গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছেই-চলছে যুদ্ধবিরতির চেষ্টাও
এখন গাজা উপত্যকার মানুষকে প্রতি মুহূর্তে তাড়া করছে মৃত্যুভয়। পাতা ঝরার শব্দেও আঁতকে উঠছে অনেকেই। ইসরায়েলি সেনাদের ছোড়া বোমা বা গুলিতে এই বুঝি প্রাণটা গেল! এ অবস্থার মধ্য দিয়েই গতকাল রবিবার টানা পঞ্চম দিনের মতো গাজায় হামলা অব্যাহত রাখে ইসরায়েল।
জল, স্থল ও আকাশপথে চালানো মুহুর্মুহু হামলায় গাজার অনেক এলাকায়ই এখন ক্ষত-বিক্ষত। গাজার নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল হামাসের সদর দপ্তর, সরকারি অফিস-আদালত ও সাধারণ নাগরিকদের বাসাবাড়ির মতোই গতকাল আক্রমণের শিকার হয় দুটি টেলিভিশন ভবন। এতে আহত হয়েছেন অন্তত আট সাংবাদিক। এর মধ্যে একজনের পা উড়ে গেছে। এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে মিসর। ফিলিস্তিনও বলছে, আজ-কালের মধ্যেই গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসতে পারে। তবে গাজায় আরো জোরেশোরে হামলা চালাতে সব ধরনের প্রস্তুতি বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।গাজায় ইসরায়েলি হামলায় গতকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮ জনে। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৫০ জনেরও বেশি। সাধারণ নাগরিক আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় গতকাল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রেড ক্রস (আইসিআরসি)। সংস্থাটি জানায়, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ইসরায়েল ও গাজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
গতকাল ভোররাতে গাজা শহরের শোয়ায় স্থানীয় আরব গণমাধ্যম আল কুদস টেলিভিশন দপ্তরে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইসরায়েল। এতে আহত হন তিন সাংবাদিক। এ টেলিভিশনটি হামাসের সমর্থক বলে দাবি করছে ইসরায়েল। অন্যদিকে গাজা শহরের শুরুখ ভবনে আল আকসা টেলিভিশনের দপ্তরে গুলি ছুড়েছে ইসরায়েল সেনারা। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ছয় সাংবাদিক।
এ ছাড়া গতকাল গাজার উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় বিমান থেকে বোমা ও গুলি ছুড়েছে ইসরায়েলি সেনারা। হামলায় হামাসের এক কর্মকর্তার বাড়িতে নিহত হয়েছে ১০ জন। জেবালি শরণার্থী শিবিরের এক শিশু নিহত ও অন্তত ১২ জন আহত হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রগুলো জানিয়েছে। বিমান হামলায় উত্তরাঞ্চলে দুজন নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হওয়ার খবর মিলেছে। এ ছাড়া হামলা হয় পূর্বাঞ্চলের এক পুলিশ স্টেশনেও।
বিপরীতে ইসরায়েলে রকেট হামলা অব্যাহত রেখেছে হামাস। তেল আবিবে রকেট হামলা চালানোর পর সেখানে গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিপদ সংকেতের সাইরেন বাজানো হয়। তবে গতকাল পর্যন্ত ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা ছিল তিন। হামাসের ছোড়া রকেটের বেশির ভাগই ইসরায়েলের মাটিতে পড়ার আগেই থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী আয়রন ডোম সিস্টেম ব্যবহার করে এ কাজ করা হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন ইসরায়েলি এক কর্মকর্তা।
এদিকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চালাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতারা। বিষয়টি 'ইতিবাচক' হিসেবে দেখছে হামাস। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রেসেপ তাইয়েপ এরদোগান মিসরের রাজধানী কায়রোতে মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুরসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য হামাসের নেতা খালেদ মেহশাল এখন কায়রোতে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া কায়রোতে আরব অঞ্চলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। আরব লীগের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সংস্থার প্রধান নাবিল আল-আরাবির নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল আগামীকাল মঙ্গলবার গাজা পরিদর্শনে যাবেন। মিসরীয় কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেন, 'শিগগিরই যুদ্ধবিরতির ইঙ্গিত আছে, তবে নিশ্চিত করে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।' ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরা ফেবিয়াস ইসরায়েলের জেরুজালেম, তেল আবিব ও ফিলিস্তিন সফরের উদ্দেশে গতকাল প্যারিস ত্যাগ করেছেন। ফিলিস্তিনি এক কর্মকর্তা জানান, রামাল্লার পশ্চিম তীরে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।
এদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব উইলিয়াম হেগ গতকাল ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় হামলা তীব্রতর করলে তা ইসরায়েলের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহমর্মিতা হারাতে পারে ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের আছে। গাজায় সামরিক অভিযান ও আক্রমণকে সমর্থন করে বিবৃতিতে বলা হয়- ওবামা প্রশাসন মনে করে, বিশ্বের নেতাদের উচিত হামাসকে চাপ দেওয়া।
গত বুধবার ইসরায়েলের হামলায় হামাসের সামরিক প্রধান আহমেদ সায়েদ খলিল আল-জাবারি নিহত হওয়ার পরপরই দুই দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনা শুরু হয়। শনিবার ভোরে ইসরায়েলের হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে হামাসের সদর দপ্তর। এরই মধ্যে ১৬ হাজার রিজার্ভ সেনাকে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশের পর শুক্রবার আরো ৭৫ হাজার রিজার্ভ সেনাকে প্রস্তুত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা।
এদিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে গতকাল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় প্রায় হাজারখানেক মুসলিম ছাত্র ফিলিস্তিনের পতাকা ও ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং নিহত বেসামরিক মানুষের ছবি নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে। এ সময় তারা 'গাজা বাঁচাও, মানবতা বাঁচাও' বলে স্লোগান দেয়। সূত্র : বিবিসি, এএফপি, গার্ডিয়ান, জি-নিউজ (অনলাইন)।
No comments