নিত্যজাতম্-ইরাবতীর তীরে আজ নয়া উৎসব by মহসীন হাবিব
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বার্মা বা মিয়ানমার দেখে রুডিয়ার্ড কিপলিং বলেছিলেন, quite unlike any land you know about. সেই সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যের দেশের জলকন্যা ইরাবতী, সালোয়ান বা কুমন বামের জল আজ আবার নেচে উঠবে, পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে থাকা প্যাগোডার গায়ে লাগবে নতুন দিনের রোদ।
কারণ আর কিছুই নয়, দীর্ঘ স্থবিরতার পর গণতন্ত্র, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাকস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির ডালি সাজিয়ে আজ বার্মায় এসে নামবেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিশম্যাটিক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বার্মা-ই বললাম। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুধু যে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল তা-ই নয়, কী নামে ডাকা হবে তা নিয়েও ছিল মন-কষাকষি। এখন থেকে ২৩ বছর আগে বার্মার সামরিক জান্তা দেশটির নাম পাল্টে রেখেছিলেন মিয়ানমার। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রবক্তারা সে নাম পরিবর্তন মেনে নেননি। জনগণের সঙ্গে আলোচনা না করে, গায়ের জোরে সামরিক সরকার নাম পরিবর্তন করায় তা এতকাল ধরে মেনে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত কাগজে-কলমেও এ দেশগুলো বার্মা নাম ব্যবহার করে এসেছে। একগুঁয়েমিতে মিয়ানমারের হর্তা-কর্তারাও কম যাননি। কেউ বার্মা ডাকলেই তাঁদের গা জ্বলে উঠত। এই তো মাত্র গত বছরই সামরিক সরকার বিরোধীদলীয় নেতা অং সান সু চিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। তিনি বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের নাম বার্মা বলায় তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের নাম রিপাবলিক অব দি ইউনিয়ন অব মিয়ানমার। সংবিধানের বাইরে বার্মা ডাকা চলবে না। সু চি উত্তরে বলেছিলেন, যেকোনো নামে ডাকা আমার ব্যক্তিগত অধিকার। গত বছর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যখন মিয়ানমার সফর করেন, তখন তিনি কোনো নাম উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করেছেন। শুধু বারবার 'এই দেশটি' উচ্চারণ করেছেন। দেখা যাক না, আজ ওবামা কী করেন।
আজ তিনি যে নামেই ডাকুন না কেন, দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও বার্মার মধ্যে উষ্ণতা। এই এক বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কখনো দেশটিকে মিয়ানমার বলছেন, কখনো বা বার্মা বলছেন। এ নিয়ে আপত্তি নেই এখন মিয়ানমারের বা মিয়ানমারের সামরিক মদদপুষ্ট প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনেরও। এটাই প্রমাণ করে, সম্পর্ক উষ্ণ হলে ছোটখাটো ভুলত্রুটি আর ধর্তব্য নয়।
ঝগড়া-ঝাঁটি, মান-অভিমানের সেই দিনগুলো অতি দ্রুতই শেষ হয়েছে। তাই আজ বন্ধুত্বের আলিঙ্গন করতে ছুটে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের মিয়ানমার সফর এটি।
দিন এক রকম যায় না। মাত্র কয়েক বছর আগে, ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মিয়ানমারের তিক্ত সম্পর্ক এমন চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছিল যে দেশটির সামরিক কর্তারা ধারণা করলেন, রাজধানী ইয়াঙ্গুন সমুদ্রের থেকে কাছে, আমেরিকা যখন-তখন মিয়ানমার আক্রমণ করতে পারে। তাই হঠাৎ করে গভীর রাতে ইয়াঙ্গুন থেকে রাজধানী সরিয়ে নেপিডো নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। পশ্চিমের দেশগুলো স্যাটেলাইট থেকে এ কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সারি সারি ট্রাকবোঝাই সামরিক সরঞ্জাম, কাগজপত্র নিয়ে কোথায় চলছে সরকার! প্রায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কী, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলো প্রথম কয়েক ঘণ্টা বিপাকে পড়ল। অবশেষে জানা গেল, ইয়াঙ্গুন কর্তৃপক্ষ রাজধানী সরিয়ে নিচ্ছে। মিয়ানমারের সংস্কৃতিতে গনকের প্রতি বিশ্বাস খুবই দৃঢ়। অনেকে বলেন, গণক তখনকার সামরিক জান্তাকে নিকট-ভবিষ্যৎ গণনা করে বিপদের কথা বলেছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজধানী সরিয়ে নেপিডো নিয়ে যেতে। 'গুরুবাক্য' শিরোধার্য করেছিল বার্মার সরকার।
কিন্তু কোনো গণকই আজকের দিনের কথা বলতে পারেননি। ২০০৫ সালে গণকদের জানা ছিল না, মাত্র ছয়-সাত বছরে সম্পর্কে এমন আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠবে বার্মার নতুন আশা-ভরসা। ঘটনাক্রমেই আজকের এ পরিবর্তন। বেশ কিছুকাল ধরেই গণচীনের মিয়ানমারনীতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। একদিকে চীন মিয়ানমার সরকারের উন্নয়ন সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিভাবকত্ব করে এসেছে, একদিকে বিশাল চীনের বাজার তৈরি হয়েছে ছয় কোটি মানুষের এই দেশে, অন্যদিকে ৯টি বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে বেশ কয়েকটিকে তলে তলে অস্ত্র সরবরাহ করেছে চীন। বিশেষ করে চীনের অবসরগ্রহণকারী উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা সে কাজটি করেছেন। চীনের ইউনান প্রদেশে রয়েছে তাঁদের অস্ত্র কারখানা ও ব্যবসা। সেই অস্ত্র বিক্রির স্বার্থে ও কট্টর সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যে চীনের এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ভালো চোখে দেখেনি। ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় গেলে মিয়ানমারের সামরিক মদদপুষ্ট সরকার থেইন সেইনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। তিনি আগে থেইে সংস্কারপন্থী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। সাবেক এই সেনা কমান্ডারকে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট করা হয়। বার্মার রাজনীতিতে সরাসরি পরিবর্তন আসতে থাকে থেইন সেইনের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের সময় দেশের অসহায়ত্ব দেখে থেইন সেইন ও তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি ডেসপারেট চিন্তা কাজ করতে শুরু করে। ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল যুক্তরাষ্ট্র হয়তো। প্রথমে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং পরে সরকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে গত বছর হিলারি ক্লিনটন বার্মা সফর করেন। এবার খোদ ওবামা।
মনে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার কথা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার অর্থনীতিতে মুহূর্তের মধ্যে পশ্চিমা হাওয়া লেগেছিল। অবাক হয়ে রাশিয়ার মানুষরা লাল-নীল ও চকমকে-ঝকঝকে পশ্চিমা পণ্য দেখতে ও ব্যবহার করতে শুরু করে। ঠিক সেই অবস্থাই যেন তৈরি হচ্ছে আজকের মিয়ানমারে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতগুলো দ্রুতই ঢিলে করে দেওয়া হচ্ছে। গত বছর এই সময়ে একটি মোবাইল সিম কার্ডের মূল্য ছিল বার্মায় বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০ হাজার টাকা। এ বছর তার দাম কমে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। দীর্ঘদিনের পুরনো গাড়িগুলোর জায়গা দখল করতে শুরু করেছে নতুন নতুন বিদেশি গাড়ি। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের জনগণ কথা বলতে শুরু করেছে। ওবামার সফরকে সম্মান জানিয়ে প্রায় পাঁচ শ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে বার্মার নরম হয়ে আসা সামরিক সরকার। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ওবামার সফরের পর এ পালে আরো জোরে হাওয়া লাগতে শুরু করবে।
ওবামা বেশি সময় থাকবেন না। তিনি থাইল্যান্ড থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ইয়াঙ্গুন আসবেন। সেখান থেকে যাবেন কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সবার নজর ও গুরুত্ব এই সংক্ষিপ্ত বার্মা সফরের দিকে। কারণ এটাই সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ : একটু নিজেদের স্বার্থের কথা না বললেই নয়। ওবামার উৎসবমুখর সফরের পর রোহিঙ্গা সমস্যা কতটা দূর হবে, তা বলা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের জনসংখ্যার মাত্র ০.১৫ ভাগ এই মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে আজ বাংলাদেশ বিপাকে পড়েছে। তবে ওবামার সফর সামনে রেখে বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে তুলে ধরে আশা ব্যক্ত করেছে, ওবামা হয়তো সমস্যাটি নিয়ে সমাধানের জন্য আলোচনা করবেন। দ্বিতীয়ত, ওবামার সফরের মধ্য দিয়ে বার্মার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে। বার্মা একটি গার্মেন্ট উৎপাদনকারী দেশ। ২০১১ সালে বার্মা ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট রপ্তানি করেছে। ইয়াঙ্গুনেই রয়েছে প্রায় ২০০ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির দেশ। স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্র আসছে বছরই বার্মাকে যে গার্মেন্ট রপ্তানি সুবিধা দিতে চাইবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে ব্যবসায়ী মহল ও সরকারকে তীব্র নজর রাখতে হবে। সেই সঙ্গে বার্মার নতুন বাজার ধরার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এগিয়ে যেতে হবে। বার্মায় সব বিষয়ে কমপিটিশন করা যাবে না। শুধু বুঝে উঠতে হবে, বাংলাদেশের জন্য কোন কোন পণ্য নিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
কারণ আর কিছুই নয়, দীর্ঘ স্থবিরতার পর গণতন্ত্র, মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাকস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির ডালি সাজিয়ে আজ বার্মায় এসে নামবেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারিশম্যাটিক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বার্মা-ই বললাম। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শুধু যে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল তা-ই নয়, কী নামে ডাকা হবে তা নিয়েও ছিল মন-কষাকষি। এখন থেকে ২৩ বছর আগে বার্মার সামরিক জান্তা দেশটির নাম পাল্টে রেখেছিলেন মিয়ানমার। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রবক্তারা সে নাম পরিবর্তন মেনে নেননি। জনগণের সঙ্গে আলোচনা না করে, গায়ের জোরে সামরিক সরকার নাম পরিবর্তন করায় তা এতকাল ধরে মেনে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড। রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত কাগজে-কলমেও এ দেশগুলো বার্মা নাম ব্যবহার করে এসেছে। একগুঁয়েমিতে মিয়ানমারের হর্তা-কর্তারাও কম যাননি। কেউ বার্মা ডাকলেই তাঁদের গা জ্বলে উঠত। এই তো মাত্র গত বছরই সামরিক সরকার বিরোধীদলীয় নেতা অং সান সু চিকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। তিনি বিদেশ সফরে গিয়ে দেশের নাম বার্মা বলায় তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের নাম রিপাবলিক অব দি ইউনিয়ন অব মিয়ানমার। সংবিধানের বাইরে বার্মা ডাকা চলবে না। সু চি উত্তরে বলেছিলেন, যেকোনো নামে ডাকা আমার ব্যক্তিগত অধিকার। গত বছর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যখন মিয়ানমার সফর করেন, তখন তিনি কোনো নাম উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করেছেন। শুধু বারবার 'এই দেশটি' উচ্চারণ করেছেন। দেখা যাক না, আজ ওবামা কী করেন।
আজ তিনি যে নামেই ডাকুন না কেন, দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও বার্মার মধ্যে উষ্ণতা। এই এক বছরের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কখনো দেশটিকে মিয়ানমার বলছেন, কখনো বা বার্মা বলছেন। এ নিয়ে আপত্তি নেই এখন মিয়ানমারের বা মিয়ানমারের সামরিক মদদপুষ্ট প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনেরও। এটাই প্রমাণ করে, সম্পর্ক উষ্ণ হলে ছোটখাটো ভুলত্রুটি আর ধর্তব্য নয়।
ঝগড়া-ঝাঁটি, মান-অভিমানের সেই দিনগুলো অতি দ্রুতই শেষ হয়েছে। তাই আজ বন্ধুত্বের আলিঙ্গন করতে ছুটে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের মিয়ানমার সফর এটি।
দিন এক রকম যায় না। মাত্র কয়েক বছর আগে, ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মিয়ানমারের তিক্ত সম্পর্ক এমন চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছিল যে দেশটির সামরিক কর্তারা ধারণা করলেন, রাজধানী ইয়াঙ্গুন সমুদ্রের থেকে কাছে, আমেরিকা যখন-তখন মিয়ানমার আক্রমণ করতে পারে। তাই হঠাৎ করে গভীর রাতে ইয়াঙ্গুন থেকে রাজধানী সরিয়ে নেপিডো নিয়ে যাওয়া শুরু হলো। পশ্চিমের দেশগুলো স্যাটেলাইট থেকে এ কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সারি সারি ট্রাকবোঝাই সামরিক সরঞ্জাম, কাগজপত্র নিয়ে কোথায় চলছে সরকার! প্রায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কী, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলো প্রথম কয়েক ঘণ্টা বিপাকে পড়ল। অবশেষে জানা গেল, ইয়াঙ্গুন কর্তৃপক্ষ রাজধানী সরিয়ে নিচ্ছে। মিয়ানমারের সংস্কৃতিতে গনকের প্রতি বিশ্বাস খুবই দৃঢ়। অনেকে বলেন, গণক তখনকার সামরিক জান্তাকে নিকট-ভবিষ্যৎ গণনা করে বিপদের কথা বলেছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন রাজধানী সরিয়ে নেপিডো নিয়ে যেতে। 'গুরুবাক্য' শিরোধার্য করেছিল বার্মার সরকার।
