের কথাগুলোই তুলে ধরেছেন মাত্র।
যে অসুস্থতা বিবেকের
বেশি ভয়ে মানুষ পাগলের প্রলাপ বকে। এমন ভীতু মানুষের সামনে ছোটখাটো মানুষও ভয়ঙ্কর দৈত্য মনে হয়। এমন ভয়ে আক্রান্ত আবুল বারকাত। তার মুখে তাই প্রলাপও অনেক। জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সংগঠন তাই তার কাছে সাধারণ সংগঠন মনে হয়নি; মনে হয়েছে বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী একটি পৃথক রাষ্ট্র! তার নিজের কথা—‘তারা সৃষ্টি করেছে মূল ধারার রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র, মূল ধারার সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার, মূল ধারার অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি।’ প্রশ্ন হলো, একটি রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়, সে জ্ঞান কি আবুল বারকাতের আছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কী—সেটি কি কখনওই তিনি একবার পড়ে দেখেছেন? রাষ্ট্র মানবসমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের যেমন নিজস্ব মানচিত্র থাকে, তেমনি সরকার, বিশাল প্রশাসন ও বিশাল বিশাল বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও থাকে। থাকে বিচারকার্য নির্বাহের জন্য আইন-কানুন ও আদালত। থাকে বেতনভোগী বিশাল সশস্ত্র সেনা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী। কিন্তু জামায়াতের হাতে এর কোনটি আছে? তাদের অফিসগুলো তো দীর্ঘকাল তালাবদ্ধ। তাদের কর্মীরা তো রাজপথে নামে খালি হাতে। তাদের রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট মানচিত্র বা সীমানাটি কোথায়? কোথায় সে রাষ্ট্রের প্রহরায় সশস্ত্র সেনাবাহিনী? কোথায় তাদের সে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন? একটি ব্যাংক, কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অর্থ কি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা? ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে এর চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠান আছে। জামায়াত যদি আলাদা রাষ্ট্র হয়েই থাকে, তবে সে রাষ্ট্রের প্রধান বছরের পর বছর শত্রুপক্ষের জেলে থাকলে সে রাষ্ট্র বেঁচে থাকে কী করে? আবুল বারকাতের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর আছে কি? অথচ এরাই আওয়ামী লীগের প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী! এককালে বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। সে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের প্রাদেশিক গভর্নর ছিল এবং তার একটি প্রশাসনও ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে ভারতীয় বাহিনীর দখলদারির কারণে সে প্রাদেশিক সরকারের সবাই কারারুদ্ধ হয়। তখন পাকিস্তানি রাষ্ট্রও এ প্রদেশটিতে আর বাঁচেনি। এতে জামায়াত যদি রাষ্ট্রই হয়ে থাকে, তবে দলটির প্রধান ও তার কেন্দ্রীয় নেতারা কারারুদ্ধ হলে সে রাষ্ট্র বাঁচে কী করে? এসব প্রশ্ন কি আবুল বারকাতের মনে একবারও উদয় হয়েছে?
বহু মানুষ শুধু মানসিক বিকলঙ্গতা নিয়ে জন্মায় না। জন্মের পর, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রি নিয়েও বহু মানুষ পাগল হয়। আওয়ামী লীগে এমন অপ্রকৃতস্থ পাগলের সংখ্যা কি কম; বরং এ আওয়ামী পাগলদের পাগলামিটা ভিন্ন মাত্রার। কোনো বদ্ধপাগলও কি কখনও বলবে, কিছু মানুষের ঝাঁকুনিতে একটি নয়তলা বিশাল বিল্ডিং ধসে পড়বে? অথচ যিনি বলেছেন, তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আর তার নাম মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ফলে আওয়ামী লীগে এমন পাগল শুধু আবুল বারকাত একা নন। ডাকাত দলে একজনও সুস্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি পাওয়া যাবে না আওয়ামী লীগেও। কারণ সুস্থ মানুষের সুস্থতার সবচেয়ে বড় গুণটি হলো ডাকাতিকে ঘৃণা করা। তাই ডাকাত দল গড়ে ওঠে শতভাগ অসুস্থ ও চরিত্রহীন মানুষ দিয়ে। এ অসুস্থতা দৈহিক নয়, বরং নৈতিক। তেমনি কোনো স্বৈরাচারী শাসকের দলেও কোনো সুস্থ ও চরিত্রবান মানুষ পাওয়া যায় না। মূর্তিপূজারি কাফেরদের মন্দিরে ঈমানদার খুঁজে পাওয়ার মতো সেটিও এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। কারণ সুস্থ ও চরিত্রবান মানুষ দিয়ে তো আর ফ্যাসিবাদী দল গড়া যায় না এবং তাদের দিয়ে বাকশালি স্বৈরাচার ও হাজার হাজার মানুষ হত্যার নীতিকে সমর্থন করিয়ে নেয়া যায় না।
মিথ্যা বলা যেখানে স্ট্র্যাটেজি
ইসলামের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘকালীন গণহত্যার যুদ্ধকে ন্যায়সঙ্গত করার স্বার্থে আল কায়েদাকে একটি দানবীয় শক্তিরূপে চিত্রিত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন জনগণকে আল কায়েদার ভয় না দেখালে সরকারের পক্ষে কি সম্ভব হতো তাদের পকেট থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুট করা? সম্ভব হতো কি আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের বিশাল যুদ্ধকে গ্রহণযোগ্য করা? বাংলাদেশেও তেমনি ইসলামপন্থীদের সহিংসতা নির্মূলের লক্ষ্যে ইসলামি দলগুলোকে দানবীয় শক্তিরূপে চিত্রিত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা হচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার কর্মীকে নির্মমভাবে হতাহত করাকে জায়েজ করতে তারা প্রচার করছে হেফাজতের মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররমের সামনে বইয়ের দোকানে পবিত্র কোরআন শরিফ পুড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা রাস্তার গাছ নষ্ট করেছে। শত শত মানুষ হত্যাকারী এ খুনিরা এখন গাছপ্রেমিক হয়েছে? বলা হচ্ছে, তারা নাকি ব্যাংকগুলোতে আগুন দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। এক্ষেত্রে আবুল বারকাতের নিজের মিথ্যাচারটিও দেখবার মতো। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন প্রতি তিনজন ছাত্রের একজন মাদরাসার ছাত্র (যার মোট সংখ্যা হবে ৮০ লাখ)। দেশে মোট মাদরাসার সংখ্যা হবে ৫৫ হাজারের বেশি, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা। এসব মাদরাসা পরিচালনে বছরে ব্যয় হয় আনুমানিক ১,৪০০ কোটি টাকা আর মাদরাসা পাসদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭৫ শতাংশ।’ বোঝা যাচ্ছে, যেখানেই তিনি নজর দেন, সেখানেই তিনি মাদরাসার ছাত্র দেখতে পান। সে সংখ্যাও প্রতি তিনজনে একজন! ফলে সর্বত্র দেখতে পান বিপুলসংখ্যক ইসলামের ঝান্ডাবাহীদের। এটি তার মহাদুশ্চিন্তা। তার ভাষায় মহাবিপর্যয়। প্রশ্ন হলো, এমন মহাবিপর্যয়ের এত দুশ্চিন্তা নিয়ে তিনি ঘুমান কী করে? অথচ তার মনে সামান্য ঈমান থাকলে বিষয়টি ভিন্নতর হতো। কারণ যেখানেই ইসলাম, যেখানে মাদরাসার ছাত্র—তা দেখে তো একজন ঈমানদার খুশি হন। কারণ তারা তো ইসলামের সেবক। তাদের দেখে মৃত্যুর ভয় পাবে তো ইসলামের শত্রুরা। কিন্তু সেটিই হয়েছে আবুল বারকাতের ক্ষেত্রে। ইসলাম ও মাদরাসার ছাত্র দেখে তিনি ভয়ে জর্জরিত। তিনি ভয় পাচ্ছেন, ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অচিরেই দখল করে নেবে! তার ভয়, ইসলামি যুবকদের আত্মদানে। তারা কেন শহীদ হয় এবং শহীদি জজবা নিয়ে বোমায় পরিণত হয়, তা নিয়ে তার প্রচুর বিস্ময়।
আরও প্রশ্ন হলো, এসব আজগুবি তথ্য আবুল বারকাত পেলেন কোত্থেকে? বাংলাদেশের প্রতি তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন মাদরাসা ছাত্র এবং তাদের সংখ্যা ৮০ লাখ—এসব কি বিশ্বাসযোগ্য? মাদরাসার পেছনে ১৪শ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়—এমন নিখুঁত হিসাবইবা কোত্থেকে বের করলেন? মিথ্যা আবিষ্কারে তাদের মগজ যে কত উর্বর, এ হলো তার নমুনা। হার্ভার্ডে বসে হাসিনাতনয় জয়ও এমন মিথ্যা আবিষ্কার করেছিলেন। সে বলেছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক অফিসার হলো মাদরাসার ছাত্র। আওয়ামী নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের ঘরে ঘরে এভাবেই মিথ্যা উত্পাদনের ফ্যাক্টরি।
নিন্দিত হচ্ছে জিহাদ ও ইসলামি রাষ্ট্র
ইসলামের শত্রুদের কাছে ইসলামি রাষ্ট্র যেমন নিন্দিত, তেমনি অপরাধ হলো সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ। আবুল বারকাত সে জিহাদকে চিত্রিত করেছেন জঙ্গিবাদরূপে। তার মতো লোকদের কাছে জঘন্য ভাষায় নিন্দিত হচ্ছে ইসলামপন্থীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেয়ার চেষ্টা। ইসলামি রাষ্ট্র তাদের কাছে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। ইসলামের বিরুদ্ধে এমন এক বিষাক্ত ঘৃণা নিয়েই তো নাস্তিক ব্লগাররা মহান আল্লাহ তায়ালা, তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.) ও রাসুল (সা.)-এর বিবিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে যাচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পর থেকে ইসলামের শত্রুপক্ষের মনে ইসলামভীতি এখন তুমুলে। তাদের বিরুদ্ধে আবুল বারকাতের অভিযোগ, ‘সুসংগঠিত জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত।’ বলেছেন, ‘তারা ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে।’ অভিযোগ তুলেছেন, ‘ধর্মভিত্তিক এ রাজনৈতিক মতাদর্শ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’
প্রশ্ন হলো, ইসলামের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করা এবং সে জিহাদে প্রাণ দেয়া এবং ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা কি এক কথা? মুসলমান হওয়ার দায়বদ্ধতা হলো, ইসলামি বিধান প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেয়া। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে না নিলে রাষ্ট্রের বুকে ইসলামের শরিয়তি বিধানের প্রতিষ্ঠা কীরূপে সম্ভব? ইসলাম তাই মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ বা মাজারে বন্দি থাকার বিষয় নয়। নবীজী তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নিয়েছিলেন, সাহাবারাও নিয়েছিলেন। ইসলামের শত্রুপক্ষের অধিকৃতি হটিয়ে দখলে নেয়ার কাজটি হলো জিহাদ। এমন জিহাদে প্রাণদান হলো শাহাদত। ইসলামে তো এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মকর্ম। অথচ আবুল বারকাত এর মধ্যে দোষ খুঁজছেন। তার কথা, ইসলাম যতদিন মসজিদ-মাদরাসা, সুফিদের মাজারে বা খানকায় আবদ্ধ থাকবে, ততদিনই সেটি প্রকৃত ধর্ম। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নেয়ার চেষ্টা হলেই সেটি উগ্র জঙ্গিবাদ। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়েছেন খোদ নবীজি (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনরা। প্রশ্ন হলো, তাদের তিনি কী বলবেন? আবুল বারকাতের কাছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলো রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ। অথচ মুজিব যেভাবে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করলেন, ছিনিয়ে নিলেন জনগণের মৌলিক মানবিক অধিকার এবং হত্যা করলেন ৩০-৪০ হাজার মানুষ, তাকে তিনি কী বলবেন? মুজিবের মতো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রমাণিত শত্রুকে তিনি বঙ্গবন্ধু বলতে পাগল! তিনি মুজিবকে এতটা মাথায় তুলেছেন তার নিজের অবস্থান গণতন্ত্র, মানবতা ও ইসলামের বিপক্ষে হওয়ার কারণে। মানবতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি বিপক্ষীয় অবস্থান থেকে তিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে গালাগাল করবেন এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নাস্তিকদের ইসলামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ ও ইসলামি নেতাদের ফাঁসির আন্দোলনকে ‘তরুণ প্রজন্মের আলোকিত আন্দোলন’ বলবেন, সেটিই কি স্বাভাবিক নয়?
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা কি বিপর্যয়?
যেখানেই ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার, সেখানেই আবুল বারকাতের মতো ব্যক্তি পশ্চাত্পদতা ও সাম্প্রদায়িকতা দেখেন; দেখেন বিপর্যয় এবং মুসলমানদের গলাকাটার মধ্যে দেখেন প্রগতি। তাই প্রচণ্ড প্রগতি দেখেছেন মতিঝিলে হাজার হাজার মুসল্লি হত্যার মধ্যে। অথচ ভারতে মুসলিম নিধন ও মুসলমান নারীদের ধর্ষণের মাঝে তিনি কোনো পশ্চাত্পদতা দেখেন না। তাই তার বিরুদ্ধে নিন্দাবাদও জানান না। বহু ভারতীয় হিন্দুও ভারতে এরূপ মুসলিম হত্যার প্রবল নিন্দা জানিয়েছেন। অরুন্ধতি রায়ের মতো ব্যক্তিরা আন্দোলনেও নেমেছেন। কিন্তু আবুল বারকাতরা কি একটিবারের জন্যও নিন্দা বা প্রতিবাদ জানিয়েছেন? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাঝে যৌক্তিকতা দেখেছেন, এমনকি অনেক অমুসলমানও। আবুল বারকাতরা যে ভারতীয় হিন্দুদের চেয়েও বেশি মুসলিমবিদ্বেষী, সেটি কি এরপরও বুঝতে বাকি থাকে? এমন একটি মুসলিমবিদ্বেষ নিয়েই তিনি ১৯৪৭ সালের উপমহাদেশের মুসলমানদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনকে বলেছেন পশ্চাত্মুখী। তার কথায় ‘পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে প্রথম বড় মাপের পশ্চাত্মুখী রূপান্তর (বিপর্যয়) ঘটেছে গত শতাব্দীতে—যখন ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ এলো।’ যেখানেই মুসলমানের জাগরণ ও স্বার্থ রক্ষণের বিষয়, সেটিই আবুল বারকাতের কাছে মনে হয়েছে পশ্চাত্পদতা। সে ধারণা নিয়েই তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে বলছেন সাম্প্রদায়িকতা। কথা হলো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে আজকের বাংলাদেশ কোত্থেকে আসত? সে হুশ কি তার আছে? তার আফসোস, ‘ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাজনে ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক-মানবিক ধারার সুফি-ওলামারা বাধা দিতে পারলেন না।’ অথচ মহম্মদ ঘোরির হাতে দিল্লি বিজয়েরে পর দক্ষিণ এশিয়ার বুকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক ঘটনা। মুসলমানের বিজয় ও গৌরব নিয়ে যাদের মনঃকষ্ট একমাত্র তারাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সৃষ্টিতে কষ্ট পেতে পারে। সে কষ্ট যেমন ভারতীয় হিন্দুরা পায়, তেমনি বাংলাদেশের বুকে তাদের প্রতিপালিত এজেন্টরাও পায়।
বাংলাদেশে আজও ইসলামপন্থীদের কেন ফাঁসিতে ঝোলানো যায়নি, তা নিয়ে আবুল বারকাতদের বড়ই আফসোস। সে কাজ সে হাসিনা শুরু করেছেন। তাতেই তার আনন্দ। তবে তার ভয় বেড়েছে ইসলামের পক্ষে গণজাগরণ দেখে। সে জাগরণের মাঝে তিনি বিপন্নতা দেখছেন। বলেছেন, ‘উগ্র জঙ্গিবাদ যে ‘আত্মঘাতী বোমা সংস্কৃতি’ চালু করেছে, তাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে দেশের সব মানুষের জীবন বিপন্নপ্রায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া যতই ত্বরান্বিত হচ্ছে, এ বিপন্নতা ততই বাড়ছে।’ অথচ আবুল বারকাত দেখেও দেখেন না যে, দেশে আজ প্রচণ্ড ফ্যাসিবাদী শাসন। দেশের শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে ইসলামপন্থীদের হাতে নয়, বরং আওয়ামী দুর্বৃত্তদের হাতে। দেশ বিপন্ন তো হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে। দেশের স্বাধীনচেতা মানুষের পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ৩০-৪০ হাজার মানুষ আজ জেলে। ৫ মে ও ৬ মে বহু হাজার মুসল্লিকে এ ফ্যাসিস্ট সরকার নির্মমভাবে নিহত ও আহত করল। তার আগে নিহত করেছে প্রায় দুইশ’ জামায়াত শিবিরকর্মী ও সাধারণ মানুষকে। সরকারবিরোধী গণমাধ্যমগুলো একের পর এক বন্ধ করা হচ্ছে। মানুষ গুম হচ্ছে। ‘আমার দেশ’ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্মম নির্যাতন করা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের। এরূপ ফ্যাসিবাদী নির্মমতার বিরুদ্ধে বহু বিবেকবান মানুষই প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদে সাধারণ জনগণও জেগে উঠেছে। জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া প্রতিটি মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। যখনই কোনো স্বৈরশাসক জনগণের ওপর এরূপ আঘাত হানে, তখনই জনগণ এভাবে জেগেছে। সেটি যেমন মুজিব আমলে জেগে উঠেছিল, তেমনি আজও জেগে উঠছে। এটিই একটি জীবিত জনগণের স্বাভাবিক রূপ। কিন্তু বিবেকের সে সুস্থতা কি আবুল বারকাতের মতো আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের আছে? থাকলে এ নৃশংসতার বিরুদ্ধে তা মুখে প্রতিবাদ কই? জনগণের জেগে ওঠার বিরুদ্ধে তারা এত শঙ্কিত কেন?
ফ্যাসিবাদের নাশকতা
রোগ-জীবাণুর আক্রমণে দেহের মৃত্যু ঘটে। আর ফ্যাসিবাদের আক্রমণে হাজার হাজার মানুষের দৈহিক মৃত্যুর সঙ্গে মৃত্যু ঘটে অসংখ্য মানুষের বিবেকেরও। বিপুল হারে উত্পাদিত হয় দাস চরিত্রের মানুষ। বাংলাদেশের বুকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হাতে এখানেই ঘটেছে সবচেয়ে বড় নাশকতা। তারা বহু হাজার মানুষকেই শুধু হত্যা করনি, হত্যা করেছে লাখ লাখ মানুষের বিবেকও। অন্ধ করে দিয়েছে তাদের মনও। সেটি যেমন মুজিব আমলে ঘটেছিল, তেমনি আজও ঘটছে। এতে আওয়ামী লীগ ও তার পক্ষের হাজার হাজার নেতাকর্মী আজ বিবেকশূন্য। হাসিনা সরকারের হাতে নির্মম নৃশংসভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু যেমন তাদের নজরে পড়ে না, তেমনি নজরে পড়ে না শেখ মুজিবের বাকশালি স্বৈরাচারের নিষ্ঠুরতাও। সরকারি প্রচারযন্ত্র ব্যস্ত মুজিবের সে নিষ্ঠুরতা ভুলিয়ে তাকে ফেরেশতাতুল্য হিসেবে জাহির করার কাজে। সে কাজে নেমেছেন আবুল বারকাতের মতো শত শত ব্যক্তি। সে মুজিবি নিষ্ঠুরতা যে কত নির্মম ছিল, তার বিবরণ বহু। উদাহরণ দেয়া যাক কমিউনিস্ট নেতা (সিপিবি নয়) শান্তি সেনের স্ত্রী অরুণা সেনের বিবৃতি থেকে। অরুণা সেন ও তার পুত্রবধূ রিনা সেন ও হনুফা বেগমকে রক্ষীবাহিনী কী বর্বর নির্যাতনই না করেছিল! শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, পুকুরে চোবানো, চাবুক দিয়ে পেটানো, নগ্ন অসুস্থ অবস্থায় কম্বলচাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে রাখা (কথামালার রাজনীতি ১৯৭২-’৭৯/ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, তৃতীয় সংস্করণ, পৃ.৫৫)। মুজিব আমলে বাজিতপুরের ইকোটিয়া গ্রামের কৃষক আবদুল আলীর ছেলে রশিদের খুনের ঘটনাটি কত নৃশংসাভাবে ঘটেছিল, সে বিবরণ দিয়েছেন আবদুল আলী এক সাক্ষাত্কারে। সেটি এরূপ : ‘আমার সামনে ছেলেকে গুলি করে হত্যা করল। আমার হাতে কুঠার দিয়ে বলল, ‘মাথা কেটে দে, ফুটবল খেলব।’ আমি কি তা পারি? আমি যে বাপ। কিন্তু অত্যাচার কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়। সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে ছেলের মাথা কেটে দিয়েছি।’ (বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমেদ মুসা, পৃ. ৬৭-৬৮)। এরূপ নির্যাতন ও এরূপ নৃশংসতা শুধু অরুণা সেন, রিনা সেন কিংবা কৃষক আবদুল আলীর ছেলে রশিদের ক্ষেত্রেই ঘটেনি; ঘটেছে আরও হাজার হাজার মানুষের ক্ষেত্রে। ইদানীং একই নৃশংসতা ঘটে গেল শাপলা চত্বরে। আজও ঘটছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও শত শত জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে।
ঘরের শত্রু ও বিপর্যয়ের পথে দেশ
আবুল বারকাতের দৃষ্টিতে এ নৃশংস মুজিবই বাংলার ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং তার দল আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগঠন। তিনি তার বয়ানে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনরূপে ভূষিত করেছেন। অন্য কোনো দলের প্রশংসায় তিনি একটি কথাও বলেননি। কথা হলো, আবুল বারকাত কি স্বাধীনতার অর্থ বোঝেন? স্বাধীনতার অর্থ একটি মানচিত্র লাভ। বাংলার মানচিত্র কি আগেও কেউ গিলে খেয়েছিল? স্বাধীনতার অর্থ তো সাধারণ জনগণের মতামত প্রকাশ, সংগঠন গড়া, রাজনীতি করা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করার পূর্ণ স্বাধীনতা, সেটি স্রেফ কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বাধীনতা নয়। শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ কি সে স্বাধীনতা জনগণকে কোনোকালেও দিয়েছে; আজও কি দিচ্ছে? বরং জনগণের সে স্বাধীনতা নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেটি যেমন একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে, তেমনি মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে। বরং আওয়ামী লীগের অপরাধ তো আরও জঘন্য। শুধু কথা বলা, দল গড়া বা রাজনীতির অধিকারই তারা হরণ করেনি; বরং কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার অধিকারও। মুজিব তার শাসনামলে হত্যা করেছেন ৩০-৪০ হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে। ৫ মে ও ৬ মে মাত্র এ দুটি দিনে মুজিবকন্যা নিহত ও আহত করেছেন হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার মুসল্লিকে। বাংলার বুকে মুসলমানের এত বড় ক্ষতি কোনো মনুষ্যজীবের হাতে কি কোনোকালেও হয়েছে? জনগণের জানমাল ও স্বাধীনতার এত বড় শত্রুকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বললে স্বাধীনতার শত্রু কে?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব ও তার পরিবারের অনেকেই নিহত হয়েছেন। কিন্তু মুজিব পরিবারের সব সদস্য তার পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়ে ডাইনোসরের মতো নির্মূল হয়ে যাননি। বাংলার মানুষ তাই ডাইনোসরকে না চিনলেও মুজিব ও তার পরিবারকে চেনে। মাঝে মধ্যে ভুলে গেলেও আবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য মুজিব পরিবারের সদস্যরা এখনও বেঁচে আছেন। রাজনীতিতে বেঁচে আছেন মুজিবি নৃশংসতা নিয়ে। বাংলাদেশে জনগণের বুকে বারবার ছোবল মারছে মুজিবি বাকশাল। আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানার জন্য কি ইতিহাসের বই পাঠের প্রয়োজন পড়ে? আবুল বারকাতদের বয়ান শোনারও কি প্রয়োজন হয়? তবে তার বয়ানে যেটি প্রকাশ পেয়েছে, সেটি তার নিরেট মিথ্যাচার ও চাটুকারী চরিত্র। সেই সঙ্গে ইসলামের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রোশ। বাংলাদেশের মুসলমানের বিরুদ্ধে এরাই ঘরের শত্রু। জানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু গোখরা শাপগুলোক চিনলে চলে না, ভালোভাবে চিনতে হয় ঘরের শত্রুদেরও; চিনতে হয় বিদেশি শত্রুদেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রির চেয়েও এ জ্ঞানের গুরুত্ব অনেক বেশি। ইসলামের শুরুতে কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, কিন্তু মসজিদের পবিত্র মেঝেতে এ জ্ঞানলাভটি সঠিকভাবে হয়েছিল। ফলে ঘরের গোখরা শাপগুলো চিনতে ও নির্মূলে তারা ভুল করেননি। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটাই যথার্থভাবে হয়নি। এ কারণে নিশ্চিত হয়নি দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও গৌরব। মানুষ তাই হাজারে হাজার লাশ হচ্ছে, গুম হচ্ছে, ধর্ষিতাও হচ্ছে এবং দেশ ধেয়ে চলেছে মহাবিপর্যয়ের দিকে।
No comments