পাকিস্তান-মানুষ ডুবছে বন্যায় আর নেতারা ভাসছেন টাকায় by তারিক আলী
বাইবেলে বর্ণিত নুহের প্লাবন যেন। মাসখানেক আগের ভারী বৃষ্টিপাত থেকে সৃষ্ট বন্যায় আক্রান্ত প্রায় দুই কোটি মানুষ, মৃত দেড় হাজারেরও বেশি। হিসাবটা দিয়েছে পাকিস্তানের দুর্যোগ মোকাবিলা সংস্থা। পাকিস্তানে আগস্ট হলো মৌসুমি ঋতুর মাস। এ বছর ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই, তাই বন্যার পানি আর সরছে না।
পাকিস্তানের একদিকে মানুষের তৈরি আফগান যুদ্ধের বিপর্যয়, অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্রথমটিতেই কাহিল পাকিস্তান, বন্যা মোকাবিলায় পর্যুদস্ত। যেকোনো সরকারের জন্যই এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কষ্টকর, কিন্তু বর্তমান সরকার যেন অবশ হয়ে পড়েছে।
গত ৬০ বছরে পাকিস্তানের শাসকেরা কোনো সামাজিক অবকাঠামো তৈরি করতে পারেননি। ব্যবস্থার এই গভীর ঘাটতির শিকার হচ্ছে জনগণ। আর এখন পাকিস্তান আইএমএফের নয়া উদারতাবাদী হুকুম তামিল করে যাচ্ছে, যাতে ঋণের জোগান চালু থাকে। ভালো সময়েও এই ঋণ তেমন উপকার করেনি, আর গত কয়েক দশকের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে তা অকার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
বন্যা মোকাবিলায় পশ্চিমাদের দিলখোলা সাহায্য না পেয়ে ইসলামাবাদে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার মার্কিনপন্থী সাংবাদিকেরা দিনরাত আরজি জানিয়ে যাচ্ছেন, সাহায্য না এলে নাকি সন্ত্রাসীরা সব দখল করে ফেলবে। ডাহা আহাম্মকি। ত্রাণ কার্যক্রমের ওপর সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অন্যদিকে বরাবরের মতোই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোসহ বিভিন্ন মহল থেকে ত্রাণের জন্য টাকা তোলা হচ্ছে। এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়।
নয়/এগারোর পর থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কিছু অংশে ইসলামভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বহু সংস্কৃতির ব্রিটেনে’ সাম্প্রতিক এক জরিপে ‘ইসলাম’ শব্দটি শুনলেই কিসের কথা আগে মনে আসে—এমন প্রশ্নের জবাবে দেখা গেছে, ৫০ শতাংশই বলেছে, ‘সন্ত্রাস’। ফ্রান্স কিংবা জার্মানি, হল্যান্ড কিংবা ডেনমার্ক—সবখানে একই অবস্থা।
ইসলামকে ইউরোপ তার স্থায়ী ‘প্রতিপক্ষ’ মনে করে। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই মনোভাব অ্যান্টি-সেমিটিজমের (ইহুদিবিদ্বেষ) মতোই ভুল। এ রকম মনোভাবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপীয় জাতিবিদ্বেষ ও গণহত্যাকে উসকে দিয়েছিল। একইভাবে ইরাকেও ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে: তাতে কার কী যায়-আসে? প্রতিদিনই নিরীহ আফগানরা নিহত হচ্ছে: তাদের দোষেই তারা মরছে—এই হচ্ছে মনোভাব। তাই পাকিস্তান যখন বন্যার পানিতে ডুবছে, তখন পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে উদাসীনতা। যথেষ্টভাবে এগিয়ে না আসার কারণ নিঃসন্দেহে ওই মনোভাব।
অন্য কারণটির জন্ম পাকিস্তানেই। গত কয়েক সপ্তাহে যে কয়েকজন পাকিস্তানির সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই ত্রাণের জন্য টাকা দিতে উত্সাহী নন। তাঁদের ধারণা, এই টাকা শেষ পর্যন্ত দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরাট পকেটে গিয়ে জমা পড়বে। বন্যার পানি যখন পাকিস্তানকে ঢেকে ফেলছে, সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জারদারি ইউরোপে রওনা হলেন। সেখানকার সহায়-সম্পত্তি দেখা; ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে শোভাযাত্রা করে ছেলেকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে অভিষিক্ত করাই ছিল উদ্দেশ্য।
ওদিকে পাকিস্তানে স্লোগান ওঠে: ‘হাজার মানুষ মরছে, প্রেসিডেন্ট ফুর্তি করছে’। ইউরোপীয় টিভি চ্যানেলগুলোয় যখন ডুবন্ত পাকিস্তানের দৃশ্য দেখা হচ্ছে, তখন এর প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সে ষোলো শতকের একটি দুর্গের পথে রওনা হয়েছেন। বার্মিংহামের অভিষেক অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়। এত কিছুর পরও জারদারির নির্লজ্জ বক্তৃতার সময় এক বর্ষীয়ান কাশ্মীরি রাগে ‘দুর্নীতিবাজ, চোর’ বলে চিত্কার করতে করতে তাঁর দিকে জুতা ছুড়ে মারেন। অপমানিত জারদারি খেপে সভা ছেড়ে চলে যান। পরদিন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়, ‘জারদারিও বুশের সঙ্গে জুতা ক্লাবে যোগ দিলেন’।
বিক্ষোভকারীদের অনেকেই জারদারির ছবিতে জুতা দিয়ে আঘাত করে। অনেকের হাতের প্লাকার্ডে লেখা ছিল, ‘জারদারি পরিবার ইংল্যান্ডে আনন্দ করছে আর লক্ষ লক্ষ লোক ঘরছাড়া’। এসব দেখে মানুষ ত্রাণকাজে আরও হতাশ হয়ে পড়ে।
সংকটাপন্ন পাকিস্তান আর এই উদ্বাস্তু জনগণের ছবি ইউরোপীয় টেলিভিশনে যখন দেখানো হচ্ছে, তখন ফরাসি বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে জারদারি তাঁর সেই ষোলো শতকের বিলাসবহুল প্রাসাদের দিকে যাচ্ছেন। বিরাট এ প্রাসাদে রয়েছে পার্ক, লেক ও বন। আসলে এটা তৈরি করা হয়েছিল রাজা ষষ্ঠ ফিলিপের বিধবা স্ত্রীর জন্য। আর এখন এটা হয়েছে এক পাকিস্তানি বিপত্নীকের সম্পত্তি। এত বিলাসের টাকা কোত্থেকে আসে? সবাই জানে, পাকিস্তানে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া ঘুষ থেকে।
এদিকে পাকিস্তানের বৃহত্তম মিডিয়া সাম্রাজ্য জং গ্রুপকে বলা হয়, তারা যেন প্রেসিডেন্টকে জুতা মারার দৃশ্যটি তাদের জিয়ো টিভিতে প্রচার না করে। তারা উপদেশ অমান্য তো করেই, উল্টো জুতা নিক্ষেপকারীর সাক্ষাত্কার প্রচার করে।
ইউটিউব বন্ধ করতে না পেরে জারদারির লোকজন করাচি ও সিন্ধুর কিছু এলাকায় জিয়ো টিভিসহ আরও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করে দেয়। শত শত জারদারিভক্ত করাচিতে জিয়ো টিভির দপ্তরের সামনে জড়ো হয়ে জুতা ও ঢিল ছুড়তে থাকে। গোটা করাচি খুঁজেও পুলিশের সাহায্য তারা পায়নি। গোটা করাচিতে জং গ্রুপের সংবাদপত্রগুলো পোড়ানো হয়। জবাবে জিয়ো টিভি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে বেনজির ভুট্টোর বক্তৃতা প্রচার করে। ওদিকে বন্যা চলতেই থাকে...
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
তারিক আলী: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক।
গত ৬০ বছরে পাকিস্তানের শাসকেরা কোনো সামাজিক অবকাঠামো তৈরি করতে পারেননি। ব্যবস্থার এই গভীর ঘাটতির শিকার হচ্ছে জনগণ। আর এখন পাকিস্তান আইএমএফের নয়া উদারতাবাদী হুকুম তামিল করে যাচ্ছে, যাতে ঋণের জোগান চালু থাকে। ভালো সময়েও এই ঋণ তেমন উপকার করেনি, আর গত কয়েক দশকের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে তা অকার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
বন্যা মোকাবিলায় পশ্চিমাদের দিলখোলা সাহায্য না পেয়ে ইসলামাবাদে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার মার্কিনপন্থী সাংবাদিকেরা দিনরাত আরজি জানিয়ে যাচ্ছেন, সাহায্য না এলে নাকি সন্ত্রাসীরা সব দখল করে ফেলবে। ডাহা আহাম্মকি। ত্রাণ কার্যক্রমের ওপর সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অন্যদিকে বরাবরের মতোই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোসহ বিভিন্ন মহল থেকে ত্রাণের জন্য টাকা তোলা হচ্ছে। এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়।
নয়/এগারোর পর থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার কিছু অংশে ইসলামভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বহু সংস্কৃতির ব্রিটেনে’ সাম্প্রতিক এক জরিপে ‘ইসলাম’ শব্দটি শুনলেই কিসের কথা আগে মনে আসে—এমন প্রশ্নের জবাবে দেখা গেছে, ৫০ শতাংশই বলেছে, ‘সন্ত্রাস’। ফ্রান্স কিংবা জার্মানি, হল্যান্ড কিংবা ডেনমার্ক—সবখানে একই অবস্থা।
