সেই ছবি- সংসদের শীর্ষ তিন আসনে তিন নারী...
সংসদের শীর্ষ তিন আসনে তিন নারী। স্পিকার,
সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা। স্পিকারের আসনে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদ
নেতার আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বেগম খালেদা
জিয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভিনব দৃশ্য।
এক অন্যরকম
আবহ। এ যেন ভিন্ন এক সংসদ। গতকাল বিকাল ৫টা ৫২ মিনিট ছিল সেই
মাহেন্দ্রক্ষণ। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সংসদের
বাজেট অধিবেশনে যোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতির সামনে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি
ভেসে ওঠে। ইতিহাসের চাকায় দেশ এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখে। এ তিনজনের বাইরে
আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি সংসদের উপনেতা। তিন শীর্ষ নারী যখন
ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছেন তখন উপনেতার আসনে ছিলেন সাজেদা
চৌধুরী। এর আগে গত ৪ঠা মে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে
সংসদে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা,
স্পিকার নারী এমন নজির হয়তো আর নেই। আসুন আমরা মিলে একটি ছবি তুলি।
সংসদে কাল ছিল সেই ছবি। না, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কোন গ্রুপ ছবি তোলেন নি সংসদের তিন শীর্ষ জন, তিন নারী। তা না হলেও গোটা সংসদই যেন হয়ে উঠেছিল সেই ছবি।
সংসদে কাল ছিল সেই ছবি। না, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কোন গ্রুপ ছবি তোলেন নি সংসদের তিন শীর্ষ জন, তিন নারী। তা না হলেও গোটা সংসদই যেন হয়ে উঠেছিল সেই ছবি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ প্রথমবারের মতো একজন নারী স্পিকারের নেতৃত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হলে অন্যরকম আবহের সূচনা হয় গতকাল। অধিবেশন শুরুর কিছু সময় পরই যোগ দেয় বিএনপি। প্রায় ১৫ মাস পর সংসদে আসেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া। প্রায় ৫১ মিনিট তিনি সংসদ অধিবেশন কক্ষে ছিলেন। নামাজের বিরতির পরে তিনি আর যোগ দেননি। গত বছরের ২০শে মার্চ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সর্বশেষ সংসদে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখেন।
বাজেট অধিবেশন শুরু, বিরোধী দলের ওয়াকআউট: বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোটের অংশ নেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে মহাজোট সরকারের শেষ বাজেট অধিবেশন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় নবনির্বাচিত স্পিকার ড. শিরিন শারমীন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হয়। দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী স্পিকার তিনি। অধিবেশনের শুরুতে এমপিরা টেবিল চাপড়ে তাকে স্বাগত জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। ১৫ মিনিট পরে যোগ দেন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রধান বিরোধীদলীয় জোট। এ সময় বিরোধীদলীয় নেতাকে হাত উঠিয়ে স্পিকার সালাম জানান। খালেদা জিয়াও হাত উঠিয়ে সালামের জবাব দেন। এদিকে শুরুতে নবনির্বাচিত স্পিকারকে অভিনন্দন জানান মহাজোটের শরীক দলের এমপিরা। তবে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে স্পিকারকে স্বাগত জানিয়ে কোন ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়নি। এদিকে স্পিকার তার স্বাগত বক্তব্যে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। সেক্ষেত্রে স্পিকার হিসেবে তিনি যে কোন ধরনের সহযোগিতা দেবেন বলে জানিয়েছেন। এদিকে রাত আটটায় বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা ওয়াকআউট করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভা-সমাবেশের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ওয়াকআউটের পর তারা আর অধিবেশনে যোগ দেননি।
বিএনপির যোগদান: টানা ৮৩ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয় বিরোধীদলীয় জোট। এর আগে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে সংসদ সচিবালয়ে বিরোধী দলের সংসদীয় দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৪১ জন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩৮ জন বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকটি বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে শুরু হয় এবং শেষ হয় ৫টা ৩৫ মিনিটে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৫টা ৫২ মিনিটে অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত হন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। ১২তম অধিবেশন থেকে ১৭তম অধিবেশন পর্যন্ত টানা অধিবেশন বর্জন করেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল। বেগম খালেদা জিয়া এ সংসদে মাত্র ৮ কার্যদিবস উপস্থিত ছিলেন। টানা বর্জনের কারণে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতি ৮৩ কার্যদিবসে ঠেকেছে। বিরোধী দল গত বছরের ১৮ই মার্চ সংসেদ ফিরে মাত্র তিন কার্যদিবস ছিল। তারা ২০শে মার্চ মাগরিবের নামাজের বিরতির পর বেরিয়ে যাওয়ার পর আর অধিবেশনে ফেরেননি। সংবিধান অনুযায়ী, স্পিকারের অনুমতি ছাড়া টানা ৯০ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়।
সহযোগিতা চাইলেন স্পিকার: দেশের ইতিহাসের প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে সরকারি ও বিরোধী দলের কাছে সহযোগিতা চাইলেন ড. শিরিন শারমীন চৌধুরী। তিনি দেশের ইতিহাসে ১২তম স্পিকার। স্পিকার তার স্বাগত বক্তব্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি বলেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মতপার্থক্য ও ভিন্নতা আলোচনার মধ্য দিয়ে নিরসন সম্ভব। জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিরোধীদলীয় নেতাসহ সদস্যদের স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, নারী স্পিকার দেশে নারীর ক্ষমতায়নে অন্যান্য মাইলফলক হয়ে থাকবেন। এ বিজয় ও গৌরব দেশের সব নারীর। যে কোন সমস্যা সংসদে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। আমি আশা করবো, সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অধিবেশন পরিচালনায় আমাকে সহায়তা করবেন। তিনি স্পিকার নির্বাচিত করায় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতাসহ সকল সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানান। মহিলা স্পিকার হিসেবে প্রথম কার্যদিবসে দায়িত্ব পালন করায় তিনি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের অব্যাহত অগ্রযাত্রা সুসংহত করার মধ্যদিয়ে সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সংসদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্পিকার বিরোধীদলীয় নেতাসহ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, আমি আশা করি আপনাদের অব্যাহত উপস্থিতি, গঠনমূলক ভূমিকা সংসদ অধিবেশনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ সংসদকে প্রাণবন্ত ও অধিক কার্যকর করে তুলবে। গণতন্ত্রে মতপার্থক্য থাকা কেবল স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্যই নয় বরং সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে অনেকাংশে প্রয়োজনীয় বটে। স্পিকার বক্তব্য রাখার সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেবিল চাপড়ে স্পিকারকে ধন্যবাদ জানান।
শুরুতে স্পিকারকে অভিনন্দন: দেশের প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীকে সংসদে মহাজোটের এমপিদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়। শুরুতে হুইপ আ স ম ফিরোজ অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার এ তিনজনই নারী। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে নতুন ইতিহাস। এরপর অভিনন্দন জানান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন। তোফায়েল আহমেদ অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আপনি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি দক্ষতার সঙ্গে সংসদ পরিচালনা করতে পারবেন। এটা আমাদের বিশ্বাস। তিনি বলেন, আপনি এই আসনে যখন বসেন তখন আমার স্মৃতিতে অনেক কিছু ভেসে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আপনার পিতা ছিলেন তার সেক্রেটারি। আমিও মাত্র ২৯ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সেক্রেটারি হই। তখন প্রায়ই আমি আপনাদের বাসায় যেতাম। আপনি ছিলেন তখন খুবই ছোট। ক্লাস ওয়ানে পড়তেন। আপনাকে আমি তখন বলতাম, আপনি ইংরেজিতে কথা বলুন। সেই সময় আপনি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতেন। তখন আমি বলেছিলাম, আপনি অনেক বড় হবেন। আজ আপনি জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছেন। বিরোধী দল সংসদে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। বিরোধী দল আজ সংসদে যোগ দিয়েছে। সংসদ আজ কানায় কানায় পূর্ণ। তোফায়েল আহমেদ বিরোধী দলকে পুরো বাজেট অধিবেশনে থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনাদের যা বলার আছে সংসদেই বলবেন। তারপর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। রাশেদ খান মেনন অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আপনি আজও নিরপেক্ষতার কথা বললেন। আগেও আপনি স্পিকার হিসেবে নিরপেক্ষ থাকবেন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, নারী ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা চলছে। এরই অংশ হিসেবে দেশে প্রথমবারের মতো একজন নারীকে স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। এসময় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় জোট উপস্থিত থাকলেও তারা স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে কোন বক্তব্য রাখেননি। সংসদ সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে স্পিকার বলেন, আপনাদের পরামর্শ দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে এবং আগামী দিনে চলার পথে পাথেয় হবে।
