বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৫৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, বীর বিক্রম অনন্য বিক্রমী এক মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ দলনেতা (কোম্পানি কমান্ডার) হিসেবে বেশ কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এর মধ্যে কামালপুরের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।


জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত কামালপুর। ৩১ জুলাই এখানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক তাঁর নিজের বয়ানে (১৯৭৩)।
‘ভোর সাড়ে তিনটার সময় দুই কোম্পানি (‘বি’ ও ‘ডি’) মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কামালপুর বিওপিতে আক্রমণ করি। বি কোম্পানির কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে। ডি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)। আমরা একটি ফিল্ড ব্যাটারির সাহায্য নিই। ক্যাপ্টেন মাহবুবের (মাহবুবুর রহমান বীর উত্তম, কানাইঘাট যুদ্ধে শহীদ) নেতৃত্বে ‘এ’ কোম্পানিকে পাঠানো হয় উঠানিপাড়ায়, যাতে তারা কাটঅফ পার্টিতে যোগ দিতে পারে।
‘আমরা এফইউপিতে পৌঁছানোর আগেই আমাদের পক্ষ থেকে আর্টিলারির গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এটা আমরা এফইউপিতে পৌঁছার পর শুরু হওয়ার কথা ছিল। এতে মুক্তিযোদ্ধারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এ সময় শত্রুপক্ষও (পাকিস্তান সেনাবাহিনী) আর্টিলারি ও ভারী মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ শুরু করে।
‘তার পরও আমি এবং সালাহউদ্দিন আমাদের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের একত্র করে শত্রুদের আক্রমণ করি। আমরা “জয়বাংলা” ধ্বনি দিতে দিতে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হই। মাইনফিল্ড অতিক্রম করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শত্রুর প্রতিরক্ষার অর্ধেক জায়গা দখল করে নিই। শত্রুরা পেছনে হটে যায়।
শত্রুরা পেছনে অবস্থান নিয়ে আর্টিলারি ও মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। শত্রুর গোলাগুলিতে তিনি হঠাৎ শহীদ হন। তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর যোদ্ধাদের উৎসাহ ও সাহস জোগান। একটু পর আমিও মর্টারের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হই। আমার শরীরের পাঁচ জায়গায় স্প্লিন্টার লাগে। আমাকে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই দলই নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। তাঁদের মনোবল ভেঙে যায়। ফলে তাঁরা পিছিয়ে আসে।’
হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা (এমএ) শেষ করে অনেকটা খেলার ছলে যোগ দেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৬৮ সালে কমিশন পান। কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। খেলাধুলা বিশেষত ফুটবলের প্রতি ছিল তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ। পাকিস্তানের জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে ফুটবল নিয়ে এবং সেনাবাহিনীর নিয়মনিষ্ঠ জনবিচ্ছিন্ন জীবনের ঘেরাটোপেই তিনি নিমগ্ন ছিলেন।
১৯৭১ সালের মার্চে হাফিজ উদ্দিন তাঁর ইউনিটের সঙ্গে যশোরের প্রত্যন্ত এলাকা জগদীশপুরে শীতকালীন প্রশিক্ষণে ছিলেন। দেশের চলমান ঘটনা সম্পর্কে তেমন অবহিত ছিলেন না। ২৫ মার্চের পর তাঁদের যশোর সেনানিবাসে তলব করা হয়। ২৯ মার্চ গভীর রাতে তাঁরা সেনানিবাসে ফেরেন। পরদিন সকালে আক্রান্ত হন। দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে তিনি দেরি করেননি। এ সময় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।
পরে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে বেনাপোলে সমবেত হন। সেখানেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করেন। এরপর ভারতে যান। সেখানে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পর তিনি প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরের অধীন কামালপুরে যুদ্ধ করেন। উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ কামালপুর, ধলই বিওপি, কানাইঘাট ও সিলেট এমসি কলেজের যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মদকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১০।
হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তখন তিনি মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০১-০৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি ভোলার লালমোহনে। বর্তমানে বাস করেন ঢাকায় (ঠিকানা বাড়ি কে-২১, সড়ক ২৭, বনানী)। তাঁর বাবার নাম আজহার উদ্দিন আহম্মদ, মা করিমুন্নেছা। স্ত্রী দিলারা হাফিজ। তাঁদের এক মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বীর বিক্রম, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, রাফিয়া চৌধুরী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১১।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.