জামায়াতের রাজনীতি- শঙ্কিত নই, তবে সতর্ক হতে হবে by শেখ হাফিজুর রহমান
সম্প্রতি সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব দেখা গেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, চাঁদপুর, সিলেট, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় দলটি বেপরোয়া ও সহিংস তৎপরতা চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এই ফ্যাসিস্ট দলের নেতা-কর্মীরা প্রতিটি জায়গায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন।
পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছেন। গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুলিশকে হত্যাচেষ্টার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতেও দ্বিধা করেননি দলটির নেতা-কর্মীরা। ১৩ নভেম্বর জামায়াত-শিবির হামলা চালায় আইনমন্ত্রীর গাড়িবহরে। এতে গুরুতর জখম হয়েছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। টিভির পর্দায় ‘জামায়াতি ভায়োলেন্স’ দেখে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, জামায়াত-শিবিরের যেসব নেতা-কর্মী সারা দেশে ‘তাণ্ডবলীলায়’ অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের মারকুটে ভঙ্গি, আক্রমণের ধরন ও লক্ষ্যবস্তু বলে দেয় যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ও নাশকতা চালানোর জন্যই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয় হচ্ছে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পুলিশ। তাঁরা লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করছেন এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পুলিশের মাথা। এটাকে জামায়াত-শিবিরের ‘স্পর্ধা’ বা ‘বেপরোয়া সাহস’ বলব, নাকি পুলিশের নপুংসকতাজনিত কাপুরুষতা বলব?
স্মরণ করতে চাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কথা। ওই দিন প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। পুলিশের অনেক সদস্য শহীদ হন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। সেই গৌরবের উত্তরাধিকারী পুলিশ বাহিনী কেন জামায়াত-শিবিরকে মোকাবিলা করতে পারছে না? তাহলে তাদের মধ্যেও কি জামায়াত-শিবির ঢুকে পড়েছে?
জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা হঠাৎ করে তাঁদের ভয়াল রূপে ঝলসে উঠলেন কেন? সম্ভাব্য কারণ দুটি। এক, বিএনপি আর জামায়াত-শিবিরের দায় নিতে চাইছে না। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার ভারত সফর এবং তৎপরবর্তী কর্মকাণ্ডে জামায়াতকে ‘ডিজওন’ করার পষ্টাপষ্টি ইঙ্গিত আছে। দুই, জামায়াত-শিবির বুঝতে পেরেছে যে তাদের ‘যুদ্ধাপরাধী নেতাদের’ শাস্তি আসন্ন। তাই জামায়াত-শিবিরের জন্য এটি অস্তিত্বের লড়াই এবং সে কারণেই তারা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
জামায়াতের গত কয়েক দিনের তাণ্ডব এবং পুলিশের ওপর অতর্কিত আক্রমণে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমি শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা কতটা জায়গা দখল করেছে? জনসমর্থনের বাটখারা দিয়ে যদি জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থানকে মূল্যায়ন করি, তা হলে গত চার-পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের খতিয়ান নিতে হবে। ওই খতিয়ান অনুযায়ী, তাদের দৌড় ওই পর্যন্তই যে তারা এককভাবে নির্বাচন করে নিজেদের শক্তিতে জাতীয় সংসদের এক থেকে পাঁচটি আসন লাভের সামর্থ্য রাখে। আর বিএনপির সঙ্গে যদি প্রকাশ্যে বা গোপনে আঁতাত হয়, তাহলে ১৮ থেকে ২০টি আসন লাভের ক্ষমতা তারা রাখে। তাদের জনসমর্থনের ভিত্তি হচ্ছে ‘ডানপন্থী মৌতাতের’ সম্মিলিত শক্তি। এ রকম ‘সিলেকটিভ’ জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে যাকে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়, তাকে নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ দেখি না। কেননা, ঐতিহাসিকভাবে জামায়াত জনদাবির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা যেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিল, তেমনি তারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠারও বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। একাত্তরে তারা ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধকালীন এসব অপরাধের জন্যই এখন জামায়াতের শীর্ষনেতাদের বিচার চলছে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদের রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। মন্ত্রিত্বে অভিষিক্ত করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেয় মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গাড়িতে। ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘোষকের’(!) দল কী করে এত বড় অন্যায় করল?