কিন্তু কোনো গণকই আজকের দিনের কথা বলতে পারেননি। ২০০৫ সালে গণকদের জানা ছিল না, মাত্র ছয়-সাত বছরে সম্পর্কে এমন আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠবে বার্মার নতুন আশা-ভরসা। ঘটনাক্রমেই আজকের এ পরিবর্তন। বেশ কিছুকাল ধরেই গণচীনের মিয়ানমারনীতিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিল। একদিকে চীন মিয়ানমার সরকারের উন্নয়ন সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভিভাবকত্ব করে এসেছে, একদিকে বিশাল চীনের বাজার তৈরি হয়েছে ছয় কোটি মানুষের এই দেশে, অন্যদিকে ৯টি বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে বেশ কয়েকটিকে তলে তলে অস্ত্র সরবরাহ করেছে চীন। বিশেষ করে চীনের অবসরগ্রহণকারী উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা সে কাজটি করেছেন। চীনের ইউনান প্রদেশে রয়েছে তাঁদের অস্ত্র কারখানা ও ব্যবসা। সেই অস্ত্র বিক্রির স্বার্থে ও কট্টর সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে জিইয়ে রাখার উদ্দেশ্যে চীনের এই ইঁদুর-বিড়াল খেলা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ভালো চোখে দেখেনি। ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় গেলে মিয়ানমারের সামরিক মদদপুষ্ট সরকার থেইন সেইনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে। তিনি আগে থেইে সংস্কারপন্থী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। সাবেক এই সেনা কমান্ডারকে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট করা হয়। বার্মার রাজনীতিতে সরাসরি পরিবর্তন আসতে থাকে থেইন সেইনের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের সময় দেশের অসহায়ত্ব দেখে থেইন সেইন ও তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি ডেসপারেট চিন্তা কাজ করতে শুরু করে। ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল যুক্তরাষ্ট্র হয়তো। প্রথমে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং পরে সরকারের সঙ্গে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে গত বছর হিলারি ক্লিনটন বার্মা সফর করেন। এবার খোদ ওবামা।
মনে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার কথা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার অর্থনীতিতে মুহূর্তের মধ্যে পশ্চিমা হাওয়া লেগেছিল। অবাক হয়ে রাশিয়ার মানুষরা লাল-নীল ও চকমকে-ঝকঝকে পশ্চিমা পণ্য দেখতে ও ব্যবহার করতে শুরু করে। ঠিক সেই অবস্থাই যেন তৈরি হচ্ছে আজকের মিয়ানমারে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতগুলো দ্রুতই ঢিলে করে দেওয়া হচ্ছে। গত বছর এই সময়ে একটি মোবাইল সিম কার্ডের মূল্য ছিল বার্মায় বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০ হাজার টাকা। এ বছর তার দাম কমে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। দীর্ঘদিনের পুরনো গাড়িগুলোর জায়গা দখল করতে শুরু করেছে নতুন নতুন বিদেশি গাড়ি। তার চেয়েও বড় কথা, দেশের জনগণ কথা বলতে শুরু করেছে। ওবামার সফরকে সম্মান জানিয়ে প্রায় পাঁচ শ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে বার্মার নরম হয়ে আসা সামরিক সরকার। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ওবামার সফরের পর এ পালে আরো জোরে হাওয়া লাগতে শুরু করবে।
ওবামা বেশি সময় থাকবেন না। তিনি থাইল্যান্ড থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ইয়াঙ্গুন আসবেন। সেখান থেকে যাবেন কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সবার নজর ও গুরুত্ব এই সংক্ষিপ্ত বার্মা সফরের দিকে। কারণ এটাই সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ : একটু নিজেদের স্বার্থের কথা না বললেই নয়। ওবামার উৎসবমুখর সফরের পর রোহিঙ্গা সমস্যা কতটা দূর হবে, তা বলা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের জনসংখ্যার মাত্র ০.১৫ ভাগ এই মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে আজ বাংলাদেশ বিপাকে পড়েছে। তবে ওবামার সফর সামনে রেখে বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে তুলে ধরে আশা ব্যক্ত করেছে, ওবামা হয়তো সমস্যাটি নিয়ে সমাধানের জন্য আলোচনা করবেন। দ্বিতীয়ত, ওবামার সফরের মধ্য দিয়ে বার্মার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে। বার্মা একটি গার্মেন্ট উৎপাদনকারী দেশ। ২০১১ সালে বার্মা ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট রপ্তানি করেছে। ইয়াঙ্গুনেই রয়েছে প্রায় ২০০ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির দেশ। স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্র আসছে বছরই বার্মাকে যে গার্মেন্ট রপ্তানি সুবিধা দিতে চাইবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে ব্যবসায়ী মহল ও সরকারকে তীব্র নজর রাখতে হবে। সেই সঙ্গে বার্মার নতুন বাজার ধরার জন্য সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এগিয়ে যেতে হবে। বার্মায় সব বিষয়ে কমপিটিশন করা যাবে না। শুধু বুঝে উঠতে হবে, বাংলাদেশের জন্য কোন কোন পণ্য নিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments