জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের নিশ্চয়তা চাই by ড. এম শামসুল আলম
২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট গত ৬
জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি নিজেই এ বাজেটকে
অশোভনীয় আশাবাদের বাজেট বলে অভিহিত করেন। পরে সমালোচলার মুখে অশোভনীয়
শব্দটি অসম্ভব শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছেন।
বাজেটে
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে যেসব আশা বা প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে,
তা পূরণ বা বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব বা বাস্তবসম্মত অথবা অসম্ভব আশাবাদ কি না
সে বিষয়টি এ লেখায় খতিয়ে দেখা হয়েছে।
চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে সাত হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাত উন্নয়নে এক হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। বাজেটে ভর্তুকি বাবদ কোনো বরাদ্দ ছিল না। তবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন : দ্বিতীয় হালচিত্রে ভর্তুকি উল্লেখ রয়েছে বিদ্যুৎ খাতে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাতে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাস্তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি আসে না, আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার লোন দেয়। বাজেটে এ লোন ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি উল্লেখ না থাকায় এ লোনের উৎস কী, বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের কত অংশ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে, তাতে কতটা উন্নয়ন সম্ভব এবং বাস্তবে কতটা উন্নয়ন হয়েছে- তা অনুধাবন করা কঠিন। তাই প্রস্তাবিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বাজেট অসম্ভব আশাবাদী কি না, তা খতিয়ে দেখার আগে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে চলতি বাজেটে যেসব আশা বা প্রতিশ্রুতি ছিল, তার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, সে সম্পর্কে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি তেল সরবরাহে আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে পাঁচ হাজার ১৭০ কোটি টাকা এবং ১৩ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যয় ধরা ছিল ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয় হলো ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঘাটতি সমন্বয় কি উন্নয়ন বাজেটের অর্থে হয়েছে, নাকি বকেয়া রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে সমন্বয়ের জন্য? তা যা-ই হোক না কেন, চলতি বাজেটের বরাদ্দে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন যে নিশ্চিত হয়নি, তা এখন স্পষ্ট।
২০১১-১২ অর্থ বছরের বাজেটে জ্বালানি খাত উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ৭২৬ কোটি টাকা। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ যোগ হওয়ায় এ বছরের বাজেটে সে বরাদ্দ দাঁড়ায় এক হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। অথচ চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থে নেওয়া দুটি প্রকল্পের অগ্রগতি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ মাত্র। সরবরাহকৃত গ্যাসে বিদেশি কম্পানির গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারি খাতে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদে দেশি কম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। তাই গ্যাস বিলের সঙ্গে বাড়তি অর্থ দিয়ে ভোক্তারা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করে। বাস্তবে দেখা যায়, সরবরাহকৃত গ্যাসে বিদেশি কম্পানির গ্যাসের অনুপাত ২০০৮ সালে ছিল ৪৮ শতাংশ। এখন ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেই উন্নয়ন হয় না, এ দৃষ্টান্ত তারই প্রমাণ। গ্যাস সরবরাহ বাড়লেও সরবরাহকৃত গ্যাসে দেশি কম্পানির গ্যাসের অনুপাত বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বা আশা বাস্তবায়ন হয়নি।
গত অর্থবছরে জ্বালানি খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ খাত এগিয়ে থাকলেও এবার পিছিয়ে পড়েছে। এডিপিভুক্ত ৫৯টি বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম ১০ মাসে অগ্রগতি হয়েছে ৬৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ১০ মাস অর্থাৎ চার পঞ্চাংশ সময়েও দুই-তৃতীয়াংশ অগ্রগতি হয়নি। সিরাজগঞ্জ ও আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ১০ জেলার বিদ্যুৎ বিতরণ উন্নয়ন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কম্বাইন্ড সাইকেল উন্নয়নসহ পিডিবি, আরইবি ও ডেসকোর এডিপিভুক্ত অনেক কার্যক্রমের অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। ফলে এসব কার্যক্রম আগামী অর্থবছরে এডিপিভুক্ত হবে। আবার বিদ্যুৎ বিতরণে এ অর্থবছরে আর্থিক ঘাটতি ৭১৬ কোটি টাকা। যদি সমন্বয়ের সুযোগ না থাকে, তাহলে বকেয়া হিসেবে এ অর্থ আগামী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বাজেট ঘাটতি বাড়াবে এবং উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
চলতি অর্থবছরে তিন হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি সাপেক্ষে পাইকারি বিদ্যুতের সর্বশেষ মূল্যহার বিইআরসি নির্ধারণ করে ৪.৭০ টাকা। বিইআরসির আদেশ অনুযায়ী ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা চার হাজার কোটি একক। তাতে লোডশেডিং মোকাবিলা করা সহজ হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্যাসস্বল্পতার কারণে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে এবং আর্থিক ঘাটতি কমানোর জন্য তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশও হয়নি। লোডশেডিং মোকাবিলা করা যায়নি। যদিও লোডশেডিং মোকাবিলার জন্যই বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ের তাগিদে বিদ্যুতের মূল্যহার দফায় দফায় অস্বাভাবিক বেড়েছে। তার পরও আর্থিক ঘাটতি কমানোর অজুহাতে শেষমেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের বিগত বাজেট বক্তৃতায় সে বছর ও তার আগের বছরের এডিপিভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের নানা কার্যক্রমের গতি ও অগ্রগতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন। চলতি বছরের এডিপিভুক্ত নানা কার্যক্রম সম্পর্কে তারই ধারাবাহিকতায় তিনি নানা আশা ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। এসব গতি ও অগ্রগতি এবং আশা ও প্রতিশ্রুতি যদি ফলপ্রসূ হতো, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর্থিক ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য লোডশেডিং বাড়ানো এখন অপরিহার্য হতো না। তাই বিদ্যমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বলা যায়, চলতি বছরের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বাজেট অসম্ভব আশাবাদী ছিল। অর্থাৎ বাস্তবসম্মত ছিল না।
২০১৩-১৪ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ৯ হাজার ৬০ কোটি টাকা এবং দুই হাজার ২৫৫ কোটি টাকা রয়েছে জ্বালানি খাত উন্নয়নে। চলতি বছরের মতোই বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ না থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন পথনকশা : অগ্রগতির ধারা শিরোনামের প্রকাশনায় আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলার জন্য অর্থবরাদ্দ ধরা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতের জন্য পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাতের জন্য সাত হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।
গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, আগামী দুই অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। সেই সঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেন, তিন হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরকার সরবরাহ করেছে। অর্থাৎ চার বছরে আগের তুলনায় এখন বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে দ্বিগুণ। অথচ তিনি বলেননি, এ বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেকই স্বল্পমেয়াদি ভাড়াভিত্তিক দামি তেল-বিদ্যুৎ। আগামী দুই বছরের মধ্যে এ বিদ্যুতের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তার মেয়াদ বৃদ্ধি হচ্ছে। চরম বিদ্যুৎসংকটে বিদ্যুৎ সরবরাহে এমন বিদ্যুৎ 'লাইফ সাপোর্ট'। তাই এ বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। তা ছাড়া এসব বিদ্যুৎ প্লান্টের বেশির ভাগই পিকিং প্লান্ট। তার মধ্যে অনেকগুলো নির্মাণাধীন। নির্মাণের অগ্রগতি থেকে কোনোভাবেই নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। এ সব প্লান্ট পরিকল্পনামাফিক পরবর্তী দুই বছরে উৎপাদনে আসবে এবং উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। আবার যেসব প্লান্ট নির্মাণ হয়েছে, সেসব প্লান্ট গ্যাসস্বল্পতার কারণে ঠিকমতো চলেনি, ভবিষ্যতেও চলবে কি না অনিশ্চিত; উৎপাদন ব্যয় কমাতে তেল সাশ্রয়ের জন্য চালানো হয়নি তেল-বিদ্যুৎ প্লান্ট, ভবিষ্যতেও হবে না। এমন সব প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সূত্রে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বললেন, 'আমি প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় বিদ্যুৎ সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশার কথা, এ ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্যও অর্জন করেছি।' এরপর আর বিচার বিশ্লেষণের অপেক্ষা না করে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের ব্যাপারে প্রস্তাবিত বাজেটকে অসম্ভব আশাবাদী বাজেটই নয়, অশোভনীয় আশাবাদের বাজেট বললেও কম বলা হবে।
জ্বালানি সংকট সমাধানে বাজেটে উল্লেখযোগ্য কোনো দিক নির্দেশনা নেই। আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগের অভাবে গ্যাস সরবরাহ প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে না। তবে কয়লা উত্তোলন ও এলএনজি আমদানি পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে দেওয়ার কথা বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন। আগামীতে জ্বালানি সংকট আরো বাড়বে। ফলে সংকট মোকাবিলায় গ্যাসস্বল্পতার কারণে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে। তাতে জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে যদি না-ও বাড়ে, তবু আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তা ছাড়া কয়লা আমদানির ব্যাপারেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ ও অগ্রগতি নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপারে বাজেটে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হলেও রিফাইনারির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প বাজেটে আসেনি। রামপালে আমদানীকৃত কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ প্রকল্প এডিপিভুক্ত। মংলা পোর্টের মাধ্যমে এ কয়লা আনা হবে। কয়লাবাহী জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য বন্দরের ড্রাফ্ট ১০ মিটারে অধিক থাকা অবশ্যক। অনেক জায়গায় অনেক সময় ৬ মিটার ড্রাফ্টও থাকে না। এ সীমাবদ্ধতার কারণে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে মংলা বন্দরের উন্নয়ন ব্যাহত। তাহলে এ কয়লা আসবে কিভাবে? তাহলে কি গ্যাসবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও তেল-বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই উৎপাদনক্ষমতা থাকবে, অথচ কয়লা সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হবে? তা ছাড়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে, এ কারণে রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আপত্তি উঠেছে। এ প্রকল্পের পরিবেশ প্রভাব নিরূপণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে সুন্দরবন বিবেচনায় আসেনি। পরিবেশ প্রভাব নিরূপণে প্রকল্প এলাকাকে গ্রামীণ জনবসতি এলাকা ধরা হয়েছে। সুন্দরবন বিবেচনায় নেওয়া হলে এ বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশবান্ধব হতো কি না, তা নিশ্চিত নয়। আবার কয়লা খাত উন্নয়নের প্রশ্নে ভূগর্ভস্থ নবায়নযোগ্য পানিসম্পদ রক্ষার বিষয়টি অতীতেও মীমাংসা হয়নি, বর্তমান সরকারও মীমাংসা না করে পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে যাচ্ছে। সুতরাং গ্যাস খাত উন্নয়ন ব্যতীত জ্বালানি খাত উন্নয়ন স্থবির বললে ভুল হবে না। অথচ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বললেন, '...জ্বালানি নিরাপত্তার ওপরও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি।' তাঁর এ কথা কি শুধুই কথার কথা নয়?
কেবল পর্যাপ্ত বা অপর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহের ওপরই জ্বালানি নিরাপত্তা নির্ভর করে না, পাশাপাশি জ্বালানির দামহারের ওপরও নির্ভর করে। জ্বালানি সরবরাহ অপ্রতুল না হলেও জনগণ জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে পারে। তার বড় প্রমাণ, এ বছর আর্থিক ঘটতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে লোডশেডিং বৃদ্ধি করা হয়েছে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা বিপন্ন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপিভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কর্মসূচিতে এই জ্বালানি নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি আসন্ন।
আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরে ব্যয় হলো বিদ্যুৎ খাতে পাঁচ হাজার ১৭০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি তেল খাতে ১৩ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ব্যয় ধরা হয়েছে বিদ্যুতে পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি তেলে সাত হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। সে জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি হতে হবে ১০ শতাংশের অধিক। এ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তার সিংহভাগ হবে তেল-বিদ্যুৎ। তার বিকল্প নেই। বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে যে পরিমাণ বাড়তি জ্বালানি তেল দরকার হবে, তাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেল বাবদ আর্থিক ঘাটতি এ অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে অনেক বেশি হবে। অথচ আগামী অর্থবছরে এ বাড়তি ঘাটতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের জন্য অর্থ বরাদ্দ তেমন বাড়েনি এবং জ্বালানি তেলে বাড়ার পরিবর্তে কমেছে চলতি বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ। সুতরাং আগামী বছরের ঘাটতি পূরণের জন্য এ বছরের মতোই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দামহার বাড়ানো অব্যাহত থাকবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহ কমিয়ে লোডশেডিং বাড়ানো হবে। তাতে একদিকে জ্বালানি নিরাপত্তায় আরো বিপর্যয় নেমে আসবে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে ধরে রাখা কঠিন হবে। অন্যদিকে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা চলতি বছরের তুলনায় হ্রাস পাবে অনেক বেশি। ফলে এ প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন অনিশ্চিত না বলে উপায় নেই।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ ছিল বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে সাত হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাত উন্নয়নে এক হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। বাজেটে ভর্তুকি বাবদ কোনো বরাদ্দ ছিল না। তবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন : দ্বিতীয় হালচিত্রে ভর্তুকি উল্লেখ রয়েছে বিদ্যুৎ খাতে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাতে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাস্তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি আসে না, আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার লোন দেয়। বাজেটে এ লোন ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি উল্লেখ না থাকায় এ লোনের উৎস কী, বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের কত অংশ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে, তাতে কতটা উন্নয়ন সম্ভব এবং বাস্তবে কতটা উন্নয়ন হয়েছে- তা অনুধাবন করা কঠিন। তাই প্রস্তাবিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বাজেট অসম্ভব আশাবাদী কি না, তা খতিয়ে দেখার আগে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে চলতি বাজেটে যেসব আশা বা প্রতিশ্রুতি ছিল, তার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, সে সম্পর্কে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি তেল সরবরাহে আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে পাঁচ হাজার ১৭০ কোটি টাকা এবং ১৩ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যয় ধরা ছিল ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয় হলো ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঘাটতি সমন্বয় কি উন্নয়ন বাজেটের অর্থে হয়েছে, নাকি বকেয়া রয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে সমন্বয়ের জন্য? তা যা-ই হোক না কেন, চলতি বাজেটের বরাদ্দে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন যে নিশ্চিত হয়নি, তা এখন স্পষ্ট।
২০১১-১২ অর্থ বছরের বাজেটে জ্বালানি খাত উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ৭২৬ কোটি টাকা। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ যোগ হওয়ায় এ বছরের বাজেটে সে বরাদ্দ দাঁড়ায় এক হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। অথচ চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থে নেওয়া দুটি প্রকল্পের অগ্রগতি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ মাত্র। সরবরাহকৃত গ্যাসে বিদেশি কম্পানির গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারি খাতে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদে দেশি কম্পানির বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। তাই গ্যাস বিলের সঙ্গে বাড়তি অর্থ দিয়ে ভোক্তারা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করে। বাস্তবে দেখা যায়, সরবরাহকৃত গ্যাসে বিদেশি কম্পানির গ্যাসের অনুপাত ২০০৮ সালে ছিল ৪৮ শতাংশ। এখন ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেই উন্নয়ন হয় না, এ দৃষ্টান্ত তারই প্রমাণ। গ্যাস সরবরাহ বাড়লেও সরবরাহকৃত গ্যাসে দেশি কম্পানির গ্যাসের অনুপাত বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বা আশা বাস্তবায়ন হয়নি।
গত অর্থবছরে জ্বালানি খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ খাত এগিয়ে থাকলেও এবার পিছিয়ে পড়েছে। এডিপিভুক্ত ৫৯টি বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম ১০ মাসে অগ্রগতি হয়েছে ৬৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ১০ মাস অর্থাৎ চার পঞ্চাংশ সময়েও দুই-তৃতীয়াংশ অগ্রগতি হয়নি। সিরাজগঞ্জ ও আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ১০ জেলার বিদ্যুৎ বিতরণ উন্নয়ন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কম্বাইন্ড সাইকেল উন্নয়নসহ পিডিবি, আরইবি ও ডেসকোর এডিপিভুক্ত অনেক কার্যক্রমের অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। ফলে এসব কার্যক্রম আগামী অর্থবছরে এডিপিভুক্ত হবে। আবার বিদ্যুৎ বিতরণে এ অর্থবছরে আর্থিক ঘাটতি ৭১৬ কোটি টাকা। যদি সমন্বয়ের সুযোগ না থাকে, তাহলে বকেয়া হিসেবে এ অর্থ আগামী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বাজেট ঘাটতি বাড়াবে এবং উন্নয়ন ব্যাহত হবে।
চলতি অর্থবছরে তিন হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি সাপেক্ষে পাইকারি বিদ্যুতের সর্বশেষ মূল্যহার বিইআরসি নির্ধারণ করে ৪.৭০ টাকা। বিইআরসির আদেশ অনুযায়ী ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা চার হাজার কোটি একক। তাতে লোডশেডিং মোকাবিলা করা সহজ হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্যাসস্বল্পতার কারণে গ্যাস-বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে এবং আর্থিক ঘাটতি কমানোর জন্য তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশও হয়নি। লোডশেডিং মোকাবিলা করা যায়নি। যদিও লোডশেডিং মোকাবিলার জন্যই বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ের তাগিদে বিদ্যুতের মূল্যহার দফায় দফায় অস্বাভাবিক বেড়েছে। তার পরও আর্থিক ঘাটতি কমানোর অজুহাতে শেষমেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থ বছরের বিগত বাজেট বক্তৃতায় সে বছর ও তার আগের বছরের এডিপিভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের নানা কার্যক্রমের গতি ও অগ্রগতি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন। চলতি বছরের এডিপিভুক্ত নানা কার্যক্রম সম্পর্কে তারই ধারাবাহিকতায় তিনি নানা আশা ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। এসব গতি ও অগ্রগতি এবং আশা ও প্রতিশ্রুতি যদি ফলপ্রসূ হতো, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আর্থিক ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য লোডশেডিং বাড়ানো এখন অপরিহার্য হতো না। তাই বিদ্যমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বলা যায়, চলতি বছরের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন বাজেট অসম্ভব আশাবাদী ছিল। অর্থাৎ বাস্তবসম্মত ছিল না।
২০১৩-১৪ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ৯ হাজার ৬০ কোটি টাকা এবং দুই হাজার ২৫৫ কোটি টাকা রয়েছে জ্বালানি খাত উন্নয়নে। চলতি বছরের মতোই বাজেটে ভর্তুকি বরাদ্দ না থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন পথনকশা : অগ্রগতির ধারা শিরোনামের প্রকাশনায় আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলার জন্য অর্থবরাদ্দ ধরা হয়েছে বিদ্যুৎ খাতের জন্য পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাতের জন্য সাত হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।
গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, আগামী দুই অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। সেই সঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেন, তিন হাজার ৮৪৫ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরকার সরবরাহ করেছে। অর্থাৎ চার বছরে আগের তুলনায় এখন বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে দ্বিগুণ। অথচ তিনি বলেননি, এ বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেকই স্বল্পমেয়াদি ভাড়াভিত্তিক দামি তেল-বিদ্যুৎ। আগামী দুই বছরের মধ্যে এ বিদ্যুতের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তার মেয়াদ বৃদ্ধি হচ্ছে। চরম বিদ্যুৎসংকটে বিদ্যুৎ সরবরাহে এমন বিদ্যুৎ 'লাইফ সাপোর্ট'। তাই এ বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নের মাপকাঠি নয়। তা ছাড়া এসব বিদ্যুৎ প্লান্টের বেশির ভাগই পিকিং প্লান্ট। তার মধ্যে অনেকগুলো নির্মাণাধীন। নির্মাণের অগ্রগতি থেকে কোনোভাবেই নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। এ সব প্লান্ট পরিকল্পনামাফিক পরবর্তী দুই বছরে উৎপাদনে আসবে এবং উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে। আবার যেসব প্লান্ট নির্মাণ হয়েছে, সেসব প্লান্ট গ্যাসস্বল্পতার কারণে ঠিকমতো চলেনি, ভবিষ্যতেও চলবে কি না অনিশ্চিত; উৎপাদন ব্যয় কমাতে তেল সাশ্রয়ের জন্য চালানো হয়নি তেল-বিদ্যুৎ প্লান্ট, ভবিষ্যতেও হবে না। এমন সব প্লান্টের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সূত্রে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বললেন, 'আমি প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় বিদ্যুৎ সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশার কথা, এ ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্যও অর্জন করেছি।' এরপর আর বিচার বিশ্লেষণের অপেক্ষা না করে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নের ব্যাপারে প্রস্তাবিত বাজেটকে অসম্ভব আশাবাদী বাজেটই নয়, অশোভনীয় আশাবাদের বাজেট বললেও কম বলা হবে।
জ্বালানি সংকট সমাধানে বাজেটে উল্লেখযোগ্য কোনো দিক নির্দেশনা নেই। আগামী অর্থবছরে বিনিয়োগের অভাবে গ্যাস সরবরাহ প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে না। তবে কয়লা উত্তোলন ও এলএনজি আমদানি পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে দেওয়ার কথা বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন। আগামীতে জ্বালানি সংকট আরো বাড়বে। ফলে সংকট মোকাবিলায় গ্যাসস্বল্পতার কারণে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে। তাতে জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে যদি না-ও বাড়ে, তবু আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তা ছাড়া কয়লা আমদানির ব্যাপারেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ ও অগ্রগতি নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপারে বাজেটে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলা হলেও রিফাইনারির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্প বাজেটে আসেনি। রামপালে আমদানীকৃত কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ প্রকল্প এডিপিভুক্ত। মংলা পোর্টের মাধ্যমে এ কয়লা আনা হবে। কয়লাবাহী জাহাজ আসা যাওয়ার জন্য বন্দরের ড্রাফ্ট ১০ মিটারে অধিক থাকা অবশ্যক। অনেক জায়গায় অনেক সময় ৬ মিটার ড্রাফ্টও থাকে না। এ সীমাবদ্ধতার কারণে আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে মংলা বন্দরের উন্নয়ন ব্যাহত। তাহলে এ কয়লা আসবে কিভাবে? তাহলে কি গ্যাসবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও তেল-বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই উৎপাদনক্ষমতা থাকবে, অথচ কয়লা সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ব্যাহত হবে? তা ছাড়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে, এ কারণে রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আপত্তি উঠেছে। এ প্রকল্পের পরিবেশ প্রভাব নিরূপণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে সুন্দরবন বিবেচনায় আসেনি। পরিবেশ প্রভাব নিরূপণে প্রকল্প এলাকাকে গ্রামীণ জনবসতি এলাকা ধরা হয়েছে। সুন্দরবন বিবেচনায় নেওয়া হলে এ বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশবান্ধব হতো কি না, তা নিশ্চিত নয়। আবার কয়লা খাত উন্নয়নের প্রশ্নে ভূগর্ভস্থ নবায়নযোগ্য পানিসম্পদ রক্ষার বিষয়টি অতীতেও মীমাংসা হয়নি, বর্তমান সরকারও মীমাংসা না করে পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে যাচ্ছে। সুতরাং গ্যাস খাত উন্নয়ন ব্যতীত জ্বালানি খাত উন্নয়ন স্থবির বললে ভুল হবে না। অথচ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বললেন, '...জ্বালানি নিরাপত্তার ওপরও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি।' তাঁর এ কথা কি শুধুই কথার কথা নয়?
কেবল পর্যাপ্ত বা অপর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহের ওপরই জ্বালানি নিরাপত্তা নির্ভর করে না, পাশাপাশি জ্বালানির দামহারের ওপরও নির্ভর করে। জ্বালানি সরবরাহ অপ্রতুল না হলেও জনগণ জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে পারে। তার বড় প্রমাণ, এ বছর আর্থিক ঘটতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে লোডশেডিং বৃদ্ধি করা হয়েছে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা বিপন্ন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপিভুক্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন কর্মসূচিতে এই জ্বালানি নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি আসন্ন।
আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরে ব্যয় হলো বিদ্যুৎ খাতে পাঁচ হাজার ১৭০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি তেল খাতে ১৩ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে ব্যয় ধরা হয়েছে বিদ্যুতে পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জ্বালানি তেলে সাত হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। সে জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি হতে হবে ১০ শতাংশের অধিক। এ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য যে পরিমাণ বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তার সিংহভাগ হবে তেল-বিদ্যুৎ। তার বিকল্প নেই। বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে যে পরিমাণ বাড়তি জ্বালানি তেল দরকার হবে, তাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেল বাবদ আর্থিক ঘাটতি এ অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে অনেক বেশি হবে। অথচ আগামী অর্থবছরে এ বাড়তি ঘাটতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের জন্য অর্থ বরাদ্দ তেমন বাড়েনি এবং জ্বালানি তেলে বাড়ার পরিবর্তে কমেছে চলতি বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ। সুতরাং আগামী বছরের ঘাটতি পূরণের জন্য এ বছরের মতোই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দামহার বাড়ানো অব্যাহত থাকবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহ কমিয়ে লোডশেডিং বাড়ানো হবে। তাতে একদিকে জ্বালানি নিরাপত্তায় আরো বিপর্যয় নেমে আসবে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশে ধরে রাখা কঠিন হবে। অন্যদিকে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা চলতি বছরের তুলনায় হ্রাস পাবে অনেক বেশি। ফলে এ প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত বাজেটে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন অনিশ্চিত না বলে উপায় নেই।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
No comments