ঠিক এই জায়গাটিতে আমি শঙ্কিত। কেননা, জামায়াতের যে দুর্বল জনভিত্তি, একাত্তরের গণবিরোধী ভূমিকা, নানা জাতীয় ইস্যুতে আপসকামিতা, তাতে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক আগেই তাদের এক গুরুত্বহীন ‘ফুটনোট’ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিএনপি কোলে-ঘাড়ে তুলে জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতির ‘দুষ্টগ্রহ’ করে রেখেছে। একক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত নই। কেননা, একাত্তর ও তৎপরবর্তী ভূমিকার কারণে বাঙালি মাত্রই ‘জামায়াত-শিবির’, ‘রাজাকার’—এই শব্দগুলো অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করে। সুস্থ, শিক্ষিত ও গণতন্ত্রী বাঙালির কাছে ‘জামায়াত-শিবির’, ‘রাজাকারের’ স্থান নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কী শাস্তি হয় জানি না। তবে ইতিহাস ওদের বিচার করে দিয়েছে।
তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় জামায়াতকে নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ না থাকলেও তাদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্য ১০১টা কারণ রয়েছে। কয়েকটা কারণ উল্লেখ করতে চাই। এক, জামায়াত একটি দুষ্টগ্রহ হয়ে সমাজে নানা ‘ভাইরাস’ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই দল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে জঙ্গিবাদকে। দুই, শিক্ষিত তরুণদের একাংশের ‘মগজ ধোলাই’ করে তাদের দলীয় সন্ত্রাসে নামিয়ে দিচ্ছে। তিন, অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে আটটি খাতে জামায়াত বিনিয়োগ করেছে এবং বছরে আয় করছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে ব্যাংক-বিমা, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এনজিও, কোচিং সেন্টার, গণমাধ্যম, প্রকাশনা সংস্থা ও পরিবহন সেক্টরে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তারা কর্মী রিক্রুট করে। ওদিকে হাজার কোটি টাকার ‘ধর্মীয় অর্থনীতি’র মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিসহ নানা কর্মকাণ্ড। ‘মগজ ধোলাই’য়ের কার্যকর কারখানা এবং হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি থাকা সত্ত্বেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে জামায়াত কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। কোনো রকম শঙ্কা বা উৎকণ্ঠা নয়, ৩০ লাখ শহীদের কথা ভেবে সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি যদি একটু সাহসী আর সতর্ক হয়, তাহলেই তা সম্ভব।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছেন। গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুলিশকে হত্যাচেষ্টার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতেও দ্বিধা করেননি দলটির নেতা-কর্মীরা। ১৩ নভেম্বর জামায়াত-শিবির হামলা চালায় আইনমন্ত্রীর গাড়িবহরে। এতে গুরুতর জখম হয়েছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। টিভির পর্দায় ‘জামায়াতি ভায়োলেন্স’ দেখে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে, জামায়াত-শিবিরের যেসব নেতা-কর্মী সারা দেশে ‘তাণ্ডবলীলায়’ অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁদের মারকুটে ভঙ্গি, আক্রমণের ধরন ও লক্ষ্যবস্তু বলে দেয় যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ও নাশকতা চালানোর জন্যই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
লক্ষণীয় হচ্ছে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে পুলিশ। তাঁরা লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেল নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করছেন এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু পুলিশের মাথা। এটাকে জামায়াত-শিবিরের ‘স্পর্ধা’ বা ‘বেপরোয়া সাহস’ বলব, নাকি পুলিশের নপুংসকতাজনিত কাপুরুষতা বলব?
স্মরণ করতে চাই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কথা। ওই দিন প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। পুলিশের অনেক সদস্য শহীদ হন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। সেই গৌরবের উত্তরাধিকারী পুলিশ বাহিনী কেন জামায়াত-শিবিরকে মোকাবিলা করতে পারছে না? তাহলে তাদের মধ্যেও কি জামায়াত-শিবির ঢুকে পড়েছে?
জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা হঠাৎ করে তাঁদের ভয়াল রূপে ঝলসে উঠলেন কেন? সম্ভাব্য কারণ দুটি। এক, বিএনপি আর জামায়াত-শিবিরের দায় নিতে চাইছে না। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার ভারত সফর এবং তৎপরবর্তী কর্মকাণ্ডে জামায়াতকে ‘ডিজওন’ করার পষ্টাপষ্টি ইঙ্গিত আছে। দুই, জামায়াত-শিবির বুঝতে পেরেছে যে তাদের ‘যুদ্ধাপরাধী নেতাদের’ শাস্তি আসন্ন। তাই জামায়াত-শিবিরের জন্য এটি অস্তিত্বের লড়াই এবং সে কারণেই তারা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে।
জামায়াতের গত কয়েক দিনের তাণ্ডব এবং পুলিশের ওপর অতর্কিত আক্রমণে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আমি শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা কতটা জায়গা দখল করেছে? জনসমর্থনের বাটখারা দিয়ে যদি জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থানকে মূল্যায়ন করি, তা হলে গত চার-পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের খতিয়ান নিতে হবে। ওই খতিয়ান অনুযায়ী, তাদের দৌড় ওই পর্যন্তই যে তারা এককভাবে নির্বাচন করে নিজেদের শক্তিতে জাতীয় সংসদের এক থেকে পাঁচটি আসন লাভের সামর্থ্য রাখে। আর বিএনপির সঙ্গে যদি প্রকাশ্যে বা গোপনে আঁতাত হয়, তাহলে ১৮ থেকে ২০টি আসন লাভের ক্ষমতা তারা রাখে। তাদের জনসমর্থনের ভিত্তি হচ্ছে ‘ডানপন্থী মৌতাতের’ সম্মিলিত শক্তি। এ রকম ‘সিলেকটিভ’ জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে যাকে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হয়, তাকে নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ দেখি না। কেননা, ঐতিহাসিকভাবে জামায়াত জনদাবির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা যেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিল, তেমনি তারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠারও বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। একাত্তরে তারা ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, লুটতরাজ ও নারী নির্যাতনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধকালীন এসব অপরাধের জন্যই এখন জামায়াতের শীর্ষনেতাদের বিচার চলছে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াত তথা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদের রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। মন্ত্রিত্বে অভিষিক্ত করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেয় মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের গাড়িতে। ‘মুক্তিযুদ্ধের ঘোষকের’(!) দল কী করে এত বড় অন্যায় করল?
ঠিক এই জায়গাটিতে আমি শঙ্কিত। কেননা, জামায়াতের যে দুর্বল জনভিত্তি, একাত্তরের গণবিরোধী ভূমিকা, নানা জাতীয় ইস্যুতে আপসকামিতা, তাতে করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক আগেই তাদের এক গুরুত্বহীন ‘ফুটনোট’ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিএনপি কোলে-ঘাড়ে তুলে জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতির ‘দুষ্টগ্রহ’ করে রেখেছে। একক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত-শিবিরকে নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত নই। কেননা, একাত্তর ও তৎপরবর্তী ভূমিকার কারণে বাঙালি মাত্রই ‘জামায়াত-শিবির’, ‘রাজাকার’—এই শব্দগুলো অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করে। সুস্থ, শিক্ষিত ও গণতন্ত্রী বাঙালির কাছে ‘জামায়াত-শিবির’, ‘রাজাকারের’ স্থান নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কী শাস্তি হয় জানি না। তবে ইতিহাস ওদের বিচার করে দিয়েছে।
তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় জামায়াতকে নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ না থাকলেও তাদের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার জন্য ১০১টা কারণ রয়েছে। কয়েকটা কারণ উল্লেখ করতে চাই। এক, জামায়াত একটি দুষ্টগ্রহ হয়ে সমাজে নানা ‘ভাইরাস’ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই দল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে জঙ্গিবাদকে। দুই, শিক্ষিত তরুণদের একাংশের ‘মগজ ধোলাই’ করে তাদের দলীয় সন্ত্রাসে নামিয়ে দিচ্ছে। তিন, অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে আটটি খাতে জামায়াত বিনিয়োগ করেছে এবং বছরে আয় করছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে তাদের ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে ব্যাংক-বিমা, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এনজিও, কোচিং সেন্টার, গণমাধ্যম, প্রকাশনা সংস্থা ও পরিবহন সেক্টরে। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তারা কর্মী রিক্রুট করে। ওদিকে হাজার কোটি টাকার ‘ধর্মীয় অর্থনীতি’র মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিসহ নানা কর্মকাণ্ড। ‘মগজ ধোলাই’য়ের কার্যকর কারখানা এবং হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি থাকা সত্ত্বেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে জামায়াত কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। কোনো রকম শঙ্কা বা উৎকণ্ঠা নয়, ৩০ লাখ শহীদের কথা ভেবে সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি যদি একটু সাহসী আর সতর্ক হয়, তাহলেই তা সম্ভব।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments