জীবন আরো কঠিন হবে by রাজীব আহমেদ

অর্থমন্ত্রী ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় শিল্পকে কর সুবিধা দিলেন। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেন। আমদানিকারকদেরও দিলেন কিছু সুবিধা। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দিলেন না কিছুই। বাড়িভাড়া ও পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো দাবিগুলো আলোচনায়ই এলো না।


মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সাধারণ মানুষের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। বাড়ানো হয়েছে ন্যূনতম কর। মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করের (মূসক) পরও আরো ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করা হলো। খুচরা বিক্রেতাদের ওপর প্যাকেজ করের বদলে আরোপ করা হলো ৪ শতাংশ মূসক। এর চাপ পড়বে ক্রেতাদের ঘাড়ে। ব্যাংকে কিছু টাকা রেখে নিম্ন আয়ের মানুষ কিছু আয় করবে, এর ওপরও বাড়তি ৫ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করলেন অর্থমন্ত্রী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের কষ্ট কমানোর কোনো চেষ্টা নেই। গত এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয়ে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা কমারও কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়ে যেতে পারে। ভর্তুকি সামাল দিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। এতে চাপ আরো বাড়বে।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশে বেঁধে রাখার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, তা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন হবে বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'বাজেটে যেসব ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তাতে এ কথা স্পষ্ট যে আগামীতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম আরো বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের দামও বাড়বে।' তিনি ন্যূনতম কর দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করার প্রস্তাবেরও সমালোচনা করেন। ড. দেবপ্রিয় বলেন, 'আমরা আমাদের বাজেট প্রস্তাবে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ করার প্রস্তাব করেছিলাম। অর্থমন্ত্রী তাতে সাড়া দেননি। অবাক করার বিষয় হলো, ন্যূনতম কর তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির বাজারে এটা সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে কম আয়ের মানুষদেরও করের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।'
ভোক্তা অধিকার সংস্থা ভলান্টারি কনজ্যুমার ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাজেটে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে স্বস্তি আসতে পারে এমন কিছু আমি দেখছি না। বরং মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে। পণ্যের দাম বাড়বে। আর যারা করের যোগ্য নয়, তাদেরও করের আওতায় আসতে হবে মোবাইল ফোনের উৎসে কর আরোপ এবং করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর ফলে। এ ছাড়া ছোট দোকানদারদের ওপর চার প্যাকেজের বদলে ৪ শতাংশ মূসক আরোপ করায় পণ্যের দামও বাড়বে।'
করের চাপ বাড়বে : প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা এক লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে বাড়াননি অর্থমন্ত্রী। একজন চাকরিজীবীর মূল বেতনের পুরোটাই করযোগ্য। এর সঙ্গে বাড়িভাড়ার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত করমুক্ত, অর্থাৎ বাড়িভাড়া ৭০ শতাংশ হলে ২০ শতাংশের ওপর কর দিতে হবে। বছরে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত যাতায়াত ভাতা করমুক্ত। তবে বোনাস পেলে সেটি করযোগ্য। হিসাব করলে দেখা যায়, মোটামুটি ১২ হাজার টাকা মূল বেতন হলেই করের আওতায় পড়ার সুযোগ রয়েছে।
যাঁদের মূল বেতন ১২ হাজার টাকা, তাঁদের বাড়িভাড়া ও অন্যান্য ভাতা যুক্ত হয়ে বেতন ২৫-২৬ হাজার টাকার বেশি হয় না। ঢাকা শহরে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ১০-১২ হাজার টাকা এবং মাসে দুই হাজার টাকার কাছাকাছি ইউটিলিটি বিল দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। অথচ এর ওপর কর বজায় রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। করমুক্ত আয়সীমা না বাড়িয়ে অর্থমন্ত্রী প্রকৃত সীমা আরো কমিয়েছেন। কারণ গত এক বছরে উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ফলে টাকার প্রকৃত মূল্য কমেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে চার মাস দুই অঙ্কে থাকার পর মূল্যস্ফীতি এপ্রিলে কিছুটা কমেছে। মে মাসে তা দাঁড়িয়েছে ৯.১৫ শতাংশে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, করমুক্ত আয়সীমা প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করা উচিত। এর জন্য একটি ধারাবাহিক নীতির প্রয়োজন। এ বছরও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।
দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক ৯ কোটি। তাদের মধ্যে যেমন উচ্চবিত্ত আছে, তেমনি খুবই নিম্নবিত্তের মানুষও আছে। কিন্তু ওই নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর ওপরও ২ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করেছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও এখন মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আছে। এ ক্ষেত্রে উৎসে কর আরোপ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন ড. এ কে এনামুল হক ও খলিলুর রহমান।
ঋণ কঠিন হবে, সঞ্চয়ের আয় কমবে : আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে ৫২ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। এই ঘাটতির ৩৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে মেটানোর কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের মতে, এর ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট বাড়বে, ঋণের সুদের হারও বাড়বে। সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণ ব্যয়সাপেক্ষ হবে। পণ্য উৎপাদের খরচসহ ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে। বাড়বে ব্যক্তির পণ্য কেনার জন্য নেওয়া ভোক্তা ঋণের খরচও।
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না বাড়ানো এবং উৎসে কর না কমানোয় এ খাত থেকে মানুষের আয় বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ব্যাংকে আমানত থাকলে তা থেকে আয় কমে যাবে নিম্ন আয়ের মানুষের। কারণ যাঁদের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই তাঁদের আমানতের সুদের ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে ব্যাংকে টাকা রাখার প্রবণতা কমে যেতে পারে। ফলে তারল্য সংকট আরো বাড়ায় সুদের হার বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
পণ্যের দাম বাড়বে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত : প্রস্তাবিত বাজেটে ছোট বিক্রেতাদের মূসক দেওয়ার প্যাকেজ ব্যবস্থা উঠিয়ে ৪ শতাংশ হারে আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর অর্থ হলো- আগে এলাকাভেদে যে ছোট দোকানদাররা বছরে এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা হারে মূসক দিতেন, তাঁদের এখন সারা বছরের বিক্রির ওপর ৪ শতাংশ হারে মূসক দিতে হবে। নতুন ব্যবস্থায় করব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে। এতে একেবারে উপজেলা পর্যন্ত পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, এর ফলে পণ্যের দাম যেমন বাড়বে, তেমনি অনিয়মের সুযোগ তৈরি হবে। দোকান মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে প্যাকেজ কর কিছুটা বাড়ানো যেত। কিন্তু এভাবে মূসক আরোপ ঠিক হয়নি।
'চূড়ান্ত পর্যায়' শেষ হয় না প্রতিযোগিতা আইনের : কোনো পণ্যের বাজারেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি ওষুধের মতো জরুরি পণ্যের বাজার দেখারও কেউ নেই। সম্প্রতি দেশে ওষুধের দোকান মালিকদের সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা মোড়কে উল্লেখ থাকা দামের এক পয়সা কম দামেও ওষুধ বিক্রি করবে না। ফলে ক্রেতাদের কিছুটা কম দাম পাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়েছে।
'ভোক্তা'র নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতা আইন থাকলে সমিতির পক্ষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো না। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আইনটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন, এ বছরও তিনি একই কথা বললেন। ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে আইন না হলেও কর আইন ও মূসক আইন তৈরি করতে সময় লাগে না।
উৎপাদন খরচ অনুসারে একটি এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম হওয়া উচিত ৩০-৩২ টাকা। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার বেশি দরে। সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। কারণ প্রতিযোগিতা আইন নেই। এ আইনটি তৈরি হলে এর অধীনে একটি 'প্রাইস কমিশন' থাকবে, যার মাধ্যমে ক্রেতারা পণ্যের দাম নিয়ে অভিযোগের সুযোগ পাবে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১ নম্বর গুরুত্বের বিষয় ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। আর সেখানে 'ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ' গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে আসতে শুরু করলেও ওই প্রতিশ্রুতি রক্ষার লক্ষণ নেই।
টিসিবির জন্য বাজেটে কিছু নেই : এবারের বাজেটেও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) এক পয়সাও দেওয়া হলো না তহবিল হিসেবে। গড়ে উঠল না আড়াই হাজার কোটি টাকার পণ্যের আপৎকালীন মজুদ, যা নিয়ে জরুরি প্রয়োজনে পণ্যের বাজারে হাজির হতে পারত সরকারি এ সংস্থাটি।
তহবিলের বদলে টিসিবিকে দেওয়া হয়েছিল ব্যাংক গ্যারান্টি। ওই গ্যারান্টির বিপরীতে আবার টিসিবিকে দিতে হয় ১৪ শতাংশের কাছাকাছি সুদ। খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ পান ১০ শতাংশের কম সুদে। ফলে বাজারে অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দাম নিয়ে প্রতিযোগিতায় পারে না টিসিবি। অথচ রমজান এলে সংস্থাটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় সরকার।

No comments

Powered by Blogger.