রতিক্রিয়া ‘আমার দেশ’ ও মাহমুদুর রহমানের সাংবাদিকতা by মহিউদ্দিন আহমদ
গত মঙ্গল ও বুধবার প্রথম আলোতে মশিউল
আলমের ওপরে উল্লিখিত বিষয়ে দুই কিস্তিতে প্রকাশিত লেখার জন্য প্রথম আলো এবং
মশিউল আলমকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর
রহমানও মাহমুদুর রহমান এবং তাঁর পত্রিকার বিষয়ে সরকারের গৃহীত সাম্প্রতিক
ব্যবস্থাগুলোর সমালোচনা করে দেওয়া বিবৃতির স্বাক্ষরকারী ১৫ জন সম্পাদকের
একজন। তার পরও মশিউল আলমের মোটামুটি ভারসাম্যমূলক লেখাটি প্রথম আলোতে
প্রকাশিত হয়েছে, সে জন্য প্রথম আলোকে আরেকবার ধন্যবাদ। যতটুকু মনে করতে
পারি, প্রথম আলোতে এ বিষয়ের ওপর এটাই প্রথম লেখা।
তবে মশিউল আলমের কয়েকটি কথা মেনে নিতে পারছি না। সম্পাদকদের যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদের পরদিনই ১৫ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিবৃতি দেয়। কলাম লেখেন আরও কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁদের লেখার মধ্যে ‘ভিন্নমত, অন্য চিন্তার প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটেছে। একই রকম অসহিষ্ণু সমালোচনা হয়েছে টিভির টক শোতেও’—লিখেছেন মশিউল আলম দ্বিতীয় কিস্তিতে। কিন্তু মশিউল আলমের এই কথাগুলোতে আমার মনে হয়েছে, তাঁরই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ। সম্পাদকদের বিবৃতির প্রতিবাদে কলাম লেখকেরা কে কীভাবে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার উল্লেখ জরুরি ছিল বলে মনে করি। জায়গার অভাবে মশিউল আলম যদি তা এবার না পেরে থাকেন, তা পরে কোনো সময়ে করবেন আশা রাখি।
মশিউল আলম ‘ব্রিটিশ প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন’-এ ক্ষুব্ধ নাগরিকদের ‘রিলিফ’, প্রতিকার পাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বোধ হয় জানেন না যে, প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন কিছু পত্রপত্রিকা, তার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বেপরোয়া, আগ্রাসী আচরণের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে, বা যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছিল না বলে সম্প্রতি এই ‘কমিশন’কে বিলোপ করে দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে ব্রিটিশ ‘হাউস অব কমন্স’। তার জায়গায় আসছে বেশ কঠোর ব্যবস্থা।
আমাদের ‘প্রেস কাউন্সিলের’ কথাও মশিউল আলম উল্লেখ করেছেন। প্রথম আলোর সম্পাদককে নোংরাভাবে আক্রমণ করে যেসব সাংবাদিক, সম্পাদক আমাদের প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছেন, তাঁদের অবস্থানের কি কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা, মানমর্যাদা, সম্মান—এসবের কি এতটুকু ক্ষতি হয়েছে? তাঁরা আগের মতোই সম্পাদক আছেন, লেখালেখি করছেন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখে, ‘টক শো’তে উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে ওয়াজ করে চলছেন। কেউ কেউ টক শোর উপস্থাপকও হয়ে গিয়েছেন। যাঁরা প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক নিন্দিত, তাঁদের কি কোনো পদাবনতি ঘটেছে বা বেতন-ভাতা কমেছে? প্রথম আলোর সম্পাদকের দায়ের করা মামলায় বর্তমান প্রেস কাউন্সিল তবু কয়েকটি রায় দিলেন। কিন্তু গত ৩০ বছরে সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে আমাদের প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকাটি কী? বরং প্রেস কাউন্সিলে নিন্দিত সম্পাদককে পরে প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হতেও দেখেছি।
যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও যেখানে প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন ব্যর্থ, সেখানে বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিলকে বিলুপ্ত করে দিলে অনেকগুলো টাকা বেঁচে যায়।
