মত ও মন্তব্য-কতটা টেকসই হবে খালেদা জিয়ার নতুন ভারতনীতি? by হারুন হাবীব

খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফরকে নানা মাত্রায় দেখার সুযোগ আছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বিরোধীরা অনেকেই এ সফরকে আগামী নির্বাচনে তাঁদের ক্ষমতায় আসার অন্যতম 'শত পূরণ' হিসেবে দেখছেন। সফরটি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
এমনকি একই মাত্রায় দেখছেন না রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও।
আলোচিত সফরটি ঘটেছে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বিরোধীদলীয় নেতা সুষমা স্বরাজ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, বিজেপি সভাপতি নীতিন গড়করী ও লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে খালেদা জিয়া বৈঠক করেছেন। কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে অবশ্য তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি।
২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও খালেদা জিয়া দিলি্ল সফর করেছিলেন। সে সফর খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এবারের সফরটি (২৮ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২০১২) দুই দেশের গণমাধ্যমের কাছেও সবিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে। নতুন দিলি্লতে যাওয়ার মাত্র সাত দিন আগে খালেদা জিয়া বেইজিং সফর শেষ করেছেন। সেদিক থেকেও সফরটির গুরুত্ব আছে।
কয়েক মাস আগে ভারতীয় গণমাধ্যমের একটি রিপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে লেখালেখি হয়েছিল। এতে ছিল, শেখ হাসিনা সরকারের জনপ্রিয়তা কমনোর প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে খবরটিতে এ আশঙ্কাও ছিল যে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশে আবারও জঙ্গি উত্থান ঘটবে, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নতুন তৎপরতা চলবে; কাজেই ভারত উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের মন থেকে এ রকম আশঙ্কা দূর করতেই খালেদা জিয়া নতুন দিলি্লকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীকে তিনি বা তাঁর দল বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবেন না। ভারতের স্বার্থ বিঘি্নত হয় এমন কিছু করবেন না।
কয়েক যুগের অভিজ্ঞতায় এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে বিএনপির রাজনীতি মূলত দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। প্রথমটি চরম আওয়ামী লীগ বিরোধিতা, দ্বিতীয়টি চরম ভারত-বিরোধিতা। এই রাজনৈতিক মূলধনগুলো ব্যবহার করতে তারা একটিবারের জন্য পিছপা হয়েছে_এমনটা দেখা যায়নি। এমনকি ২০১০ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শেখ হাসিনা ও ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে দুই পড়শি দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে ঐতিহাসিক ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তাকেও খালেদা জিয়া ও তাঁর মৌলবাদী দোসররা ক্রমেই 'ভারতের স্বার্থরক্ষা' বা বিদেশের কাছে 'দেশ বিক্রি' বলে নির্বিচারে আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে আওয়ামী লীগকে ভারতের তাঁবেদাররূপে প্রচার করা তাদের রাজনৈতিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে তারা এভাবেই বিভ্রান্ত করেছে। বলাই বাহুল্য, জিয়াউর রহমান থেকে শুরু হয়ে খালেদা জিয়ার হাতে ভারত-বিরোধিতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
কাজেই সেই খালেদা জিয়া যখন ভারত সরকারের আমন্ত্রণে নতুন দিলি্ল সফর করেন এবং তাঁদের দীর্ঘ লালিত নীতি পরিবর্তনের কথা শোনান, তখন স্বাভাবিকভাবেই নানা মহলে কথা উঠবে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে, বিএনপির নেত্রী কি তাঁর দীর্ঘকালীন ভারতবিরোধী নীতি পরিবর্তন করতে যাচ্ছেন, নাকি আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে সুবিধাবাদী কৌশল নিতে মনস্থ করেছেন?
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এ সম্পর্কের স্থায়িত্ব দান করেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। কাজেই ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে বিএনপি 'ভারতবিরোধী' নীতির চর্চা করে আসছে, সে কেন চিরাচরিত খোলস পাল্টে হঠাৎ ভারতমুখী হতে যাচ্ছে- সেটিও অনেকে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন।
যে খালেদা জিয়া ভারত-বিরোধিতা মুখে নিয়ে প্রায় তিন যুগ রাজনীতির মাঠে বিচরণ করছেন এবং যা তাঁর রাজনৈতিক পুঁজি, সেই পুঁজি তিনি হারাবেন- এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। তবে রাজনীতিতে নাকি শেষকথা বলে কিছু নেই। কাজেই অনেকে এও ভাবছেন যে নিছক কৌশলগত কারণেই বিএনপি নেত্রীকে ভারতে গিয়ে নানা কথা বলতে হয়েছে, যা আসলে তাঁর মনের কথা হওয়ার সুযোগ নেই।
অবশ্য কেউ কেউ আবার ২০০৬ সালের কথা মনে করতে চেষ্টা করছেন। তখনকার জোট সরকারের শেষ দিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। আজকের প্রেক্ষাপটে হয়তো সে কারণেই খালেদার ভারত সফরকে অনেকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের কাছে ভারত নিরাপত্তা প্রশ্নে গ্যারান্টি চায়। ট্রানজিট সুবিধা চায়। চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দর ব্যবহার করতে চায়। শেখ হাসিনার সরকার এসব চাহিদা পূরণে শুধু অঙ্গীকারবদ্ধই নয়, তারা তা বাস্তবায়ন করে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে বিএনপি ও তার রাজনৈতিক মিত্ররা এসব প্রশ্নে চরম বিরোধী ভূমিকা পালন করে আসছে। কোনো শত্রু কখনো মিত্র হবে না তা ভাবা ঠিক নয়। ইউরোপ প্রমাণ করেছে, শত যুদ্ধবিগ্রহের পরও একে অন্যের মিত্র হওয়া সম্ভব। কাজেই পারস্পরিক বন্ধুত্বের সুবাতাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেই বা কেন বইবে না? কিন্তু চিরন্তন ভারতবৈরী খালেদা জিয়া রাতারাতি ভারতমুখী হয়েছেন- যাঁরা এমনটা ভাবেন, তাঁদের সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না বলে দুঃখিত।
জানা গেছে, ভারত সফরে সীমান্ত সমস্যা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি প্রসঙ্গে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়া কথা বলেছেন। তিনি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ভারতকেও অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী নন। দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলাপ-আলোচনার আগে গণতান্ত্রিক রীতিতেই সরকারের সঙ্গে তাঁর পরামর্শ করা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সে রীতি রক্ষা করা হয়নি। যেকোনো দেশেই মৌলিক পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দল পরামর্শ করে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে সে রীতির চর্চা নেই।
মনে রাখা উচিত, বিএনপির পরীক্ষিত রাজনৈতিক মিত্র ধর্মীয় জঙ্গি, মৌলবাদী ও রাজনৈতিক ইসলামবাদীরা, যাদের বেশির ভাগের শিকড় বাংলাদেশের বাইরে। কাজেই দলটির পক্ষে রাতারাতি ভারতকে গ্রহণ করার সুযোগ কম। সে কারণে খালেদার 'পেছন ছেড়ে সামনে তাকানোর' যে প্রতিশ্রুতি, তার বাস্তবায়নে আমি খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখি না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.