চারুশিল্প- সমুদ্র-শহরে আর্টক্যাম্প by আবুল হাসনাত

২৩ অক্টোবর মধ্যাহ্নে মিহিরলংকা এয়ারলাইনস কলম্বো বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শের কিছু আগেই জানালায় চোখ রেখে আমরা দেখলাম সবুজের বিপুল সমারোহ আর সমুদ্রের জলরাশি। বৃষ্টি পড়ছে। তবে একটানা নয়।


খানিক বাদেই আবার সূর্যের মুখ দেখা গেল। চোখ জুড়িয়ে গেল আমাদের। দলে ছিলাম আমরা ১৭ জন। ১২ জন চিত্রকরকে নিয়ে বিরাট একটি দল। এই ১২ জন শিল্পী হলেন: কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, নাজলী লায়লা মনসুর, ফরিদা জামান, রনজিৎ দাস, মোহাম্মদ ইউনুস, রোকেয়া সুলতানা, কনকচাঁপা চাকমা, মাকসুদা ইকবাল এবং বিশ্বজিৎ গোস্বামী।
কলম্বোর সমুদ্রসৈকত-সংলগ্ন হোটেল বীরজায়াতে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত চার দিনব্যাপী ‘বেঙ্গল-বিএটিবি আর্ট ক্যাম্প ২০১২’-এ অংশ নিতেই এ সফর।
ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত আর্ট ক্যাম্পে ১২ জন বিশিষ্ট শিল্পী ছবি আঁকবেন। জাতিসংঘ ২০১৩ সালে পানি সংরক্ষণ সম্পর্কে যে ঘোষণা দিয়েছে তাই ছবি আঁকার বিষয়বস্তু। কাজটি সহজ নয়। আমাদের অনেকের প্রিয় কবি পাবলো নেরুদা অল্প কিছুদিন ছিলেন চিলির বাণিজ্যদূত হয়ে এই কলম্বোয়। শ্রীলঙ্কার কালো এক মেয়ে তাঁর হূদয় হরণ করেছিল। তাঁর স্মৃতিকথায় এই কলম্বোকে নিয়ে কত না মনোগ্রাহী বর্ণনা আছে। বিমানে বসে সে কথা মনে পড়ছিল।
বিমানবন্দর থেকে মূল শহরের বেশ দূরত্ব। হোটেলে যাওয়ার পথে আমরা যানজট পেলাম। তবে পথে-পথে ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তি দেখা আমাদের জন্য হয়ে উঠেছিল বিরল অভিজ্ঞতা। যানজটের জন্য হোটেলে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছিল। সবাই খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। হোটেলে পৌঁছে সমুদ্রের কল্লোলধ্বনি শুনে আর জোয়ারের জলরাশির সৈকতে আছড়ে পড়া দেখে প্রাণমন জুড়িয়ে গেল। সমুদ্রের অতিসন্নিকটে উন্মুক্ত স্থানে নৈশ আহার ও মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডা হয়ে উঠল চিত্রকরদের সৃজনের জন্য আনন্দময় পটভূমি।
পরের দিন ২৪ অক্টোবর সকালে হোটেল বীরজায়ার হলরুমে উদ্বোধন হলো আর্ট ক্যাম্প। সকাল ১০টার মধ্যেই এ দেশের ১২ জন বিশিষ্ট শিল্পী প্রস্তুতি নিলেন রং, তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে।
শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ সুফিউর রহমান এলেন। অনাড়ম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাইয়ুম চৌধুরী ভাষণ দিলেন ও ইজেলে একটি মাছের ছবি এঁকে এই আর্ট ক্যাম্পের শুভ সূচনা করলেন। রফিকুন নবী আঁকলেন মাছ। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা ছোট ছোট ড্রয়িংয়ে ভরিয়ে দিলেন এই ক্যানভাস। সব মিলিয়ে এটা এক মনোজ্ঞ চিত্র হয়ে উঠল। বক্তব্য দিলেন শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান। কাইয়ুম চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বললেন, ভাবের আদান-প্রদান এবং শিল্পপ্রচেষ্টার নানা দিক নিয়ে আলোচনা হবে এই আর্ট ক্যাম্পে। সমুদ্রের সন্নিকটে ছবি আঁকা হয়ে উঠবে সবার জন্য প্রাণময়। বাংলাদেশের ছবি বিষয়-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। আমাদের ১২ জনের ছবিতে এই বৈচিত্র্য নানাভাবে তাৎপর্যময় হয়ে উঠবে।
বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের পরিচালক সুবীর চৌধুরী বললেন, সমুদ্রসৈকতের মনোরম পরিবেশে এই আর্ট ক্যাম্প শিল্পীদের মানসযাত্রায় নবীন মাত্রা সংযোজন করবে সন্দেহ নেই। আমরা অনেক আর্ট ক্যাম্পে অংশ নিয়েছি। কিন্তু সমুদ্রসৈকতে আর্ট ক্যাম্প এই প্রথম। প্রাকৃতিক এই পরিবেশ শিল্পীদের সৃজনকে করে তুলবে তাৎপর্যময়।
প্রথমদিকে ১২ জন শিল্পীই বিষয় বেঁধে দেওয়ায় তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে খুবই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন ছিলেন।
পানি সংরক্ষণ ভাবনাটি নানা দিক থেকে জটিল। এক-একজনের ভাবনায় বিষয়টি নানাভাবে আসবে। কীভাবে আসবে এবং কোন চিত্রকর কোন প্রেক্ষিতকে অগ্রাধিকার দেবেন এবং তাদের নির্মাণ ও সৃষ্টি কোন ধ্যানে পূর্ণতা পাবে—তা সবার জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। দেখা গেল, ২৪ তারিখ বিকেলেই সবার কাজ পূর্ণতা পেল। শিল্পিত এবং মনোগ্রাহী ভঙ্গিতে এক-একটি ছবি হয়ে উঠল বিষয়গুণে অনন্য। ভাবনা ও মনীষার সমন্বয়ে কত গভীর ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিটি চিত্র হয়ে উঠছিল কখনো আবেগধর্মী, কখনো অর্থময়। পানি সংরক্ষণ ধারণাটি ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা নিয়ে রূপায়িত হলো। কেউ মানবজীবনে পানির প্রয়োজন নিয়ে ছবি আঁকলেন। কেউ প্রাণিজগৎ নিয়ে ছবি আঁকলেন। কেউ আঁকলেন পাখির, কেউ জলাধারের, কেউ আঁকলেন বৃক্ষের। বাংলাদেশের গ্রামের মেয়েরা দৈনন্দিনতার প্রয়োজনে পানি নিয়ে আসে দূর থেকে। এই বিষয়ের ছবিও প্রাধান্য পেয়েছিল। আর পার্বত্য অঞ্চলে ঝরনাবাহিত জল দৈনন্দিনতার প্রয়োজনে কেমন করে সংরক্ষণ করা হয় তা পরস্ফুিট হয়ে উঠল একজনের ক্যানভাসে। কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাশেম খান, মাহমুদুল হক, রনজিৎ দাস, ফরিদা জামান, রোকেয়া সুলতানা, কনকচাঁপা চাকমা—এই শিল্পীরা তাঁদের স্বকীয় চিত্রভাষা, শৈলী অবলম্বন করে পানি সংরক্ষণভিত্তিক ছবি আঁকলেন। তাঁদের সৃষ্টিতে নানা ভাবনা ও দৃষ্টিকোণের প্রতিফলন ঘটেছিল। পানি মানব ও জগতের সব প্রাণীর জন্য কতভাবে প্রাণদায়ী, চিত্রপটে সে কথা বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।
চার দিনের আর্ট ক্যাম্পে বিমূর্ত, আধা বিমূর্ত এবং বাস্তবধারার ছবিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। শিল্পীরা যে কত অনুভূতিপ্রবণ, সংবেদনশীল ও বৈচিত্র্যসন্ধানী এই চিত্রগুচ্ছে তা ধরা পড়েছে।
২৭ ও ২৮ তারিখ কলম্বো শহরের দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন হয়ে উঠেছিল শিল্পীদের জন্য বিরল অভিজ্ঞতা। শহরটি ছিমছাম ও সমুদ্রঘেরা, খুবই পরিচ্ছন্ন। পুরোনো ও নতুন কলম্বোয় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। ব্রিটিশ, ডাচ ও পর্তুগিজ স্থাপত্যশৈলী এখনো বিদ্যমান।
২৮ অক্টোবর কলম্বোর জাতীয় চিত্রশালা এবং সাপুমল ফাউন্ডেশন গ্যালারিতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিল এই শিল্পীর দল।
বিগত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে যে আধুনিক শিল্প-আন্দোলন শ্রীলঙ্কাকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করছে তা এই দুটি গ্যালারিতে দেখা দলটির অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করেছে। শ্রীলঙ্কার চিত্র আন্দোলন নানা দিক থেকে খুবই তাৎপর্য। দুটি গ্যালারির বহুমাত্রিক কাজে পরস্ফুিট হয়ে উঠেছে আধুনিক শ্রীলঙ্কার চিত্র আন্দোলনের নানা দিক। একদিকে ঐতিহ্যিক প্রবাহের ছাপ, অন্যদিকে আধুনিক পথনির্মাণের প্রয়াস। আমরা উইলিয়াম আর্চারের একটি গ্রন্থে জর্জ কিটের কিছু ছবির মৌলিক প্রতিলিপি দেখেছিলাম। আর্চার ভারত ও আধুনিক শিল্প গ্রন্থে জর্জ কিটকে, তাঁর ছবিকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন। জর্জ কিট শ্রীলঙ্কার আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের পথিকৃৎ। গ্যালারিতে তাঁর ২০টি মৌলিক ছবি ছিল। তিনি যে সত্যিকার অর্থেই একজন শক্তিমান শিল্পী এবং ভারতীয় ঐতিহ্য ও ইউরোপীয় পরিমণ্ডলে তাঁর কত সহজ বিচরণ ও পরিগ্রহণ ছিল তা খুব সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছিল। যামিনী রায়ের সমসাময়িক জর্জ কিটও একসময় বাংলার পটচিত্রে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আবার পরিণতকালে পিকাসো ও ব্রাক দ্বারাও আলোড়িত হয়েছিলেন। এই মৌলিক ছবিগুলোতে তার ছাপ ছিল। এ দেখা আমাদের সবার শিল্পরুচিকে সমৃদ্ধ করেছে।
সাপুমল গ্যালারির সংগ্রহে রয়েছে ৩০০ ছবি ও ড্রয়িং। এ গ্যালারিতে যামিনী রায়ের ১২টি মৌলিক ছবি রয়েছে। নন্দলাল বসুরও ছবি রয়েছে। এই কাজগুলো দেখা ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। তেমনি অবাক হয়েছি এই গ্যালারির রক্ষণাবেক্ষণ দেখে। বিরল লতানো বৃক্ষশোভিত এই গ্যালারিটি শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের এক সুখকর অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে এ গ্যালারিটি স্থাপিত হয়।
চার দিনের আর্ট ক্যাম্প ও দুই দিনের কলম্বো-ভ্রমণে সমুদ্র ও নিসর্গ একাকার হয়ে এক সুখস্মৃতি বহন করছে ১৭ জন মানুষের মনে।

No comments

Powered by Blogger.