দুই শিল্পীর যুগলবন্দী by আহমেদ মুনির

ওয়াকিলুর রহমান ও দিলারা বেগম জলির যৌথ চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল চট্টগ্রামের শিল্পকলা একাডেমীর গ্যালারিতে। পাঁচ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী শেষ হয় ১০ অক্টোবর। প্রায় চার দশক ধরে নিরবচ্ছিন্ন শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত এই দুজন শিল্পী।


একজনের কর্মক্ষেত্র রাজধানী ঢাকায়, অন্যজনের চট্টগ্রামে। বহু দিন পর একটি প্রদর্শনীতে এসে সমসাময়িক এই দুই শিল্পীর কাজ দেখার সৌভাগ্য হলো চট্টগ্রামের দর্শকদের।
দিলারা বেগম জলির পাঁচটি স্থাপনা, ২০টি ড্রয়িং ও পাঁচটি তেলচিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছিল গ্যালারির দোতলার তিনটি কক্ষ। তাঁর কাজের শিরোনাম ‘অমরা’ অর্থাৎ গর্ভাশয়।
ড্রয়িং, পেইন্টিং, ভাস্কর্য, স্থাপনাশিল্প ও পারফরম্যান্স সব মাধ্যমেই কাজ করেন জলি। প্রদর্শনীতে প্রায় সব মাধ্যমের কাজ হাজির করেছেন তিনি।
জলির নানা মাধ্যমের কাজে নারীর ‘অমরা’ বা গর্ভাশয় ঘুরেফিরে এসেছে। স্থাপনাশিল্পগুলোতেও ছিল নারী ফিগার ও অমরার উপস্থিতি। সূক্ষ্ম ডিটেলের ড্রয়িংগুলোতে নানাভাবে নারীর মাতৃত্ব উপস্থাপন করেছেন তিনি। বাদ যায়নি পেইন্টিংগুলোও।
নারীত্বের জয়গানও ধ্বনিত হয় তাঁর কাজে। জলির একটি স্থাপনাশিল্পের বিবরণ তুলে ধরলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধড়বিহীন একটি ফিগার সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ছাদ থেকে। ফিগারটির দেহগহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছে বিয়েবাড়ি সাজানোর ছোট ছোট ফেন্সি লাইট। তার নিচে মেঝেতে সাদা চকের গুঁড়োর বৃত্তের মাঝে অনেকগুলো গোলাপ। এই কাজ দেখে মনে হয় নারীর দেহ ও তার অন্তর্গত সৌন্দর্যও উদ্যাপনের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কাজগুলো সম্পর্কে জলি বলেন, ‘মাতৃত্ব একজন নারীর মাঝে দুইভাবে কাজ করে। মাতৃত্ব তাকে মহিমান্বিত করে, আবার তার ওপর পুরুষের আকাঙ্ক্ষার বোঝাও চাপিয়ে দেয়। এই দুটো অনুভূতি নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি আমি। পাশাপাশি নারীর গর্ভে জীবনের উন্মেষ হয়। নারী তাই জীবন ও মৃত্যুকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে। এটাও আমার কাজের মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছি।’
গ্যালারির তৃতীয় তলায় চলছিল শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। ‘কালচারাল ফুড ফেস্টিভ্যাল’ শিরোনামে তিনটি কক্ষে শোভা পাচ্ছিল তাঁর কাজ। আলোকচিত্রকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও প্রথাগত আলোকচিত্রের নন্দন ও কৌশল ব্যবহার করেননি তাঁর কাজে। ছোট ক্যামেরায় প্রায় শৌখিন ঢঙে তোলা ছবিগুলো সাজিয়ে তৈরি করেছেন নতুন ভাষ্য। খেলনা, পুতুল, ছবির ফ্রেম, নারীর সাজসজ্জার উপাদান, গৃহসজ্জার উপকরণ, মাছের অ্যাকুরিয়ামের ভেতরের ল্যান্ডস্কেপ তাঁর ছবির বিষয় হয়ে এসেছে। দেয়ালজুড়ে ইমেজগুলোর দিকে দেখতে দেখতে দর্শকের মনে হবে, আরে, এসব তো আমাদের চারপাশের জিনিস!
সারি সারি খেলনা, চুড়ি, ক্লিপ, চিরুনি, ছবির ফ্রেম, পোস্টকার্ডের ছবি ব্যবহার করে ভিন্ন এক কোলাজ তৈরি করেছেন ওয়াকিলুর রহমান। দেখাতে চেয়েছেন সমসাময়িক সভ্য দুনিয়ার উপরিতলের একটা ছবি। সস্তা রংদার এসব সামগ্রী ভিন্ন এক নন্দন তৈরি করেছে। হয়ে উঠেছে সর্বভুক ক্ষয়িষ্ণু এক সংস্কৃতির প্রচারক।
নিজের কাজ সম্পর্কে ওয়াকিলুর রহমান বলেন, ‘আমার কাজের শিরোনামের মধ্যে ফাস্টফুড কথাটি আছে। ফাস্টফুড সবখানে পাওয়া যায়। বিশ্বের সর্বত্রই তার চেহারা ও স্বাদ এক। এটা সস্তা ও অস্বাস্থ্যকর, আবার অন্য সব অভ্যাসকে ছাপিয়ে যায়। আমরা এখন যেন এই সংস্কৃতিতে বসবাস করছি। যে জিনিসগুলো আমরা ব্যবহার করি সেসব সস্তা, ঠুনকো এবং মেকি। এই দ্রব্যসমাজের ভেতরকার ছবি যেন এসব জিনিসপত্রের মধ্যে দেখা যায়। আমি সেটাই আবিষ্কার করতে চেয়েছি।’

No comments

Powered by Blogger.