রিমান্ডে নির্যাতন ও মানবাধিকার বেপারিদের নীরবতা by অলিউল্লাহ নোমান
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হুজুর
মৃত্যুশয্যায়। তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। যদিও এ লেখা শুরু করার সময় তাকে
আইসিইউ থেকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। স্বাভাবিক কোনো কারণে তার এই অবস্থা হয়নি।
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের
শিকার দেশের এই প্রখ্যাত আলেম।
যিনি হাজারও ছাত্রকে
বুখারি ও তাফসিরের দরস দিয়েছেন। ওস্তাজুল ওলামা তিনি। বানোয়াট কিছু মামলায়
তাকে আসামি করে রিমান্ড চায় পুলিশ। আমাদের স্বাধীন আদালতের ‘বিজ্ঞ’
ম্যাজিস্ট্রেটরা সরকারের হুকুম তামিল করেন। বাবুনগরী হুজুরকে প্রথম দফায় ১৩
দিন ও পরে আরও ২২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। যে আদালত জামিন না দিয়ে
রিমান্ড দিয়েছিল সে আদালতেই আবার তাকে তড়িঘড়ি জামিন দেয়া হয়েছে। বিচিত্র সব
ঘটনা! বিচিত্র আমাদের আইনের ব্যবহার।
কারাগারে যখন বাবুনগরী হুজুরের অবস্থা শঙ্কটাপন্ন তখন দ্রুত নেয়া হয় বারডেম হাসপাতালে। পরের দিন ভোরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন এক আইনজীবীকে। অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার চেম্বারে তিনি জুনিয়র হিসেবে কাজ করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে ফোনে অনুরোধ করেন বাবুনগরী হুজুরের জামিন চাওয়ার জন্য। জামিন চাইলে আদালত জামিন মঞ্জুর করবে এই সিদ্ধান্তের কথাও তাকে জানিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ কর্তা আগেই জানেন জামিন চাইলেই আদালত মঞ্জুর করবে। তার মানেই হচ্ছে আদালতে আইন চলে পুলিশ ও সরকারের ইশারায়। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রজ্ঞা ও আইনের বিশ্লেষণ এখানে কোনো কাজে আসে না। কিছুক্ষণ পরেই আবার কোর্ট ইন্সপেক্টর ওই আইনজীবীকে ফোন করেন। তিনিও একই কথা জানান তাকে। বাবুনগরী হুজুরের জন্য জামিনের আবেদন করার অনুরোধ। ছুটে আসেন নির্ধারিত মামলাগুলোর কোর্ট দারগা। আইনজীবীকে অনুরোধ করেন বাবুনগরী হুজুরের জামিন চান। চাইলেই তার জামিন দেয়া হবে। শুধু ওই আইনজীবী নয়, সিনিয়রদেরও ফোন করা হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। সুস্থ বাবুনগরী হুজুরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ৬ মে। অসুস্থ অবস্থায় ফেরত দেয়ার জন্য মরিয়া সরকার। সুস্থ অবস্থায় একই আদালত তাকে জামিন দেয়নি। আদালত দিয়েছিল রিমান্ডে। গ্রেফতারের দিন থেকে টানা এক মাসের বেশি রাখা হয় পুলিশের হেফাজতে। রিমান্ডে থাকাকালীন এই ডায়াবেটিক রোগীকে কোনো রকমের ওষুধ খেতে দেয়া হয়নি। তার উপর চালানো হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষরও নেয়া হয়। এই কাগজে তৈরি করা হয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। ঘটনাগুলো আইনজীবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় জানা গেছে।
তার আগে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ১১ এপ্রিল কমান্ডো স্টাইলে হানা দিয়ে পত্রিকা কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়। সেদিন বিকাল থেকে পত্রিকাটির ছাপাখানা তালাবদ্ধ করে রেখেছে পুলিশ। যদিও তথ্যমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে পরের দিনই বলেছিলেন আমার দেশ প্রকাশে কোনো বাধা নেই। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়নি। কিন্তু পত্রিকা ছাপতে দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে সেদিনই পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করে। বানোয়াট কিছু মামলায় রিমান্ড চায় পুলিশ। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পুলিশের আবেদন মঞ্জুর করে। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে মাহমুদুর রহমান গাড়ি ভাংচুর করেছেন, বাধা দিয়েছেন পুলিশের কাজে। ভাংচুরে উস্কানি দেয়ার অভিযোগেও তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মাহমুদুর রহমানকেও রিমান্ডে বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। এক পর্যায়ে ১৩ দিনের রিমান্ডে মাত্র সাতদিনের মাথায় আদালতে নিয়ে আসে পুলিশ। কারণ নির্যাতনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে দৈনিক আমার দেশ-এর প্রেস বন্ধ করে দেয়া, তার বৃদ্ধা মায়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং বিকল্প প্রেস থেকে ছাপার সময় ১৯ জন কর্মচারীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে তিনি রিমান্ডেই অনশন শুরু করেন। শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি দেখে পুলিশ তড়িঘড়ি করে আদালতে নিয়ে আসে তাকে। আদালত অবশ্য বাবু নগরীর মতো তার জামিন মঞ্জুর করেনি। পাঠিয়ে দেয় কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করে। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের আগেই তাকে সরকারি নির্দেশে হাসপাতাল থেকে আবার নেয়া হয়েছে কারাগারে। মাহমুদুর রহমানের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, মাহমুদুর রহমানকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। একই অবস্থা আল্লামা বাবুনগরীর বেলায়ও। আরও ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির বেলায়।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেফতারের পর টানা ৫২ দিন রিমান্ডে রাখে পুলিশ। পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করেই যাচ্ছিলেন। শিবির সভাপতিকে মুমূর্ষু অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয় চ্যাংদোলা করে। এই মুমূর্ষু অবস্থা থেকে উঠে দৌড়ে পালাতে পারেন, এজন্য পায়ে পরানো হয় ডাণ্ডাবেড়ি। অজ্ঞান অবস্থায় ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতিকে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে পুলিশ আদালতে হাজির করে। পত্রিকার পাতায় অজ্ঞান শিবির সভাপতির পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে চ্যাংদোলা করে আদালতে হাজির করার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার শারীরিক অবস্থা জানানোর জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। এই আবেদনের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, শিবির সভাপতির শরীরে নির্যাতনের কোনো চিহ্ন নেই। যেখানে ছবি কথা বলে, সেখানে রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল কতটা সত্য বলছেন সেই বিচার দেশের মানুষ করবে।
এর আগে বিএনপি কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা ১৫৮ জন নেতাকর্মীকে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তাদের আবার মঞ্জুর করা হয় রিমান্ড।
শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের এক যুবককে পুলিশ ধরে এনে নির্যাতন করে। চারদিন টানা রাখা হয় থানায়। নির্যাতনে মৃত্যুশয্যায় নেয়া হয় হাসপাতালে। ওই যুবক আর ফিরে আসেনি পরিবারের কাছে। চলে গেছে ইহজগত্ ছেড়ে।
২০১১ সালের ১৪ আগস্ট রাতে গ্রেফতার করা হয় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এমইউ আহমদকে। তাকেও ডিবি অফিসে নিয়ে বর্বর নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনে অজ্ঞান হয়েছিলেন তিনি। আর ফিরে আসেননি পরিবারের কাছে। তাকেও অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে কয়েক দিন চিকিত্সা দেয়া হয়। বেঁচে থাকার ভরসা না পেয়ে পুলিশ জামিন ছাড়াই তাকে পরিবারের জিম্মায় হাসপাতালে রেখে চলে যায়। পুলিশের এরকম বর্বর নির্যাতনের কাহিনী লিখে শেষ করা যাবে না। লেখা হচ্ছে পত্রিকায়। টকশো’র বুদ্ধি ব্যাপারিরাও কম বলছেন না। কিন্তু সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। সরকারের পুলিশ বাহিনী একেবারেই বেপরোয়া। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুলিশ এই বেপরোয়া ভাব দেখাচ্ছে। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বলেছেন, বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককে রাজপথে প্রকাশ্যে নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়েছে এক পুলিশ কর্তাকে। উপরের বিষয়গুলো এ কারণেই বলা, যাদের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো তারা কেউ-ই সাধারণ নাগরিক নন। সবাই সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাদের বেলায় যখন এ পরিণতি, সাধারণ নাগরিকের কী অবস্থা সেটা সহজেই অনুমেয়।
এখন দেখা যাক নির্যাতনের বিষয়ে আমাদের আইন কী বলছে। আইনে কতটা সুযোগ রয়েছে। আর আইনে সুযোগ না থাকলে ম্যাজিস্ট্রেটরা দেখেশুনে এভাবে রিমান্ড মঞ্জুর করছেন কেন। তাহলে কি আমাদের দেশে আইন, আদালত বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই? পুলিশ কর্তৃক এককভাবে গ্রেফতার-আটকের সময় ম্যাজিস্ট্রেটের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা থাকে না। কিন্তু গ্রেফতারকৃত সেই ব্যক্তিকে পুলিশ আদালতে উপস্থাপন করলে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু দায়বদ্ধতা দিয়েছে আইন। যখন তার কাছে রিমান্ড আবেদন করা হয় তখন তা কতটা যৌক্তিক বা আইনসঙ্গত সেটা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত দেয়ার দায়িত্ব হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেটের। পুলিশ রিমান্ড চেয়েছে বলেই ঢালাওভাবে বাছ-বিচার না করে তা প্রদান করা আইন সমর্থন করে না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় রিমান্ডের আবেদন জানাতে পারে পুলিশ। এই ধারায় রিমান্ডের আবেদন জানানোর এখতিয়ার দেয়া আছে। এই ধারাটিতে বলা হয়েছে—‘কোনো ব্যক্তিকে যে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় সেই মামলার তদন্তকার্য যদি ২৪ ঘণ্টায় শেষ করা না যায় এবং গ্রেফতারকৃত আসামিকে তদন্তের স্বার্থে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয় তবে গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগের প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ ও রিমান্ডের যৌক্তিকতা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাহার কেস ডায়রিতে উল্লেখপূর্বক উক্ত আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করিয়া রিমান্ডের জন্য আবেদন করিতে পারেন।’
