ভ্রমণ- ভ্যাটিকানের ভেনাস by লতিফুল ইসলাম
ভ্যাটিকান হচ্ছে দেশের ভেতরে দেশ, নগরের ভেতরে স্বাধীন নগররাষ্ট্র। এর রয়েছে নিজস্ব ডাকটিকিট, রেলস্টেশন, রোমান অবজারভার নামে নিজস্ব দৈনিক পত্রিকা, আছে দৃষ্টিনন্দন পুলিশ বাহিনী, ১৬ শতাব্দী থেকে একই পোশাকে
পাহারা দিচ্ছে যারা; এটা ধারণা করা হয় যে ভ্যাটিকান পুলিশের এই পোশাক ডিজাইন করেছিলেন শিল্পী মিকেলাঞ্জেলো। পুরো শহরটাই যেন একটা জাদুঘর, প্রতিটি ইঞ্চিতে ফিসফিস করে কথা বলছে ইতিহাস। পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শিহরিত হয়ে ওঠে শরীর, এ পথেই হেঁটেছেন রাফায়েল, বতিচেল্লি, মিকেলাঞ্জেলো, বেরনিনি, ব্রুমান্তেসহ কত কত শিল্পী ভাস্কর স্থপতি।
ভিয়া দেল্লা কনসিলিয়াজোনের বারান্দায় মাথার ক্যাপ ফেলে বসে আছে নিঃসঙ্গ এক বেহালাবাদক, পকেট থেকে মুঠোভরে খুচরো পয়সাগুলো ঝনঝন করে ফেললাম ওর ক্যাপের মধ্যে, আমার গায়ের রং আর পয়সার পরিমাণ ওকে ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিলেও মুহূর্তেই ওর মুখে ফুটে উঠল তুসকান শিল্পীর হাসি, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তার পরই প্রায় নির্জন রোমান পিয়াৎজাকে শোকাতুর করে বেজে উঠল ওর বেহালা। সেই সুরে মনুমেন্ট ‘ভ্যাটিকান অবিলিস্কে’র সকরুণ ছায়া দীর্ঘ হতে হতে যেন ভেদ করে গেল আমার হূৎপিণ্ড। এখন বুঝি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বেহালার সুরটি আসলে শোনা হয়ে গেছে সেদিন। সেই সুরে যে বেদনার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল বাদকের চোখে-মুখে, সেই বেদনা আর হাহাকারে আমিও পুড়েছি সেদিন।
ভ্যাটিকানের অলি-গলিতে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঢুকি সাধু পিটারের ব্যাসিলিকার ভেতরে। চোখ ধাঁধানো শিল্প সৌন্দর্যের মধ্যে ঢুকে আমার প্রথমেই একধরনের অসহায় অনুভূতি হলো। মেঝে থেকে সুউচ্চ ছাদ পর্যন্ত নান্দনিক ঐশ্বর্যের বিশালত্বের ধাক্কা সামলাতে আমার সময় লাগল খানিকটা। রেনেসাঁর উঁচুদরের সব শিল্পীদের জীবন উজাড় করে আঁকা শিল্পকর্ম সেইন্ট পিটার ব্যাসেলিকাকে দিয়েছে একধরনের রহস্যময় সৌন্দর্য। চরম পারলৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শিল্পের মিশেলে যেন সৃষ্টি হয়েছে অপার্থিব এক গাম্ভীর্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর সুন্দর এই চার্চের প্রধান স্থপতি হলেন বিশ্ববিখ্যাত ব্রুমান্তে, মিকেলাঞ্জেলো, কার্লো মার্দিনো, বেরনিনি, জিওভান্নি পাওলো পান্নিনি এবং আরও অনেকে। বেরনিনির গড়া অসাধারণ বেদি ‘বলডাচিন’-এর সামনে সমবেত প্রার্থনা চলছে। এটা ব্যাসেলিকার মূল কেন্দ্র। চতুর্দিকে মহিমান্বিত সব শিল্পকর্মের মধ্যে একধরনের স্নায়বিক চাপ অনুভব করছিলাম, তাই সারি সারি পেতে রাখা আসনের একটিতে বসে বসে শুনছি বাইবেল থেকে উচ্চারিত সুরেলা শ্লোক। বাইবেল পাঠ শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হলো, সাদা কাগজের মতো পাতলা গোল বাতাসা যেন। আমি হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে বোঝার চেষ্টা করি এটা কী দিয়ে তৈরি হতে পারে। হঠাৎ পেছন থেকে তখুনি একটা নারীকণ্ঠ ইংরেজিতে আমেরিকান উচ্চারণে বলে ওঠে, ‘মনে মনে একটা চমৎকার উইশ করে এটা খেয়ে ফেলো।’
মাথা ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, আমার মুখের কাছে ঠিক এক হাতের দূরত্বে সবুজ চোখের দেবী ভেনাস যেন মিটমিট করে হাসছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘এই রোমান সাম্রাজ্যে তোমার সঙ্গ ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কোনো উইশ নেই’ বলে সাদা বাতাসাটা পুরে দিলাম মুখে। হতাশ হলাম এটার স্বাদে, কোনো স্বাদ নেই।
দেবী ভেনাসের মুচকি হাসি এবার আলো ছড়াল ‘কী আশ্চর্য! গড তোমার দোয়া কবুল করেছেন, তবে একটা শর্ত।’
আমি চেহারাটা কপট মলিন করে বললাম, ‘কী শর্ত?’
