সংকটে পোশাকশিল্প by নিয়াজ আহমেদ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে বাংলাদেশি
পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্তি (জিএসপি) অব্যাহত রাখা নিয়ে ইউরোপীয়
পার্লামেন্টে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। পার্লামেন্টের বেশির ভাগ
সদস্য কারখানাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশি গার্মেন্ট
পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিতের পক্ষে মত দেন।
এর আগে
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু
মনির সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্য সুবিধা
জিএসপি বহাল রাখা এবং শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রসঙ্গে
বাংলাদেশের অনুরোধের ব্যাপারে জন কেরি সর্বোচ্চ চেষ্টার আশ্বাস দিয়েছেন।
তবে শর্ত থাকে যে এ বিষয়ে কাজের পরিবেশ, বিশেষ করে কারখানায় আগুন ও ভবন
নিরাপত্তা এবং শ্রম আইন সংশোধন ইস্যুতে বাংলাদেশকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত গার্মেন্ট শিল্পে ট্রেড
ইউনিয়ন চালু করার আহ্বান জানান। অন্যদিকে বাংলাদেশের ৩০০ পোশাক কারখানার
ওপর নিজস্ব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চেইন স্টোর
ওয়ালমার্ট। উপরোক্ত সংবাদগুলো বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের জন্য একটি
অশনিসংকেত। বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো যদি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কঠোর
অবস্থান গ্রহণ করে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় সংকটে পড়বে বলে অনেকের ধারণা।
যে তিনটি বড় খাতের মাধ্যমে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে গার্মেন্ট শিল্প অন্যতম। অন্য দুটি খাত হলো কৃষি ও ফরেন রেমিট্যান্স। গত কয়েক বছরে কৃষি খাতের সাফল্য আশাব্যঞ্জক। ব্যাপক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে বাংলাদেশ পতিত না হওয়ায় কৃষকের বড় উন্নতি না হলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে বাইরে থেকে খাদ্য আমদানির পরিমাণ কমছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি পুনরায় শুরু হয়েছে। সৌদি আরবে বসবাসরত কয়েক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি কাজের বৈধতা পেতে যাচ্ছে। পাশাপাশি হংকংসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক দেশে জনশক্তি রপ্তানি চলছে। খোদ মার্কিন সরকারের অভিবাসন নীতির সংশোধনের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করছি, অবৈধ অনেক বাংলাদেশি সেখানে আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে। কৃষি ও জনশক্তি রপ্তানির খাতের অবস্থা যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন আমাদের সবচেয়ে বড় খাত যা থেকে রপ্তানি আয় সবচেয়ে বেশি সেই খাতের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন। আবার অনেকে বলেন, মালিকদের অধিক মুনাফা ও শ্রমিকদের প্রতি শোষণ এ খাতকে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণিত তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে দ্বিতীয় বিষয়টি আমরা কমবেশি সবাই বুঝতে পারি। আমাদের দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী বেকার। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় ঢের বেশি। বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া সম্ভব নয়। কেননা রয়েছে দারিদ্র্য। শুধু বেঁচে থাকার জন্য আরো সহজভাবে বলতে গেলে দুই বেলা খাওয়ার জন্য গার্মেন্টে কাজ করছে আমাদের দেশের মেয়েরা। শ্রমের জোগান যেখানে বেশি সেখানে বেতন বেশি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অর্থনীতি তাই বলে। প্রদত্ত বেতনে শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ হয় কি হয় না মালিক তা বিবেচনায় আনেন না। ফলে অপেক্ষাকৃত কম মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের ঘামে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বিত্তশালী হয়েছেন আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হুংকার দিলেও পরক্ষণে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। কেননা তাদেরও লাভ কম নয়। সস্তা দামে পণ্য ক্রয় করা অন্য কোনো দেশ থেকে সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেতন কাঠামো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ন্যূনতম বেতন আমাদের দেশের শ্রমিকদের। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে মজুরি ১৩০ ডলার, সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ৩৮ ডলার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় ক্যালরিসহ একজন মানুষের পক্ষেও বেঁচে থাকা দুরূহ।
এক একটি ঘটনা ঘটে। দুঃখ প্রকাশ, তদন্ত কমিটি গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ডেকে নিয়ে সামান্য অর্থের একটি চেক হস্তান্তর-এখানেই সমাপ্তি। অপেক্ষা আর একটি ঘটনার। আমরা লক্ষ করেছি, কিভাবে তাজরীন গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে ১৪১ জন শ্রমিক মারা গেছে। শ্রমিকদের শোক না কাটতেই স্মরণকালের ভয়াবহ ঘটনা ঘটল সাভারের রানা প্লাজায়। ঘটনার নায়ক যিনি ভবনের মালিক তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী। স্থানীয় এমপির সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান তখন তিনি স্থানীয় এমপির সঙ্গে কথা বলেননি। আইএলও ও বিশ্বব্যাংকের বহুদিনের দাবি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ দেওয়া। সেটা কতটুকু সম্ভব হবে জানি না। কেননা প্রথম থেকেই আমাদের গার্মেন্ট মালিকপক্ষ ট্রেড ইউনিয়নের বিরোধিতা করে আসছে। অথচ তাদের নিজেদের রয়েছে নিজ নিজ জোট ও সংগঠন।
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওয়ালমার্টে শপিং করার। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের এক বিশাল সমারোহ। বিশাল এ মার্কেট যদি বাংলাদেশ হারায় এবং সত্যিই যদি তারা ৩০০ পোশাক কারখানা থেকে পণ্য নেওয়া বন্ধ করে দেয়, তা যেমন ওই সব কারখানার জন্য সমস্যা হবে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সব মহলের বোধোদয় আশা করি, তারা যেন বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ঝুঁকি থেকে দেশকে রক্ষা করে। আমাদের বিশ্বাস, সরকার ও মালিকপক্ষ আন্তরিক হলে এ খাতে বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধান হবে।
লেখক : অধ্যাপক, শাবিপ্রবি
যে তিনটি বড় খাতের মাধ্যমে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে গার্মেন্ট শিল্প অন্যতম। অন্য দুটি খাত হলো কৃষি ও ফরেন রেমিট্যান্স। গত কয়েক বছরে কৃষি খাতের সাফল্য আশাব্যঞ্জক। ব্যাপক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে বাংলাদেশ পতিত না হওয়ায় কৃষকের বড় উন্নতি না হলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে বাইরে থেকে খাদ্য আমদানির পরিমাণ কমছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি পুনরায় শুরু হয়েছে। সৌদি আরবে বসবাসরত কয়েক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি কাজের বৈধতা পেতে যাচ্ছে। পাশাপাশি হংকংসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক দেশে জনশক্তি রপ্তানি চলছে। খোদ মার্কিন সরকারের অভিবাসন নীতির সংশোধনের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আশা করছি, অবৈধ অনেক বাংলাদেশি সেখানে আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে। কৃষি ও জনশক্তি রপ্তানির খাতের অবস্থা যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন আমাদের সবচেয়ে বড় খাত যা থেকে রপ্তানি আয় সবচেয়ে বেশি সেই খাতের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন। আবার অনেকে বলেন, মালিকদের অধিক মুনাফা ও শ্রমিকদের প্রতি শোষণ এ খাতকে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণিত তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে দ্বিতীয় বিষয়টি আমরা কমবেশি সবাই বুঝতে পারি। আমাদের দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী বেকার। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় ঢের বেশি। বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া সম্ভব নয়। কেননা রয়েছে দারিদ্র্য। শুধু বেঁচে থাকার জন্য আরো সহজভাবে বলতে গেলে দুই বেলা খাওয়ার জন্য গার্মেন্টে কাজ করছে আমাদের দেশের মেয়েরা। শ্রমের জোগান যেখানে বেশি সেখানে বেতন বেশি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অর্থনীতি তাই বলে। প্রদত্ত বেতনে শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণ হয় কি হয় না মালিক তা বিবেচনায় আনেন না। ফলে অপেক্ষাকৃত কম মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের ঘামে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বিত্তশালী হয়েছেন আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হুংকার দিলেও পরক্ষণে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। কেননা তাদেরও লাভ কম নয়। সস্তা দামে পণ্য ক্রয় করা অন্য কোনো দেশ থেকে সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কার গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বেতন কাঠামো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ন্যূনতম বেতন আমাদের দেশের শ্রমিকদের। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে মজুরি ১৩০ ডলার, সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ৩৮ ডলার। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় ক্যালরিসহ একজন মানুষের পক্ষেও বেঁচে থাকা দুরূহ।
এক একটি ঘটনা ঘটে। দুঃখ প্রকাশ, তদন্ত কমিটি গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ডেকে নিয়ে সামান্য অর্থের একটি চেক হস্তান্তর-এখানেই সমাপ্তি। অপেক্ষা আর একটি ঘটনার। আমরা লক্ষ করেছি, কিভাবে তাজরীন গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে ১৪১ জন শ্রমিক মারা গেছে। শ্রমিকদের শোক না কাটতেই স্মরণকালের ভয়াবহ ঘটনা ঘটল সাভারের রানা প্লাজায়। ঘটনার নায়ক যিনি ভবনের মালিক তিনি একজন রাজনৈতিক কর্মী। স্থানীয় এমপির সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান তখন তিনি স্থানীয় এমপির সঙ্গে কথা বলেননি। আইএলও ও বিশ্বব্যাংকের বহুদিনের দাবি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ দেওয়া। সেটা কতটুকু সম্ভব হবে জানি না। কেননা প্রথম থেকেই আমাদের গার্মেন্ট মালিকপক্ষ ট্রেড ইউনিয়নের বিরোধিতা করে আসছে। অথচ তাদের নিজেদের রয়েছে নিজ নিজ জোট ও সংগঠন।
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওয়ালমার্টে শপিং করার। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের এক বিশাল সমারোহ। বিশাল এ মার্কেট যদি বাংলাদেশ হারায় এবং সত্যিই যদি তারা ৩০০ পোশাক কারখানা থেকে পণ্য নেওয়া বন্ধ করে দেয়, তা যেমন ওই সব কারখানার জন্য সমস্যা হবে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা সংশ্লিষ্ট সব মহলের বোধোদয় আশা করি, তারা যেন বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ঝুঁকি থেকে দেশকে রক্ষা করে। আমাদের বিশ্বাস, সরকার ও মালিকপক্ষ আন্তরিক হলে এ খাতে বিদ্যমান সব সমস্যার সমাধান হবে।
লেখক : অধ্যাপক, শাবিপ্রবি
No comments