শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-ভূতরাই না হয় টাকার জোগান দিক by অজয় দাশগুপ্ত
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর : একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮২ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যতে যারা পড়তে আসবে তাদের জন্য ৭ লাখ টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। এ জন্য ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে দিয়েছে ১০ হাজার টাকা করে। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তিদান তহবিল এনডাউমেন্ট ফান্ড হিসেবে পরিচিত।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এ তহবিলে জমা অর্থের পরিমাণ বিপুল। আমরা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে পরিচিত। ২০১১ সালে এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি তহবিলের অঙ্ক পেঁৗছেছে ৩১৭২ কোটি ডলারে (বাংলাদেশের মুদ্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, তুলনা করুন যে আমাদের চলতি বছরে জাতীয় বাজেটের মোট অঙ্ক ১ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা!)। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস সিস্টেমে ২০১১ সালে ছিল ১৭১৪ কোটি ডলার, ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ১৯৩৯ কোটি ডলার, রকফেলার ইউনিভার্সিটিতে ১৭৪৬ কোটি ডলার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে এ তহবিলের আকার ছিল ৪২৮ কোটি পাউন্ড (বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা)। ২০০৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল ৫৩৫ কোটি পাউন্ড।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা এখন শ'খানেক। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সরকারি অর্থেই পরিচালিত হতো। যেমন : ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা বেড়েছে। অনেকের অভিযোগ, এগুলোর বেশির ভাগ শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে। যত না পড়ায়, তার চেয়ে ঢের বেশি কামায়। তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ নিচ্ছে, কিন্তু সে তুলনায় শিক্ষার মান বাড়াতে অর্থ ব্যয় করছে না। তারা উচ্চমানের শিক্ষক নিয়োগ করে না, গবেষণাগার-পাঠাগারের পেছনে তেমন ব্যয় করে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ায় না, কারণ এ ধরনের বিষয়ের জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করা কষ্টকর হয়। তার চেয়ে বিবিএ বা কম্পিউটার সায়েন্স ঢের ঢের আকর্ষণীয়, পাস করলে চাকরি অনেকটা নিশ্চিত। মাঝে কয়েকটি বছর সরকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তেমন উদ্যোগী হয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়টিতে নতুন করে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি নতুন ছাত্রাবাস উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী_ একটি ছাত্রদের, আরেকটি ছাত্রীদের। এ উপলক্ষে ভাষণে তিনি বলেছেন, 'আমি যে প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে এলাম তার জন্য কী করলাম ভেবে দেখা উচিত। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই। মন্ত্রী হিসেবে যে বেতন-ভাতা পাই তার একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে চাই।' একটি অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেছেন, 'টাকা থাকলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকে অবৈতনিক করে দিতাম।'
তার এ মনোভাব প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রীর বেতন-ভাতার একটি অংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করার ঘোষণা নিয়ে সংবাদপত্র এবং বেতার-টেলিভিশনে আলোচনা হবে বলে আশা করেছিলাম। এ পদে যিনি থাকেন, তিনি অশেষ ক্ষমতাধর। চাইলে বেতন-ভাতার বাইরেও হাজারো সূত্রে উপার্জন হতে পারে। একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, 'অর্থমন্ত্রীর কারও কাছে কিছু চাইতে হয় না। অনেকেই অর্থের ডালা নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকেন। এর বিনিময়ে দিতে হয় সুবিধা।' প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে অন্যায় সুবিধা লেনদেন করাই যায়। বাংলাদেশে সরকারি পদে থেকে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এক সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তার অভিমত_ শহর-গ্রামের সর্বত্র কিছু লোকের মধ্যে একটি প্রবণতা প্রকট। যে কোনো মূল্যে দ্রুত ধনী হতে হবে এবং এ জন্য সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সরকারি সুবিধা কাজে লাগানো। মন্ত্রী-এমপি-সচিবদের পক্ষে সরকারি সুবিধা বিলানো অপেক্ষাকৃত সহজ এবং এর বিনিময়ও মেলে নগদ নগদ। রাতারাতি এ অবস্থার পরিবর্তন হবে, এমন আশা করি না। অনিয়মকে যখন অনেক লোক দোষের কিছু নয় বলে মনে করে তখন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পেঁৗছে যায় এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দরকার হয় সম্মিলিত প্রয়াসের। মন্ত্রী-এমপিদের উল্লেখযোগ্য অংশ দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত বলে এ ব্যবস্থার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যাবে না, এমন ধারণা ঠিক বলে মনে করি না। নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু করতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে আমি মহৎ উদ্যোগ হিসেবেই গণ্য করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী দান করছেন বলে সবাইকে করতে হবে, এমন নয়। কিন্তু যাদের আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে এবং একই সঙ্গে রয়েছে শিক্ষার প্রতি দরদ তাদের অবশ্যই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আমার কাছে এক ব্যক্তি এসেছিলেন কয়েকজন 'অদম্য মেধাবীকে' আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে। আমার কাজ ছিল সমকালের জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ ধরনের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর নাম-পরিচয় তাকে দেওয়া। তবে তার একটি শর্ত ছিল_ কোনোক্রমেই তার নাম সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না। এটুকু বলতে পারি যে তার নামের একটি অংশ আশরাফ। এমন ব্যক্তি অনেক রয়েছেন সমাজে। আমার কাছেই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার সাবেক এক অধিবাসী এসেছিলেন একটি প্রস্তাব নিয়ে_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিশের দশকে অক্ষয় কুমার সেনশর্মা নামে এক কৃতী ছাত্র ছিলেন, যিনি মৃত্যুকালে রেখে যাওয়া ৫ লাখ টাকা তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য রেখে গেছেন। আমাকে এ সংক্রান্ত ট্রাস্টের সদস্য করে তিনি সম্মানিত করেছেন। প্রসঙ্গত বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অনেক বৃত্তি তহবিল রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কন্যা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন সিতারা পারভিনের পরিবারের সদস্যরা চালু করেছেন ২০ লাখ টাকার একটি বৃত্তি তহবিল। প্রতি বছর অনার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে এ তহবিল থেকে বৃত্তি দেওয়া হয়। জগন্নাথ হল অ্যালাইনাই অ্যাসোসিয়েশন জগন্নাথ হলের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। আমি নিজে দুটি স্কুলে বৃত্তি প্রদানের সঙ্গে জড়িত_ একটি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট বিদ্যালয়, অন্যটি বরিশালের গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দেশের আরও শত শত প্রতিষ্ঠানে সাবেক শিক্ষার্থীর এ ধরনের বৃত্তি তহবিল চালু রয়েছে। আমার মনে হয়, সংগঠিত উদ্যোগ থাকলে আরও হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি চালু হতে পারে। বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করে দেওয়া কিংবা এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের দেশে বহু যুগ ধরে প্রচলিত। এখন সরকার থেকেই স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়। স্কুলে স্কুলে বইও সরকার দেয় বিনামূল্যে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের রাজকোষ বাড়ন্ত হলে সব ছাত্রছাত্রীকে বিনা বেতনে পড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রতি সরকারকে অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা চাই। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজের শিক্ষক হিসেবে টেনে আনতে হলে অবশ্যই আকর্ষণীয় বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে চাই সাবেক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। তারা ব্যক্তিগত বা সংগঠিতভাবে এ উদ্যোগ নিতে পারেন। এমন হতে পারে যে একটি বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা ২-৩ জন শিক্ষকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করবেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক বাছাইয়ে তাদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সে জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন করা চাই। সাবেক শিক্ষার্থীরা যদি মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রী বা ছাত্রকে তারা শিক্ষক হিসেবে স্কুলে নিয়ে আসবেন এবং এ জন্য অর্থ ব্যয়ে কার্পণ্য করা হবে না_ সেটা করায় কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। সাবেক শিক্ষার্থীরা এভাবে ছাত্রাবাস তৈরি করে দিতে পারেন। গবেষণাগার ও পাঠাগার-গ্রন্থাগার এবং কম্পিউটার ল্যাববেটরি আধুনিক করে দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এ ধরনের উদ্যোগে সহায়ক হতে পারে। তবে এ জন্য আরেকটি শর্ত_ স্কুল ও কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতি আস্থা। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা কমিটি সম্পর্কে সাধারণ অভিযোগ_ তারা রাজনীতির লোক এবং এ স্বার্থকে বড় করে দেখেন। দুর্নীতি-অনিয়মকে তারা প্রশ্রয় দেন। সরকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিয়ে থাকে। এর পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু সরকারি কোষাগার থেকে তা পাওয়া যায় নিয়মিত। আর এই সুবিধার কারণে নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ-বাণিজ্য অসহনীয় পর্যায়ে পেঁৗছেছে বলে যে অভিযোগ তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। সাবেক শিক্ষার্থীরা নিজেদের অর্থে ভালো শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেবেন, কিন্তু এ নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি বাণিজ্য করতে চাইলে কেউ এগিয়ে আসতে চাইবে না। শিক্ষায় অ্যালামনাইদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চাইলে অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হবে ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যোগ্যদের নিয়ে আসা। কমিটির সভাপতি দলের লোক হতে হবে_ এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়াতে আগ্রহী সম্মানিত ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিয়ে আসা সম্ভব হলে সবাইকে বিনা বেতনে পড়ানোর লক্ষ্য অর্জন মোটেই কঠিন কাজ হবে না। 