যুক্তি তর্ক গল্প-ব্যক্তিত্বই নারীর নিরাপত্তার সেরা বর্ম by আবুল মোমেন

উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক একটি নির্দেশনা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি পরিপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক-আশাক নিয়ে মাথায় কিছু ভাবনা এল। খেয়াল করে দেখেছি, উচ্চ আদালত বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধ করেনি; শুধু বলেছে, কাউকে বাধ্য করা যাবে না। এটিই গণতান্ত্রিক আচরণ, পরিণত বক্তব্য।


পশ্চিমের উন্নত দেশে বেশির ভাগ স্কুল থেকে ইউনিফর্মের কড়াকড়ি উঠে গেছে, সম্ভবত পোশাক ও সজ্জা সম্পর্কে সাধারণ একটা গাইডলাইন থাকে। তারা মনে করে, ইউনিফর্মের বাধ্যতার মধ্যে রেজিমেন্টেশনের ভাব আছে, গণতান্ত্রিক ভাব থাকে না। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে পরিবারে-পরিবারে অর্থবিত্তের তারতম্য ব্যাপক, সেখানে ইউনিফর্মের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবতে হয়। তা ছাড়া আমাদের জনসংখ্যা বেশি, তার অর্ধেকই আবার ছাত্র বয়সী, যাদের মধ্যে অর্ধেক হবে স্কুলগামী। এই সোয়া তিন বা সাড়ে তিন কোটি ছাত্রের পরিবারের মধ্যে নানা বৈপরীত্য ও বৈষম্য আছে এবং একটি বড় অংশ সরকারি সহায়তায় প্রদত্ত ইউনিফর্মের ওপর নির্ভরশীল। আর স্বভাবত বিশৃঙ্খলাপ্রবণ জাতির মধ্যে জীবনপ্রভাতে কিছু শৃঙ্খলা, সমতা ও ঐক্যের বীজ নানাভাবে ঢোকানোর প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যাবে না।
ইউনিফর্ম মেনে নিলে কেবল কী করা যাবে না তা বলে বিষয়টার নিষ্পত্তি হবে না, কেমন পোশাক পরতে হবে অর্থাৎ ড্রেস কোডের প্রশ্ন উঠবে।
যেকোনো বিষয়ে সংঘাত এড়িয়ে সমাধান করতে পারলে তার বাড়াু আর কিছু নেই। কেউই সংঘাত চায় না, কিন্তু আবার এও সত্য, চিন্তার বৈপরীত্য, এমনকি সংঘাত থেকেই দুই বিপরীত ভাবনার মধ্যে একটি বেগবান হয়, সেটি সঠিক হলে সমাজ এগোয়, বেঠিক হলে বিপর্যয় নেমে আসে।
সাম্প্রতিক একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি ও স্থানীয় কাগজের একজন মালিক এক তারকা হোটেলে মুখোমুখি হয়েছিলাম জার্মানির হাইনরিশ হাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের। আলোচনার একপর্যায়ে আপাত আধুনিক মালিক ভদ্রলোক বললেন, আমি মেয়েদের পর্দার পক্ষে, কারণ তারা ঢেকেঢুকে না থাকলে পুরুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। আমি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। কারণ এ তো পুরুষের নিজেকে অসভ্য জানোয়ারের (পশুকুল ক্ষমা করুক আমায়, কারণ তারা তো অসভ্য নয়) বেশি ভাবতে না পারারই স্বীকারোক্তি। যদি আমরা ধরে নিই যে নারীকে তার স্বাভাবিক পোশাকে অর্থাৎ শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরিহিতা দেখলেই কারও অসভ্যতা করতে ইচ্ছা করতে পারে, তবে তার সম্পর্কে ধারণাটি কী হবে? সোজাসাপ্টা উত্তর হবে, যে অসভ্যতা করে সে অসভ্য।
মানুষ তো আর ইতর প্রাণী নয় যে তার বিধিলিপি জন্মের সঙ্গেই বাঁধা থাকবে—অর্থাৎ বাঘের বাচ্চা হয়ে জন্মালে বাঘই হওয়া বিধিলিপি, হরিণশাবকের হরিণ, বানরপুত্রের বানর, হাঁসের ছানার হাঁস ইত্যাদি। একমাত্র মানুষের সন্তানকেই মানুষ হতে হয়। ঠিকমতো শিক্ষা না পেলে সে এরশাদ শিকদার থেকে হিটলার হয়ে অনেক অধর্মই করতে পারে।
মানবসমাজে অধর্ম কম হচ্ছে না। জরিপ চালালে দেখা যাবে, তার সিংহভাগ ঘটাচ্ছে পুরুষ। হেলেনের জন্য বা হেলেনদের পাওয়ার জন্য যে যুদ্ধ, তাও পুরুষের একান্ত কাম্যজনকে পাওয়ার অদম্য কামনার ফল। তাই প্রশ্নটা সভ্য হওয়ার, বিশেষত পুরুষের। মানুষের যে অগ্রগতির ইতিহাস, তাকে বলা হয় সভ্যতার ইতিহাস। সে ইতিহাসের বাহ্যরূপ হিসেবে আমরা দালানকোঠা তথা নানা স্থাপনা ও দৃশ্যমান কীর্তি দেখতে পাই বটে, কিন্তু সব ফসলই ফলে অন্তরের তথা হূদয় ও মস্তিষ্কের উত্কর্ষের জোরে। সেখানে মানুষের সভ্য হয়ে ওঠার বিষয়টিই মুখ্য।
এ অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমরা সবাই জানি গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার কথা। তিনি মানুষের সব জাগতিক দুঃখের কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন অপরিমিত কামনাকে। নিজেকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আটটি সোনালি পথের কথাও তিনি বলেছেন। ইসলামেও কি এসব শিক্ষা নেই? আছে। হাদিস বলছে, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। এ ছাড়া অতিমুনাফা, ব্যভিচার নিষিদ্ধ করার অর্থ, মানুষের জীবনাচরণে সর্বত্র সীমা টানতে চাওয়া হয়েছে। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না—এমন কথাও পবিত্র কোরআনেই আছে।
কিন্তু পুরুষ যদি বলে, নারীকে চোখের আড়াল করে না রাখলে আমার কামনা সীমা মানতে চাইবে না, দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় আমার নয়, মেয়েটির, তাতে পুরুষ দুভাবে নিজেকে খাটো করছে—প্রথমত, তার নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই বা নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা নেই, এ কথা কবুল করছে সে; দ্বিতীয়ত, এই নিয়ন্ত্রণহীনতার দায় নির্লজ্জভাবে অপরের ওপর চাপাচ্ছে। এতে তার অন্তর্নিহিত দুর্বলতা বা সমস্যাটি উদ্ঘাটিত হয়। সোজা কথা, পুরুষটি সমাজে চলার মতো মানবগুণের অধিকারী হয়নি। তার সভ্য হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া অসম্পন্ন রয়ে গেছে। আর সেটা অসম্পন্ন থেকে গেলে মেয়েকে ঘরে বন্দী করে কিংবা বোরকায় আবৃত করে রাখলেও নিস্তার পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে না। কারণ পুরুষ যদি শিকারি পশুর প্রবৃত্তি নিয়েই চলে (এটি জার্মান দার্শনিক স্পেংলারের কথা, আমার নয়) তাহলে সে কি সামান্য কাপড়ের বোরকা মানবে? বাংলাদেশে দরজা ভেঙে, বেড়া কেটে ঘরে ঢুকে ধর্ষণের কত ঘটনার কথা আমরা জানি!
রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কাহিনিটি মনে করুন। তাবৎ দুনিয়া চামড়া মুড়ে যেমন ধুলো থেকে পা রক্ষা করা যায়নি, তেমনি ঝেঁটিয়েও সব ধুলো উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই বিশ্বায়নের যুগে ঘরের কাছের মেয়েরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে ছেলের দল একটু সেয়ানা হতে না-হতেই সাইবার ক্যাফেতে, পিসিতে, হালের মুঠোফোনে গোপন পথে অবৈধ উত্তেজনার কল্পলোকের নেশায় পড়বে আর বাস্তবে তক্কে তক্কে থাকবে উত্তেজনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রের খোঁজে। ঠাকুরমার ঝুলিতে আছে, ‘ঘোমটার আড়ালে জিভ লকলক।’ স্বাভাবিক মেলামেশা, চলাফেরার সুযোগ না থাকলে দুই পক্ষের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কে অজ্ঞানতার বহর যেমন জমে পাহাড় হবে, তেমনি সহজাত কামনা অস্বাভাবিক বুভুক্ষার লকলকে জিহ্বাকে সামলাতে পারবে না। তখন উভয়ের স্বাভাবিক মেলামেশায় একটি সুন্দর প্রাণবন্ত স্বাস্থ্যকর সমাজ তৈরি অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে এই ঘটনাটাই ঘটেছে, যার প্রতিফলন হিসেবে ইভ টিজিং ও ধর্ষণের মহামারি লেগেছে এ সমাজে।
উচ্চ আদালত ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় মোল্লাদের জন্য সাঁকো নাড়ানোর কাজ করেনি। কেবল বোরকা পরায় বাধ্য করতে নিষেধ করেছে, না পরার কথা বলেনি। পর্দা, বোরকা কিংবা নারীর অবরুদ্ধ জীবন নিয়ে কথা আজ নতুন হচ্ছে না। এ দেশে যাঁকে নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসেবে সবাই শ্রদ্ধা জানাই, তাঁর প্রায় শতবর্ষ আগে রচিত বিখ্যাত অবরোধবাসিনীর পত্র একবার পড়ে দেখবেন পাঠক। তাঁর ভাবনাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে তাঁকে কি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব? কই, শ্রদ্ধার লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না, কেবল নাম জপেই সারা।
ওই একই সময়ে, ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন চলাকালে কয়েকজন তরুণ গড়েছিলেন আরেকটি সংগঠন, Anti Purdah League। সম্ভবত আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের কাজে উদ্দীপ্ত হয়ে তাঁরা এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শিখাগোষ্ঠীর সদস্য তরুণ আবুল ফজল প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘পর্দাপ্রথার সাহিত্যিক অসুবিধা’। তবে গ্রামবাংলায় পর্দার বাড়াবাড়ি কোনো কালেই ছিল না। সম্ভবত এর কারণ শালীনতা ও সৌন্দর্যে বাঙালি নারীর মূল পোশাক শাড়ির কোনো তুলনাই হয় না। তার ওপর বাকি সবই বাহুল্য, অপচয়। উপনিষদে আছে, দেবতারা বর চেয়ে ধ্যান করেছিলেন, তাদের ধ্যানে সন্তুষ্ট হয়ে প্রজাপতি ক্রমান্বয়ে তিনটি বর দিয়েছিলেন, তিনবারই তিনি একটিমাত্র ধ্বনির পুনরাবৃত্তি করেছেন। সেই ধ্বনিটি হলো ‘দ’। এতে তিনি বুঝিয়েছেন যথাক্রমে দান, দমন ও দয়া। তিনি বললেন, এই হচ্ছে ধর্ম। ব্যাখ্যা করে বলা যায়, দুঃখীকে দান করো, নিজের রিপুকে দমন করো এবং অন্যের প্রতি দয়াপ্রবণ হবে। বিখ্যাত ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট তাঁর জগদ্বিখ্যাত কবিতা ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ (পোড়ো জমি) এই মন্ত্র দিয়ে শেষ করেছিলেন। শত্রুকে নিজের মধ্যে পেলেপুষে বড় করে অন্যের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হওয়াকে কী বলব? নির্দ্বিধায় কাপুরুষতা বলা যায়। কাপুরুষতা দিয়ে রক্ষা পাওয়া যায় না, তার স্বখাত সলিলেই মরণ, যা বাংলাদেশে ঘটতে দেখছি আমরা।
প্রসঙ্গটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি। বেশ কয়েক বছর আগে লক্ষ্মীপুরের গ্রামে স্বল্পশিক্ষিতা নারীদের এক সমাবেশে কিছু বলতে গিয়েছিলাম। নানা কথার পর তাদের প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা বলুন তো, খালেদা-হাসিনা-সোনিয়া উপমহাদেশের এই তিন রাজনীতিকের মধ্যে নারী হিসেবে কাকে মনে হয় সবচেয়ে নিরাপদ? প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে উত্তর এল, সোনিয়া। আমি বললাম, পর্দার দিক থেকে তিনি তো সবচেয়ে পিছিয়ে, ঘোমটাও দেন না। এ কথায় প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে আলাদা করে তাঁদের ভাবনার পক্ষে চমত্কার সব কারণ বললেন তাঁরা। পক্ষের যুক্তিগুলো এ রকম, মানুষটা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, হাঁটা-চলায় দৃঢ়তার প্রকাশ ঘটে, কথাবার্তায় সাবলীল, পোশাকে ও চলায় স্মার্টনেস আছে ইত্যাদি।
সব শুনে আমি বললাম, আপনাদের ব্যাখ্যাগুলোকে একত্র করে যদি বলি ব্যক্তিত্ব, মেনে নেবেন? একেবারে হাততালি দিয়ে সমর্থন জানান তাঁরা। আমি বললাম, ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় কিসে? আবারও নানা ব্যাখ্যা, নানা পয়েন্ট উঠে এল। আমি এবার বলি, ব্যক্তিত্ব অর্জনের প্রধান মাধ্যম কি শিক্ষা? সবাই হাস্যোজ্জ্বল মুখে সমর্থন জানান।
আসলেই শিক্ষা, সুশিক্ষা, সঠিক শিক্ষাই হলো সব অনাচারের জবাব। সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই প্রধানত আসবে, তবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সঠিক শিক্ষায় রচিত ব্যক্তিত্বই হলো নারীর আত্মরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী বর্ম। গ্রামাঞ্চলে অনেক সময় দেখা মেলে অসাধারণ ব্যক্তিত্বশালিনী মহিলার, যার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বা খুবই অল্প। হয়তো পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা তাঁকে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পুঁজি ও পুষ্টি দিয়েছে। দেখবেন, এমন নারীকে পুরুষেরাও মান্য করে চলে, শ্রদ্ধা করে। বেগম সুফিয়া কামালের কথা ভাবুন একবার। তবে শিক্ষার প্রধান উৎস যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাই সেখানে ছেলেমেয়ের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। মেয়েদের পর্দার অন্তরালে ঠেলে দিয়ে সমান সুযোগ দেওয়া যাবে না, তাতে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ভঙ্গুর গাঁথুনির ওপর তৈরি হবে। কারণ, অজ্ঞতা, অস্পষ্টতা, অবিশ্বাস কোনো সম্পর্কেরই ভিত্তি হতে পারে না।
মেয়েদের অবরোধ থেকে মুক্তি দিতে হবে আর ছেলেদের মানুষ হওয়ার, বিশেষত মেয়েদের সঙ্গে আচরণে সভ্য হওয়ার সাধনায় উদ্বুদ্ধ করতে ও সহায়তা দিতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.