ফসলের ন্যায্যমূল্য-কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করুন
কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না_ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এই সরল স্বীকারোক্তি কৃষকের জীবনের করুণ অধ্যায়কে অতীতের বিষয়ে পরিণত করবে কি-না, সেটা বলার সময় আসেনি। চার দশকে লোকসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
এই সময়ে চাষাবাদের জমির পরিমাণ কমলেও মাথাপিছু খাদ্যের জোগান বেড়েছে। শুধু তাই নয়, দশকের পর দশক ধরে পরনির্ভর দেশটি এখন খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমনকি আসন্ন আমন মৌসুমে বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা সামনে রেখে চাল রফতানির বিষয়টিও গভীরভাবে বিবেচনাধীন। তাহলে কৃষক কেন ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন? কৃষি খাতে সাম্প্রতিক অগ্রগতির কৃতিত্ব কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে প্রদানে কার্পণ্য করার মতো লোক কম। তিনি বরাবর কৃষক, ভোক্তা ও খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন।
কৃষকের উৎপাদন ব্যয় যাতে কম থাকে, সে জন্য সরকার চাষাবাদের উপকরণ, যেমন ভালো মানের বীজ, সেচের পানি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সময়মতো ও ন্যায্য দামে সরবরাহ বহুলাংশে নিশ্চিত করেছে। তারপরও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদন করা ফসলের ন্যায্যমূল্য কৃষক পাচ্ছেন না। সবাই মুক্তকণ্ঠে কৃষকের অবদান স্বীকার করেন। তাদের জাতীয় বীর হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ধান-চাল এবং শাক-সবজিসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্যের বাজারমূল্যে দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়ে কৃষকের স্বার্থই সবচেয়ে উপেক্ষিত। তাদের সাফল্য ছিনিয়ে নিয়ে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের সম্পদ বাড়ান।
আসন্ন আমন মৌসুমে ফের বাম্পার ফলন এনে দেবেন কৃষক ও ক্ষেতমজুররা_ এমনই আভাস। অথচ এখনই ধান-চালের দর কৃষকের প্রত্যাশার তুলনায় কম এবং নতুন ফসল উঠলে দাম আরও কমে যেতে পারে বলে শঙ্কা। শনিবার যে দ্বিতীয় হাওর জাতীয় সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কৃষকের মন্দ কপালের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন, সেই অনুষ্ঠানেই জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং শস্যভাণ্ডার হিসেবে স্বীকৃত হাওর অঞ্চলের জনপ্রিয় নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ধান ছাড়া হাওরের মানুষের কিছু নেই। তাদের এ ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা চাই। হাওরের অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার প্রতিও তিনি অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করা চলে না। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের বাজারে বিক্রয়ের মতো ধান-চাল-সবজি উৎপাদন যত কৃষক করছেন, তার চেয়ে ভোক্তা বা ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। দাম কম থাকলে ক্রেতার সন্তুষ্টি_ এটাই স্বাভাবিক। সরকারেরও তাতে সুবিধা। কিন্তু এভাবে চললে শুধু কৃষকের সর্বনাশ নয়, সার্বিকভাবে অর্থনীতিরও ক্ষতি। ফসলের উপযুক্ত মূল্য পেলে কৃষকরা নতুন বিনিয়োগে প্রণোদনা পান এবং শিল্পপণ্য কেনার মতো নগদ অর্থও তাদের হাতে আসে। ক্রমাগত ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা যদি ধানের মতো ফসলের চাষ থেকে ক্রমে সরে এসে বেশি লাভ মেলে এমন ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। এমন শঙ্কাও করা হচ্ছে যে, ধান উৎপাদন কমে গেলে বাংলাদেশ ফের খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত হবে। এখন আমরা দেশের কৃষককে যে চালের জন্য প্রতি কেজিতে ৩০-৩২ টাকা দিতে চাই না, সেই চাল তখন ৩৮-৪০ টাকায় আমদানি করতে হবে। এমন সর্বনাশা পরিস্থিতি কেউ চায় না। দেশের প্রবৃদ্ধির হার যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। এ অবস্থায় কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আরও কিছু পদক্ষেপের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে।
No comments