তদন্ত চলাকালেই কাজে যোগ দিলেন মসিউর

পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম চলাকালেই সরকারি কাজে যোগ দিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার এক মাসের ছুটি শেষে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিজ দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে দাপ্তরিক কাজ করেন।


বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের পর এ প্রকল্পে ফিরে আসার ক্ষেত্রে তাদের চার শর্তের প্রথমটি ছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ছুটিতে পাঠাতে হবে।
সেই শর্ত মেনেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গত ২৩ জুলাই পদত্যাগ করেন। মসিউর রহমানকে গত ১ অক্টোবর থেকে প্রাথমিকভাবে এক মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকেও ছুটিতে পাঠানো হয়। একইভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মসিউর রহমান গতকাল বেলা একটায় পতাকাবাহী গাড়িতে করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান। সেখানে তিনি কয়েক ঘণ্টা নিজ দপ্তরে অবস্থান করেন।
পরে যোগাযোগ করা হলে মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছুটি শেষ হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) কাজে যোগ দিলাম।’ কত দিনের ছুটি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক মাসের’। তাঁর একান্ত সচিব তপন চক্রবর্তীও জানান, ছুটি শেষে মসিউর রহমান গতকাল কাজে যোগ দিয়েছেন এবং পুরো সময় অফিস করেছেন।
মসিউর রহমানের ছুটি গতকাল শেষ হলেও দুই দিন আগে গত মঙ্গলবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিজ দপ্তরে যান। দীর্ঘ সময় তিনি সেখানে ছিলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মসিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো ব্যাখ্যা দেব না। এখানে ব্যাখ্যা দেওয়ার কিছু নেই। ব্যক্তিগত কাজেও তো আমি সেখানে যেতে পারি। দীর্ঘদিন বাইরে ছিলাম। ঈদ গেল। তাই সামাজিকতা থেকেই সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের জন্য অফিসে গিয়েছিলাম।’
এদিকে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি থেকে মসিউর রহমানকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এ-সংক্রান্ত আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এ দুটি কমিটি হলো: বিনিয়োগ বাড়ানো ও সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ-সংক্রান্ত কমিটি এবং ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন, ২০১০-এর খসড়া পরীক্ষা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটি। মসিউর রহমান এ দুই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এস এ সামাদকে মসিউরের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে।
মসিউর রহমানের কাজে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর তো ছুটি শেষ হয়নি, কাজে যোগ দেওয়ার কথা নয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
ছুটিতে যাওয়ার সময় মসিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের বিষয়টি তাঁর পদত্যাগের ওপর নির্ভর করে না। এ সরকারের সময় বিশ্বব্যাংকের টাকায় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব নয়। অবশ্য তিনি ছুটিতে যাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, মসিউর রহমান যথাসম্ভব পদ্মা সেতু প্রকল্প ও আর্থিক কোনো বিষয়ে সম্পৃক্ত থাকছেন না। এরপর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মসিউর রহমানকে ৬ নভেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মসিউর রহমান ৪ নভেম্বর যেতে চান। এ সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জন্য তদন্তকাজ খামাখা দেরি করার দরকার কী? তাই আগেভাগেই দুদকে যাচ্ছি।’
বিশ্বব্যাংকের শর্ত: পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক চারটি শর্ত দিয়েছিল। (ক) যে সকল সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি ব্যক্তিবর্গের (আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব থেকে তাঁদের ছুটি প্রদান; (খ) এই অভিযোগ তদন্তের জন্য বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ; (গ) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সকল তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি প্রদান, যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন-সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে। এবং (ঘ) বিকল্প বাস্তবায়ন ব্যবস্থার বিষয়ে একমত হওয়া, যাতে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী দাতারা প্রকল্পের ক্রয় কর্মকাণ্ড আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়।
মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চার শর্ত পূরণ করার পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে বলেন, দুর্নীতি হলে বিশ্বব্যাংক ফিরত না। দুর্নীতি হয়নি বলেই তারা ফিরেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ওই সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর উপদেষ্টা মসিউর রহমানকেও দেখা যায়। এ নিয়ে নানা মহলে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরপরই গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে বিশ্বব্যাংক একটি বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, গণমাধ্যমে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন সরকারি ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ সরকারকে একাধিকবার দিয়েছে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সাড়া না পাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থায়নকারী হিসেবে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য গত বছরের ২৮ এপ্রিল সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে সরকারের সঙ্গে এক বছর ধরে টানাপোড়েন চলার পর গত ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করেছিল।

No comments

Powered by Blogger.