ইসলামকে ইউরোপ তার স্থায়ী ‘প্রতিপক্ষ’ মনে করে। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই মনোভাব অ্যান্টি-সেমিটিজমের (ইহুদিবিদ্বেষ) মতোই ভুল। এ রকম মনোভাবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপীয় জাতিবিদ্বেষ ও গণহত্যাকে উসকে দিয়েছিল। একইভাবে ইরাকেও ১০ লাখ মানুষ মারা গেছে: তাতে কার কী যায়-আসে? প্রতিদিনই নিরীহ আফগানরা নিহত হচ্ছে: তাদের দোষেই তারা মরছে—এই হচ্ছে মনোভাব। তাই পাকিস্তান যখন বন্যার পানিতে ডুবছে, তখন পশ্চিমা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে উদাসীনতা। যথেষ্টভাবে এগিয়ে না আসার কারণ নিঃসন্দেহে ওই মনোভাব।
অন্য কারণটির জন্ম পাকিস্তানেই। গত কয়েক সপ্তাহে যে কয়েকজন পাকিস্তানির সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই ত্রাণের জন্য টাকা দিতে উত্সাহী নন। তাঁদের ধারণা, এই টাকা শেষ পর্যন্ত দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরাট পকেটে গিয়ে জমা পড়বে। বন্যার পানি যখন পাকিস্তানকে ঢেকে ফেলছে, সেই মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট জারদারি ইউরোপে রওনা হলেন। সেখানকার সহায়-সম্পত্তি দেখা; ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে শোভাযাত্রা করে ছেলেকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে অভিষিক্ত করাই ছিল উদ্দেশ্য।
ওদিকে পাকিস্তানে স্লোগান ওঠে: ‘হাজার মানুষ মরছে, প্রেসিডেন্ট ফুর্তি করছে’। ইউরোপীয় টিভি চ্যানেলগুলোয় যখন ডুবন্ত পাকিস্তানের দৃশ্য দেখা হচ্ছে, তখন এর প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সে ষোলো শতকের একটি দুর্গের পথে রওনা হয়েছেন। বার্মিংহামের অভিষেক অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়। এত কিছুর পরও জারদারির নির্লজ্জ বক্তৃতার সময় এক বর্ষীয়ান কাশ্মীরি রাগে ‘দুর্নীতিবাজ, চোর’ বলে চিত্কার করতে করতে তাঁর দিকে জুতা ছুড়ে মারেন। অপমানিত জারদারি খেপে সভা ছেড়ে চলে যান। পরদিন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়, ‘জারদারিও বুশের সঙ্গে জুতা ক্লাবে যোগ দিলেন’।
বিক্ষোভকারীদের অনেকেই জারদারির ছবিতে জুতা দিয়ে আঘাত করে। অনেকের হাতের প্লাকার্ডে লেখা ছিল, ‘জারদারি পরিবার ইংল্যান্ডে আনন্দ করছে আর লক্ষ লক্ষ লোক ঘরছাড়া’। এসব দেখে মানুষ ত্রাণকাজে আরও হতাশ হয়ে পড়ে।
সংকটাপন্ন পাকিস্তান আর এই উদ্বাস্তু জনগণের ছবি ইউরোপীয় টেলিভিশনে যখন দেখানো হচ্ছে, তখন ফরাসি বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে জারদারি তাঁর সেই ষোলো শতকের বিলাসবহুল প্রাসাদের দিকে যাচ্ছেন। বিরাট এ প্রাসাদে রয়েছে পার্ক, লেক ও বন। আসলে এটা তৈরি করা হয়েছিল রাজা ষষ্ঠ ফিলিপের বিধবা স্ত্রীর জন্য। আর এখন এটা হয়েছে এক পাকিস্তানি বিপত্নীকের সম্পত্তি। এত বিলাসের টাকা কোত্থেকে আসে? সবাই জানে, পাকিস্তানে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া ঘুষ থেকে।
এদিকে পাকিস্তানের বৃহত্তম মিডিয়া সাম্রাজ্য জং গ্রুপকে বলা হয়, তারা যেন প্রেসিডেন্টকে জুতা মারার দৃশ্যটি তাদের জিয়ো টিভিতে প্রচার না করে। তারা উপদেশ অমান্য তো করেই, উল্টো জুতা নিক্ষেপকারীর সাক্ষাত্কার প্রচার করে।
ইউটিউব বন্ধ করতে না পেরে জারদারির লোকজন করাচি ও সিন্ধুর কিছু এলাকায় জিয়ো টিভিসহ আরও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের প্রচার বন্ধ করে দেয়। শত শত জারদারিভক্ত করাচিতে জিয়ো টিভির দপ্তরের সামনে জড়ো হয়ে জুতা ও ঢিল ছুড়তে থাকে। গোটা করাচি খুঁজেও পুলিশের সাহায্য তারা পায়নি। গোটা করাচিতে জং গ্রুপের সংবাদপত্রগুলো পোড়ানো হয়। জবাবে জিয়ো টিভি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে বেনজির ভুট্টোর বক্তৃতা প্রচার করে। ওদিকে বন্যা চলতেই থাকে...
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
তারিক আলী: পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক।
No comments