শোক প্রস্তাব: সমপ্রতি প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্পিকার। শোক প্রস্তাবে সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মাসুদ রেজা ও এডভোকেট মেহেরুন্নেসা খাতুন, যুক্তফ্রন্টের সাবেক প্রচার সম্পাদক এমএ হান্নান, ভাষাসৈনিক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) খুরশীদ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল জব্বার সরকার, নিবেদিতা নাগ ও অধ্যাপক সারা তৈফুর মাহমুদের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সাভারের ভবন ধস ও ঘূর্ণিঝড়ে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করা হয়। সংসদে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। আর এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচন: স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে সংসদ অধিবেশন পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে ফজলে রাব্বি মিয়া, এবিএম গোলাম মোস্তফা, মুজিবুল হক, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, ফরিদা রহমানকে নির্বাচন করা হয়।
বিএনপির মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার: টানা ৮৩ দিন পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের যোগদানে এক প্রাণবন্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয় জাতীয় সংসদে। সংসদে যোগ দিলেও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিরোধীদলীয় এক এমপির দেয়া মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয় তারা। তাদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকেই তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল ইস্যুটি আলোচনায় আনতে হবে। পরে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে ওয়াকআউট করে বিরোধী দল। এর আগে বিকাল ৪টায় সংসদ ভবনে যান বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সংসদ ভবনে বিরোধী নেতার কক্ষে বিরোধী এমপিদের নিয়ে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন। এ সময় বিরোধী দলের এমপিরা বাজেট অধিবেশনের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। তারা শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হল-মার্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ৫০টির মতো মুলতবি প্রস্তাব দিয়েছেন। জমাকৃত প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে চান তারা। কিন্তু সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোন প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে চান না। বৈঠক শেষে তিনি নিজের কক্ষে আছরের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় এমপিরা অধিবেশন কক্ষে যান। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিদলীয় এমপি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, এম কে আনোয়ার, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতের দুই এমপি শামসুল ইসলাম ও হামিদুর রহমান আজাদসহ বিরোধী জোটের ৩৭ এমপি উপস্থিত ছিলেন। তবে কারাগারে থাকায় বিএনপিদলীয় এমপি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকায় শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। এদিকে সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে বিএনপিদলীয় মহিলা এমপি নিলোফার চৌধুরী মনি স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আজ সংসদের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার তিনজনই নারী। আমরা আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনাকে অভিনন্দিত করতেই বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী দল সংসদে এসেছে। তিনি নতুন স্পিকারকে বিরোধী দলের দিকে সুদৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান।’
সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের প্রতিবাদে ওয়াকআউট: সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বলেন, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের দেয়া মৌখিক নির্দেশকে অনৈতিক মন্তব্য করে তার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯শে মে মিরসরাইয়ে বলেছেন, সভা-সমাবেশ করা যাবে না। এ অনৈতিক। এরপর তিনি আবারও বলেন, আগামী এক মাস সভা-সমাবেশ করা যাবে না। পরে বিবিসিকে বলেন, সরকারের অনুমতি নিয়ে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে পারবেন। তবে তার নিজের মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোন আদেশ জারি করা হয়নি। এমনকি মন্ত্রিসভায়ও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। পুলিশ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের কোন নির্দেশ পায়নি। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনবার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধের কথা বলেছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ১৪ দলের সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের নিন্দা করা হয়। ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। ১৪ দলের নেতারা বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য অসাংবিধানিক। সে সভায় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, আমরা কোন দেশে আছি? এটা কি গণতান্ত্রিক নাকি স্বৈরতান্ত্রিক দেশে আছি? স্পিকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আমি বাইরে ছিলাম। আপনি সুন্দর করে গণতন্ত্র, মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের কথা বলেছেন। সুন্দর লেগেছে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে কোন মিল নেই। তিনি বলেন, বিএনপি হলো সর্ববৃহৎ জনপ্রিয় দল। সভা-সমাবেশ করতে না দিয়ে গণতন্ত্র আছে বলে আমরা মনে করি না। দেশবাসীও মনে করে না। তিনি বলেন, আইন থাকলে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা যায়। তবে দেশে সে ধরনের কোন আইন নেই। একমাত্র জরুরি আইনেই এটা করা যায়। তাহলে কি ধরে নেব মুখের কথায় জরুরি আইন জারি করা হয়েছে? মুখের কথায় দেশ চলে এ কথা প্রথম শুনলাম। ব্যারিস্টার মওদুদ সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা চিরদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। আমরাও চিরদিন বিরোধী দলে থাকবো না। কোন সরকারই শেষ সরকার নয়। মৌলিক অধিকার মুখের কথায় হরণ করা সম্ভব নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা করেছেন তা এ সরকারের অন্যতম কলঙ্ক হয়ে থাকবে। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংসদে দুঃখ প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে বলেন, তিনি দুঃখ প্রকাশ করলে তার সম্মানহানি হবে না। বরং সম্মান বাড়বে। তিনি সেটা করলে সংসদ কার্যকর করতে আমরাও ভূমিকা রাখবো। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক ঘোষণার প্রতিবাদে ওয়াকআউট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা ওয়াকআউট করলাম। এরপর এমপিদের নিয়ে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান তিনি। বিরোধী জোটের ওয়াকআউটের পরই পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য রাখেন সরকারদলীয় এমপি তোফায়েল আহমেদ ও আলী আশরাফ। ওয়াকআউট ঘটনাকে তারা নিন্দা জানান। তোফায়েল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, আমি বিস্মিত, লজ্জিত। অবাক হয়ে গেলাম। কি কারণে বিরোধী দল ওয়াকআউট করলো তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, আর ৮ দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তাদের সদস্যপদ চলে যেতো। এটা রক্ষা করতেই সংসদে যোগ দেন তারা। সদস্যপদ রক্ষা করতেই যে তাদের সংসদে যোগদান- এটাই আমরা প্রমাণ পেলাম। তোফায়েল আহমেদ বলেন, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ যে বক্তব্য রেখেছেন তা স্ববিরোধী। অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ সভা-সমাবেশ করতে চাইলে তাদের অনুমতি দেয়া যায় না। বিএনপি সভা-সমাবেশের নামে অশুভ শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি সেনাবাহিনীকে ইঙ্গিত করেও বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য আমরাও সরাসরি সমর্থন করিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপির মুলতবি প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে জানতে পারলাম বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মুলতবি প্রস্তাব দিয়ে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আজ সংসদের কার্যউপদেষ্টা বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিএনপি যদি এ ইস্যুতে আলোচনা করতে চায় তাতে আমরা রাজি। অথচ এখন দেখছি বিএনপিই ওই ইস্যু নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে রাজি নয়।
এদিকে অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, ওয়াকআউটের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো বিরোধী দল তা হাস্যকর। এর মধ্যে কি উদ্দেশ্য রয়েছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। তিনি বলেন, আমরা বিরোধী দলের এ ওয়াকআউটের তীব্র নিন্দা জানাই।
মতিঝিল হত্যা নিয়ে রানুর প্রশ্ন: এর আগে বিরোধীদলীয় এমপি রেহেনা আক্তার রানু পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ৫ই মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে হামলা করে তাদের হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। নির্বিচারে যারা আলেমদের হত্যা করেছে তাদের বিচারের কোন উদ্যোগ নেবেন কিনা। জবাবে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেদিন শাপলা চত্বরে একটি লোকও মারা যায়নি।
মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার: নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দেয়া মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বিএনপিদলীয় এমপি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। সংসদে যোগদানের আগে বিরোধী দলের পার্লামেন্টারি বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক জানান, এ ধরনের মুলতবি প্রস্তাব এর আগেও একাধিক এমপি দিয়েছিলেন। এখন রাজনৈতিক আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। বিরোধী দল মনে করে সরকারকে উদ্যোগী হয়েই এ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। এ জন্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপির ব্যক্তিগতভাবে জমা দেয়া এ-সংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব তিনি সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যাহার করেছেন।
এদিকে সংসদীয় দলের সভাশেষে মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক জানান, আমরা এ মুলতবি প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিয়েছি। সংসদীয় দলের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর প্রস্তাব দেবো না। আলোচনা করবো না। তাই আমাদের সংশ্লিষ্ট সদস্য তার ৫ মিনিট আগে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা সংসদে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে নতুন স্পিকার অতীতের স্পিকারের মতো আমাদের কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না, এটা আমরা ‘সাইনিং লেডি স্পিকারে’র কাছ থেকে এটাই আশা করি।
বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন্য বিরোধী দলের পক্ষ থেকে দু’দিন আগে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে মুলতবি প্রস্তাব জমা দেন নোয়াখালী-১ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপিদলীয় এমপি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। কার্যপ্রণালী বিধির ৬২ ধারা অনুযায়ী ওই প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন তিনি। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ‘সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। বিধি ৬২ অনুযায়ী সংসদ মূলতবি করে এ বিষয়ে আলোচনা করা হোক।’ বৈঠক শেষে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা ৫০টির মতো মুলতবি প্রস্তাব জমা দিয়েছি। আশা করি স্পিকার আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে আলোচনার সুযোগ দেবেন। নতুন স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, বিগত দিনে আমাদের কথা বলা থেকে বঞ্চিত করেছেন। আশা করি এ স্পিকার আমাদের সময় দেবেন। সংসদে কত দিন থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংসদের পুরো সময় আমরা থাকতে চাই। কিন্তু সরকারি দলের সদস্যদের আচার-আচরণের ওপর নির্ভর করবে কত দিন থাকতে পারবো।
আনোয়ারের সঙ্গে ইনু-মেননের হ্যান্ডশেক: রাজনীতিতে তারা প্রতিপক্ষ। রাজপথে পরস্পরের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দেন। কিন্তু জাতীয় সংসদে তারা অন্য মানুষ। দীর্ঘদিন পর বিরোধীদলীয় এমপিদের সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণকে টেবিল চাপড়ে স্বাগত জানান। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান এম কে আনোয়ারের পাশের আসনে বসেন মহাজোটের দুই শরিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। বিরোধী দল সংসদে গেলে ইনু ও মেনন দু’জনই এম কে আনোয়ারের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন। এরপর অধিবেশন চলাকালে তাদের বারবার ঘনিষ্ঠ হয়ে আলাপ করতে দেখা গেছে।
অধিবেশন চলবে ৩রা জুলাই পর্যন্ত: জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন ৩রা জুলাই পর্যন্ত চলবে। গতকাল অধিবেশন শুরুর আগে সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কমিটির সভাপতি স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তোফায়েল আহমেদ, ফজলে রাব্বী মিয়া, এডভোকেট মো. রহমত আলী, রাশেদ খান মেনন ও আবদুল মতিন খসরু উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত ও আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. কামরুল ইসলাম। বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আগামী ৬ই জুন সংসদে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হবে। আলোচনা শেষে ওই বাজেট ৩০শে জুন পাস হবে। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর ৪০ ঘণ্টা আলোচনা হবে। অধিবেশন শুরু হবে প্রতিদিন বেলা ৩টায়। শেষ হবে রাত ৯টায়। অধিবেশনের মেয়াদ ৩রা জুলাই পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলেও তা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা স্পিকারের ওপর দেয়া হয়েছে।
No comments