তবে এই রিমান্ডের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে দিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের এই সীমারেখা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আমলেই নেয় না। পুলিশের তো নেয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ পুলিশ রাজপথে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করছে। সুতরাং উচ্চ আদালত কী বলল, বা নির্দেশনা দিল এতে তাদের কিছু যায় আসে না। কর্তার মর্জি রক্ষাটাই হচ্ছে তাদের কাছে বড় আইন!
রিমান্ড বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা : ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এই রায় দিয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল, হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আপিল বিভাগেও বহাল থাকে। রায়ে বলা হয়,
১. আটকাদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না। ২. কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। ৩. অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করতে হবে। ৪. গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে। ৫. গ্রেফতারের ৩ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে কারণ জানাতে হবে। ৬. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতের নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ৭. গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। ৮. জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ৯. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া গেলে তদন্ত কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। ১০. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ডাক্তার দেখাতে হবে।
আইনে আরও বলা আছে—(২) ‘পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই পুলিশের কেস ডায়রি এবং গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণ, যৌক্তিকতা ইত্যাদি পর্যালোচনা করিবেন। অতঃপর নিজে সন্তুুষ্ট হইবার পর রিমান্ড মঞ্জুর করিবেন।’
আইনের স্পিরিটটি হলো—মামলা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তদন্ত শেষ করতে হবে। তা না হলে ১৫ দিনের বেশি সময় তাতে নেয়া যাবে না (ধারা পিআরবি-২৬১) এবং কোনোক্রমেই কোনো আসামিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি পুলিশের রিমান্ডে দেয়া যাবে না। অথচ রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে সাজানো একাধিক মামলার আবরণে মাসের পর মাস পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে। এই রিমান্ডের যৌক্তিকতা বা আইনগত সামঞ্জস্য কতটা প্রমাণ করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং আবেদনকারী পুলিশ কর্মকর্তা? যদি তা না পারেন এবং তখন যদি তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা ধারা দণ্ড-২১৯ ও ২২০-এর আলোকে অভিযোগ আনেন, তখন কি তারা আইনের প্রটেকশন পাবেন বলে বিশ্বাস করেন? একবারও কি তারা আইনের এই ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে ভাবেন না?
আইনের তোয়াক্কা না করেই পুলিশ রিমান্ড চাইছে এবং ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করছে। সুস্থ মানুষকে রিমান্ডে নিয়ে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে পুলিশ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কারও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিকলাঙ্গ করে দেয়া হচ্ছে। ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে অজ্ঞান ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার পরও অ্যাটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে বলছেন, শরীরে কোনো নির্যাতনের চিহ্ন দেখা যায়নি। এর চেয়ে বড় লজ্জা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন আর কিছুই হতে পারে না। তারপরও আমাদের দলবাজ একপেশে মিডিয়াগুলো সরকারের এই নির্যাতন ও জুলুম রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। আদালতের আইন ব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। একটি জাতির ধ্বংসের জন্য এই অবিচার ও মিডিয়ার রাজনীতিই যথেষ্ট।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকার বেপারিরা রিমান্ডের এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো দেখেও না দেখার ভান করছেন। অতীতে পান থেকে চুন খসলেই মানবাধিকার বেপারি ও আদালত সরব হয়ে উঠতেন। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে সে তারাই নীরব। কারণ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদের মানবাধিকার থাকতে নেই!
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, লিখেছেন যুক্তরাজ্য থেকেax
কারাগারে যখন বাবুনগরী হুজুরের অবস্থা শঙ্কটাপন্ন তখন দ্রুত নেয়া হয় বারডেম হাসপাতালে। পরের দিন ভোরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন এক আইনজীবীকে। অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার চেম্বারে তিনি জুনিয়র হিসেবে কাজ করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে ফোনে অনুরোধ করেন বাবুনগরী হুজুরের জামিন চাওয়ার জন্য। জামিন চাইলে আদালত জামিন মঞ্জুর করবে এই সিদ্ধান্তের কথাও তাকে জানিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ কর্তা আগেই জানেন জামিন চাইলেই আদালত মঞ্জুর করবে। তার মানেই হচ্ছে আদালতে আইন চলে পুলিশ ও সরকারের ইশারায়। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রজ্ঞা ও আইনের বিশ্লেষণ এখানে কোনো কাজে আসে না। কিছুক্ষণ পরেই আবার কোর্ট ইন্সপেক্টর ওই আইনজীবীকে ফোন করেন। তিনিও একই কথা জানান তাকে। বাবুনগরী হুজুরের জন্য জামিনের আবেদন করার অনুরোধ। ছুটে আসেন নির্ধারিত মামলাগুলোর কোর্ট দারগা। আইনজীবীকে অনুরোধ করেন বাবুনগরী হুজুরের জামিন চান। চাইলেই তার জামিন দেয়া হবে। শুধু ওই আইনজীবী নয়, সিনিয়রদেরও ফোন করা হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। সুস্থ বাবুনগরী হুজুরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ৬ মে। অসুস্থ অবস্থায় ফেরত দেয়ার জন্য মরিয়া সরকার। সুস্থ অবস্থায় একই আদালত তাকে জামিন দেয়নি। আদালত দিয়েছিল রিমান্ডে। গ্রেফতারের দিন থেকে টানা এক মাসের বেশি রাখা হয় পুলিশের হেফাজতে। রিমান্ডে থাকাকালীন এই ডায়াবেটিক রোগীকে কোনো রকমের ওষুধ খেতে দেয়া হয়নি। তার উপর চালানো হয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই নির্যাতনের এক পর্যায়ে তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষরও নেয়া হয়। এই কাগজে তৈরি করা হয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। ঘটনাগুলো আইনজীবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় জানা গেছে।
তার আগে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে ১১ এপ্রিল কমান্ডো স্টাইলে হানা দিয়ে পত্রিকা কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়। সেদিন বিকাল থেকে পত্রিকাটির ছাপাখানা তালাবদ্ধ করে রেখেছে পুলিশ। যদিও তথ্যমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে পরের দিনই বলেছিলেন আমার দেশ প্রকাশে কোনো বাধা নেই। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়নি। কিন্তু পত্রিকা ছাপতে দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি সম্পাদক জনাব মাহমুদুর রহমানকে সেদিনই পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করে। বানোয়াট কিছু মামলায় রিমান্ড চায় পুলিশ। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পুলিশের আবেদন মঞ্জুর করে। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে মাহমুদুর রহমান গাড়ি ভাংচুর করেছেন, বাধা দিয়েছেন পুলিশের কাজে। ভাংচুরে উস্কানি দেয়ার অভিযোগেও তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মাহমুদুর রহমানকেও রিমান্ডে বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। এক পর্যায়ে ১৩ দিনের রিমান্ডে মাত্র সাতদিনের মাথায় আদালতে নিয়ে আসে পুলিশ। কারণ নির্যাতনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। একই সঙ্গে দৈনিক আমার দেশ-এর প্রেস বন্ধ করে দেয়া, তার বৃদ্ধা মায়ের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং বিকল্প প্রেস থেকে ছাপার সময় ১৯ জন কর্মচারীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে তিনি রিমান্ডেই অনশন শুরু করেন। শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি দেখে পুলিশ তড়িঘড়ি করে আদালতে নিয়ে আসে তাকে। আদালত অবশ্য বাবু নগরীর মতো তার জামিন মঞ্জুর করেনি। পাঠিয়ে দেয় কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষ তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করে। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশের আগেই তাকে সরকারি নির্দেশে হাসপাতাল থেকে আবার নেয়া হয়েছে কারাগারে। মাহমুদুর রহমানের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, মাহমুদুর রহমানকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি। একই অবস্থা আল্লামা বাবুনগরীর বেলায়ও। আরও ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতির বেলায়।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেফতারের পর টানা ৫২ দিন রিমান্ডে রাখে পুলিশ। পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করেই যাচ্ছিলেন। শিবির সভাপতিকে মুমূর্ষু অবস্থায় আদালতে হাজির করা হয় চ্যাংদোলা করে। এই মুমূর্ষু অবস্থা থেকে উঠে দৌড়ে পালাতে পারেন, এজন্য পায়ে পরানো হয় ডাণ্ডাবেড়ি। অজ্ঞান অবস্থায় ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতিকে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে পুলিশ আদালতে হাজির করে। পত্রিকার পাতায় অজ্ঞান শিবির সভাপতির পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে চ্যাংদোলা করে আদালতে হাজির করার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার শারীরিক অবস্থা জানানোর জন্য হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। এই আবেদনের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, শিবির সভাপতির শরীরে নির্যাতনের কোনো চিহ্ন নেই। যেখানে ছবি কথা বলে, সেখানে রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল কতটা সত্য বলছেন সেই বিচার দেশের মানুষ করবে।
এর আগে বিএনপি কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা ১৫৮ জন নেতাকর্মীকে ডাণ্ডাবেড়ি লাগিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তাদের আবার মঞ্জুর করা হয় রিমান্ড।
শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের এক যুবককে পুলিশ ধরে এনে নির্যাতন করে। চারদিন টানা রাখা হয় থানায়। নির্যাতনে মৃত্যুশয্যায় নেয়া হয় হাসপাতালে। ওই যুবক আর ফিরে আসেনি পরিবারের কাছে। চলে গেছে ইহজগত্ ছেড়ে।
২০১১ সালের ১৪ আগস্ট রাতে গ্রেফতার করা হয় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এমইউ আহমদকে। তাকেও ডিবি অফিসে নিয়ে বর্বর নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনে অজ্ঞান হয়েছিলেন তিনি। আর ফিরে আসেননি পরিবারের কাছে। তাকেও অজ্ঞান অবস্থায় পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে কয়েক দিন চিকিত্সা দেয়া হয়। বেঁচে থাকার ভরসা না পেয়ে পুলিশ জামিন ছাড়াই তাকে পরিবারের জিম্মায় হাসপাতালে রেখে চলে যায়। পুলিশের এরকম বর্বর নির্যাতনের কাহিনী লিখে শেষ করা যাবে না। লেখা হচ্ছে পত্রিকায়। টকশো’র বুদ্ধি ব্যাপারিরাও কম বলছেন না। কিন্তু সরকার কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করছে না। সরকারের পুলিশ বাহিনী একেবারেই বেপরোয়া। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুলিশ এই বেপরোয়া ভাব দেখাচ্ছে। কারণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বলেছেন, বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুককে রাজপথে প্রকাশ্যে নির্যাতনের পুরস্কার হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়েছে এক পুলিশ কর্তাকে। উপরের বিষয়গুলো এ কারণেই বলা, যাদের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো তারা কেউ-ই সাধারণ নাগরিক নন। সবাই সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাদের বেলায় যখন এ পরিণতি, সাধারণ নাগরিকের কী অবস্থা সেটা সহজেই অনুমেয়।
এখন দেখা যাক নির্যাতনের বিষয়ে আমাদের আইন কী বলছে। আইনে কতটা সুযোগ রয়েছে। আর আইনে সুযোগ না থাকলে ম্যাজিস্ট্রেটরা দেখেশুনে এভাবে রিমান্ড মঞ্জুর করছেন কেন। তাহলে কি আমাদের দেশে আইন, আদালত বলে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই? পুলিশ কর্তৃক এককভাবে গ্রেফতার-আটকের সময় ম্যাজিস্ট্রেটের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা থাকে না। কিন্তু গ্রেফতারকৃত সেই ব্যক্তিকে পুলিশ আদালতে উপস্থাপন করলে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু দায়বদ্ধতা দিয়েছে আইন। যখন তার কাছে রিমান্ড আবেদন করা হয় তখন তা কতটা যৌক্তিক বা আইনসঙ্গত সেটা খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত দেয়ার দায়িত্ব হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেটের। পুলিশ রিমান্ড চেয়েছে বলেই ঢালাওভাবে বাছ-বিচার না করে তা প্রদান করা আইন সমর্থন করে না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় রিমান্ডের আবেদন জানাতে পারে পুলিশ। এই ধারায় রিমান্ডের আবেদন জানানোর এখতিয়ার দেয়া আছে। এই ধারাটিতে বলা হয়েছে—‘কোনো ব্যক্তিকে যে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় সেই মামলার তদন্তকার্য যদি ২৪ ঘণ্টায় শেষ করা না যায় এবং গ্রেফতারকৃত আসামিকে তদন্তের স্বার্থে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয় তবে গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগের প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ ও রিমান্ডের যৌক্তিকতা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা তাহার কেস ডায়রিতে উল্লেখপূর্বক উক্ত আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করিয়া রিমান্ডের জন্য আবেদন করিতে পারেন।’
তবে এই রিমান্ডের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে দিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের এই সীমারেখা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আমলেই নেয় না। পুলিশের তো নেয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ পুলিশ রাজপথে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে মানুষ খুন করছে। সুতরাং উচ্চ আদালত কী বলল, বা নির্দেশনা দিল এতে তাদের কিছু যায় আসে না। কর্তার মর্জি রক্ষাটাই হচ্ছে তাদের কাছে বড় আইন!
