ছিনতাই by আবু রুশদ

শুক্রবার বিকেলের এলিফ্যান্ট রোড। চলমান পথিকের সংখ্যা কম। তবে মোটরগাড়ির বেহায়া বিজ্ঞাপন নতুন-বিজ্ঞানের প্রকোপ প্রকট করে তুলেছে। ক্রিম রঙের ২০০ মার্সিডিজ-এ উৎকট হলুদ রঙের পর্দা ভেতরের আব্রু রক্ষা করার জন্য যেন কোনো অনাচার-ক্লিষ্ট মনের উদ্ভাবন।


সদ্য আমদানি করা এক চকোলেট রঙের টয়োটায় রেডিওর অস্তিত্ব বাইরে লতার মতো হেলানো নতুন কালো এরিয়ালে অভ্রান্তভাবে স্পষ্ট।
চালক, দেখা যায়, বেশির ভাগই নবীন যুবা। তবে কোন বেকুবে বলবে বাঙালি তরুণের নম্রতা বা সৌজন্য তাদের চেহারায় বা দৃষ্টিতে। পরিপুষ্ট মুখে এক বেলুচি কাঠিন্য; হিপি জুলপি ও আকস্মিক ভল্লুক-গুম্ফে এক আন্তর্জাতিক চমক ও আরণ্যক সংকল্প তাদের সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছে।
বিপণির নামকরণে কিন্তু বাঙালি উচ্ছ্বাস। যদিও বিদেশি সওদা তাদের মালিকের সমকালীন বৈষয়িক ধূর্ততার নমুনা। কী চান আপনি, বলেন? মুদ্রাবান হলে প্রায় সবকিছুই পাবেন। 'বুটিক'-এর শার্ট, অভিজাত টাই, ইয়ার্ডলি সাবান, রেভলনের লিপস্টিক, নিখুঁত এক আধুনিক ডিজাইনের আরামকেদারা, টেলিভিশন ক্যামেরা, রেকর্ডপ্লেয়ার, থ্রি ইন ওয়ান, জর্জেট শিফন মাদ্রাজি শাড়ি।
আর আপনার সচ্ছল সংসারে যদি কঠিন অসুখে পড়ে কেউ রুচি-বিকৃতির পরিচয় দিয়ে থাকেন, ঘাবড়াবেন না। দুর্লভতম ওষুধটাও পেয়ে যাবেন। সব দোকানে নয়। দু-একজন কেমিস্টের নাক এখনো একটু উঁচু রয়ে গেছে। তারা দামের ব্যাপারে বেশি এদিক-ওদিক করতে পারে না। তবে বাঘাটে কেমিস্টও পাবেন যিনি সে ওষুধটা সহাস্যে আপনাকে দেবেন, যদি আপনি হাসিখুশি ধরনের দাম দিতে রাজি হন আর কথা বেশি না বলেন।
মাঝখানের আশপাশের বস্তিগুলোই বিপাক বাধায়। বদ্ধ নর্দমায় কীট-কলোনির মতো তারা কিলবিল করে। কোনোই সুঠাম ভাব নেই বা আলাদা এক আকৃতি। ইত্যাদি ও প্রভৃতির মতো চুলকানি ও পাঁচড়া ও উকুন ও ন্যাকাটি পেটের ঝোলায় তারা নামহারা। 'উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা'ও তারা বোধ হয় চোখ তুলে কখনো দেখে না।
পিজি হাসপাতালের দালানে নতুন বিপণিবিতান পটুভাবে পট বদলায়। ইন্টারকন্টিনেন্টালে কোনো বিদেশি আগন্তুকের কক্ষে কিছু আমোদিত প্রহর কাটিয়ে অষ্টাদশী রাহেলা বা সালেহা বা জমিলা বিলাসী পণ্যের দিকে নতুন সম্ভাবনার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কেউ বা সাহস করে ভেতরে ঢোকে দু-একটা পছন্দসই সওদার দাম করে_গ্রামীণ কলহাস্য ও বিদেশি আগন্তুক-অভিনন্দিত পাছার দোলানি বাইরের পথচারীকে উপহার দিয়ে।
তবে কেন্দ্রীয় এক ঘটনার মতো পথের বাঁকটা প্রথমে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়ে পরে ক্রমে ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগল। শাহবাগ এভিনিউর মাঝখানের ফোয়ারাটা বিকল হয়ে পড়েছে। ভরা পানি যা আছে তা সন্ধ্যার বিজলিবাতির বিজুরিতে খোলতাই হবে, তবে বিকেলের রোদে একটু গদ্য-গদ্য ভাব। অধিকাংশ যানবাহন কোনো কিছুর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে লোমহর্ষক দ্রুততার চলন অব্যাহত রেখেছে, তবে ডানদিকের ১০০ গজ জুড়ে মোটরগাড়ি, বাস, বেবিট্যাঙ্,ি রিকশা এক অস্বাভাবিক ব্যাসের সৃষ্টি করেছে। তাদের আরোহী ও চালক প্রত্যেকের মুখে আশু এক কর্মতৎপরতার কঠিন সংকল্প মূর্ত হয়ে উঠেছে। চারদিক থেকে জটলা করে পথচারীরা এসে জড়ো হয়ে সে ব্যাসের পরিধিকে বাড়িয়ে তুলছে ও আসন্ন নাটকের পটভূমি তৈরি করছে।
_না! এর একটা বিহিত করতেই হবে। এটাকে আর চলতে দেওয়া যায় না। পুরু কালো ফ্রেমের চশমা পরা মাস্টারি চেহারার এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক চোখের ঈষৎ-রক্ত তারাকে রাগের দ্যোতনায় নেকড়ে-কুটিল করে বলে।
সর্দির তাড়নায় নাক থেকে অবিরত পড়া নোনতা পানিকে কিছুটা জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে কিছুটা হাত দিয়ে মুছে এক মিশকালো রিকশাচালক অনির্দেশ্য এক লোকের দিকে অব্যবহৃত বাঁ হাতটা বাড়িয়ে কী এক কল্পিত তামাশায় হাসতে থাকে আর হেঁক হেঁক করে কেশে শিক্ষিত বাংলায় বলে : ধর্ শালাদের ধর্, পিটিয়ে তালগোল পাকিয়ে দে, শালারা হাইজ্যাক করার তালে আছ, হারামির পোলা।
ততক্ষণ বেশ প্রশংসনীয় তৎপরতা ও নিপুণ পন্থায় ছিনতাইয়ের কাজটা সম্পন্ন হচ্ছিল। এক ছোট্ট ছাই রঙের ফিয়াট থেকে নেমে তিনজন তরুণ মিলিটারি ধরনে গুরুত্বপূর্ণ কোণগুলো দখল করে এক ল্যান্ডরোভারকে থামায়। তারপর দরজাটা অনুশীলিত দ্রুততার সঙ্গে খুলে ড্রাইভারকে মস্ত এক হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে পাশের আরোহীর হাত থেকে মাঝারি ধরনের এক স্যুটকেস ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে পেছনের আরোহীর কাছ থেকে আচানক বাধা পায়। পূর্বপরিকল্পিত ক্রিয়া সম্পাদনার আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি এমন এক বাধা পাওয়ায় তরুণটা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিনা দ্বিধায়, যেন দৈনন্দিন এক অনুত্তেজিত কাজ করছে, স্টেনগান উঠিয়ে পেছনের আরোহীকে তাৎক্ষণিক পটুতায় গুলিবিদ্ধ করে স্যুটকেসটা পেশাগত স্বাচ্ছন্দ্যে ছিনিয়ে নেয় : তার লোম-ধনী হাতটা স্যুটকেস বহনকারী জিন্দা আরোহীর হাতে লাগলে কাপুরুষ নাগরিক খরগোশের মতো কাঁপতে থাকে। তিন মিনিটে নিজেদের কাজ সেরে তিনজনই চারপাশে জমা পথচারীদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ফিয়াটে চড়ে ঢাকা ক্লাবের দিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে সবেগে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের দিকে ধাওয়া করে, কিন্তু হঠাৎ একটা টায়ার ফেটে যাওয়ায় মাঝপথে থেমে গাড়ি ফেলে রেখে দুজন রমনা পার্কের দিকে আর একজন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে দৌড় দেয়।
এদিকে ল্যান্ডরোভারের পেছনের সিট নিহত আরোহীর রক্তে কালচে লাল হয়ে ওঠে আর ড্রাইভার ও তার পাশে বসা আরোহী কেমন উদভ্রান্ত চোখে কৌতূহলী ও ক্ষিপ্ত জনতার দিকে চেয়ে থাকে।
কে একজন জিজ্ঞেস করে_স্যুটকেসে ছিল কী সাহেব?