'ভূতে টাকা জোগায়' বলে একটি প্রবাদ রয়েছে বাংলা ভাষায়। প্রাক্তনীদেরও কিন্তু ভূত-ই বলা যায়। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে পরিচালিত হয় তাহলে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এমনটিই চাইবেন। তিনি নিজে যেভাবে তার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়ের একটি অংশ প্রদান করতে চাইছেন, তার দলের লাখ লাখ সদস্যও তাকে অনুসরণ করতে পারেন। এ নিয়ে প্রতিযোগিতা হলেই-বা ক্ষতি কী!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা এখন শ'খানেক। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সরকারি অর্থেই পরিচালিত হতো। যেমন : ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা বেড়েছে। অনেকের অভিযোগ, এগুলোর বেশির ভাগ শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছে। যত না পড়ায়, তার চেয়ে ঢের বেশি কামায়। তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ নিচ্ছে, কিন্তু সে তুলনায় শিক্ষার মান বাড়াতে অর্থ ব্যয় করছে না। তারা উচ্চমানের শিক্ষক নিয়োগ করে না, গবেষণাগার-পাঠাগারের পেছনে তেমন ব্যয় করে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ায় না, কারণ এ ধরনের বিষয়ের জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করা কষ্টকর হয়। তার চেয়ে বিবিএ বা কম্পিউটার সায়েন্স ঢের ঢের আকর্ষণীয়, পাস করলে চাকরি অনেকটা নিশ্চিত। মাঝে কয়েকটি বছর সরকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তেমন উদ্যোগী হয়নি। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ বিষয়টিতে নতুন করে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি নতুন ছাত্রাবাস উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী_ একটি ছাত্রদের, আরেকটি ছাত্রীদের। এ উপলক্ষে ভাষণে তিনি বলেছেন, 'আমি যে প্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া করে এলাম তার জন্য কী করলাম ভেবে দেখা উচিত। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই। মন্ত্রী হিসেবে যে বেতন-ভাতা পাই তার একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে চাই।' একটি অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেছেন, 'টাকা থাকলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকে অবৈতনিক করে দিতাম।'
তার এ মনোভাব প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রীর বেতন-ভাতার একটি অংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করার ঘোষণা নিয়ে সংবাদপত্র এবং বেতার-টেলিভিশনে আলোচনা হবে বলে আশা করেছিলাম। এ পদে যিনি থাকেন, তিনি অশেষ ক্ষমতাধর। চাইলে বেতন-ভাতার বাইরেও হাজারো সূত্রে উপার্জন হতে পারে। একজন সাবেক অর্থমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, 'অর্থমন্ত্রীর কারও কাছে কিছু চাইতে হয় না। অনেকেই অর্থের ডালা নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকেন। এর বিনিময়ে দিতে হয় সুবিধা।' প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে অন্যায় সুবিধা লেনদেন করাই যায়। বাংলাদেশে সরকারি পদে থেকে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি এক সমাজকর্মী ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তার অভিমত_ শহর-গ্রামের সর্বত্র কিছু লোকের মধ্যে একটি প্রবণতা প্রকট। যে কোনো মূল্যে দ্রুত ধনী হতে হবে এবং এ জন্য সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সরকারি সুবিধা কাজে লাগানো। মন্ত্রী-এমপি-সচিবদের পক্ষে সরকারি সুবিধা বিলানো অপেক্ষাকৃত সহজ এবং এর বিনিময়ও মেলে নগদ নগদ। রাতারাতি এ অবস্থার পরিবর্তন হবে, এমন আশা করি না। অনিয়মকে যখন অনেক লোক দোষের কিছু নয় বলে মনে করে তখন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পেঁৗছে যায় এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দরকার হয় সম্মিলিত প্রয়াসের। মন্ত্রী-এমপিদের উল্লেখযোগ্য অংশ দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত বলে এ ব্যবস্থার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যাবে না, এমন ধারণা ঠিক বলে মনে করি না। নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু করতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকে আমি মহৎ উদ্যোগ হিসেবেই গণ্য করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী দান করছেন বলে সবাইকে করতে হবে, এমন নয়। কিন্তু যাদের আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে এবং একই সঙ্গে রয়েছে শিক্ষার প্রতি দরদ তাদের অবশ্যই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আমার কাছে এক ব্যক্তি এসেছিলেন কয়েকজন 'অদম্য মেধাবীকে' আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে। আমার কাজ ছিল সমকালের জেলা-উপজেলা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ ধরনের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর নাম-পরিচয় তাকে দেওয়া। তবে তার একটি শর্ত ছিল_ কোনোক্রমেই তার নাম সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না। এটুকু বলতে পারি যে তার নামের একটি অংশ আশরাফ। এমন ব্যক্তি অনেক রয়েছেন সমাজে। আমার কাছেই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার সাবেক এক অধিবাসী এসেছিলেন একটি প্রস্তাব নিয়ে_ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রিশের দশকে অক্ষয় কুমার সেনশর্মা নামে এক কৃতী ছাত্র ছিলেন, যিনি মৃত্যুকালে রেখে যাওয়া ৫ লাখ টাকা তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করার জন্য রেখে গেছেন। আমাকে এ সংক্রান্ত ট্রাস্টের সদস্য করে তিনি সম্মানিত করেছেন। প্রসঙ্গত বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের অনেক বৃত্তি তহবিল রয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কন্যা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন সিতারা পারভিনের পরিবারের সদস্যরা চালু করেছেন ২০ লাখ টাকার একটি বৃত্তি তহবিল। প্রতি বছর অনার্স পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে এ তহবিল থেকে বৃত্তি দেওয়া হয়। জগন্নাথ হল অ্যালাইনাই অ্যাসোসিয়েশন জগন্নাথ হলের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। আমি নিজে দুটি স্কুলে বৃত্তি প্রদানের সঙ্গে জড়িত_ একটি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট বিদ্যালয়, অন্যটি বরিশালের গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। দেশের আরও শত শত প্রতিষ্ঠানে সাবেক শিক্ষার্থীর এ ধরনের বৃত্তি তহবিল চালু রয়েছে। আমার মনে হয়, সংগঠিত উদ্যোগ থাকলে আরও হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি চালু হতে পারে। বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করে দেওয়া কিংবা এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের দেশে বহু যুগ ধরে প্রচলিত। এখন সরকার থেকেই স্কুল-কলেজের ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়। স্কুলে স্কুলে বইও সরকার দেয় বিনামূল্যে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের রাজকোষ বাড়ন্ত হলে সব ছাত্রছাত্রীকে বিনা বেতনে পড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রতি সরকারকে অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা চাই। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের স্কুল-কলেজের শিক্ষক হিসেবে টেনে আনতে হলে অবশ্যই আকর্ষণীয় বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে চাই সাবেক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। তারা ব্যক্তিগত বা সংগঠিতভাবে এ উদ্যোগ নিতে পারেন। এমন হতে পারে যে একটি বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা ২-৩ জন শিক্ষকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করবেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক বাছাইয়ে তাদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সে জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন করা চাই। সাবেক শিক্ষার্থীরা যদি মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রী বা ছাত্রকে তারা শিক্ষক হিসেবে স্কুলে নিয়ে আসবেন এবং এ জন্য অর্থ ব্যয়ে কার্পণ্য করা হবে না_ সেটা করায় কোনো বাধা থাকা উচিত নয়। সাবেক শিক্ষার্থীরা এভাবে ছাত্রাবাস তৈরি করে দিতে পারেন। গবেষণাগার ও পাঠাগার-গ্রন্থাগার এবং কম্পিউটার ল্যাববেটরি আধুনিক করে দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা এ ধরনের উদ্যোগে সহায়ক হতে পারে। তবে এ জন্য আরেকটি শর্ত_ স্কুল ও কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতি আস্থা। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা কমিটি সম্পর্কে সাধারণ অভিযোগ_ তারা রাজনীতির লোক এবং এ স্বার্থকে বড় করে দেখেন। দুর্নীতি-অনিয়মকে তারা প্রশ্রয় দেন। সরকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিয়ে থাকে। এর পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু সরকারি কোষাগার থেকে তা পাওয়া যায় নিয়মিত। আর এই সুবিধার কারণে নতুন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ-বাণিজ্য অসহনীয় পর্যায়ে পেঁৗছেছে বলে যে অভিযোগ তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। সাবেক শিক্ষার্থীরা নিজেদের অর্থে ভালো শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেবেন, কিন্তু এ নিয়ে ম্যানেজিং কমিটি বাণিজ্য করতে চাইলে কেউ এগিয়ে আসতে চাইবে না। শিক্ষায় অ্যালামনাইদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চাইলে অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হবে ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যোগ্যদের নিয়ে আসা। কমিটির সভাপতি দলের লোক হতে হবে_ এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়াতে আগ্রহী সম্মানিত ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নিয়ে আসা সম্ভব হলে সবাইকে বিনা বেতনে পড়ানোর লক্ষ্য অর্জন মোটেই কঠিন কাজ হবে না। 'ভূতে টাকা জোগায়' বলে একটি প্রবাদ রয়েছে বাংলা ভাষায়। প্রাক্তনীদেরও কিন্তু ভূত-ই বলা যায়। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে পরিচালিত হয় তাহলে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রছাত্রীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এমনটিই চাইবেন। তিনি নিজে যেভাবে তার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য আয়ের একটি অংশ প্রদান করতে চাইছেন, তার দলের লাখ লাখ সদস্যও তাকে অনুসরণ করতে পারেন। এ নিয়ে প্রতিযোগিতা হলেই-বা ক্ষতি কী!
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments