সপ্তাহের হালচাল-সংশোধনী বাতিলের সুফল জনগণ পাবে কি না by আব্দুল কাইয়ুম
একজন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন, সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হয়েছে তো কী হয়েছে? যে মানুষটি দিন আনে দিন খান, অথবা কৃষিকাজ করে কোনোভাবে খেয়ে-পরে বাঁচেন, তাঁর সুদিন ফিরবে কি? ওই দুটি সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে কি তাঁর রুটি-রুজি বাড়বে? তাঁর সন্তানের চাকরি, আয়-উপার্জনের সুবিধা হবে?
হয়তো বেগম জিয়া বা তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা মুষড়ে পড়েছেন, কারণ তাঁদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উৎসে একটা ঘা লেগেছে। হয়তো এরশাদের মনে ভয় ধরেছে, আবার না জেলে যেতে হয়। কিন্তু তাতে কী? তাঁদের পাপের ফল তাঁরা ভোগ করবেন, কিন্তু মানুষ কী পাবে?
এ প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংশোধনী দুটি বাতিলের পর সংবিধান সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংসদের বিশেষ কমিটি কাজ করছে। তাদের সামনে এটা প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হওয়া উচিত। এমন কিছু সংশোধনী তাদের আনতে হবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যেন এটা পরিষ্কার হয় যে সংবিধান মানুষের জন্য, তার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য।
সম্প্রতি এক দল তরুণ প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে ‘আমরা জানতে চাই’ শীর্ষক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশায় কর্মরত তরুণদের সংগঠন ‘জাগরী’ এ আলোচনার আয়োজন করে। উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ। একজন তরুণ প্রশ্ন করেন, সাধারণ মানুষের কাছে সংবিধান সংশোধনের তাৎপর্য কী? তাঁর আরেকটি প্রশ্ন ছিল, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা হচ্ছে। তাহলে আমরা কি পেছনে ফিরে যাচ্ছি, সামনে না এগিয়ে?
আমরা অনেক সময় সংবিধানকে জনগণের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি না। কিন্তু সংবিধান তো জনগণের ইচ্ছারই প্রতিফলন। ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক, ড. আসিফ নজরুল, মিজানুর রহমান খান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ সেদিন এ বিষয়টির ওপরই গুরুত্ব দিলেন। জনগণের জীবনের সঙ্গে সংবিধানের সংযোগ গভীরতর করার জন্যই বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দেখা দরকার। কারণ, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার অন্যতম ফসল। তাই যখন আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলব, তখন যেন মনে রাখি, জনগণের জন্যই সেটা করতে হবে। আর যদি সেটা করা হয়, তাহলে তা আর পেছনে ফেরা হবে না। সেটা হবে জনগণের সংবিধানের মূল কাঠামোয় ফিরে যাওয়া।
এর অর্থ কোনোভাবেই যেন পেছনে ফিরে যাওয়া না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে আইনপ্রণেতাদের। কীভাবে সেটা তাঁরা করতে পারেন? এর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, গণতন্ত্র শক্তিশালী করা। যদি সংবিধানে গণতন্ত্র দৃঢ়তর করার বিধানগুলো যথাযথভাবে প্রতিস্থাপিত হয়, যদি বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়, যদি আইনের শাসন থাকে, যদি জনগণের সুবিচার পাওয়ার সুযোগ অবারিত হয়, তাহলেই সেই সংবিধানের সুফল সাধারণ মানুষের জীবনে তাৎপর্যবহ হবে।
সংবিধানের সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক কী, তা অনেক সময় বোঝা যায় না। মনে হয় সংবিধান শুধু বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার, সাধারণ মানুষের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু এবার সে ভুল ধারণা অনেকটা কেটে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সিদ্দিক আহমদ একজন সাধারণ মানুষ। তিনি ২৫ বছর ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, সামরিক আইন কীভাবে একজন নিরীহ মানুষের জীবনের সব সুখ-স্বস্তি কেড়ে নিতে পারে। সাধারণ আদালতে বিচার হলে তাঁর সান্ত্বনা থাকত। লক্ষণীয় যে এরশাদের সামরিক শাসনের ছায়া তাঁর জীবন থেকে এখনো মুছে যায়নি। কারণ এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন জড়িত, যা এখনো অমীমাংসিত বা রায় বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়নি। তবে এতটুকু বলা যায়, সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্ট যখন সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তখন হাইকোর্টের রায় শেষ নয়। তাই বলা যায়, আপিল বিভাগের রায়ের ওপর নির্ভর করছে সিদ্দিক আহমদের অভিযুক্ত হওয়া-সংক্রান্ত প্রশ্নের ফয়সালা। তিনি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৪ সালে এক হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি সামরিক আদালতে স্থানান্তরিত হলে তিনি আত্মগোপনে যান। তখন ছিল এরশাদের সামরিক শাসন। সামরিক আদালতে তাঁর যাবজ্জীবন কারাবাস হয়। যেহেতু সামরিক আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তেমন থাকে না, তাই বানোয়াট অভিযোগে তাঁর জেল হয়ে গেল। ২১ বছর তিনি ফেরারি জীবন কাটান। এরশাদের পতন হলেও সামরিক আইনে সাজা তাঁর পিছু ছাড়ে না। ২০০৬ সালের ২ জুলাই তাঁকে পটিয়া থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি জেলে বসে সামরিক শাসনের ঘানি টানতে শুরু করেন। সৌভাগ্যবশত একজন আইনজ্ঞ তাঁর বিষয়টি নিয়ে আদালতে যান। এরই সূত্র ধরে আদালত সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করেন। এরশাদের সামরিক শাসনের আমলের কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়। তাঁর অবৈধ ক্ষমতা দখলও বেআইনি বলে এখন গণ্য হবে। দেশে অবাধ গণতন্ত্র না থাকলে সাধারণ মানুষ কতভাবে হয়রানির শিকার হন, এটা তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
আমাদের সামনে আছে আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এম এ তাহেরের ফাঁসি হয়। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সেই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ হয়েছে। সামরিক ফরমানের আওতায় আদালত গঠন এবং গোপন বিচারে তাঁর ফাঁসি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন। সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক আইনের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া অবিচার-অনিয়মের প্রতিকার চাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। এবং সেটা করা হয়েছিল ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ প্রবক্তা বলে দাবিদার জেনারেল জিয়ার আমলে। সুতরাং সংবিধান সংশোধনীর সময় বিশেষ নজর দিতে হবে, যেন আর কেউ কখনো সামরিক শাসন জারি করে বা সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে জনগণের অধিকার হরণ করতে না পারেন।
আইন করে সামরিক শাসন বন্ধ করা যায় কি না, এ প্রশ্ন অনেকে তুলছেন। এটা ঠিক, আইন পাকিস্তানের সংবিধানেও আছে, কিন্তু সেখানে চারবার সামরিক শাসন হয়েছে, ভবিষ্যতেও যে হবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারেন না। প্রতিবার সামরিক শাসন জারির সময় অরাজকতা ও দুঃশাসনের অজুহাত দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশেও ঠিক একই কারণ দেখিয়ে দুবার সামরিক শাসন এসেছে। তাই সামরিক শাসন বন্ধ করার জন্য প্রথম বন্ধ করতে হবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, অকল্পনীয় দুর্নীতি, দলীয়প্রীতি, আত্মীয়প্রীতি প্রভৃতি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সংবিধানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দরকার নেই। আইনেরও প্রয়োজন আছে। এখনো প্রচলিত আইনে নানাভাবে, নানা কথায় সংবধানবহির্ভূত উপায়ে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে বিধান আছে। কিন্তু সেগুলো আরও স্পষ্ট করা দরকার। পরিষ্কার ভাষায় লেখা দরকার, কেউ কখনো সামরিক শাসন কায়েম কিংবা সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে ক্ষমতা দখল করলে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। এ রকম বিধান সামরিক আইনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রধান শর্ত সৃষ্টি করবে।
কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না আনতে পারলে মানুষের জীবনের দুর্ভোগ কমবে না। এই যে সিদ্দিক আহমদ দীর্ঘ ২৫ বছর সামরিক শাসনের অভিশাপে জর্জরিত হলেন, এ রকম অনেক উদাহরণ আছে গণতান্ত্রিক শাসনামলেও। মিথ্যা মামলায় যুগ যুগ ধরে জেলে বন্দী থাকার ঘটনা প্রতিটি সরকারের আমলেই দেখা গেছে। কারণ, সংবিধানে মানবাধিকার, সব নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা থাকলেও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের রাজনৈতিক অসততার কারণে সেগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে সব সময় প্রতিফলিত হয় না।
সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে মানুষ ভালো কিছু পাবে না। আজ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। বিরোধী দল সংসদে যায় না, এ নিয়ে সরকারি দলের মাথাব্যথাও নেই। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে আর সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল। এসব রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূর করার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এখনই।
সংবিধান সংশোধন হবে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়, সাধারণ মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানোর ব্যবস্থা করাই মূল কথা। সে জন্য সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্ব অনেক বেশি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
এ প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সংশোধনী দুটি বাতিলের পর সংবিধান সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংসদের বিশেষ কমিটি কাজ করছে। তাদের সামনে এটা প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হওয়া উচিত। এমন কিছু সংশোধনী তাদের আনতে হবে, যা সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যেন এটা পরিষ্কার হয় যে সংবিধান মানুষের জন্য, তার জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য।
সম্প্রতি এক দল তরুণ প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে সংবিধান সংশোধন বিষয়ে ‘আমরা জানতে চাই’ শীর্ষক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশায় কর্মরত তরুণদের সংগঠন ‘জাগরী’ এ আলোচনার আয়োজন করে। উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞ। একজন তরুণ প্রশ্ন করেন, সাধারণ মানুষের কাছে সংবিধান সংশোধনের তাৎপর্য কী? তাঁর আরেকটি প্রশ্ন ছিল, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা হচ্ছে। তাহলে আমরা কি পেছনে ফিরে যাচ্ছি, সামনে না এগিয়ে?
আমরা অনেক সময় সংবিধানকে জনগণের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি না। কিন্তু সংবিধান তো জনগণের ইচ্ছারই প্রতিফলন। ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক, ড. আসিফ নজরুল, মিজানুর রহমান খান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ সেদিন এ বিষয়টির ওপরই গুরুত্ব দিলেন। জনগণের জীবনের সঙ্গে সংবিধানের সংযোগ গভীরতর করার জন্যই বাহাত্তরে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দেখা দরকার। কারণ, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার অন্যতম ফসল। তাই যখন আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলব, তখন যেন মনে রাখি, জনগণের জন্যই সেটা করতে হবে। আর যদি সেটা করা হয়, তাহলে তা আর পেছনে ফেরা হবে না। সেটা হবে জনগণের সংবিধানের মূল কাঠামোয় ফিরে যাওয়া।
এর অর্থ কোনোভাবেই যেন পেছনে ফিরে যাওয়া না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে আইনপ্রণেতাদের। কীভাবে সেটা তাঁরা করতে পারেন? এর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, গণতন্ত্র শক্তিশালী করা। যদি সংবিধানে গণতন্ত্র দৃঢ়তর করার বিধানগুলো যথাযথভাবে প্রতিস্থাপিত হয়, যদি বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়, যদি আইনের শাসন থাকে, যদি জনগণের সুবিচার পাওয়ার সুযোগ অবারিত হয়, তাহলেই সেই সংবিধানের সুফল সাধারণ মানুষের জীবনে তাৎপর্যবহ হবে।
সংবিধানের সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক কী, তা অনেক সময় বোঝা যায় না। মনে হয় সংবিধান শুধু বিশেষজ্ঞদের ব্যাপার, সাধারণ মানুষের সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু এবার সে ভুল ধারণা অনেকটা কেটে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সিদ্দিক আহমদ একজন সাধারণ মানুষ। তিনি ২৫ বছর ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, সামরিক আইন কীভাবে একজন নিরীহ মানুষের জীবনের সব সুখ-স্বস্তি কেড়ে নিতে পারে। সাধারণ আদালতে বিচার হলে তাঁর সান্ত্বনা থাকত। লক্ষণীয় যে এরশাদের সামরিক শাসনের ছায়া তাঁর জীবন থেকে এখনো মুছে যায়নি। কারণ এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন জড়িত, যা এখনো অমীমাংসিত বা রায় বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়নি। তবে এতটুকু বলা যায়, সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্ট যখন সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তখন হাইকোর্টের রায় শেষ নয়। তাই বলা যায়, আপিল বিভাগের রায়ের ওপর নির্ভর করছে সিদ্দিক আহমদের অভিযুক্ত হওয়া-সংক্রান্ত প্রশ্নের ফয়সালা। তিনি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৪ সালে এক হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি সামরিক আদালতে স্থানান্তরিত হলে তিনি আত্মগোপনে যান। তখন ছিল এরশাদের সামরিক শাসন। সামরিক আদালতে তাঁর যাবজ্জীবন কারাবাস হয়। যেহেতু সামরিক আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তেমন থাকে না, তাই বানোয়াট অভিযোগে তাঁর জেল হয়ে গেল। ২১ বছর তিনি ফেরারি জীবন কাটান। এরশাদের পতন হলেও সামরিক আইনে সাজা তাঁর পিছু ছাড়ে না। ২০০৬ সালের ২ জুলাই তাঁকে পটিয়া থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি জেলে বসে সামরিক শাসনের ঘানি টানতে শুরু করেন। সৌভাগ্যবশত একজন আইনজ্ঞ তাঁর বিষয়টি নিয়ে আদালতে যান। এরই সূত্র ধরে আদালত সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করেন। এরশাদের সামরিক শাসনের আমলের কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়। তাঁর অবৈধ ক্ষমতা দখলও বেআইনি বলে এখন গণ্য হবে। দেশে অবাধ গণতন্ত্র না থাকলে সাধারণ মানুষ কতভাবে হয়রানির শিকার হন, এটা তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
আমাদের সামনে আছে আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এম এ তাহেরের ফাঁসি হয়। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সেই বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ হয়েছে। সামরিক ফরমানের আওতায় আদালত গঠন এবং গোপন বিচারে তাঁর ফাঁসি কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন। সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক আইনের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া অবিচার-অনিয়মের প্রতিকার চাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল। এবং সেটা করা হয়েছিল ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ প্রবক্তা বলে দাবিদার জেনারেল জিয়ার আমলে। সুতরাং সংবিধান সংশোধনীর সময় বিশেষ নজর দিতে হবে, যেন আর কেউ কখনো সামরিক শাসন জারি করে বা সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে জনগণের অধিকার হরণ করতে না পারেন।
আইন করে সামরিক শাসন বন্ধ করা যায় কি না, এ প্রশ্ন অনেকে তুলছেন। এটা ঠিক, আইন পাকিস্তানের সংবিধানেও আছে, কিন্তু সেখানে চারবার সামরিক শাসন হয়েছে, ভবিষ্যতেও যে হবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারেন না। প্রতিবার সামরিক শাসন জারির সময় অরাজকতা ও দুঃশাসনের অজুহাত দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশেও ঠিক একই কারণ দেখিয়ে দুবার সামরিক শাসন এসেছে। তাই সামরিক শাসন বন্ধ করার জন্য প্রথম বন্ধ করতে হবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, অকল্পনীয় দুর্নীতি, দলীয়প্রীতি, আত্মীয়প্রীতি প্রভৃতি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সংবিধানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দরকার নেই। আইনেরও প্রয়োজন আছে। এখনো প্রচলিত আইনে নানাভাবে, নানা কথায় সংবধানবহির্ভূত উপায়ে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে বিধান আছে। কিন্তু সেগুলো আরও স্পষ্ট করা দরকার। পরিষ্কার ভাষায় লেখা দরকার, কেউ কখনো সামরিক শাসন কায়েম কিংবা সংবিধানবহির্ভূত উপায়ে ক্ষমতা দখল করলে তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। এ রকম বিধান সামরিক আইনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রধান শর্ত সৃষ্টি করবে।
কিন্তু রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না আনতে পারলে মানুষের জীবনের দুর্ভোগ কমবে না। এই যে সিদ্দিক আহমদ দীর্ঘ ২৫ বছর সামরিক শাসনের অভিশাপে জর্জরিত হলেন, এ রকম অনেক উদাহরণ আছে গণতান্ত্রিক শাসনামলেও। মিথ্যা মামলায় যুগ যুগ ধরে জেলে বন্দী থাকার ঘটনা প্রতিটি সরকারের আমলেই দেখা গেছে। কারণ, সংবিধানে মানবাধিকার, সব নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা থাকলেও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের রাজনৈতিক অসততার কারণে সেগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে সব সময় প্রতিফলিত হয় না।
সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা না থাকলে মানুষ ভালো কিছু পাবে না। আজ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। বিরোধী দল সংসদে যায় না, এ নিয়ে সরকারি দলের মাথাব্যথাও নেই। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে আর সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিরোধী দল। এসব রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূর করার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এখনই।
সংবিধান সংশোধন হবে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়, সাধারণ মানুষের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানোর ব্যবস্থা করাই মূল কথা। সে জন্য সরকার ও বিরোধী দলের দায়িত্ব অনেক বেশি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments