মহাজোটের 'ফেইট অ্যাকমপ্লি' অর্জিত হয়নি by এম আবদুল হাফিজ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দৃষ্টি এখন সামনে। স্বভাবতই জোট এখন আগামীর হিসাব-নিকাশ কষছে। আসন্ন নির্বাচনে তার প্রসপেক্ট এবং তা আশানুরূপ না হলে গৃহীতব্য ব্যবস্থাগুলো এ সময়ে জোট অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের বিবেচ্য। জোটপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য বেশ আগেই নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে।


তার উক্তি ও মেজাজে পরিস্ফুট যে, আগামী নির্বাচনটিও জিততে তিনি মরিয়া। একইভাবে মরিয়া বিরোধী দল ও তার নেত্রী খালেদা জিয়াও। কিন্তু জিতবে তো শুধু একটি পক্ষই। জেতার কৌশল নির্ধারণে বিরোধী দলের অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা, যার মধ্যে বিএনপি নিতৃত্বাধীন ১৮ দল এখন ফেঁসে আছে। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীনদের হাতে প্রাক-নির্বাচনী তৎপরতার জন্য অনেক কার্ড মজুদ আছে।
মহাজোট এখন একের পর এক সেই কার্ডই খেলছে। বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদলীয় শীর্ষ নেতাদের ইতিমধ্যে অজামিনযোগ্য মামলা দিয়ে কারার অন্তরালে পাঠিয়েছে। প্রচণ্ড দমননীতির জাঁতাকল এড়াতে বাকি নেতাকর্মীরাও ব্যাপকহারে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ফলে রাজনীতির মাঠে এখন ক্ষমতাসীনরাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু তলে তলে ক্ষমতাসীনরা যে মারণাস্ত্রটি বিরোধীদের জন্য উঁচিয়েছে তা হলো নির্বাচন কার অধীনে হবে তার একটি আইনি ও সাংবিধানিক সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। বিগত কয়েকটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে হলেও মহাজোট ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আর তত্ত্বাবধায়কের ওপর ভরসা করতে পারছে না। যে আওয়ামীরা একযুগ আগে তত্ত্বাবধায়কের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তাদেরই এই পদ্ধতিতে এখন অরুচি কোনো শুভ সংকেত বহন করে না।
এক অনুগত বিচার ব্যবস্থার সহায়তায় এবং সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এ ইস্যুতে তাদের সাফল্য আওয়ামীদের একটি ফেইট অ্যাকমপ্লি অর্জিত হয়েছে বলে তারা ভেবেছিল। আরও ভেবেছিল যে, এভাবে পরিবর্তিত একটি পদ্ধতি অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে_ এ জন্য যে কেউ আরেকটি আইনি ও সাংবিধানিকভাবে সেটল্ড ইস্যু নিয়ে উচ্চবাচ্য করবে না। কিন্তু তেমনটি না হয়ে এখন নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতিই চলমান রাজনীতির সবচেয়ে বিতর্কিত ইস্যু। যদিও আত্মপ্রসাদে মগ্ন আওয়ামীরা এ ইস্যুতে বিরোধীদের কোনো পাত্তাই দিতে চাইছে না এবং একটি চণ্ডনীতির মধ্য দিয়ে বিরোধীদের দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের সিদ্ধান্তটিই গেলাতে চাইছে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে তা হবে এই জটিল ইস্যুর একটি হাস্যকর সরলীকরণ।
দেশ-বিদেশের সকল মহল থেকেই সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি এখন সর্বজনীন। মুখে আওয়ামীরা যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন বাস্তবে দলের শক্তিতে, জনপ্রিয়তায় এবং গ্রহণযোগ্যতায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমানে সমান। কোনোটিকেই কোনোটির চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল ভাবা যাবে না। বাংলাদেশে আগ্রহী যে কোনো দেশ এবং দেশের অভ্যন্তরে সব মহলই এ সত্যটি অনুধাবন করে। কোনো সঙ্গত কারণে যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্থাপত্য মুখ থুবড়ে পড়বে এবং এ দেশের সব গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাই বিলুপ্তির মুখে পড়বে। তাই আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়েই এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কখনোই মসৃণ বা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কিন্তু মহাজোটের আগামী নির্বাচনে জয়ের বিকার এবং অদম্য লিপ্সা জোটটিকে দিগ্গি্বদিক জ্ঞানশূন্য করে তুলেছে এবং অবাস্তব নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নের পথে ঠেলে দিয়েছে। ফলে তা গ্রাউন্ট রিয়ালিটি থেকে সম্পূর্ণভাবে ছিটকে পড়েছে। এর আগে চারদলীয় জোটকেও এমন দশায় ফেলেছিল। তার পরিণতি আওয়ামী লীগসহ কারও কাছে অজ্ঞাত নয়। মহাজোট কি তাহলে সেই একই পথে এগোচ্ছে এবং একটি এক-এগারোর প্রাদুর্ভাব ঘটানোর প্রেক্ষিত তৈরি করছে?
আওয়ামী লীগ তো কোনো ফেলনা দল নয়। এই দলকে এমনটা মানায় না। দলটি যদি বিরোধীদের সঙ্গে একটি সমঝোতার পথে অগ্রসর হয়, চাই কি তাও আজকের ব্যর্থ মহাজোট সরকারের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হবে এবং তাদের নির্বাচনী প্রসপেক্টকে উজ্জ্বল করতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, একটি সমঝোতার পথের সঙ্গে এ দেশে গণতন্ত্রের অস্তিত্বও সম্পৃক্ত হয়ে আছে। কিন্তু যদি ক্ষমতার মদমত্ততায় হার্ডলাইনই প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের পথ হয়ে থাকে তার জন্য অন্য অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে ফলপ্রসূভাবে হার্ডলাইন প্রয়োগ হতে পারে। অন্তত মেয়াদের প্রায় অন্তিম সময়ে এসেও যদি আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট দেশজোড়া বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও নজিরবিহীন প্রশাসনিক অনিয়মের বিরুদ্ধে হার্ডলাইন গ্রহণ করতে পারে এবং দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের দানবকে পরাভূত করতে পারে, কে জানে তা হয়তো আশাতীতভাবে তাদের নির্বাচনী সম্ভাবনাকে নতুন মাত্রায় পেঁৗছে দিতে পারে। কিন্তু যে কোনো অবস্থায় সাংঘর্ষিক নীতি পরিত্যাজ্য। চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে তার মাশুল জনগণকে দিতে হয়। যাদের কাছে ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী দলগুলোকে হাত পাততে হবে। এক্ষুণি ক্ষমতাসীনদের জন্য আত্মসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। পূর্বাপর বিবেচনায় পুলকিত ও নিশ্চিন্ত থাকার জন্য ক্ষমতাসীনরা 'ফেইট অ্যাকমপ্লির' কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না যতক্ষণ রাজপথে উত্তাপ স্তিমিত না হয় বা বিরোধী দল রণে ভঙ্গ না দেয়। এখনও অনেক কিছু ঘটার বাকি আছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের জন্য একমাত্র লাভজনক পথ একেবারেই শেষ বেলায় হলেও জনহিতকর কিছু কাজের উদ্যোগ গ্রহণ এবং বিরোধী জোটের সঙ্গে সমঝোতা। একইভাবে বিরোধী জোটও অনেক ক্ষতি ও দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে যদি তারাও 'এক দফার' বা সরকার পতনের আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং বড় বড় বুলি আওড়ানো থেকে বিরত থাকে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক
বিআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.