সমকালীন প্রসঙ্গ-ভোট দিয়ে জনগণ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি কেন পাঠান? by বদরুদ্দীন উমর

আজ ৩ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, এই অধিবেশনে বিএনপি যোগদান করবে। ১৯৯১ সালের সংসদীয় নির্বাচনের পর থেকে বিরোধী দলের দ্বারা সংসদ অধিবেশন বর্জনের যে সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তা বিগত বাইশ বছর ধরে জায়মান আছে।
ক্ষমতায় যেতে না পারলেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একইভাবে মনে করে যে, জাতীয় সংসদ ক্ষমতাসীন দলের জমিদারি এবং বিরোধী দল হিসেবে সংসদে তারা প্রজাতুল্য! কাজেই বিরোধী দলে থেকে জাতীয় সংসদে বসার অর্থ হলো সেখানে প্রজার ভূমিকা পালন করা! এ কারণে তারা প্রজা হিসেবে জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সংসদের বাইরে থাকে! এই যাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ তারা গণতন্ত্র বলতে বাস্তবত কী বোঝেন এটা তারাই জানেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এটা হলো যে ভোটাররা তাদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠান তাদের প্রতি সরাসরি বেইমানি করা। বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে বলে যে ক্ষমতাসীন দল তাদের সংসদে কথা বলতে দেয় না, যেসব সুযোগ তাদের পাওয়া দরকার সেটা তাদের দেওয়া হয় না, কাজেই সংসদে যাওয়া নিরর্থক! এ ধরনের কথা শুনেও মনে হয়, এটা জমিদার ও প্রজার লড়াই! সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন সংবিধান অনুযায়ী, জনগণ ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি পাঠান তাদের নানা স্বার্থ বিষয়ে, দেশের হাজার রকম সমস্যা নিয়ে সংসদে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। প্রত্যেক পার্লামেন্ট বা জাতীয় সংসদে সরকারি দলই ভোটের জোরে তাদের প্রস্তাব পাস ও সিদ্ধান্ত কার্যকর করে থাকে। তবে বিরোধী দল শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সংসদে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে ক্ষেত্রবিশেষে অবশ্যই কিছু পরিবর্তন ও সংশোধন করতে পারে। সেটা না পারলেও তারা সংসদে বসেই সরকারের প্রস্তাবগুলোর সমালোচনা করে তার মাধ্যমেই একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন। কোনো দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র অল্পবিস্তর কার্যকর থাকলে এটাই ঘটে থাকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে ভারতের পার্লামেন্ট পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই বিরোধী দলকে মাঝে মাঝে প্রতিবাদ হিসেবে সংসদ বর্জন করতে দেখা যায়। বিভাগ-পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদেও এটা দেখা যেত, এখনও যেমন দেখা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিয়ে প্রত্যেক বিধানসভার ক্ষেত্রে। কিন্তু তারা কেউই পার্লামেন্ট বা বিধানসভা একটানাভাবে কখনও বর্জন করে না। এই বর্জন হয় কয়েক ঘণ্টার জন্য অথবা কোনো বিশেষ ঘটনার সময় একদিনের জন্য। এদিক দিয়ে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে সংসদ বর্জন একটা রুটিন ব্যাপার হিসেবে প্রত্যেক বিরোধী দলের দ্বারাই হয়ে থাকে।
সংসদ বর্জন করার সময় বিরোধী দল বলে যে, তারা সংসদের বাইরে থেকে সরকারের সমালোচনা করবে। কেন? তাহলে কেন তারা নির্বাচন করেন সংসদে বসার জন্য? সংসদের বাইরে থেকে তো যে কোনো দল, এমনকি ব্যক্তি পর্যন্ত সরকারের সমালোচনা করতে পারে। সংসদের ভেতরে তর্ক-বিতর্ক-সমালোচনা এবং সংসদের বাইরে থেকে তর্ক-বিতর্ক-সমালোচনা যদি একই ব্যাপার হয়, তাহলে জাতীয় সংসদ নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রয়োজন কী? বাস্তবত দেখা যায় যে, নির্বাচনের পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ একটিই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। সেটা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা সরকার গঠন। এভাবে সরকার গঠনের পর বিরোধী দল বিপুল অধিকাংশ সংসদ অধিবেশন বর্জন করে এবং সরকারি দল যথেচ্ছভাবে সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করে যা করে তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ও কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া বাস্তবত দেখা যায় যে, দেশের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাই সংসদে আলোচিত হয় না। হলেও এমনভাবে হয় যার কোনো রাজনৈতিক বা আইনগত তাৎপর্য নেই। দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি থেকে নিয়ে বিদেশি সরকারগুলোর সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বিষয়েও সংসদে কোনো আলোচনা হয় না। যেসব বিল সংসদে উপস্থিত করা হয় সেগুলোর ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা হয় না। সংসদের কার্যবিবরণীর দিকে তাকালে দেখা যাবে, অধিকাংশ সময়েই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়। একটা বড় সময় ব্যয় হয় বিরোধী দলের লোকজনদের গালাগালি করে। এ ছাড়া সরকারপ্রধানের তোষামোদি করেও সংসদ অধিবেশনে অনেক সময় ব্যয় হয়। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি জাতীয় সংসদের এই দুরবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
সংসদ বর্জন করলেও বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদ সদস্য হিসেবে তাদের পাওনা-গণ্ডা কাঁটায় কাঁটায় গুনে নেন। এদিক দিয়ে সংসদ বর্জনকারীদের কোনো লজ্জা-শরমের বালাই নেই। কোনো নৈতিক বিবেচনা তাদের নেই। তাদের কারও মধ্যে জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা হজম করার ক্ষেত্রে বিবেকের কোনো দংশন নেই। তারা এ ব্যাপারে বলে থাকেন যে, তাদের এই প্রাপ্য সংবিধান অনুযায়ীই তারা নিয়ে থাকেন! সেটা তো বোঝা গেল। কিন্তু জনগণের পয়সা ঘরে বসে অপহরণ করার জন্য তো সংবিধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সংসদ অধিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্য একটি বিষয়ে তারা সংবিধান খুব যথাযথভাবেই মেনে চলেন। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক অধিবেশনে কোনো সদস্য যদি অনুপস্থিত থাকেন তা হলে তার সদস্যপদ খারিজ হওয়ার কথা। সেই অনুযায়ী সংসদ বর্জনকারীরা সেই সংখ্যা পার হওয়ার আগেই সংসদে যোগ দিয়ে নিজেদের সংসদ সদস্যপদ বহাল রেখে আবার সংসদ থেকে বেরিয়ে আসেন! এর থেকে অনৈতিক, কুৎসিত রাজনৈতিক কাজ আর কী হতে পারে? এর থেকে কি এটা প্রমাণিত হয় না যে, নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে উপস্থিত থাকা তারা একটা সাংবিধানিক দায়িত্ব বলে বিবেচনা না করলেও সংসদ সদস্য হিসেবে পাওনা-গণ্ডা বুঝে নেওয়ার যে ব্যাপার আছে সেটা তারা খুব সতর্কতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন।
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে এটাই হয়ে আসছে এবং এর পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু অবস্থা এদিক দিয়ে আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। এটা এক বাস্তব ব্যাপার। কিন্তু এ ব্যাপারটি কেন এভাবে হচ্ছে, সংসদ সদস্যদের ও শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা কেন এখন এমন দাঁড়িয়েছে এর কারণ বোঝা দরকার। অন্যান্য কারণ ছাড়াও যে প্রধান কারণে এটা ঘটছে তা হলো, ১৯৯০ সালের দিকে এসে শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। ১৯৭২ সাল থেকে ব্যবসায়ীরাই শাসক শ্রেণীর প্রধান অংশে পরিণত হতে থাকে। এই প্রাধান্যের ফলেই তারা এ দলগুলোকে শুধু বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ না করে দলের মধ্যে ঢুকেই সরাসরি তাদের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে। এটা সবারই জানা যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে দলের মনোনয়ন পাওয়া থেকে নিয়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে কোনো বিজয়ী প্রার্থী অথবা বিজয়ী প্রার্থীর নিকট প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। এই অর্থ ব্যবসায়ী ছাড়া বাংলাদেশে কার আছে? কাজেই টাকার জোরে ব্যবসায়ীরা দলের মনোনয়ন পায় এবং নির্বাচনে বিশাল আকারে অর্থ ব্যয় করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের অন্তত আশি ভাগ অথবা তারও বেশি সরাসরি ব্যবসায়ী অথবা অন্য নানাভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ব্যবসায়ীরা জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়াকে নিজেদের ব্যবসায়ী স্বার্থে পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করেন। প্রশাসনে অবাধ চুরি- দুর্নীতির এটাই অন্যতম প্রধান কারণ। সংসদ বর্জনের বিষয়ে ফিরে এসে বলা যায় যে, এই বর্জন সম্ভব হচ্ছে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যের জন্য। আগেকার দিনে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সংসদে থেকে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদিতে যেভাবে আগ্রহান্বিত থাকতেন নিজেদের পেশা হিসেবে এখন সেটা আর নেই। কারণ এখন সংসদ সদস্যদের মূল পেশা রাজনীতি নয়। তাদের পেশা হলো ব্যবসা। কাজেই জাতীয় সংসদ বর্জন করা হলেও অথবা জাতীয় সংসদে অনুপস্থিত থাকলেও এই ব্যবসায়ী-সংসদ সদস্যদের কিছুই যায় আসে না। এ কারণে বিরোধীদলীয় সদস্যরা অনায়াসে একটানাভাবে সংসদ অধিবেশন বর্জন করেন এবং সরকারি দলের সদস্যরা একটানাভাবে না হলেও অনেকেই অনেক দিন অনুপস্থিত থাকেন। সংসদে কোরাম সংকট এ কারণেই হয়। এদিক দিয়ে বিরোধী দলের সংসদ বর্জন এবং সরকারি দলের কোরাম সংকট একই সূত্রে গ্রথিত।
ব্যবসায়ী শ্রেণী শাসিত বাংলাদেশে এই হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের চিত্র ও চরিত্র। কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, তাদের কাছে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বের ম্যান্ডেট থেকে নিয়ে নিজেদের সংবিধান পর্যন্ত কোনো কিছুই পবিত্র নয়। সব কিছুই তাদের ব্যবসায়ী স্বার্থের অধীন। তাদের শাসনে বাংলাদেশের প্রশাসন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে নিয়ে সব কিছুই এভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা গণতান্ত্রিক উপাদান বলে কিছু নেই। এর মধ্যে জনগণের কোনো স্বার্থ নিহিত নেই। এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দল কেন সংসদ বর্জন করে এবং সরকারি দলে ৩০০ সদস্য থাকলেও কোরাম কেন ফেল হয়, এ নিয়ে উত্তেজিত না হয়ে এর কারণগুলো চিহ্নিত এবং অনুধাবন করা দরকার। বোঝা দরকার যে, বর্তমান শাসন ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বর্তমান শাসক শ্রেণীর অধীনে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভাবনা নেই। এই শ্রেণী শাসন সমূলে উচ্ছেদ ছাড়া পরিস্থিতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন হওয়ার উপায় নেই। কাজেই এর জন্য সংগ্রাম করাই বর্তমান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।
৩.৬.২০১৩

No comments

Powered by Blogger.