রশিদুল হকের বই পড়া by তানিম হুমায়ুন
রশিদুল হকের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা, আমি তখন রংপুরের একটা কলেজে পড়ি। রশিদুল হক নাগেশ্বরীর একজন কলেজশিক্ষক। রংপুরের টাউনহল চত্বরের সামনে কী একটা অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে পরিচয়।
অনুষ্ঠান শেষে তিনি আমার কয়েকজন বন্ধুসহ আমাকে নিয়ে গেলেন রংপুরের বিখ্যাত ‘মৌনতা’ রেস্তোরাঁয়। সেখানে শসা দিয়ে শিককাবাব চিবুতে চিবুতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কেউ জায়েদ হকের লেখা পড়স?’ দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তখন টুকটাক চোখ বোলাতাম। জায়েদ হকের নামটা আমার দেখা ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন লেখাটা?’ রশিদুল হক খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘আদিপাপ।’ বললাম, ‘না, পড়িনি।’ তিনি বললেন, ‘আপাতত পড়ার দরকার নাই। একটু বড়দের জন্য লেখা। বাট, তোমরা তো কলেজে পড়তেস। ছাত্রদের একটু সাহিত্য পাঠও দরকার।’
রশিদুল হকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের এই ঘটনাটুকুই আমার মনে আছে। মাঝখানে অনেক দিন তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার প্রতি আমি আরও ঝুঁকেছি। কোনো এক শুক্রবার দৈনিক আশার কথার সাহিত্য পাতায় স্বনামধন্য এক লেখক প্রবন্ধ লিখলেন জায়েদ হকের উপন্যাস নিয়ে। সেখানে তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও জায়েদ হকের লেখার একটা তুলনামূলক আলোচনা করলেন। সেটা পড়ে জানতে পারলাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হককে টেক্কা দিতে পারেন—এমন একজন লেখকই আছেন; তিনি জায়েদ হক।
রংপুরে সাহিত্যের বই জোগাড় করা মুশকিল। তাই জায়েদ হকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে উঠল না। পুরো কলেজজীবনে রশিদুল হকেরও আর দেখা পেলাম না। কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রথম সেমিস্টার চলছে। শেরেবাংলা হলের দোতলায় থাকি। হলের নিচতলায় গেস্টরুম। রুমমেটদের প্রেমিকারা দেখা করতে এলে হলের দারোয়ান সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে ডাক পাড়েন। যেমন শিহাব স্যার, ৩১০। ৩১০ হলো রুম নম্বর।
হঠাৎ একদিন আমারও ডাক পড়ল। তানিম স্যার, ২০৩। আমি টেবিলে বসে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের প্রতিবেদন তৈরি করছিলাম। তানিম স্যার, ২০৩—এই ডাকে আমার রুমমেটরা বাঁকা হাসি হাসল। কৌতূহল নিয়ে নিচতলার গেস্টরুমে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম, তাতে একটু থতমত খেতে হলো। গেস্টরুমের একটা অন্ধকার কোণে, সোফায় রশিদুল হক বসে আছেন। তাঁর শরীরের একদিকে আলো, বাকি অর্ধেকটা ছায়ার মতো লাগছে।
বছর দুই পর রশিদুল হককে দেখছি। দেখতে অচেনা লাগছে। মুখের চামড়ায় ভাঁজ। কিন্তু চোখে-মুখে আগ্রহ ও কৌতূহলের পুরোনো ছায়া লেপটে আছে। আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে বলা শুরু করলেন, ‘ওই যে আমার ছেলেটা, অমিত, ডিএমসিতে চান্স পাইসে, ওকে ভর্তি করাইতে আসছিলাম। ভাবলাম, তোমাকে একটু দেখে যাই। তোমার এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে তোমার অ্যাড্রেসটা নিলাম।’
তাঁর সঙ্গে কী আলাপ পাড়া যায়, মাথায় আসছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখন কী করতেসেন?’
তিনি বললেন, ‘ওই কলেজেই পড়াই, নাগেশ্বরীর। আর বইটা পড়তেসি।’
‘কোন বইটা?’
‘ওই জায়েদ হকের। আদিপাপ। খুব ভালো বই।’
আমার মুখে প্রায় চলেই এসেছিল, একটা বই পড়তে আপনার এত দিন লাগে? চেপে গেলাম।
রশিদুল হক বললেন, ‘গড়াই নদীর পাড়ে আহাদ আলীর খুন হওয়ার ঘটনাটা পড়তেসি ভালো করে। খুন করার সময় লিয়াকত একটা ইট দিয়ে লোকটার মাথায় বাড়ি দেয়। তিনবার। কিন্তু তিনবার কেন? দুইবার দিলেই হইত। থান ইটের বাড়ি, দুইবারই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু লিয়াকত বাড়ি দিল তিনবার। ইদানীং এটাই ভাবি আর কি। লেখকও এটা নিয়া তেমন কিসু বলেন নাই।’
এরপর রশিদুল হক বললেন একটা অদ্ভুত কথা।
‘সাহিত্য পড়ো, সাহিত্য পড়া ভালো। কিন্তু সাহিত্য করতে যাইয়ো না।’
এই কথার মানে তখন বুঝলাম না। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম; অনেক দেরিতে যদিও।
রশিদুল হকের সঙ্গে আমার পাঁচ-ছয় মাস পরপর দেখা হতে থাকল। তিনি ছেলেকে দেখতে আসেন। ফাঁকে আমার হলেও আসেন। আমার খোঁজখবর নেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এখন কী করতেসেন?’ তিনি বলেন, ‘ওই যে জায়েদ হকের উপন্যাসটা, আদিপাপ। ভালো বই।’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। তারপর বলেন, ‘কমলা চরিত্রটা বোঝার চেষ্টা করতেসি। কিন্তু লেখক এই বিষয়টাও খোলাসা করেন নাই।’
কোনো একদিন দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আহাদ আলীর পোষা মুরগির বর্ণনা দেন রশিদুল হক। আরেক দিন দেশের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে করতে ঢুকে পড়েন আদিপাপ-এর গ্রামের রাজনীতিতে। এভাবে চলতে থাকে। তিনি আসেন, ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো সময় নেন, তারপর চলে যান। আমি কোনো এক কারণে তাঁর সঙ্গে অভদ্রতা করে উঠতে পারি না। এ রকমই একটা দিন বিদায় নেওয়ার আগে তিনি আমাকে নিচু ঘড়ঘড়ে গলায় পরামর্শ দেন, ‘সাহিত্য করবা না, বুঝলা, বেলাল!’ তিনি চলে যাওয়ার পরও কথাটা আমার কানের মধ্যে বাজতে থাকে। রশিদুল হক কি আমাকে বেলাল নামে ডাকলেন? বেলাল কে?
এরপর হঠাৎ করে রশিদুল হক গায়েব হয়ে যান। আমিও যেন তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেয়ে হাঁপ ছাড়ি। দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতিতে আমি তাঁকে একরকম ভুলেই যাই। কিন্তু বছর খানেক পর রশিদুল হক আবার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠেন, যখন তাঁর ছেলে অমিতের সঙ্গে দুর্ঘটনাবশত আমার দেখা হয়ে যায়। আজিমপুর থেকে ৩৬ নম্বর বাসে করে মিরপুর যাচ্ছি। পাশের সিটে বসা ছেলেটার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তার পর জানতে পারলাম তার বাড়ি নাগেশ্বরী। বললাম, ‘নাগেশ্বরীর রশিদুল হক নামে একজনকে চিনতাম। নাগেশ্বরী কলেজের টিচার।’ ছেলেটা বলল, ‘উনি আমার বাবা।’
‘তুমি অমিত? তোমার বাবা কেমন আছেন? অনেক দিন ঢাকায় আসতেসেন না।’
‘আব্বা তো অসুস্থ।’
‘কেন, কী হইসে?’
‘মেন্টাল প্রবলেম, ভাই।’
‘কী রকম?’
‘সে বিরাট হিস্ট্রি। আব্বা সারা জীবন একটা বইই পড়তেসেন। আদিপাপ। ১৫ বছর আগে বইটা বাইর হইসে, তখন থেকেই পড়তেসেন। বইয়ের ক্যারেক্টারগুলারে খুব পছন্দ করেন। মানুষ যেমন পোষা পশুপাখিরে পছন্দ করে, সেই রকম আদর করেন। বছর দেড়েক আগেও আব্বা ভালো ছিলেন। হঠাৎ একদিন কী হইল, নিজেরে আহাদ আলী পরিচয় দেওয়া শুরু করলেন। আহাদ আলী আদিপাপ-এর একটা ক্যারেক্টার আর কি। এর কিছুদিন পর থেকে তিনি একটা অদ্ভুত টানে কথা বলার ট্রাই দিতে থাকলেন। পরে বোঝা গেল, তিনি কুষ্টিয়ার ভাষায় কথা বলতে চাইতেসেন। কারণ, আহাদ আলীর বাড়ি কুষ্টিয়া। এইভাবে মাস ছয়েক চলল। তারপর আব্বা নতুন আরেক বায়না ধরলেন। তিনি আমাদের বাড়িটা ভাঙবেন। উপন্যাসে আহাদ আলীর বাড়ি যে রকম, তিনি তেমন বাড়ি বানাবেন। বাড়ির সামনে, আহাদ আলীর বাড়ির মতো পুকুর কাটবেন। আব্বারে অনেক চেষ্টা করেও আমরা আটকাইতে পারতেসিলাম না। সুযোগ পাইলেই তিনি শাবল দিয়া ঘরের দেয়াল, বারান্দার দেয়াল ভাঙা শুরু করলেন। তাঁরে ওষুধ দিয়া রাখা শুরু করলাম। তখন থেকে আব্বা বিছানায় পড়ে থাকেন। পরিচিত কাউরেই তিনি আর আসল নামে ডাকেন না। ডাকেন আদিপাপ-এর কোনো না-কোনো ক্যারেক্টারের নামে। আমার আম্মা নাই। আমারেও আব্বা এখন তাঁর ছেলে হিসেবে চেনেন না। চেনেন লিয়াকত নামে। যে লিয়াকত আদিপাপ-এ ওনারে, আই মিন, আহাদ আলীরে খুন করসে!’
‘তাইলে ছেলে হিসেবে কারে চেনে উনি?’
‘কী জানি? এই নিয়া তো কিসু বলেন না।’
রশিদুল হকের এই অবস্থার কথা শুনে বিচলিত হলাম। ভাবলাম, ঈদে বাড়ি গেলে নাগেশ্বরীতে ওনাকে দেখতে যাব। কিন্তু জায়েদ হকের উপন্যাসটা তো পড়ে দেখা দরকার।
বইটা জোগাড় করে পড়া শুরু করলাম। ২০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস। জায়েদ হকের ভাষা তেমন জটিল নয়। তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আহাদ আলী, যিনি গড়াই নদীর ধারে লিয়াকতের হাতে খুন হন। তবে খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। লিয়াকত নিজের ইচ্ছায় খুন করেছে, নাকি করেছে বাধ্য হয়ে, তা সহজে বোঝা যায় না। বইয়ের শুরুতেই কাহিনির শেষটা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর ঘুরে-ফিরে সে ঘটনা বারবার এসেছে সঙ্গে আরও আনুষঙ্গিক ঘটনা নিয়ে।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বইটার অর্ধেক শেষ করে ফেললাম আমি। তারপর হোঁচট খেতে হলো। একটা জায়গায় এসে খুনের কারণ কিছুটা আঁচ করা যায়। সেখানে জায়েদ হক লিখেছেন:
‘...সদর থানার পাশে বিষ্ণুবাবুর দোকানে চা খেতে খেতে আহাদ আলী দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলেন, অন্যান্য শুক্রবারেও যেমন তাঁর পড়া হয়। পত্রিকাটা ছিল এক সপ্তাহ আগের, বাসি। আহাদ আলী শেষের পাতায় “ছেলের হাতে বাবা খুন”-জাতীয় একটা খবরের ওপর খানিকটা চা ফেলে বসেন। বিষ্ণুবাবু সেটা দেখে ফেলল কি না, সেটা খেয়াল করতে করতে তিনি বেখেয়ালে পত্রিকাটার আরেকটা পাতায় চলে যান। যেখানে ছাপা হয়েছে একটা গল্প। গল্পের লেখকের নামে আহাদ আলীর চোখ আটকে যায়। আহাদ আলী পড়া শুরু করেন। এক অনুচ্ছেদ পড়েই তিনি নিশ্চিত হন লেখকের পরিচয়। এটা তার ভার্সিটি-পড়ুয়া ছেলে লিখেছে। গল্পে হুবহু আহাদ আলীদের গ্রামের বর্ণনা। মানুষজনও চেনাজানা। তিনি নিজেও একটা চরিত্র। কিন্তু একটা জায়গায় এসে আহাদ আলী দেখেন, গল্পে তিনি খুন হয়ে যাচ্ছেন।
‘সেই রাতে আহাদ আলীর ভালো ঘুম হয় না। মাঝরাতে একটা খাটাশ সম্ভবত মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা ভাঙতে চায়। সে আওয়াজে আহাদ আলীর ঘুম ভাঙে। তিনি দরজা খুলে ঘরের বাইরে আসেন। জোছনার আলো এসে তাঁর উঠানের মাটি চেটে খাচ্ছে। আহাদ আলী হাঁটা দেন। উঠান পার হন। সদরঘরের পাশ দিয়ে বাইরের বড় পুকুরটার পাশে এসে দাঁড়ান। পুকুরের পানিতেও জোছনা। আহাদ আলীর মনে পড়ে গল্পটা। গল্পটায় এমন জোছনা আছে। আহাদ আলী পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন। একটা সময় এসে পৌঁছান গড়াই নদীর ধারে, যেখানে তাঁকে পেয়ে যায় লিয়াকত। লিয়াকত হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে তাঁকে সালাম দেয়, স্লামালাইকুম আহাদচা। আহাদ আলী দেখেন, লিয়াকতের আরেক হাতে একটা থান ইট। তাঁর মনে হয়, লিয়াকত যেন তৈরি হয়েই ছিল। গল্পের শেষ দৃশ্য মনে পড়ে তাঁর। তিনি কেবল ভাবতে থাকেন, ছেলেটা কেন এ গল্প লিখল? কেন ছেলেটা তাঁকে খুন করতে চায়? তিনি লিয়াকতকে বোকার মতো জিজ্ঞাসা করেন, “ইসব কি কেচ্ছার ভিতরে, লিয়াকত?” লিয়াকত কথা ঘোরায়। “আপনার পুলা তার জন্ম মাইনে নিতে পাইরতিসে না, আহাদচা।” “ক্যান, লিয়াকত?” লিয়াকত একটু ইতস্তত করে। “তারপর বলে, তারে আপনি আনিছিলেন ক্যান? আনার আগে অনুমুতি নিছিলেন?”’
বইটা আর কিছুদূর পড়ার পর আমি আর পড়তে পারি না। আমার অস্বস্তি হয়। আহাদ আলী কিংবা রশিদুল হক খুন হয়ে যাচ্ছেন এ জন্য নয়; অস্বস্তির কারণ আহাদ আলীর ছেলের নাম। তাঁর ছেলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বেলাল আহমেদ। আমার কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করতে থাকে রশিদুল হকের কথাটা, ‘সাহিত্য করবা না, বুঝলা, বেলাল। সাহিত্য করবা না।’
রশিদুল হকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের এই ঘটনাটুকুই আমার মনে আছে। মাঝখানে অনেক দিন তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার প্রতি আমি আরও ঝুঁকেছি। কোনো এক শুক্রবার দৈনিক আশার কথার সাহিত্য পাতায় স্বনামধন্য এক লেখক প্রবন্ধ লিখলেন জায়েদ হকের উপন্যাস নিয়ে। সেখানে তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও জায়েদ হকের লেখার একটা তুলনামূলক আলোচনা করলেন। সেটা পড়ে জানতে পারলাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হককে টেক্কা দিতে পারেন—এমন একজন লেখকই আছেন; তিনি জায়েদ হক।
রংপুরে সাহিত্যের বই জোগাড় করা মুশকিল। তাই জায়েদ হকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে উঠল না। পুরো কলেজজীবনে রশিদুল হকেরও আর দেখা পেলাম না। কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রথম সেমিস্টার চলছে। শেরেবাংলা হলের দোতলায় থাকি। হলের নিচতলায় গেস্টরুম। রুমমেটদের প্রেমিকারা দেখা করতে এলে হলের দারোয়ান সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে ডাক পাড়েন। যেমন শিহাব স্যার, ৩১০। ৩১০ হলো রুম নম্বর।
হঠাৎ একদিন আমারও ডাক পড়ল। তানিম স্যার, ২০৩। আমি টেবিলে বসে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের প্রতিবেদন তৈরি করছিলাম। তানিম স্যার, ২০৩—এই ডাকে আমার রুমমেটরা বাঁকা হাসি হাসল। কৌতূহল নিয়ে নিচতলার গেস্টরুমে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম, তাতে একটু থতমত খেতে হলো। গেস্টরুমের একটা অন্ধকার কোণে, সোফায় রশিদুল হক বসে আছেন। তাঁর শরীরের একদিকে আলো, বাকি অর্ধেকটা ছায়ার মতো লাগছে।
বছর দুই পর রশিদুল হককে দেখছি। দেখতে অচেনা লাগছে। মুখের চামড়ায় ভাঁজ। কিন্তু চোখে-মুখে আগ্রহ ও কৌতূহলের পুরোনো ছায়া লেপটে আছে। আমাকে বলার সুযোগ না দিয়ে বলা শুরু করলেন, ‘ওই যে আমার ছেলেটা, অমিত, ডিএমসিতে চান্স পাইসে, ওকে ভর্তি করাইতে আসছিলাম। ভাবলাম, তোমাকে একটু দেখে যাই। তোমার এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে তোমার অ্যাড্রেসটা নিলাম।’
তাঁর সঙ্গে কী আলাপ পাড়া যায়, মাথায় আসছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখন কী করতেসেন?’
তিনি বললেন, ‘ওই কলেজেই পড়াই, নাগেশ্বরীর। আর বইটা পড়তেসি।’
‘কোন বইটা?’
‘ওই জায়েদ হকের। আদিপাপ। খুব ভালো বই।’
আমার মুখে প্রায় চলেই এসেছিল, একটা বই পড়তে আপনার এত দিন লাগে? চেপে গেলাম।
রশিদুল হক বললেন, ‘গড়াই নদীর পাড়ে আহাদ আলীর খুন হওয়ার ঘটনাটা পড়তেসি ভালো করে। খুন করার সময় লিয়াকত একটা ইট দিয়ে লোকটার মাথায় বাড়ি দেয়। তিনবার। কিন্তু তিনবার কেন? দুইবার দিলেই হইত। থান ইটের বাড়ি, দুইবারই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু লিয়াকত বাড়ি দিল তিনবার। ইদানীং এটাই ভাবি আর কি। লেখকও এটা নিয়া তেমন কিসু বলেন নাই।’
এরপর রশিদুল হক বললেন একটা অদ্ভুত কথা।
‘সাহিত্য পড়ো, সাহিত্য পড়া ভালো। কিন্তু সাহিত্য করতে যাইয়ো না।’
এই কথার মানে তখন বুঝলাম না। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম; অনেক দেরিতে যদিও।
রশিদুল হকের সঙ্গে আমার পাঁচ-ছয় মাস পরপর দেখা হতে থাকল। তিনি ছেলেকে দেখতে আসেন। ফাঁকে আমার হলেও আসেন। আমার খোঁজখবর নেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এখন কী করতেসেন?’ তিনি বলেন, ‘ওই যে জায়েদ হকের উপন্যাসটা, আদিপাপ। ভালো বই।’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। তারপর বলেন, ‘কমলা চরিত্রটা বোঝার চেষ্টা করতেসি। কিন্তু লেখক এই বিষয়টাও খোলাসা করেন নাই।’
কোনো একদিন দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে আহাদ আলীর পোষা মুরগির বর্ণনা দেন রশিদুল হক। আরেক দিন দেশের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে করতে ঢুকে পড়েন আদিপাপ-এর গ্রামের রাজনীতিতে। এভাবে চলতে থাকে। তিনি আসেন, ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো সময় নেন, তারপর চলে যান। আমি কোনো এক কারণে তাঁর সঙ্গে অভদ্রতা করে উঠতে পারি না। এ রকমই একটা দিন বিদায় নেওয়ার আগে তিনি আমাকে নিচু ঘড়ঘড়ে গলায় পরামর্শ দেন, ‘সাহিত্য করবা না, বুঝলা, বেলাল!’ তিনি চলে যাওয়ার পরও কথাটা আমার কানের মধ্যে বাজতে থাকে। রশিদুল হক কি আমাকে বেলাল নামে ডাকলেন? বেলাল কে?
এরপর হঠাৎ করে রশিদুল হক গায়েব হয়ে যান। আমিও যেন তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেয়ে হাঁপ ছাড়ি। দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতিতে আমি তাঁকে একরকম ভুলেই যাই। কিন্তু বছর খানেক পর রশিদুল হক আবার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠেন, যখন তাঁর ছেলে অমিতের সঙ্গে দুর্ঘটনাবশত আমার দেখা হয়ে যায়। আজিমপুর থেকে ৩৬ নম্বর বাসে করে মিরপুর যাচ্ছি। পাশের সিটে বসা ছেলেটার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তার পর জানতে পারলাম তার বাড়ি নাগেশ্বরী। বললাম, ‘নাগেশ্বরীর রশিদুল হক নামে একজনকে চিনতাম। নাগেশ্বরী কলেজের টিচার।’ ছেলেটা বলল, ‘উনি আমার বাবা।’
‘তুমি অমিত? তোমার বাবা কেমন আছেন? অনেক দিন ঢাকায় আসতেসেন না।’
‘আব্বা তো অসুস্থ।’
‘কেন, কী হইসে?’
‘মেন্টাল প্রবলেম, ভাই।’
‘কী রকম?’
‘সে বিরাট হিস্ট্রি। আব্বা সারা জীবন একটা বইই পড়তেসেন। আদিপাপ। ১৫ বছর আগে বইটা বাইর হইসে, তখন থেকেই পড়তেসেন। বইয়ের ক্যারেক্টারগুলারে খুব পছন্দ করেন। মানুষ যেমন পোষা পশুপাখিরে পছন্দ করে, সেই রকম আদর করেন। বছর দেড়েক আগেও আব্বা ভালো ছিলেন। হঠাৎ একদিন কী হইল, নিজেরে আহাদ আলী পরিচয় দেওয়া শুরু করলেন। আহাদ আলী আদিপাপ-এর একটা ক্যারেক্টার আর কি। এর কিছুদিন পর থেকে তিনি একটা অদ্ভুত টানে কথা বলার ট্রাই দিতে থাকলেন। পরে বোঝা গেল, তিনি কুষ্টিয়ার ভাষায় কথা বলতে চাইতেসেন। কারণ, আহাদ আলীর বাড়ি কুষ্টিয়া। এইভাবে মাস ছয়েক চলল। তারপর আব্বা নতুন আরেক বায়না ধরলেন। তিনি আমাদের বাড়িটা ভাঙবেন। উপন্যাসে আহাদ আলীর বাড়ি যে রকম, তিনি তেমন বাড়ি বানাবেন। বাড়ির সামনে, আহাদ আলীর বাড়ির মতো পুকুর কাটবেন। আব্বারে অনেক চেষ্টা করেও আমরা আটকাইতে পারতেসিলাম না। সুযোগ পাইলেই তিনি শাবল দিয়া ঘরের দেয়াল, বারান্দার দেয়াল ভাঙা শুরু করলেন। তাঁরে ওষুধ দিয়া রাখা শুরু করলাম। তখন থেকে আব্বা বিছানায় পড়ে থাকেন। পরিচিত কাউরেই তিনি আর আসল নামে ডাকেন না। ডাকেন আদিপাপ-এর কোনো না-কোনো ক্যারেক্টারের নামে। আমার আম্মা নাই। আমারেও আব্বা এখন তাঁর ছেলে হিসেবে চেনেন না। চেনেন লিয়াকত নামে। যে লিয়াকত আদিপাপ-এ ওনারে, আই মিন, আহাদ আলীরে খুন করসে!’
‘তাইলে ছেলে হিসেবে কারে চেনে উনি?’
‘কী জানি? এই নিয়া তো কিসু বলেন না।’
রশিদুল হকের এই অবস্থার কথা শুনে বিচলিত হলাম। ভাবলাম, ঈদে বাড়ি গেলে নাগেশ্বরীতে ওনাকে দেখতে যাব। কিন্তু জায়েদ হকের উপন্যাসটা তো পড়ে দেখা দরকার।
বইটা জোগাড় করে পড়া শুরু করলাম। ২০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস। জায়েদ হকের ভাষা তেমন জটিল নয়। তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আহাদ আলী, যিনি গড়াই নদীর ধারে লিয়াকতের হাতে খুন হন। তবে খুনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। লিয়াকত নিজের ইচ্ছায় খুন করেছে, নাকি করেছে বাধ্য হয়ে, তা সহজে বোঝা যায় না। বইয়ের শুরুতেই কাহিনির শেষটা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর ঘুরে-ফিরে সে ঘটনা বারবার এসেছে সঙ্গে আরও আনুষঙ্গিক ঘটনা নিয়ে।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে বইটার অর্ধেক শেষ করে ফেললাম আমি। তারপর হোঁচট খেতে হলো। একটা জায়গায় এসে খুনের কারণ কিছুটা আঁচ করা যায়। সেখানে জায়েদ হক লিখেছেন:
‘...সদর থানার পাশে বিষ্ণুবাবুর দোকানে চা খেতে খেতে আহাদ আলী দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলেন, অন্যান্য শুক্রবারেও যেমন তাঁর পড়া হয়। পত্রিকাটা ছিল এক সপ্তাহ আগের, বাসি। আহাদ আলী শেষের পাতায় “ছেলের হাতে বাবা খুন”-জাতীয় একটা খবরের ওপর খানিকটা চা ফেলে বসেন। বিষ্ণুবাবু সেটা দেখে ফেলল কি না, সেটা খেয়াল করতে করতে তিনি বেখেয়ালে পত্রিকাটার আরেকটা পাতায় চলে যান। যেখানে ছাপা হয়েছে একটা গল্প। গল্পের লেখকের নামে আহাদ আলীর চোখ আটকে যায়। আহাদ আলী পড়া শুরু করেন। এক অনুচ্ছেদ পড়েই তিনি নিশ্চিত হন লেখকের পরিচয়। এটা তার ভার্সিটি-পড়ুয়া ছেলে লিখেছে। গল্পে হুবহু আহাদ আলীদের গ্রামের বর্ণনা। মানুষজনও চেনাজানা। তিনি নিজেও একটা চরিত্র। কিন্তু একটা জায়গায় এসে আহাদ আলী দেখেন, গল্পে তিনি খুন হয়ে যাচ্ছেন।
‘সেই রাতে আহাদ আলীর ভালো ঘুম হয় না। মাঝরাতে একটা খাটাশ সম্ভবত মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা ভাঙতে চায়। সে আওয়াজে আহাদ আলীর ঘুম ভাঙে। তিনি দরজা খুলে ঘরের বাইরে আসেন। জোছনার আলো এসে তাঁর উঠানের মাটি চেটে খাচ্ছে। আহাদ আলী হাঁটা দেন। উঠান পার হন। সদরঘরের পাশ দিয়ে বাইরের বড় পুকুরটার পাশে এসে দাঁড়ান। পুকুরের পানিতেও জোছনা। আহাদ আলীর মনে পড়ে গল্পটা। গল্পটায় এমন জোছনা আছে। আহাদ আলী পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন। একটা সময় এসে পৌঁছান গড়াই নদীর ধারে, যেখানে তাঁকে পেয়ে যায় লিয়াকত। লিয়াকত হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে তাঁকে সালাম দেয়, স্লামালাইকুম আহাদচা। আহাদ আলী দেখেন, লিয়াকতের আরেক হাতে একটা থান ইট। তাঁর মনে হয়, লিয়াকত যেন তৈরি হয়েই ছিল। গল্পের শেষ দৃশ্য মনে পড়ে তাঁর। তিনি কেবল ভাবতে থাকেন, ছেলেটা কেন এ গল্প লিখল? কেন ছেলেটা তাঁকে খুন করতে চায়? তিনি লিয়াকতকে বোকার মতো জিজ্ঞাসা করেন, “ইসব কি কেচ্ছার ভিতরে, লিয়াকত?” লিয়াকত কথা ঘোরায়। “আপনার পুলা তার জন্ম মাইনে নিতে পাইরতিসে না, আহাদচা।” “ক্যান, লিয়াকত?” লিয়াকত একটু ইতস্তত করে। “তারপর বলে, তারে আপনি আনিছিলেন ক্যান? আনার আগে অনুমুতি নিছিলেন?”’
বইটা আর কিছুদূর পড়ার পর আমি আর পড়তে পারি না। আমার অস্বস্তি হয়। আহাদ আলী কিংবা রশিদুল হক খুন হয়ে যাচ্ছেন এ জন্য নয়; অস্বস্তির কারণ আহাদ আলীর ছেলের নাম। তাঁর ছেলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে বেলাল আহমেদ। আমার কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করতে থাকে রশিদুল হকের কথাটা, ‘সাহিত্য করবা না, বুঝলা, বেলাল। সাহিত্য করবা না।’
No comments