_টাকা। ড্রাইভারের পাশে বসা আরোহীটা ঘোলা চোখে বিশেষ কারোর দিকে না চেয়েই বলে।
_টাকা নয় তো কি মার্বেল ছিনতাই করতে এসেছিল? টাকা ছিল কত?
_তিন লাখ।
_কী মজা, শালা আমি পেয়ে গেলে ধানমণ্ডিতে একটা বাড়ি কিনে ফেলতাম। তারপর আমার ঠাট দেখে কে!
কোনো এক কোনা থেকে ছুড়ে মারা এই বিদগ্ধ মন্তব্যে সমবেত জনতার মধ্যে আমোদের এক সাময়িক হিল্লোল খেয়ে যায়।
দূর থেকে একজন চিৎকার করে বলে : স্যুটকেস হাতে ছোকরাটাকে দেখতে পাচ্ছি। রেসকোর্সের ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমি চললাম শালাকে ধরতে। আপনারাও আসুন।
আর নিমেষে ওলটপালট কাণ্ড। জনতার প্রায় সবাই লোকটার দিকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে যায়। শৃঙ্খলা বলতে আর কিছু থাকে না, চলন্ত এক মোটর প্রচণ্ড আকস্মিকতায় ব্রেক কষে বিকট এক শব্দ করে থেমে পড়ে, ঠেলাঠেলিতে কয়েকজন রাস্তা থেকে ছিটকিয়ে ফুটপাতে নিক্ষিপ্ত হয়। হাঁচিতে গর্জনে হাসিতে ও তড়িৎবেগে জনতা নিজেদের সম্মিলিত বাড়ন্ত রাগকে এক মানবীয় মুখোশ পরতে দেয়।
_কোথায়, কোথায় লোকটা?
_ওই যে। হাতে স্যুটকেস দেখছেন না!
_স্যুটকেস দেখছি, তবে লোকটার তাড়া আছে বলে মনে হয় না। স্থির গতিতে চলেছে।
_হারামজাদার হাতে স্টেনগান আছে, তাই অত সাহস। ওরই স্টেনগান দিয়ে এবার ওকে মারব। এবার দেখি তুমি কোথায় পালাও।
বর্ণালি সব হাওয়াই শার্ট আলোতে চমকায়। মাথার চুল ঝুলপি গোফ, পায়ের বিবিধ আকৃতি, দৌড়াবার বিভিন্ন ধরন, পায়জামা, প্যান্ট ও লুঙ্গির উঠতি পড়তি হাঁপানি ও হিক্কা বিকেলের বিশেষ নম্রতায় ও স্মিত প্রাঙ্গণের বিস্তারে তামাটে শালগাছের পশ্চাদভূমিতে ও সামনের মন্দিরের চূড়ার আশ্বাসে সহসা এক কেন্দ্রীয় অর্থে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। জনতা সামনের দিকে প্রচণ্ডভাবে-উত্থিত এক সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো এগোতে থাকে। তার বিস্তারিত ও বলবান বাহুতে যেই আটকা পড়ুক না কেন, ভয়াল ক্ষিপ্রতায় সে অমোঘভাবে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
_ধর্ শালাকে ধর্, এবার দৌড়াতে আরম্ভ করেছে। দেখি কত দৌড়াতে পারে। হঠাৎ তাকে কেন্দ্র করে নিত্যবাড়ন্ত এক জনতার মারমুখী অভিযান দেখে যুবকটা একেবারে হকচকিয়ে যায় আর নিজের স্বাভাবিকত্ব সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে। আচানক ভয়ে তার নাড়ি পর্যন্ত ক্রিয়ারহিত হয়ে যায়, সম্বিৎ তো সম্ভ্রান্তভাবে আলাদা।
কিসের জন্য জনতা তার দিকে হন্তদন্ত হয়ে খেঁচিয়ে মারমুখী হিংস্রতায় এগিয়ে আসছে? সে করল কী! তার ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হতে থাকে। তার মাছুম চোখ অব্যক্ত এক আশঙ্কায় ভরে গিয়ে তাকে সাময়িকভাবে ব্যক্তিত্বহীন এক ত্রাসে রূপান্তরিত করে। তার বুকের লৌহপিঞ্জরে তড়পড়ানো হৃদয় কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য কেমন আকুলিবিকুলি করতে থাকে।
তাকে কী ঠাহর করেছে জনতা? চোর, পকেটমার! তাকে মারবার জন্য ছিঁড়বার জন্য ক্ষিপ্ত জনতা হাজারে হাজারে তার পেছনে ধাওয়া করা আরম্ভ করে দিল কিসের প্ররোচনায়? যুবকের স্বাভাবিক চিন্তাক্ষমতায় কিছুই বুঝবার উপায় থাকে না। পা-টা হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে আসতে চায়। আক্রমণের কারণ একেবারে জানা না থাকায় বোধহীন আতঙ্কে যুবকের উচ্চকিত চেতনা ভরে যায়।
_আপনারা সবাই আমাকে তাড়া করছেন কেন? আমি তো কিছু করি নাই। জাগ্রত আশার মন্ত্রণায় যুবক জনতার ন্যায়বোধের কাছে আবেদন করা মনস্থ করে।
_কিছু করে নাই! কিছু করে নাই! শুধু একটা লোককে খুন করেছে আর স্যুটকেসে তিন লাখ টাকা নিয়ে পালাচ্ছে।
_স্বাধীনতা পেয়েছ বলে শালা লোক খুন করবে, বাইনচোদ টাকা ছিনতাই করবে। তোমাকে মেরে একদম গুড়গুড়িয়ে দেব না!
_অনেক সয়েছি, আর না। কেউ যখন কিছু করবে না, আমরাই এর বিহিত করব। বাড়ন্ত রোষের তাড়নায় জনতা দ্রুততর গতিতে ধেয়ে যুবককে প্রায় ধরেই ফেলেছিল যদি মাঝখানে জনতার একাগ্রতায় আকস্মিক এক ছেদ না পড়ত।
রমনা পার্কের কাছ থেকে কোলাহল ও গুঞ্জন এ পর্যন্ত ভেসে আসে আর তামাটে শালগাছ হঠাৎ আগুনের হলকায় সাময়িক এক রোশনাই ছড়িয়ে অপ্রতিরোধ্য আগুনের তাপে কিছুটা জ্বলতে থাকে।
দূর থেকেও জনতা দেখতে পায় পরিত্যক্ত মোটরগাড়িটা আশপাশে আগুনের লেবাস পরে মাঝখানে একেবারে পোড়া কয়লার মতো কালো হয়ে গেছে। সে দৃশ্যই জনতার একাংশের কাছে বেশি নয়নাভিরাম মনে হয়। হল্লা করতে করতে তারা সেদিকে ছুট দেয়। কিন্তু জনতার সামনের সারি নিজের সংকল্প থেকে বিচ্যুত হয় না। কলগুঞ্জনে ও পরিত্যক্ত মোটরটাকে আগুনে পুড়তে দেখে তারাও অবশ্য কিছুক্ষণের জন্য পেছন ঘুরে চেয়েছিল তবে মানুষ-শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি ঘোরায়। সেই অবসরে যুবকটা প্রায় পাঁচ শ গজ দূরত্বের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ব্যবধান রচনা করতে পেরেছিল। তা দেখে ধাবমান জনতা আরো দৃঢ়সংকল্প ও ক্ষিপ্ত হয়ে যুবকের দিকে বিপুল বিক্রম ও বেগে এগোতে থাকে।
জনতার আকস্মিক নীরবতা ও পাগলা ঢেউয়ের মতো উল্লসিত অগ্রগতি যুবককে আবার নতুন করে তার আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে সন্ত্রাসের সঙ্গে সচেতন করে তোলে। তার মাথার চুল বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকে তার ধাবমান ও ত্রাসপিষ্ট শরীরের স্পন্দিত মীড় হয়ে; তার ছানাবড়া চোখ দুটো আসমানের অঙ্গনের দিকে চেয়ে খামাখাই কার যেন করুণা ভিক্ষা করছে।
আর ঠিক সে সময় ঘুঘু দেয় এক ডাক। বড় উদাস মধুর। ভেতরের কোনো খবর যেন দিতে চায় অতীতের অনেক বিচ্যুতির ডাকহরকরা হয়ে।
যুবক তখন নিশ্চিত বোঝে তার আর পরিত্রাণ নেই। উদ্যত বন্যতায় মরণ ছোবল মারার জন্য ভুল নিশানার দিকে তারা ধাওয়া করেছে, ওই যুক্তির কথা বলে জনতাকে এখন নিরস্ত করা যাবে না। পুরো দম দেওয়া এক যন্ত্রের মতো ছাড়া পেয়ে তারা নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে অমোঘভাবে এগিয়ে আসছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো মাস্টারি হাত কোথাও দেখা যায় না।
তবু যুবক একবার শেষ চেষ্টা করে দেখে। উচ্চলম্ফনে অপ্রত্যাশিত কৃতিত্ব দেখিয়ে যুবক বেড়াটা এক ফুট ব্যবধান রেখে পেরিয়ে যায়। বাংলা একাডেমী এখন প্রায় মুখোমুখি। ন্যাশনাল লাইব্রেরির পাশেই শিল্প ও চারুকলার মহাবিদ্যালয় তার অস্তিত্বকে মৃদুভাবে জাহির করছে। সেখানেই সে যাচ্ছিল নাসিমার সদ্য-সমাপ্ত প্রতিকৃতি নিয়ে। সস্তা বাদামি রঙের প্লাস্টিকের ব্রিফকেসটা এখনো হাতে রয়ে গেছে। সেটা পালাবার এক অতিরিক্ত কারণ। প্রতিকৃতিটা যেমন করেই হোক একবার নাসিমাকে দেখাতে হবে। একই মহাবিদ্যালয়ে নিচু ক্লাসে পড়া এই মেয়েটিকে যুবকটি কোনো গণিতের ধারায় না গিয়েই হৃদয়মন দিয়ে বসে আছে। বড় জনপ্রিয় নাসিমা। প্রায় সব ছাত্র আর দু-একজন মাস্টারও তার পেছনে হরদম ধাওয়া করছে। কিন্তু গত সপ্তাহে নাসিমা যুবকের হাতে এক গোলাপ ফুল উপহার দিয়েছিল। আজকে তার প্রতিকৃতি নাসিমাকে দিয়ে চমকে দেবে বলে যুবকের বড় সাধ ছিল।
