আগুন কেড়ে নিল ১১ প্রাণ
ভোররাতের আঁধারে আগুনের লেলিহান শিখা কেড়ে নিয়েছে ১১ প্রাণ। ভস্মীভূত হয়েছে বাঁশ ও কাঠের তৈরি প্রায় ৬০০ ঘর। গতকাল রবিবার ভোরের আগে আগে আকস্মিক এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর হাজারীবাগের বৌবাজার বস্তিতে।
ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী জানিয়েছে, রাত পৌনে ৩টার দিকে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট তা নিয়ন্ত্রণে আনে প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর। সিগারেট বা মশার কয়েল থেকে আগুনের সূত্রপাত্র হতে পারে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিডি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নঈম মো. শহীদুল্লাহ।ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার নির্দেশ দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এ ঘটনায় দুঃখ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি আহতদের সুচিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের দাবি জানান।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ছয়জন নারী ও পাঁচটি শিশু রয়েছে। নিহতরা হলেন সখিনা বেগম (৬০) ও তাঁর নাতনি ময়না (১৩); হেলেনা বেগম (৪৫), তাঁর মেয়ে আকলিমা (৯) ও নাতি শাকিব (৪); মুন্নী বেগম (২৫) ও তাঁর মেয়ে মীম (৩); আয়েশা ওরফে সুরাইয়া বেগম (২২) ও তাঁর মেয়ে জুলি (৭) এবং আনোয়ারা বেগম (৬০) ও মো. আবদুল্লাহ আহাদ (৫)।
এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে চারজনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন পাশের সিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
আগুনে প্রাণহানির সংবাদে সকাল থেকেই ঘটনাস্থলে আশপাশের কয়েক হাজার মানুষের ভিড় জমে যায়। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
হাজারীবাগ বেড়িবাঁধসংলগ্ন বৌবাজার এলাকায় গিয়ে গতকাল সকালে দেখা যায় ধোঁয়া আর ধ্বংসস্তূপের মাঝেই চলছে লাশের সন্ধান। রাস্তার পাশে নিচু জায়গায় গড়ে ওঠা বস্তিতে ভোররাতে আগুন লাগায় তখনো কেউ বুঝতে পারছে না প্রকৃতপক্ষে হতাহতের সংখ্যা কত। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘুমন্ত মানুষের মধ্যে কে কে রক্ষা পেয়েছে, তা নিয়ে চলছে অনুসন্ধান। একসময় গৃহবধূদের জন্য চালু হওয়া বাজারের জন্য 'বৌবাজার' বস্তি হিসেবে পরিচিত স্থানটিতে ছিল বাঁশ, কাঠ ও বেড়া দিয়ে তৈরি দোতলা বাড়িও। আশপাশে কয়েকটি বহুতল পাকা ভবন থাকলেও সেখানে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। শুধু আগুনের উত্তাপ ও ধোঁয়ায় বাইরে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। বেড়ার তৈরি বস্তিঘরগুলোর অস্তিত্ব এখন আর কিছুই নেই। সব পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে বস্তির বাসিন্দা আবুল কালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আনুমানিক রাত ৩টার দিকে তাজুর বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তেই আশপাশের ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
পুলিশের উপকমিশনার নুরুল আলম বলেন, বস্তির এক কোনায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ইটের তৈরি একটি দোতলা দালান ও টিনের তৈরি কয়েকটি দোতলা ঘর নিয়ে দেয়ালঘেরা একটি ছোট কম্পাউন্ড রয়েছে, যাকে এলাকার লোকজন শামসু প্রফেসরের বস্তি বলে চেনে। দোতলা দালানের নিচতলার বাথরুমের ভেতরেই পাওয়া গেছে আটটি লাশ।
আলোচিত শামসু প্রফেসরের বস্তি প্রসঙ্গে জানা যায়, সেখানে পাঁচ কাঠা জমির ওপর একটি দোতলা বাড়ি বানানো হয়েছে। তাতে থাকার কোনো ঘর নেই। আছে রান্নাঘর, বাথরুম ও পায়খানা। খালি জায়গায় বাঁশ, কাঠ, টিন ও বেড়া দিয়ে তৈরি দোতলা বস্তিঘর। বাড়িটির ছোট বাথরুমে আত্মরক্ষার জন্য বেশ কয়েকজন ঢুকেছিল। তাদের মধ্যে আটজনেরই মৃত্যু হয়েছে ওই ঘরে আটকে পড়ে। বস্তিতে আসা-যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো মাত্র চার ফুট চওড়া একটি গেট। সেখানে আগুন পেঁৗছে যাওয়ায় আটকে পড়াদের মধ্যে কেউ আর বাঁচতে পারেনি।
স্থানীয় লোকজন জানায়, সেখানে শামসু প্রফেসরের বস্তি ছাড়াও তাজ কম্পানি, জহির, মান্নান মিয়া, ইলিয়াস বাবলু, আমিরুল ও আবদুল বাশারের খালি প্লটগুলোতে দোতলা টিনের ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এসব ঘর মিলিয়ে পুরো এলাকাটিই বৌবাজার বস্তি নামে পরিচিত ছিল। আগুনে বস্তির সব ঘরই পুড়ে গেছে। আগুনে একটি মসজিদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে আশপাশের দালানগুলো রক্ষা পেয়েছে।