‘আমার ক্যামেরা দিয়ে তুমি আমার ছবি তুলবে আর তোমার ক্যামেরা দিয়ে আমি তোমার ছবি তুলব, রাজি?’
চেহারা সিরিয়াস করে বললাম, ‘আমি পুরো রোম সাম্রাজ্যই তোমাকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিতে পারি, ছবি তুলে দেওয়া আর এমন কি?’ চুড়ির আওয়াজের মতো রিমঝিম করে হেসে উঠল ভেনাস। বলল, ‘ঠিক আছে চলো শুরু করি।’ বুঝলাম, ছবি তোলার জন্য ওর একজন সঙ্গী দরকার ছিল।
ভেনাস যেতে যেতে বলল, ‘চলো পিয়েতা থেকে শুরু করি, আর শোনো তুমি কিন্তু অনেক ভাগ্যবান, ভ্যাটিকানের ভেতরে গাইড হিসেবে পেয়ে গেলে চারুকলার এক ছাত্রীকে।’
আমরা এসে দাঁড়ালাম মিকেলাঞ্জেলোর মহান সৃষ্টি পিয়েতার সামনে। কারারার মার্বেল পাথরকে হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে এমন জীবন্ত করা সম্ভব! সম্ভবত এর আগে কখনো পৃথিবী মানুষ, মানুষের সৃষ্টিশীলতার ক্ষমতা কোনো চরমে পৌঁছাতে পারে তার এমন নজির আর দেখেনি।
পিয়েতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি বাকরুদ্ধ। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার পাশে দাঁড়ানো ধ্যানমগ্ন ভেনাসের চোখে পানি। এ কান্না মুগ্ধতার। চোখ মুছে আমার গায়ে গা লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘জানো মিকেলাঞ্জেলো কত বছর বয়সে পিয়েতাকে গড়েছে? মাত্র ২৩ বছর বয়স ছিল তখন ওর। ভাবতে পারো, এটা মাত্র ২৩ বছর বয়সী কোনো যুবকের কাজ’, বলতে বলতে আবেগে আবার রুদ্ধ হলো ভেনাসের কণ্ঠ। আমি একধরনের ঈর্ষা নিয়ে মনে মনে ভাবছি, এত শত বছর পরও এক সুন্দরী তরুণীকে যে পাগল করে রেখেছে তার সময়ের রোমান সুন্দরীদের তখন কী অবস্থা হয়েছিল কে জানে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলা শুরু করল, ‘শোন একদিন হয়েছে কি! একদল দর্শক পিয়েতার সামনে দাঁড়িয়ে খুব প্রশংসা করছিল মিলানের শিল্পী ক্রিস্টোফারো সোলারির। মিকেলাঞ্জেলো কাছেই ছিল, নিজের সৃষ্টিকর্মের প্রশংসা পাচ্ছে অন্য শিল্পী। মন খারাপ হয়ে গেল তার। সেই রাতেই গোপনে চ্যাপেলে গিয়ে মোমবাতির আলোয় নিজের নামটা খোদাই করে দিলেন পিয়েতার ওপর। মিকেলাঞ্জেলোর এটাই একমাত্র সৃষ্টি যেখানে রয়েছে ওর স্বাক্ষর।’
আমি বললাম, ‘চলো দেখি কোথায় আছে নামটা।’
বেশি সময় লাগল না, দেখলাম কুমারী মেরির বুকের ওপর চাদরের ভাঁজে রোমান হরফে লেখা মিকেলাঞ্জেলোর নাম। ইউরোপীয় চিত্রকলার ইতিহাস আর রেনেসাঁর ওপর ভেনাসের পাণ্ডিত্য আমার মুগ্ধতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। খুব মনোযোগী ছাত্রের ভান ধরে শুনে যাচ্ছি ওর কথা। আমেরিকা থেকে এই প্রথম এসেছে রোমে, একা। অথচ মনে হচ্ছে ভ্যাটিকেনের প্রতিটি ইঞ্চি ও নিজের হাতের তালুর মতোই চেনে। প্রজাপতিরা যেভাবে এক ফুল থেকে উড়ে উড়ে অন্য ফুলে যায়, ভেনাস ঠিক তেমনি এক একটি কোণে ছুটে ছুটে ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকলার জানা-অজানা ইতিহাস গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। যেন কোনো এক মিকেলাঞ্জেলো বিশেষজ্ঞ। মিকেলাঞ্জেলোর ভাঙা নাকের গল্প, কীভাবে সহপাঠী টারিজিয়ানোর হাতে মার খেয়ে নাকটা সারা জীবনের জন্য বিকৃত হয়ে গিয়েছিল সেই ঘটনাও এমনভাবে বর্ণনা করল যেন ঘটনাটা তার নিজ চক্ষে দেখা। ‘একটা শিল্প জালিয়াতির মধ্য দিয়েই প্রথম মিকেলাঞ্জেলো লাইম লাইটে আসে, এটা জানো?’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাই নাকি! ‘বলো কী?’
‘হ্যাঁ, ফ্লোরেন্সের মেদিচিদের পরিবারেই ওর বেড়ে ওঠা, সেই পরিবারের দুই ভাই হলেন লরেঞ্জো আর গিওভান্নি। তারা তাকে বুদ্ধি দিল ঘুমন্ত কিউপিডের মূর্তি কিছুদিন মাটির নিচে পুঁতে রাখার জন্য। এতে রং বদলে গিয়ে ওটা অ্যান্টিকের রূপ নেবে, তখন চড়া দামে বেচা যাবে। মিকেলাঞ্জেলো পরামর্শমতো তাই করল, পরে লরেঞ্জো সেটা রোমের এক অ্যান্টিক ডিলারের কাছে বেচে দিল। পরে ডিলার সেটা বিক্রি করল রোমের কার্ডিনাল রিয়ারিওকে। কিন্তু কার্ডিনাল জালিয়াতিটা ধরে ফেলে টাকা ফেরত চাইল। পাশাপাশি খোঁজ লাগাল কে এই পাকা হাতের শিল্পী, লোক পাঠানো হলো ফ্লোরেন্সে। খুঁজে বের করা হলো মিকেলাঞ্জেলোকে। এই ঘটনা দিয়েই মিকেলাঞ্জেলোর রোমে আসা। এবং ভ্যাটিকানের কার্ডিনালের নজরে আসা। কার্ডিনালের অনুরোধ সেন্ট পিটার্স চ্যাপেলের জন্য একটা মূর্তি তৈরি করে দিতে হবে। আর সেটাই ছিল পিয়েতা।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘ইতিহাস বলে রাফায়েল আর মিকেলাঞ্জেলোর সম্পর্কটা নাকি সাপে নেউলের?’
‘হ্যাঁ, এটা ঠিক, অসাধারণ প্রতিভাবান বিখ্যাত স্থপতি ব্রুমান্তে ছিল রাফায়েলের চাচা, ব্রুমান্তের সঙ্গে পোপ এবং উচ্চপদস্থদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে ব্রুমান্তে চাইতেন ভালো ভালো কাজ মিকেলাঞ্জেলোর ওপর টেক্কা মেরে ভাইপো রাফায়েলকে পাইয়ে দিতে। রাফায়েল নিজেও তখন স্বীকৃত বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে একজন। আর রাফায়েলেরও ছিল নকল করার অসাধারণ গুণ। তিনি যা দেখতেন তা-ই নিখুঁতভাবে বানিয়ে ফেলতে পারতেন। ফলে মিকেলাঞ্জেলো তাঁর কাজের ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দিতেন না, ঘেরাটোপের মধ্যে কাজ করতেন।’
কথা বলতে বলতে আর ছবি তুলতে তুলতে আমরা পৌঁছে গেছি সিসটিন চ্যাপেলের কাছাকাছি। আমরা দুজনই চরম উত্তেজিত। একটা বিশাল ব্যালকনির পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল অদূরের টাইবার নদীর প্রেক্ষাপটে প্রাচীন রোমান নগরের অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। ভেনাসকে বললাম, ‘আসো, ওই ল্যান্ডস্কেপকে পেছনে রেখে তোমার একটা ছবি তুলে দিই, এই ছবিটাই হবে লার্জার দেন লাইফ। এই ছবিটার মধ্য দিয়েই তুমি আমাকে স্মরণ করবে।’ ভেনাস সত্যি সত্যি ভেনাসের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেল। আমি ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে এই প্রথম ভেনাসকে দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখলাম, হায়, আজ আমি যদি ছবি আঁকতে পারতাম। সবুজ চোখের এই অসাধারণ সুন্দরীকে আমি কোথায় তুলে রাখি, কবিতায়, ক্যানভাসে, পাথরে খোদাই করে নাকি দেয়ালের ফ্রেসকোতে।
আমরা সিসটিন চ্যাপেলের ভেতর ঢুকে আলাদা হয়ে গেলাম। আমার সামনে লাস্ট জাজমেন্ট আর মাথার ওপর ওল্ড টেস্টামেন্টের বিশ্বসৃষ্টির রহস্য। আমার মাথায় ঢোকে না এত সুউচ্চ সিলিংয়ের গায়ে কীভাবে সম্ভব হলো ছবি আঁকা। ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারই তো ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস মিকেলাঞ্জেলো একটা উঁচু মঞ্চের ওপর শুয়ে শুয়ে করেছেন এই কাজ। ঠিকমতো খাওয়া হয়নি, মাসের পর মাস বদলাননি শরীরের পোশাক। অল্প পরিসর, তাই দৃষ্টি সব সময়ই প্রায় নাকের ডগায় আটকানো, আলোর স্বল্পতা তো আছেই, তার চোখ প্রায় অন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সিলিংয়ে লাগানো রং চুইয়ে চুইয়ে ঝরেছে নাকে মুখে গায়ে, কোনো সাহায্যকারী নেই। কারণ তিনি নিজেই তা চাননি। তিনি কাজ করতে ভালোবাসতেন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আর নিভৃতে। কঠিন নির্জন নিঃসঙ্গ চ্যাপেলের মধ্যে ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের দুঃসাহসী আর দুঃসাধ্য শিল্পযজ্ঞ। এই সময়গুলোতে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। মিকেলাঞ্জেলোর কবিতা, সে আর এক ইতিহাস।
ভিয়া দেল্লা কনসিলিয়াজোনের বারান্দায় মাথার ক্যাপ ফেলে বসে আছে নিঃসঙ্গ এক বেহালাবাদক, পকেট থেকে মুঠোভরে খুচরো পয়সাগুলো ঝনঝন করে ফেললাম ওর ক্যাপের মধ্যে, আমার গায়ের রং আর পয়সার পরিমাণ ওকে ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিলেও মুহূর্তেই ওর মুখে ফুটে উঠল তুসকান শিল্পীর হাসি, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তার পরই প্রায় নির্জন রোমান পিয়াৎজাকে শোকাতুর করে বেজে উঠল ওর বেহালা। সেই সুরে মনুমেন্ট ‘ভ্যাটিকান অবিলিস্কে’র সকরুণ ছায়া দীর্ঘ হতে হতে যেন ভেদ করে গেল আমার হূৎপিণ্ড। এখন বুঝি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বেহালার সুরটি আসলে শোনা হয়ে গেছে সেদিন। সেই সুরে যে বেদনার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল বাদকের চোখে-মুখে, সেই বেদনা আর হাহাকারে আমিও পুড়েছি সেদিন।
ভ্যাটিকানের অলি-গলিতে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঢুকি সাধু পিটারের ব্যাসিলিকার ভেতরে। চোখ ধাঁধানো শিল্প সৌন্দর্যের মধ্যে ঢুকে আমার প্রথমেই একধরনের অসহায় অনুভূতি হলো। মেঝে থেকে সুউচ্চ ছাদ পর্যন্ত নান্দনিক ঐশ্বর্যের বিশালত্বের ধাক্কা সামলাতে আমার সময় লাগল খানিকটা। রেনেসাঁর উঁচুদরের সব শিল্পীদের জীবন উজাড় করে আঁকা শিল্পকর্ম সেইন্ট পিটার ব্যাসেলিকাকে দিয়েছে একধরনের রহস্যময় সৌন্দর্য। চরম পারলৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শিল্পের মিশেলে যেন সৃষ্টি হয়েছে অপার্থিব এক গাম্ভীর্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর সুন্দর এই চার্চের প্রধান স্থপতি হলেন বিশ্ববিখ্যাত ব্রুমান্তে, মিকেলাঞ্জেলো, কার্লো মার্দিনো, বেরনিনি, জিওভান্নি পাওলো পান্নিনি এবং আরও অনেকে। বেরনিনির গড়া অসাধারণ বেদি ‘বলডাচিন’-এর সামনে সমবেত প্রার্থনা চলছে। এটা ব্যাসেলিকার মূল কেন্দ্র। চতুর্দিকে মহিমান্বিত সব শিল্পকর্মের মধ্যে একধরনের স্নায়বিক চাপ অনুভব করছিলাম, তাই সারি সারি পেতে রাখা আসনের একটিতে বসে বসে শুনছি বাইবেল থেকে উচ্চারিত সুরেলা শ্লোক। বাইবেল পাঠ শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হলো, সাদা কাগজের মতো পাতলা গোল বাতাসা যেন। আমি হাতের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে বোঝার চেষ্টা করি এটা কী দিয়ে তৈরি হতে পারে। হঠাৎ পেছন থেকে তখুনি একটা নারীকণ্ঠ ইংরেজিতে আমেরিকান উচ্চারণে বলে ওঠে, ‘মনে মনে একটা চমৎকার উইশ করে এটা খেয়ে ফেলো।’
মাথা ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, আমার মুখের কাছে ঠিক এক হাতের দূরত্বে সবুজ চোখের দেবী ভেনাস যেন মিটমিট করে হাসছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘এই রোমান সাম্রাজ্যে তোমার সঙ্গ ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কোনো উইশ নেই’ বলে সাদা বাতাসাটা পুরে দিলাম মুখে। হতাশ হলাম এটার স্বাদে, কোনো স্বাদ নেই।
দেবী ভেনাসের মুচকি হাসি এবার আলো ছড়াল ‘কী আশ্চর্য! গড তোমার দোয়া কবুল করেছেন, তবে একটা শর্ত।’
আমি চেহারাটা কপট মলিন করে বললাম, ‘কী শর্ত?’
‘আমার ক্যামেরা দিয়ে তুমি আমার ছবি তুলবে আর তোমার ক্যামেরা দিয়ে আমি তোমার ছবি তুলব, রাজি?’
চেহারা সিরিয়াস করে বললাম, ‘আমি পুরো রোম সাম্রাজ্যই তোমাকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিতে পারি, ছবি তুলে দেওয়া আর এমন কি?’ চুড়ির আওয়াজের মতো রিমঝিম করে হেসে উঠল ভেনাস। বলল, ‘ঠিক আছে চলো শুরু করি।’ বুঝলাম, ছবি তোলার জন্য ওর একজন সঙ্গী দরকার ছিল।
ভেনাস যেতে যেতে বলল, ‘চলো পিয়েতা থেকে শুরু করি, আর শোনো তুমি কিন্তু অনেক ভাগ্যবান, ভ্যাটিকানের ভেতরে গাইড হিসেবে পেয়ে গেলে চারুকলার এক ছাত্রীকে।’
আমরা এসে দাঁড়ালাম মিকেলাঞ্জেলোর মহান সৃষ্টি পিয়েতার সামনে। কারারার মার্বেল পাথরকে হাতুড়ি-ছেনি দিয়ে এমন জীবন্ত করা সম্ভব! সম্ভবত এর আগে কখনো পৃথিবী মানুষ, মানুষের সৃষ্টিশীলতার ক্ষমতা কোনো চরমে পৌঁছাতে পারে তার এমন নজির আর দেখেনি।
পিয়েতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি বাকরুদ্ধ। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার পাশে দাঁড়ানো ধ্যানমগ্ন ভেনাসের চোখে পানি। এ কান্না মুগ্ধতার। চোখ মুছে আমার গায়ে গা লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘জানো মিকেলাঞ্জেলো কত বছর বয়সে পিয়েতাকে গড়েছে? মাত্র ২৩ বছর বয়স ছিল তখন ওর। ভাবতে পারো, এটা মাত্র ২৩ বছর বয়সী কোনো যুবকের কাজ’, বলতে বলতে আবেগে আবার রুদ্ধ হলো ভেনাসের কণ্ঠ। আমি একধরনের ঈর্ষা নিয়ে মনে মনে ভাবছি, এত শত বছর পরও এক সুন্দরী তরুণীকে যে পাগল করে রেখেছে তার সময়ের রোমান সুন্দরীদের তখন কী অবস্থা হয়েছিল কে জানে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বলা শুরু করল, ‘শোন একদিন হয়েছে কি! একদল দর্শক পিয়েতার সামনে দাঁড়িয়ে খুব প্রশংসা করছিল মিলানের শিল্পী ক্রিস্টোফারো সোলারির। মিকেলাঞ্জেলো কাছেই ছিল, নিজের সৃষ্টিকর্মের প্রশংসা পাচ্ছে অন্য শিল্পী। মন খারাপ হয়ে গেল তার। সেই রাতেই গোপনে চ্যাপেলে গিয়ে মোমবাতির আলোয় নিজের নামটা খোদাই করে দিলেন পিয়েতার ওপর। মিকেলাঞ্জেলোর এটাই একমাত্র সৃষ্টি যেখানে রয়েছে ওর স্বাক্ষর।’
আমি বললাম, ‘চলো দেখি কোথায় আছে নামটা।’
বেশি সময় লাগল না, দেখলাম কুমারী মেরির বুকের ওপর চাদরের ভাঁজে রোমান হরফে লেখা মিকেলাঞ্জেলোর নাম। ইউরোপীয় চিত্রকলার ইতিহাস আর রেনেসাঁর ওপর ভেনাসের পাণ্ডিত্য আমার মুগ্ধতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। খুব মনোযোগী ছাত্রের ভান ধরে শুনে যাচ্ছি ওর কথা। আমেরিকা থেকে এই প্রথম এসেছে রোমে, একা। অথচ মনে হচ্ছে ভ্যাটিকেনের প্রতিটি ইঞ্চি ও নিজের হাতের তালুর মতোই চেনে। প্রজাপতিরা যেভাবে এক ফুল থেকে উড়ে উড়ে অন্য ফুলে যায়, ভেনাস ঠিক তেমনি এক একটি কোণে ছুটে ছুটে ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকলার জানা-অজানা ইতিহাস গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। যেন কোনো এক মিকেলাঞ্জেলো বিশেষজ্ঞ। মিকেলাঞ্জেলোর ভাঙা নাকের গল্প, কীভাবে সহপাঠী টারিজিয়ানোর হাতে মার খেয়ে নাকটা সারা জীবনের জন্য বিকৃত হয়ে গিয়েছিল সেই ঘটনাও এমনভাবে বর্ণনা করল যেন ঘটনাটা তার নিজ চক্ষে দেখা। ‘একটা শিল্প জালিয়াতির মধ্য দিয়েই প্রথম মিকেলাঞ্জেলো লাইম লাইটে আসে, এটা জানো?’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাই নাকি! ‘বলো কী?’
‘হ্যাঁ, ফ্লোরেন্সের মেদিচিদের পরিবারেই ওর বেড়ে ওঠা, সেই পরিবারের দুই ভাই হলেন লরেঞ্জো আর গিওভান্নি। তারা তাকে বুদ্ধি দিল ঘুমন্ত কিউপিডের মূর্তি কিছুদিন মাটির নিচে পুঁতে রাখার জন্য। এতে রং বদলে গিয়ে ওটা অ্যান্টিকের রূপ নেবে, তখন চড়া দামে বেচা যাবে। মিকেলাঞ্জেলো পরামর্শমতো তাই করল, পরে লরেঞ্জো সেটা রোমের এক অ্যান্টিক ডিলারের কাছে বেচে দিল। পরে ডিলার সেটা বিক্রি করল রোমের কার্ডিনাল রিয়ারিওকে। কিন্তু কার্ডিনাল জালিয়াতিটা ধরে ফেলে টাকা ফেরত চাইল। পাশাপাশি খোঁজ লাগাল কে এই পাকা হাতের শিল্পী, লোক পাঠানো হলো ফ্লোরেন্সে। খুঁজে বের করা হলো মিকেলাঞ্জেলোকে। এই ঘটনা দিয়েই মিকেলাঞ্জেলোর রোমে আসা। এবং ভ্যাটিকানের কার্ডিনালের নজরে আসা। কার্ডিনালের অনুরোধ সেন্ট পিটার্স চ্যাপেলের জন্য একটা মূর্তি তৈরি করে দিতে হবে। আর সেটাই ছিল পিয়েতা।’ আমি জানতে চাইলাম, ‘ইতিহাস বলে রাফায়েল আর মিকেলাঞ্জেলোর সম্পর্কটা নাকি সাপে নেউলের?’