আমোদের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেই তাঁরা দাবি করতে থাকেন, প্রেস কাউন্সিলে কেন প্রতিকার চাওয়া হলো না? এর একটি কারণ এই যে, প্রেস কাউন্সিলে গেলে যে কিছুই হবে না, তা আমাদের গণমাধ্যমের লোকজন গত ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন। তাই তাঁরা প্রেস কাউন্সিলে যাওয়ার কথা হরহামেশাই বলে থাকেন। আমাদের সাংবাদিকেরা প্রেস কাউন্সিলকে ‘কভার’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলেই দ্রুতই এই প্রেস কাউন্সিল উঠিয়ে দিয়ে সাম্প্রতিক ব্রিটিশ উদাহরণের অনুসরণে নতুন কিছু প্রবর্তন করতে পারে আমাদের সরকার।
প্রেস কাউন্সিল কী করবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই তো সম্মান দেখানো হচ্ছে না। মাহমুদুর রহমানকে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত—‘সুপ্রিম কোর্ট’ দু-দুবার দণ্ড দিলেন, একবার জেলদণ্ড, আরেকবার জরিমানা, তাতে কিছু মানুষের কাছে মাহমুদুর রহমানের সম্মান, ইজ্জত, মর্যাদা কিছুটা কমেছে বলে মনে হয় না। তার পরও আমাদের ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিলেন! মশিউল আলমের দুই কিস্তির লেখার প্রথম কিস্তিতে মাহমুদুর রহমান এবং তাঁর আমার দেশ-এর অপসাংবাদিকতা, আগ্রাসী সাংবাদিকতার কতগুলো উদাহরণ যথার্থভাবেই উল্লেখিত হলো, কিন্তু মশিউল আলম মাহমুদুর রহমানের জেল খাটার এবং জরিমানা দেওয়ার উদাহরণগুলো একেবারেই ভুলে গেলেন! এত বড় ভুল কি মেনে নেওয়া যায়?
আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের বোধ হয় জানা নেই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়ে গণহত্যায় ভূমিকা রাখার অপরাধে ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর ‘নুরেমবার্গ ট্রায়ালে’ Der Sturmer নামের পত্রিকার সম্পাদক জুলিয়াস স্ট্রেচারকে (Juluis Streichar) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর এই মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হয় ১৬ অক্টোবর।
এই উদাহরণ অনুসরণ করে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ‘হেট মিডিয়া’র লোকদের জন্য আলাদা বিচারব্যবস্থা ছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় কাংগুরা (Kangura) নামের পত্রিকার সম্পাদক হাসান এনগেজেকে (Hassan Ngeze)। আর আরটিএলএমের (Radio Television Libre des Mille) দুই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফার্ডিন্যান্ড নাহিমানা (Ferdinand Nahimana) এবং জ্যঁ বস্কো বারাইয়াগবিজাকে (Jean Bosco Barayagwiza) দেওয়া হয় ৩৫ বছরের কারাদণ্ড। রুয়ান্ডার গণহত্যায় ১৯৯৪ সালে মাত্র ৯০ দিনে মোট ১০ লাখ ‘মাইনোরিটি টুটিস’কে হত্যা করেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘হুতু’ সম্প্রদায়ের লোক। এই গণহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতিসংঘ ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা’ গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালই এই তিন সম্পাদককে এই দণ্ডগুলো দেন। হাল জামানায় আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে এবং পৃথিবীর অনেকগুলো দেশেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই হয়তো এই অভিযুক্ত সম্পাদকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে, যেমন ছিল ১৯৪৬ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালগুলোতে, হয়তো এই তিনজনকে ২০০৩ সালের এই রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।
এই রায়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট নাভি পিল্লেই (Navi Pilley) (ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার এই নাগরিক, এখন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার) কী বলেছিলেন, তা উসকানিতে আসক্ত বাংলাদেশের কিছু সম্পাদক-সাংবাদিকের বিশেষ মনোযোগ দিয়ে মনে রাখা দরকার। নিচের অনুচ্ছেদ দুটি ২০০৫ সালের ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক সান পত্রিকাটি থেকে নেওয়া হয়েছে: (রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত) ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রশ্ন ছিল, জাতিগত বিদ্বেষ, উত্তেজনামূলক নিকৃষ্ট ধরনের ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তৃতা-বিবৃতি গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে কি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালকে কোথায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার শেষ এবং উসকানির শুরু, তার সিদ্ধান্ত দিতে বলা হলো।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীলতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, বিচারপতি পিল্লাই পরে বলেছিলেন। বিচারে দাঁড় করানো এনগেজে, বারাইয়াগবিজা এবং নাহিমানা—এঁরা সবাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, গণতন্ত্রে স্বীকৃত উদার সংবাদমাধ্যমের সব রকমের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছিলেন। মানুষের আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব পালন করার কথা। সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীলতা মেনে চলতে হবে, তাঁরা তা করেননি।
টাইম সাময়িকীর প্রচ্ছদে পূর্ব তিমুরের গৃহযুদ্ধের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত রক্তাক্ত যুবকের ছবিকে রক্তাক্ত ফেনীর ছবি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া, যেমন করেছিল আমাদের একটি ট্যাবলয়েড দৈনিক ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বর, তা একধরনের উসকানি। আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, উসকানি দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধ। এই অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জার্মানিতে জুলিয়াস স্ট্রেচারকে মৃত্যুদণ্ড এবং তার ৫৮ বছর পর ২০০৩ সালে রুয়ান্ডার তিনজন সম্পাদক হাসান এনগেজে, ফার্ডিন্যান্ড নাহিমানা ও জ্যঁ বস্কো বারাইয়াগবিজাকে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সুতরাং সম্পাদক, সাংবাদিক হলেই আইনের ঊর্ধ্বে, যা ইচ্ছা তাই লেখা যাবে, তা কোনোভাবেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নয়।
রুয়ান্ডার গণহত্যার বিভিন্ন দিক জানতে যাঁরা আগ্রহী তাঁরা ইন্টারনেটে ওপরে উল্লিখিত রুয়ান্ডা জেনোসাইড, জুলিয়াস স্ট্রেচার, নাভি পিল্লেই, কাংগুরা—এমন যেকোনো একটি বিষয় কম্পিউটারে গুগল-এ টাইপ করে ক্লিক করলে অনেকগুলো সাইট দেখতে পারেন। নির্ধারিত বিষয়ের উইকিপিডিয়ার সাইটে বিস্তারিত জানা যাবে। যেকোনো একটি বিষয়ের ওপর উইকিপিডিয়াতে গেলে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক অনেক বিষয়ের লিংক পাওয়া যাবে। এই লিংকগুলো ক্লিক করলে এ বিষয়ের ওপর আরও শত শত পৃষ্ঠা।
সবশেষে আগ্রহী পাঠকেরা ২০০৪ সালে নির্মিত হোটেল রুয়ান্ডা ছবিটিও দেখতে পারেন। ডিভিডিটি ঢাকার ভিডিও স্টোরগুলোতে পাওয়া যাওয়ার কথা; আমি দুই বছর আগে রাইফেল স্কয়ার থেকে জোগাড় করেছি। হোটেল রুয়ান্ডার একজন তরুণ ম্যানেজার একজন হুতু সম্প্রদায়ের লোক পল রুজ্সাবাগিনা, স্ত্রী টুটিস সম্প্রদায়ের টাটিয়ানা কী করে এক হাজার ২৫০ জনের মতো মানুষকে গণহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিলেন। সত্য ঘটনার ওপরে নির্মিত এই ছবিটি অনেকগুলো অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল, কয়েকটি বোধ হয় পেয়েছিল। এই দম্পতি তাঁদের সন্তানদের নিয়ে এখন ব্রাসেলসে বাস করেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কলাম লেখক।
mohiudddinahmed1944@yahoo.com
তবে মশিউল আলমের কয়েকটি কথা মেনে নিতে পারছি না। সম্পাদকদের যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদের পরদিনই ১৫ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বিবৃতি দেয়। কলাম লেখেন আরও কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁদের লেখার মধ্যে ‘ভিন্নমত, অন্য চিন্তার প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটেছে। একই রকম অসহিষ্ণু সমালোচনা হয়েছে টিভির টক শোতেও’—লিখেছেন মশিউল আলম দ্বিতীয় কিস্তিতে। কিন্তু মশিউল আলমের এই কথাগুলোতে আমার মনে হয়েছে, তাঁরই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ। সম্পাদকদের বিবৃতির প্রতিবাদে কলাম লেখকেরা কে কীভাবে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার উল্লেখ জরুরি ছিল বলে মনে করি। জায়গার অভাবে মশিউল আলম যদি তা এবার না পেরে থাকেন, তা পরে কোনো সময়ে করবেন আশা রাখি।
মশিউল আলম ‘ব্রিটিশ প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন’-এ ক্ষুব্ধ নাগরিকদের ‘রিলিফ’, প্রতিকার পাওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বোধ হয় জানেন না যে, প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন কিছু পত্রপত্রিকা, তার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বেপরোয়া, আগ্রাসী আচরণের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে, বা যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছিল না বলে সম্প্রতি এই ‘কমিশন’কে বিলোপ করে দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে ব্রিটিশ ‘হাউস অব কমন্স’। তার জায়গায় আসছে বেশ কঠোর ব্যবস্থা।
আমাদের ‘প্রেস কাউন্সিলের’ কথাও মশিউল আলম উল্লেখ করেছেন। প্রথম আলোর সম্পাদককে নোংরাভাবে আক্রমণ করে যেসব সাংবাদিক, সম্পাদক আমাদের প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক তিরস্কৃত হয়েছেন, তাঁদের অবস্থানের কি কোনো পরিবর্তন ঘটেছে? তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা, মানমর্যাদা, সম্মান—এসবের কি এতটুকু ক্ষতি হয়েছে? তাঁরা আগের মতোই সম্পাদক আছেন, লেখালেখি করছেন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লিখে, ‘টক শো’তে উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে ওয়াজ করে চলছেন। কেউ কেউ টক শোর উপস্থাপকও হয়ে গিয়েছেন। যাঁরা প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক নিন্দিত, তাঁদের কি কোনো পদাবনতি ঘটেছে বা বেতন-ভাতা কমেছে? প্রথম আলোর সম্পাদকের দায়ের করা মামলায় বর্তমান প্রেস কাউন্সিল তবু কয়েকটি রায় দিলেন। কিন্তু গত ৩০ বছরে সাংবাদিকতার মানোন্নয়নে আমাদের প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকাটি কী? বরং প্রেস কাউন্সিলে নিন্দিত সম্পাদককে পরে প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হতেও দেখেছি।
যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও যেখানে প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন ব্যর্থ, সেখানে বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিলকে বিলুপ্ত করে দিলে অনেকগুলো টাকা বেঁচে যায়।
আমোদের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেই তাঁরা দাবি করতে থাকেন, প্রেস কাউন্সিলে কেন প্রতিকার চাওয়া হলো না? এর একটি কারণ এই যে, প্রেস কাউন্সিলে গেলে যে কিছুই হবে না, তা আমাদের গণমাধ্যমের লোকজন গত ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন। তাই তাঁরা প্রেস কাউন্সিলে যাওয়ার কথা হরহামেশাই বলে থাকেন। আমাদের সাংবাদিকেরা প্রেস কাউন্সিলকে ‘কভার’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলেই দ্রুতই এই প্রেস কাউন্সিল উঠিয়ে দিয়ে সাম্প্রতিক ব্রিটিশ উদাহরণের অনুসরণে নতুন কিছু প্রবর্তন করতে পারে আমাদের সরকার।
প্রেস কাউন্সিল কী করবে? সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই তো সম্মান দেখানো হচ্ছে না। মাহমুদুর রহমানকে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত—‘সুপ্রিম কোর্ট’ দু-দুবার দণ্ড দিলেন, একবার জেলদণ্ড, আরেকবার জরিমানা, তাতে কিছু মানুষের কাছে মাহমুদুর রহমানের সম্মান, ইজ্জত, মর্যাদা কিছুটা কমেছে বলে মনে হয় না। তার পরও আমাদের ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিলেন! মশিউল আলমের দুই কিস্তির লেখার প্রথম কিস্তিতে মাহমুদুর রহমান এবং তাঁর আমার দেশ-এর অপসাংবাদিকতা, আগ্রাসী সাংবাদিকতার কতগুলো উদাহরণ যথার্থভাবেই উল্লেখিত হলো, কিন্তু মশিউল আলম মাহমুদুর রহমানের জেল খাটার এবং জরিমানা দেওয়ার উদাহরণগুলো একেবারেই ভুলে গেলেন! এত বড় ভুল কি মেনে নেওয়া যায়?
আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের বোধ হয় জানা নেই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়ে গণহত্যায় ভূমিকা রাখার অপরাধে ১৯৪৬ সালের ১ অক্টোবর ‘নুরেমবার্গ ট্রায়ালে’ Der Sturmer নামের পত্রিকার সম্পাদক জুলিয়াস স্ট্রেচারকে (Juluis Streichar) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর এই মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হয় ১৬ অক্টোবর।
এই উদাহরণ অনুসরণ করে ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় গণহত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ‘হেট মিডিয়া’র লোকদের জন্য আলাদা বিচারব্যবস্থা ছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় কাংগুরা (Kangura) নামের পত্রিকার সম্পাদক হাসান এনগেজেকে (Hassan Ngeze)। আর আরটিএলএমের (Radio Television Libre des Mille) দুই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফার্ডিন্যান্ড নাহিমানা (Ferdinand Nahimana) এবং জ্যঁ বস্কো বারাইয়াগবিজাকে (Jean Bosco Barayagwiza) দেওয়া হয় ৩৫ বছরের কারাদণ্ড। রুয়ান্ডার গণহত্যায় ১৯৯৪ সালে মাত্র ৯০ দিনে মোট ১০ লাখ ‘মাইনোরিটি টুটিস’কে হত্যা করেছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘হুতু’ সম্প্রদায়ের লোক। এই গণহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য জাতিসংঘ ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা’ গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালই এই তিন সম্পাদককে এই দণ্ডগুলো দেন। হাল জামানায় আন্তর্জাতিক কোনো আদালতে এবং পৃথিবীর অনেকগুলো দেশেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই হয়তো এই অভিযুক্ত সম্পাদকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে, যেমন ছিল ১৯৪৬ সালে নুরেমবার্গ ট্রায়ালগুলোতে, হয়তো এই তিনজনকে ২০০৩ সালের এই রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।
এই রায়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট নাভি পিল্লেই (Navi Pilley) (ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার এই নাগরিক, এখন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার) কী বলেছিলেন, তা উসকানিতে আসক্ত বাংলাদেশের কিছু সম্পাদক-সাংবাদিকের বিশেষ মনোযোগ দিয়ে মনে রাখা দরকার। নিচের অনুচ্ছেদ দুটি ২০০৫ সালের ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক সান পত্রিকাটি থেকে নেওয়া হয়েছে: (রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচারের জন্য গঠিত) ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রশ্ন ছিল, জাতিগত বিদ্বেষ, উত্তেজনামূলক নিকৃষ্ট ধরনের ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তৃতা-বিবৃতি গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে কি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালকে কোথায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার শেষ এবং উসকানির শুরু, তার সিদ্ধান্ত দিতে বলা হলো।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীলতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, বিচারপতি পিল্লাই পরে বলেছিলেন। বিচারে দাঁড় করানো এনগেজে, বারাইয়াগবিজা এবং নাহিমানা—এঁরা সবাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, গণতন্ত্রে স্বীকৃত উদার সংবাদমাধ্যমের সব রকমের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছিলেন। মানুষের আস্থা-বিশ্বাস নিয়েই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব পালন করার কথা। সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীলতা মেনে চলতে হবে, তাঁরা তা করেননি।
টাইম সাময়িকীর প্রচ্ছদে পূর্ব তিমুরের গৃহযুদ্ধের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত রক্তাক্ত যুবকের ছবিকে রক্তাক্ত ফেনীর ছবি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া, যেমন করেছিল আমাদের একটি ট্যাবলয়েড দৈনিক ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বর, তা একধরনের উসকানি। আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, উসকানি দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আন্তর্জাতিক আইনেও অপরাধ। এই অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জার্মানিতে জুলিয়াস স্ট্রেচারকে মৃত্যুদণ্ড এবং তার ৫৮ বছর পর ২০০৩ সালে রুয়ান্ডার তিনজন সম্পাদক হাসান এনগেজে, ফার্ডিন্যান্ড নাহিমানা ও জ্যঁ বস্কো বারাইয়াগবিজাকে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সুতরাং সম্পাদক, সাংবাদিক হলেই আইনের ঊর্ধ্বে, যা ইচ্ছা তাই লেখা যাবে, তা কোনোভাবেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নয়।
রুয়ান্ডার গণহত্যার বিভিন্ন দিক জানতে যাঁরা আগ্রহী তাঁরা ইন্টারনেটে ওপরে উল্লিখিত রুয়ান্ডা জেনোসাইড, জুলিয়াস স্ট্রেচার, নাভি পিল্লেই, কাংগুরা—এমন যেকোনো একটি বিষয় কম্পিউটারে গুগল-এ টাইপ করে ক্লিক করলে অনেকগুলো সাইট দেখতে পারেন। নির্ধারিত বিষয়ের উইকিপিডিয়ার সাইটে বিস্তারিত জানা যাবে। যেকোনো একটি বিষয়ের ওপর উইকিপিডিয়াতে গেলে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক অনেক বিষয়ের লিংক পাওয়া যাবে। এই লিংকগুলো ক্লিক করলে এ বিষয়ের ওপর আরও শত শত পৃষ্ঠা।
সবশেষে আগ্রহী পাঠকেরা ২০০৪ সালে নির্মিত হোটেল রুয়ান্ডা ছবিটিও দেখতে পারেন। ডিভিডিটি ঢাকার ভিডিও স্টোরগুলোতে পাওয়া যাওয়ার কথা; আমি দুই বছর আগে রাইফেল স্কয়ার থেকে জোগাড় করেছি। হোটেল রুয়ান্ডার একজন তরুণ ম্যানেজার একজন হুতু সম্প্রদায়ের লোক পল রুজ্সাবাগিনা, স্ত্রী টুটিস সম্প্রদায়ের টাটিয়ানা কী করে এক হাজার ২৫০ জনের মতো মানুষকে গণহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিলেন। সত্য ঘটনার ওপরে নির্মিত এই ছবিটি অনেকগুলো অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল, কয়েকটি বোধ হয় পেয়েছিল। এই দম্পতি তাঁদের সন্তানদের নিয়ে এখন ব্রাসেলসে বাস করেন।
মহিউদ্দিন আহমদ: সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কলাম লেখক।
mohiudddinahmed1944@yahoo.com
No comments