মোহাম্মদ রনি নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিনি ৫৪/এফ নম্বর বাড়িতে মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে ভাড়া থাকেন। ওই বাড়ির মালিক উজ্জ্বল ও তাঁর ভাই সাইফুল। বাড়িটির নিচে ইটের গাঁথুনি, ওপরে টিনের ছাউনি। তিনি বলেন, "দোতলা বাড়ির একটি কক্ষে মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত পৌনে ৩টার দিকে পাশের বাড়ির এক মহিলা 'আগুন আগুন' বলে চিৎকার করলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, তাজুর বস্তির রিকশা ও ভ্যানের গ্যারেজের মাঝখান থেকে আগুন জ্বলছে। আমি একটি বালতিতে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে যাই। তিন বালতি পানি দেওয়ার পরও আগুন না নিভে বাড়তে থাকে। দ্রুত ঘরে ফিরে মা ও ছোট ভাইকে ঘর থেকে বের করে নিরাপদ স্থানে চলে যাই।"
রনিসহ ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির বাসিন্দারা জানায়, নিহতদের মধ্যে আটজনই উজ্জ্বলের ভাড়াটিয়া। জমির মালিকের কাছ থেকে লিজ নিয়ে উজ্জ্বল সেখানে ৪০টি ঘর তুলেছিলেন। তাতে প্রায় ২০০ জন ভাড়া থাকত। ঘটনার সময় তারা সবাই ঘুমিয়ে ছিল। আগুন লাগার অনেক পরে তাদের ঘুম ভাঙে। তাদের মধ্যে ছয়জন বস্তিসংলগ্ন গোসলখানায় আর দুজন রান্নাঘরে ঢুকে মারা যায়।
মর্গে কথা হয় হোটেল কর্মচারী কাজী আকরাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি নিহত হেলেনার স্বামী। আকরাম জানান, রাতে তিনি বস্তিতে ছিলেন না। ভোরে আগুনের খবর পেয়ে বস্তিতে ফিরে স্ত্রী, মেয়ে ও নাতির মৃত্যুর খবর পান। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।
নিহত হেলেনার বড় মেয়ে শাহীনুর বেগম জানান, তাঁর যমজ দুই ছেলের মধ্যে রাকিব ও স্বামীকে নিয়ে পাশেই আরেকটি বস্তিতে থাকেন তিনি। আর শাকিব থাকত নানা-নানির সঙ্গে শামসু প্রফেসরের বস্তিতে। রাতে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে দেখতে পান শামসু প্রফেসরের বস্তি জ্বলছে। মায়ের কাছে থাকা আরেক ছেলে শাকিবকে উদ্ধারের জন্য স্বামীকে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ায় কোনোভাবেই ঘর পর্যন্ত পেঁৗছাতে পারেননি।
গাড়ির বহর : আগুনে বস্তি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় গতকাল হাজারীবাগের বৌবাজারে ছুটে গেছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ অনেকে। তাঁদের নিরাপত্তাসহ উদ্ধারকাজের জন্য র্যাব, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের একাধিক দল উপস্থিত ছিল সেখানে। দিনভর গাড়ির বহর ছিল বেড়িবাঁধে।
সকাল ৯টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় তিন হাজার পরিবারকে তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে খোঁজখবর রাখছেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস।
এদিকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকার জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (দক্ষিণ) প্রশাসক মো. জিল্লার রহমান জানান, নিহত ১১ জনের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দেবে নগর কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের গৃহনির্মাণে দেওয়া হবে মোট ৯ লাখ টাকা।
দুপুরের আগেই যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারসহ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, রিকশার গ্যারেজে কেরোসিন তেলের ড্রামবাহী দুটি ভ্যান ছিল। এই ভ্যানের একটি বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ফায়ার ব্রিগেড কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করবে। কমিটি অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ বের করার চেষ্টা করবে।
হাজারীবাগের ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, আগুনে বস্তির পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও সদস্য নির্ধারণের চেষ্টা চলছে।
আগুন নিয়ে রহস্য : নাশকতা, বস্তি উচ্ছেদের পাঁয়তারাসহ নানা কথাবার্তা চলছে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। তবে ফায়ার সার্ভিস বলছে, কোরোসিন, পেট্রল, ডিজেলসহ অতিদাহ্য কিছুর উপস্থিতিতে আগুনের বিস্তৃতি ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে রিকশা গ্যারেজে তেলবোঝাই কিছু রিকশাভ্যান থাকত, তা থেকে আগুন ছড়াতে পারে বলে জানায় বস্তিবাসী। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাৎক্ষণিক অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস জানাতে না পারলেও তাঁদেরও সে রকমই ধারণা।
লাশের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি : বস্তিতে আগুনে পোড়া পাঁচজনকে সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে সুমন (২৫) নামের এক দিনমজুর ও নুরুল ইসলাম (৩০) নামের এক রিকশাচালককে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। জুয়েল (১৬), নূপুর (১৮) ও তিন মাস বয়সী এক শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বার্ন ইউনিটে তাদের না পেয়ে স্বজনরা মনে করেন, তারা মারা গেছে। গণমাধ্যমেও এ কারণে দিনভর মৃতের সংখ্যা ১৪ বলে প্রচারিত হতে থাকে। পরে অবশ্য মর্গ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া যায়, এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১১।
বাঁচার সব চেষ্টা ব্যর্থ
No comments