‘হ্যাঁ, এটা ঠিক, অসাধারণ প্রতিভাবান বিখ্যাত স্থপতি ব্রুমান্তে ছিল রাফায়েলের চাচা, ব্রুমান্তের সঙ্গে পোপ এবং উচ্চপদস্থদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে ব্রুমান্তে চাইতেন ভালো ভালো কাজ মিকেলাঞ্জেলোর ওপর টেক্কা মেরে ভাইপো রাফায়েলকে পাইয়ে দিতে। রাফায়েল নিজেও তখন স্বীকৃত বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে একজন। আর রাফায়েলেরও ছিল নকল করার অসাধারণ গুণ। তিনি যা দেখতেন তা-ই নিখুঁতভাবে বানিয়ে ফেলতে পারতেন। ফলে মিকেলাঞ্জেলো তাঁর কাজের ত্রিসীমানায় কাউকে ঘেঁষতে দিতেন না, ঘেরাটোপের মধ্যে কাজ করতেন।’
কথা বলতে বলতে আর ছবি তুলতে তুলতে আমরা পৌঁছে গেছি সিসটিন চ্যাপেলের কাছাকাছি। আমরা দুজনই চরম উত্তেজিত। একটা বিশাল ব্যালকনির পাশে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল অদূরের টাইবার নদীর প্রেক্ষাপটে প্রাচীন রোমান নগরের অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। ভেনাসকে বললাম, ‘আসো, ওই ল্যান্ডস্কেপকে পেছনে রেখে তোমার একটা ছবি তুলে দিই, এই ছবিটাই হবে লার্জার দেন লাইফ। এই ছবিটার মধ্য দিয়েই তুমি আমাকে স্মরণ করবে।’ ভেনাস সত্যি সত্যি ভেনাসের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেল। আমি ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে এই প্রথম ভেনাসকে দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখলাম, হায়, আজ আমি যদি ছবি আঁকতে পারতাম। সবুজ চোখের এই অসাধারণ সুন্দরীকে আমি কোথায় তুলে রাখি, কবিতায়, ক্যানভাসে, পাথরে খোদাই করে নাকি দেয়ালের ফ্রেসকোতে।
আমরা সিসটিন চ্যাপেলের ভেতর ঢুকে আলাদা হয়ে গেলাম। আমার সামনে লাস্ট জাজমেন্ট আর মাথার ওপর ওল্ড টেস্টামেন্টের বিশ্বসৃষ্টির রহস্য। আমার মাথায় ঢোকে না এত সুউচ্চ সিলিংয়ের গায়ে কীভাবে সম্ভব হলো ছবি আঁকা। ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারই তো ঘাড় ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস মিকেলাঞ্জেলো একটা উঁচু মঞ্চের ওপর শুয়ে শুয়ে করেছেন এই কাজ। ঠিকমতো খাওয়া হয়নি, মাসের পর মাস বদলাননি শরীরের পোশাক। অল্প পরিসর, তাই দৃষ্টি সব সময়ই প্রায় নাকের ডগায় আটকানো, আলোর স্বল্পতা তো আছেই, তার চোখ প্রায় অন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সিলিংয়ে লাগানো রং চুইয়ে চুইয়ে ঝরেছে নাকে মুখে গায়ে, কোনো সাহায্যকারী নেই। কারণ তিনি নিজেই তা চাননি। তিনি কাজ করতে ভালোবাসতেন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আর নিভৃতে। কঠিন নির্জন নিঃসঙ্গ চ্যাপেলের মধ্যে ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসের দুঃসাহসী আর দুঃসাধ্য শিল্পযজ্ঞ। এই সময়গুলোতে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। মিকেলাঞ্জেলোর কবিতা, সে আর এক ইতিহাস।
No comments