নাসিমা বলেছিল প্রায় প্রতি ভোরে সে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ধানমণ্ডি লেকের দিকে বেড়াতে যায়। তাই একদিন ভোরের আজানের পর পরই তাদের টিনের বাসা থেকে বেরিয়ে যুবকটি ধানমণ্ডি লেকের দিকে পুরো পথ অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় হেঁটে এসেছিল।
দেখাও হয়েছিল। নাসিমার বান্ধবীটি সুলোচনা বটে তবে কালচে পাড়ের হালকা পীতরঙের এক শাড়িতে নাসিমাকে জবর দেখাচ্ছিল। ভোরের হাওয়া তখন আবার একটু ইয়ারকি দেওয়া আরম্ভ করেছে। আর এক কোকিল মুখ খুলবার পরে অন্য এক বেলি্লক কোকিল তার সঙ্গে তাল রেখে ভোরের বাড়তি আলোর আসমানকে অঢেল সুধায় ভরে দিয়েছিল। আর সম্রাট-সূর্য পুরন্ত লালিমায় আসমানের এক কোণকে একেবারে বশ করে ফেলেছিল।
নীরব ছোবলানিতে দলিত-মর্দিত হয়ে জনতা অমোঘভাবে এগিয়ে আসছে। শরীর আর যুত পায় না, পা আর উঠতে চায় না। শুধু নাসিমার পরিপুষ্ট স্তন চোখের সামনে পরিষ্কার রেখায় ভেসে ওঠে। যেন তাতে সব পিপাসার সমাধান, মোক্ষম এক শান্তি।
পেছন দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। চালককে ভদ্র ও সদাশয় মনে হয়। মরিয়া হয়ে তার সামনে শেষ প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে যুবকটি গাড়িটাকে থামায়। চালককে আশু আবেদনের সব আর্তি দিয়ে বলে : আমাকে একটু উঠতে দেন, নইলে ও লোকরা আমাকে খামাখাই মেরে ফেলবে। বিশ্বাস করুন, আমার কোনো দোষ নেই। আমাকে না বাঁচালে আমার মা-বাপ বড় কষ্ট পাবে। হুঙ্কার দিয়ে জনতা ছুটে আসছে।
চালকের পাশে বসা তরুণী সহোদরার মমতায় বলে_নাও না তুলে, দোষ যদি কিছু করে থাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেই হবে।
_পাগল হয়েছ! তাহলে ওরা আমাদেরও পিটিয়ে শেষ করে দেবে। যুবকটি গাড়িটা দ্রুত চলে যেতে দেখে আর এই প্রথমবারের মতো পিঠে কার যেন স্পর্শ লাগে। তার পরেই জনতার ঢেউ আছড়ে পড়ে।
যখন তার শরীরের ওপর দিয়ে এক এক করে অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটে যায়, তখন যুবকটি চরম বোধনের অপ্রাসঙ্গিকতায় ভাবে...
ব্রিফকেসটা ছিঁড়ে তছনছ হয়ে গেছে, যুবকের মগজের কিছু কিন্তু নাসিমার দুমড়ানো প্রতিকৃতির সঙ্গে সহ-অস্তিত্ব পেয়েছে।
_এ যে দেখছি মেয়ের এক ছবি, টাকা কই? জনতার একজনের আর্ত-জিজ্ঞাসা। আরেকজন অনেকটা অনিশ্চিত ধরনে মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে : শালা কারে পাকড়াও করলাম কে জানে। শালার বিচিটা যখন ছিঁড়ে দিচ্ছিলাম বাবু বলে কী : ছেড়ে দাও ভাই, বড় ব্যথা লাগে। আরে আমি শালা ওর ভাই হলে তার ওই জিনিসটা ছিঁড়তে যাই নাকি? বেটা অগারাম কোথাকার!

No comments

Powered by Blogger.