জন্মাষ্টমী-‘সত্যকে ধরে মাথা উঁচু করে অধর্মের বিরুদ্ধে লড়ো’ by স্বামী অমৃতত্বানন্দ

শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী পালিত হচ্ছে মহা সমারোহে। কেন এত সমারোহ? মানুষের অধ্যাত্মস্পৃহা যেখানে যত বেশি পরিমাণে তৃপ্ত হয়, সেখানেই ছোটে মানুষ। তীর্থে তাই তো এত লোক সমাগত। জোর করে তা করা যায় না। সেই কবে, কত বছর আগে ভারতের বুকে ঈশ্বরের এই লীলাখেলা হয়েছিল—তারপর এল-গেল কত রাজপাট, কত কত সদম্ভ স্থূল


বর্বরোচিত আগ্রাসন, হত্যা, লুণ্ঠন, মন্দির উৎপাটন, বিগ্রহ ধ্বংস; নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল প্রতিস্পর্ধী প্রবল শক্তি। খানিক বিরতির পর ধীরে ধীরে আবার গড়ে উঠেছে দেবালয়, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নবীন মূর্তি অপূর্ব ভাস্কর্য নিয়ে; মন্দিরগুলো গগনচুম্বী হয়ে ওঠে শিল্পের রসময় সৌন্দর্যে পূর্ণ হয়ে। কেন হয়? না, মানুষ তার অন্তর থেকে ঈশ্বরের স্পর্শ চায়, তাই সেসব ধ্বংসকে সে উপেক্ষা করে। মানুষের অন্তরের বিশ্বাস, অনুভব, চেতনা চায় প্রকাশ। অধিভূত সব প্রকাশই অধ্যাত্ম চেতনায় বিধৃত।
তাই তো শ্রীকৃষ্ণ ভাবনা নানা বিপরীত চিন্তা ও নিম্নতর সমালোচনাকে উপেক্ষা করে বৃহত্তর জনমানসে ব্যাপক সাড়া জাগায়। কারণ কী? বর্তমানের চিন্তাশীল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ স্তোকবাক্যে বিশ্বাস করে না, তাদের গভীর চেতনাকে স্পর্শ করতে না পারলে তারা কিছুই গ্রহণ করে না। এসব কারণে শ্রীকৃষ্ণজীবনের লীলাকথা আজকের মানুষকে কীভাবে তৃপ্ত করতে পারছে, তা জানা দরকার। শ্রীকৃষ্ণ জীবের অন্তরতম সত্যকে, অধ্যাত্ম চেতনাকে পূর্ণ করে, বাস্তব জীবনে নানা লীলায় তাকে রূপ দিয়েছেন। যেমন—বাল্যলীলায় তাঁর চপলতা, শিশুর নির্দোষ সরল মাতৃনির্ভর ব্যবহার—এসবই সাধকচিত্তের অবলম্বনীয় সাধনধারা হলো; ঈশ্বরকে বাৎসল্যরতির মাধ্যমে আরাধনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। তেমনি সখ্য, দাস্য, শান্ত ও মধুরভাবে জীবন ক্ষেত্রে যেরূপ মানবসংস্পর্শে এসে লৌকিক হয়ে বন্ধনের কারণ হয়, তা-ই ঈশ্বর প্রেমাবশে করা হলে মুক্তির হেতু হয়। এভাবে তিনিই তো আমাদের লৌকিক মায়াময় জীবনাচারকে পরমাভিসারী করে দেওয়ার পথ দেখালেন। এসব ভাবধারাই তো হিন্দু ধর্মের অনুপম বৈশিষ্ট্য। তাই তো ঈশ্বর ভাবনাকে হিন্দুরা ব্যক্তিসম্পর্কে সম্পর্কিত করে, নানা ভাব, ভাষায়, সংগীতে, নৃত্যে রসময় করে ব্যক্তিজীবনকে, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে দিয়েছে। শ্রীকৃষ্ণচরিতে গোপীপ্রেম ও রাসলীলা সম্পর্কে অনেকে অযৌক্তিক ও অশালীন মন্তব্য করেন, তাঁদের সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, আমাদের মধ্যেও এমন নির্বোধের অভাব নেই, যারা শ্রীকৃষ্ণ জীবনের এই অতি অপূর্ব অংশের অদ্ভুত তাৎপর্য বুঝতে পারে না, এমন অনেক অশুদ্ধচিত্ত নির্বোধ আছে, যারা গোপীপ্রেমের নাম শুনলে তা অতি অপবিত্র ব্যাপার ভেবে ভয়ে ১০ হাত পিছিয়ে যায়, তাদের শুধু এটুকু বলতে চাই, আগে নিজের মন শুদ্ধ করো, আর স্মরণ রেখো, যিনি এই গোপীপ্রেম বর্ণনা করেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই চির পবিত্র ব্যাসতনয় শুকদেব [বাণী ও রচনা ৫/১১৬]। শুধু তা-ই নয়, স্বামীজি আরও বলেন, ‘এই নিষ্কাম কর্ম ও নিষ্কাম প্রেমতত্ত্ব জগতে অভিনব মৌলিক ভাব।’ তাঁর শিষ্য বেদব্যাস ওই তত্ত্ব জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করলেন। মানবভাষায় এরূপ শ্রেষ্ঠ আদর্শ আর কখনো চিত্রিত হয়নি। আমরা তাঁর গ্রন্থে গোপীজন বল্লভ সেই বৃন্দাবনের রাখালরাজ অপেক্ষা আর কোনো উচ্চতর আদর্শ পাই না (বাণী ও রচনা ৫/১১৭)।
অবতারবাদ মানুন আর না-ই মানুন, শ্রেষ্ঠ পুরুষের এই অতিলৌকিক ব্যবহারকে, মনসম্পদকে প্রকাশ করতে গেলে তাঁকে তো কিছুতেই সাধারণ প্রতিভাবান মানবমধ্যেও স্থান দিতে পারি না। সে যে অনেক উচ্চে অসমোর্ধ্বে বিরাজিত মহিমা।
মানবজীবনের যুগসন্ধিক্ষণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্নকালে যেসব অতিমানব আবির্ভূত হয়ে সভ্যতাকে চলার পথের একেকটি ভিন্ন দিকনির্দেশ করে গিয়েছেন, তাঁদের সমগ্র চেষ্টারূপ যদি একত্র করা সম্ভব হয়, তবে আমরা দেখব, সে রূপ মহাভারতের গীতারূপে একীভূত হয়েছে। কর্ম সবাইকেই করতে হয়, আর তার ফলভোগও করতে হবেই। এই কর্মবৈচিত্র্য দেশ-জাতি ভেদে অনন্তরূপ হলেও মূলত তা সংসারকেন্দ্রিক ও ইন্দ্রিয়ভোগসর্বস্ব বাসনাময়। এই সংসারচেতনা, এই ইন্দ্রিয়ভোগসর্বস্ব জীবনকে দেশ-জাতিনির্বিশেষে সবার কল্যাণপ্রদ করার সাধনাই ধর্মসাধনা। সবার কল্যাণের জন্য কর্ম করা, স্বার্থচেতনাকে খর্ব করে পরার্থ ভাবনাই কি সর্বোচ্চ ধর্মীয় ভাবনা নয়? আর তা যদি হয়ে থাকে, তবে বলতে হবে গীতোক্ত কর্ম, অনাসক্ত নিঃস্বার্থ কর্ম, ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে করা কর্মই বন্ধনছেদী, সব বিভেদ বিলোপকারী, সর্বভূতহিতকারী ধর্মদেশনা। এরূপ কর্ম করার বিধানই কি সব অতি মানবের বাণী নয়? তাঁদের জীবনসাধনার ওই রূপটিই তো সবাইকে আকৃষ্ট করেছে প্রবলভাবে। আর কুরুক্ষেত্রের প্রবল সংঘর্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে কর্মযোগের ওই দিব্য পাঞ্চজন্যই তো বাজালেন শ্রীকৃষ্ণ। অত বড় দিব্য মহিমা মানবীয় কোনো ভাষায় কি ব্যক্ত করা সম্ভব? যিনি ভারতবিখ্যাত বীর অর্জুনের রথচালক হয়ে ধর্মসংশয়ে আচ্ছন্ন পলায়নপর অর্জুনকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপের দিকে আকর্ষণ করে মানবসভ্যতাকে ধর্মধৃত করে ধর্মস্থাপন করলেন, বললেন, ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গম পার্থ!’ ‘হে পার্থ, ক্লীবতা দূর করো, উঠে দাঁড়াও, ক্ষুদ্র হূদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করো। ত্যাগ করো ওই আমি ও আমার ভাব। সত্যকে ধরে মাথা উঁচু করে অধর্মের বিরুদ্ধে লড়ো। কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়।’ আর ওই সৎকর্মই তো সৎ মানুষের জীবন। মানবসভ্যতার অমূল্য সম্পদ। জীবনই তো কর্মময়, আর সৎকর্মই ধর্ম। নানা সভ্যতা ওই সত্য গতিকে, ন্যায় ধর্মকে বাদ দিয়ে কি সার্থকতা লাভ করবে? পৃথিবীর ইতিহাসে সব যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি কি সর্বশেষে এই এক সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করছে না যে ধর্মধৃত জীবনই জীবন—অর্ধম মৃত্যুময়, অর্ধম জয়ী হয় না। ধর্মেই সবাই প্রতিষ্ঠিত।
সত্যই ধর্ম। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বলছেন, ‘যে ধর্ম কথা বলে, লোকে বলে, ইনি সত্য বলছেন। যিনি ধর্মকথা বলেন, লোকে বলে, ইনি সত্যকথাই বলছেন।’ দেখা যাচ্ছে, ধর্মই সত্য, সত্যই ধর্ম। অধিক কি সব সৃষ্টি সত্যে প্রতিষ্ঠিত। সত্য আশ্রিত, সত্যে প্রতিষ্ঠিত থেকেই বায়ু প্রবাহিত হয়, সূর্য তাপ দেয়, মেঘ বর্ষণ করে। এ সত্যই কৃষ্ণ। মহাভারতে বলা হয়েছে, ‘যতো ধর্মস্ততঃ কৃষ্ণঃ—যেখানে ধর্ম সেখানেই কৃষ্ণ এবং যেহেতু ধর্মেরই জয় হয়, সেহেতু যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই জয়।’ তাই ‘যতো ধর্মস্ততঃ কৃষ্ণঃ’ আবার ‘যতো কৃষ্ণস্ততো জয়ঃ’।
ভারতপ্রসিদ্ধ বীর ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ভীষ্মদেবও বলেছেন, ‘যতঃ কৃষ্ণস্ততো ধর্মঃ যতো ধর্মস্ততঃ কৃষ্ণঃ’—যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই ধর্ম, যেখানে ধর্ম সেখানেই কৃষ্ণ।’ কেবল ভীষ্মই নন, সেকালে প্রসিদ্ধ মুনিঋষিগণ ও ধার্মিক রাজন্যবর্গ সবাই তাকে সনাতন ধর্ম বলতেন। দৌতকর্ম করতে যখন কৃষ্ণ উপপ্লব্যপুরে আসেন, তখন ঘরে ঘরে সভায় চত্বরে সর্বত্রই লোকে বলাবলি করতে থাকে, ‘স হি ধর্মঃ সনাতনঃ’—তিনি নিশ্চয়ই সনাতন ধর্ম। ভীষ্ম বলেন, ‘এষ ধর্মশ্চ ধর্মজ্ঞ!’—ইনি ধর্মের জ্ঞাতা ও ধর্ম; তিনি ধর্মাত্মা, সর্বধর্মস্বরূপ। সঞ্জয় বলেছেন,
‘সত্যে প্রতিষ্ঠিতঃ কৃষ্ণঃ সত্যমত্র প্রতিষ্ঠিতম্।
সত্যাৎ সত্যং তু গোবিন্দ স্তস্মাৎ সত্যোহপি নামতঃ।’
কৃষ্ণ সত্যে প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত। গোবিন্দ সত্য হলেও সত্য বা সত্যের সত্য, সেহেতু তিনি নামত সত্য।
এই সত্য কী? না, ‘সর্বভূত দয়াই ধর্ম আর সত্যও প্রজাহিতকর। কারণ ধর্ম প্রজাগণকে ধারণ করে। ধারণ করে বলেই ধর্ম।’ এ জন্য ঋষিগণ বলেছেন, প্রাণীদের প্রভবার্থই ধর্ম প্রবচন করা হয়েছে। প্রাণীদের বিনাশের জন্য নয়। এ কারণে কৃষ্ণও বলেছেন, ‘বরং মিথ্যা বলবে, তবু কখনো প্রাণী বধ করবে না। কারণ প্রাণীদের রক্ষার জন্যই ধর্ম, আর ধর্মই সত্য।’ এই প্রভাবের অর্থ হলো বৃদ্ধি, উন্নতি, উৎপত্তি।
এ জন্য কৃষ্ণকৃত ধর্মকথা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। বিশ্বের সব ধর্মপথকে কৃষ্ণ আকর্ষণ করে মুক্তি দিচ্ছেন। এ জন্যই শ্রীভগবান কৃষ্ণমুখে বলেছেন,
‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ। (গীতা ৪/১১) পার্থ! মানুষ যে ভাব সহায়ে যে পথেই আমাকে (ঐকান্তিকভাবে) ভজনা করে, আমি তাকে সেভাবেই কৃপা করি, দর্শন দিই।’
শ্রীকৃষ্ণকথা অনন্ত অপার। পত্রিকার সীমিত পরিসরে এর বেশি বলা চলে না। এ কারণেই সুদীর্ঘকাল ব্যবধানেও বহু আলোচিত নিন্দিত কৃষ্ণ, অমলিন পবিত্রতা নিয়ে ক্রমেই সর্বত্র পৃথিবীতে মূর্ত হয়ে উঠছেন। বর্তমান শতাব্দীতে তাঁর চরিতকথা দেশসীমা পেরিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে ব্যপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে যাঁরা সংকীর্ণভাবে তাঁকে রূপসীমায় বদ্ধ করে চিত্রিত করেছেন, অচিরেই তাঁদের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনা অসীমস্পর্শে সুন্দর ও ব্যাপক হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই।
‘ওঁ বসুদেব সুতং দেবং কংস চানূরমর্দনম্।
দেবকী পরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগৎগুরুম্।’
স্বামী অমৃতত্বানন্দ: অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ আশ্রম ও মিশন, দিনাজপুর।

No comments

Powered by Blogger.