রিমান্ড বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা : ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল এই রায় দিয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল, হাইকোর্টের এ নির্দেশনা আপিল বিভাগেও বহাল থাকে। রায়ে বলা হয়,
১. আটকাদেশ দেয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে না। ২. কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। ৩. অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আত্মীয় বা কাছের কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করতে হবে। ৪. গ্রেফতারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে। ৫. গ্রেফতারের ৩ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে কারণ জানাতে হবে। ৬. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতের নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ৭. গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। ৮. জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী বা পরিচিত কারও উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ৯. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া গেলে তদন্ত কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। ১০. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ডাক্তার দেখাতে হবে।
আইনে আরও বলা আছে—(২) ‘পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই পুলিশের কেস ডায়রি এবং গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগের প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণ, যৌক্তিকতা ইত্যাদি পর্যালোচনা করিবেন। অতঃপর নিজে সন্তুুষ্ট হইবার পর রিমান্ড মঞ্জুর করিবেন।’
আইনের স্পিরিটটি হলো—মামলা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তদন্ত শেষ করতে হবে। তা না হলে ১৫ দিনের বেশি সময় তাতে নেয়া যাবে না (ধারা পিআরবি-২৬১) এবং কোনোক্রমেই কোনো আসামিকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি পুলিশের রিমান্ডে দেয়া যাবে না। অথচ রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে সাজানো একাধিক মামলার আবরণে মাসের পর মাস পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে। এই রিমান্ডের যৌক্তিকতা বা আইনগত সামঞ্জস্য কতটা প্রমাণ করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং আবেদনকারী পুলিশ কর্মকর্তা? যদি তা না পারেন এবং তখন যদি তাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা ধারা দণ্ড-২১৯ ও ২২০-এর আলোকে অভিযোগ আনেন, তখন কি তারা আইনের প্রটেকশন পাবেন বলে বিশ্বাস করেন? একবারও কি তারা আইনের এই ব্যাখ্যাগুলো নিয়ে ভাবেন না?
আইনের তোয়াক্কা না করেই পুলিশ রিমান্ড চাইছে এবং ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড মঞ্জুর করছে। সুস্থ মানুষকে রিমান্ডে নিয়ে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে পুলিশ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কারও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিকলাঙ্গ করে দেয়া হচ্ছে। ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে অজ্ঞান ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার পরও অ্যাটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে বলছেন, শরীরে কোনো নির্যাতনের চিহ্ন দেখা যায়নি। এর চেয়ে বড় লজ্জা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন আর কিছুই হতে পারে না। তারপরও আমাদের দলবাজ একপেশে মিডিয়াগুলো সরকারের এই নির্যাতন ও জুলুম রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। আদালতের আইন ব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। একটি জাতির ধ্বংসের জন্য এই অবিচার ও মিডিয়ার রাজনীতিই যথেষ্ট।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকার বেপারিরা রিমান্ডের এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো দেখেও না দেখার ভান করছেন। অতীতে পান থেকে চুন খসলেই মানবাধিকার বেপারি ও আদালত সরব হয়ে উঠতেন। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে সে তারাই নীরব। কারণ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে তাদের মানবাধিকার থাকতে নেই!
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, লিখেছেন যুক্তরাজ্য থেকেax
No comments