বাজেট বিশ্লেষণ-সংকট থেকে উত্তরণে কিছু সাহসী পদক্ষেপ by মইনুল ইসলাম
বাজেট সরকারের বার্ষিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি। বাজেটে সরকারের রাজনৈতিক দর্শন প্রতিফলিত হলেও এর বাস্তবায়নের ওপরই তার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত-উত্থাপিত বাজেট বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই বলতে হয়, বর্তমান অর্থবছরে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যেসব
টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে উত্তরণের জন্য আগামী অর্থবছরের (২০১২-১৩) বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এটিকে আমি ইতিবাচক বলে মনে করি।
অনেকেই এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বাজেটে যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি যোগ করলে প্রাক্কলিত ব্যয়কে অযৌক্তিক বলা যাবে না। তবে অর্থমন্ত্রী মুদ্রাস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, তা বাস্তবায়ন কঠিনই হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যেভাবে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি খুব একটা কমানো যাবে বলে মনে হয় না।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যয় খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি, ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা রয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তা হলো, টাকার অঙ্কে বাড়লেও শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের অনুপাত কমেছে। চলতি বছরে যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছিল, আগামী বছরে তা নেমে গিয়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। এটি মন্দ নজির হয়ে থাকবে।
সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ইতিবাচক যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হলো রাজস্ব খাতে আয়কর বাড়ানোর লক্ষ্যে বেশ কিছু সাহসী দক্ষেপ। ব্যক্তি আয়করের সীমা না বাড়লেও আগে যেখানে ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ ছিল দুই হাজার টাকা; সেটি বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যেখানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৩ হাজার ২১২ জন, সেখানে এনবি আর চেয়ারম্যান দাবি করছেন, দেশে এক লাখ টাকার বেশি কর দেওয়ার লোক এক হাজারেরও কম। এখানে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের দুর্বলতা ও দুর্নীতি আছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এর প্রতিকারে কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি।
বরাবরের মতো এবারও বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কও আছে। তবে এবার নির্ধারিত করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দেওয়ার যে বিধান রাখা হয়েছে, সেটি মন্দের ভালো। কিন্তু আমাদের করণীয় হলো, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধ এবং কালোটাকার উৎসগুলো বন্ধ করা। এই উৎস বন্ধ না করতে পারলে জাতীয় সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারকে উৎসাহিত করতে বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে আশঙ্কা, আবারও বাজারে বুদ্বুদ সৃষ্টি হতে পারে। ২০১০ সালে এই বুদ্বুদ সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাঘববোয়ালরা। এবারও শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর ও শুল্কের যে বিন্যাস করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের ওপর মুদ্রাস্ফীতির চাপ তেমন কমবে না। গাড়ি, এয়ারকন্ডিশনারসহ বিলাস দ্রব্যের আমদানি কর বাড়ানো হয়েছে। এতে এসব পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত হবে। অন্যদিকে ভোজ্যতেল, ওষুধ শিল্পের যন্ত্রপাতি, শিশুখাদ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। সুষ্ঠু তদারকি করা গেলে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আয়ের ওপর যে টার্নওভার কর-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও ভালো পদক্ষেপ। এতে এই খাতের উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন।
মোবাইল টেলিফোনে কলের ওপর যে ২ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে, তাতেও রাজস্ব আয় কিছুটা বাড়বে। অনেকে এই পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও আমি মনে করি, আমাদের এখানে যথেচ্ছ মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়। অপ্রয়োজনীয় কথা বলা কমলে কাজ বেশি হবে।
বাজেটে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের জন্য অনেকগুলো সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা আছে। সরকারের এই পদক্ষেপ উৎসাহব্যঞ্জক। সব মিল-কারখানার মালিককে শোধনাগার স্থাপনে বাধ্য করতে পারলে আমরা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাব।
এবারের বাজেটে আরেকটি ভালো পদক্ষেপ হলো, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে একটি মাস্টার ডেটাবেইস তৈরির কথাও বলা হয়েছে। এটি করা সম্ভব হলে এই কর্মসূচির দুর্নীতিও অনেকাংশে কমবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের পছন্দমতো লোককে সুবিধা দেন, নিজেরাও লুটপাট করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু মাস্টার ডেটাবেইস তৈরি করে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করলে জানা যাবে কে এই কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে, আর কে পাচ্ছে না।
আরেকটি ভালো উদ্যোগ হলো, পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে জানুয়ারি ২০১৩ থেকে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন বা পিএসআই তুলে দেওয়া। যে উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তা সফল হয়নি। বরং পিএসআইয়ের নামে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে, যার দায় ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়।
বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঘাটতি মেটানো। অর্থমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত ও অন্যান্য উৎস থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা বলেছেন, বাকি ১৩ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে। জিডিপির আকারের তুলনায় এই অর্থ হয়তো বেশি নয়, কিন্তু এর নেতিবাচক দিক হলো, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ব্যাংকঋণ পেতে সমস্যা হতে পারে, যেমনটি এবার হয়েছে। তবে আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার চেয়েও তারল্যসংকটের বড় কারণ হলো খেলাপি ঋণ। পুনঃপুন তফসিলকরণের মাধ্যমে ঋণখেলাপিরা আইনের ফাঁক গলিয়ে পার পেলেও ব্যাংকিং খাতকে দারুণ ঝুঁকিতে ফেলেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় দুবার ঋণ পুনঃ তফসিলকরণের নিয়ম থাকলেও ফজলুর রহমানেরা ১৩ বার পর্যন্ত ঋণ পুনঃ তফসিল করিয়ে নিয়েছেন।
এখন ঋণখেলাপিরা নিজেরাই ব্যাংক করেছেন। ফলে নিজেদের ব্যাংক থেকে তাঁরা ইচ্ছামতো ঋণ নিচ্ছেন। এসব প্রতিরোধের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হলেও অজ্ঞাত কারণে তারা সেই দায়িত্ব পালন না করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ব্যাংকে তারল্য ঠিক রাখতে হলে সরকারের ঋণ কমানোর পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকার মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিলে সরকারের দেয় সুদের পরিমাণও বাড়বে। অতএব সরকারকে বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে।
আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। সুদ বাদ দিলে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বাজেটে যুক্ত হবে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে এখন যেসব সমস্যা চলছে, তা মিটিয়ে ফেলতে পারলে এই অর্থ পাওয়া কঠিন হবে না বলে মনে করি। তবে বিদেশি ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়াকে আমি খারাপ মনে করি না। এতে প্রমাণিত হয়, আমাদের অর্থনীতি বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যনির্ভরতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
এই বাজেটে যেমন অর্থনীতিকে গতিশীল করতে বেশ কিছু সৎ অঙ্গীকার আছে, তেমনি কিছু দুর্বলতার কথাও অস্বীকার করা যাবে না। অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের জ্বালানি পরিকল্পনায় তার প্রতিফলন নেই। সরকার তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল প্রকল্প নিয়ে যত তৎপরতা দেখিয়েছে, ভর্তুকি দিয়েছে গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার বাড়াতে, তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত শ্লথ।
অর্থমন্ত্রী নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুতে ২০২০ সাল নাগাদ ৫০০ মেগাওয়াট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি খুবই দূরবর্তী। এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র সোলার প্যানেল নির্মাণ শুল্কমুক্ত রাখা গেলে কেবল গ্রাম নয়, শহরেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়বে।
একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী এলপিজি সিলিন্ডার ক্রয়ে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখলে ভোক্তারা উপকৃত হতেন। গরিব মানুষকে শেষ পর্যন্ত সিলিন্ডারের গ্যাসই ব্যবহার করতে হবে। পাইপলাইনে নতুন করে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি শুল্কমুক্ত করা উচিত ছিল। এলপিজি সিলিন্ডারের সরকার নির্ধারিত দাম ৭৫০ টাকা হলেও ১৭০০-১৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই অতি মুনাফার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন।
সবশেষে অর্থমন্ত্রী বাজেটে যে ৭ দশমিক ২ প্রবৃদ্ধি ধরেছেন, তা কতটা বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক সময় প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা রয়েছে। এই কুঅভ্যাস থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
এই সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে কৃষি খাতকে বিবেচনা করা হয়। সে ক্ষেত্রে এবার কৃষিতে ভর্তুকি কিছুটা কমানো হলেও গত বছরেরটা যোগ হলে নয় হাজার কোটি টাকার মতো হবে। তবে অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, আমরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে যতটা মনোযোগ দিয়েছি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতের উন্নয়নে তা দিইনি। সরকার গবাদিপশুর খাদ্য ও ফিশ ফিডে ভর্তুকি দিলে গবাদি পশু ও মৎস্য উৎপাদন অনেক বাড়বে।
সরকার স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে যে ২১ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে, যা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। রাজনৈতিক স্বার্থে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে সাধারণ মানুষের চেয়ে দলীয় লোকজনই বেশি লাভবান হয়। তারচেয়ে বড় সমস্যা হলো যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া। এবার এডিপির ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে প্রথম ১০ মাসে। বাকি ৪৫ শতাংশ দুই মাসে বাস্তবায়ন করতে হলে চুরি ও অপচয় বাড়বেই। আগামী অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নে সরকার বিষয়টির দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে বলে আশা করি।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
অনেকেই এক লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বাজেটে যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি যোগ করলে প্রাক্কলিত ব্যয়কে অযৌক্তিক বলা যাবে না। তবে অর্থমন্ত্রী মুদ্রাস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, তা বাস্তবায়ন কঠিনই হবে। বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যেভাবে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি খুব একটা কমানো যাবে বলে মনে হয় না।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যয় খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি, ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টা রয়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তা হলো, টাকার অঙ্কে বাড়লেও শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের অনুপাত কমেছে। চলতি বছরে যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছিল, আগামী বছরে তা নেমে গিয়ে দাঁড়াবে ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। এটি মন্দ নজির হয়ে থাকবে।
সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ইতিবাচক যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হলো রাজস্ব খাতে আয়কর বাড়ানোর লক্ষ্যে বেশ কিছু সাহসী দক্ষেপ। ব্যক্তি আয়করের সীমা না বাড়লেও আগে যেখানে ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ ছিল দুই হাজার টাকা; সেটি বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যেখানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৩ হাজার ২১২ জন, সেখানে এনবি আর চেয়ারম্যান দাবি করছেন, দেশে এক লাখ টাকার বেশি কর দেওয়ার লোক এক হাজারেরও কম। এখানে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের দুর্বলতা ও দুর্নীতি আছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এর প্রতিকারে কোনো দিকনির্দেশনা পাইনি।
বরাবরের মতো এবারও বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্কও আছে। তবে এবার নির্ধারিত করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দেওয়ার যে বিধান রাখা হয়েছে, সেটি মন্দের ভালো। কিন্তু আমাদের করণীয় হলো, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধ এবং কালোটাকার উৎসগুলো বন্ধ করা। এই উৎস বন্ধ না করতে পারলে জাতীয় সম্পদ বিদেশে পাচার হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারকে উৎসাহিত করতে বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে আশঙ্কা, আবারও বাজারে বুদ্বুদ সৃষ্টি হতে পারে। ২০১০ সালে এই বুদ্বুদ সৃষ্টির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাঘববোয়ালরা। এবারও শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর ও শুল্কের যে বিন্যাস করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের ওপর মুদ্রাস্ফীতির চাপ তেমন কমবে না। গাড়ি, এয়ারকন্ডিশনারসহ বিলাস দ্রব্যের আমদানি কর বাড়ানো হয়েছে। এতে এসব পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত হবে। অন্যদিকে ভোজ্যতেল, ওষুধ শিল্পের যন্ত্রপাতি, শিশুখাদ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। সুষ্ঠু তদারকি করা গেলে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আয়ের ওপর যে টার্নওভার কর-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোও ভালো পদক্ষেপ। এতে এই খাতের উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন।
মোবাইল টেলিফোনে কলের ওপর যে ২ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে, তাতেও রাজস্ব আয় কিছুটা বাড়বে। অনেকে এই পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও আমি মনে করি, আমাদের এখানে যথেচ্ছ মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়। অপ্রয়োজনীয় কথা বলা কমলে কাজ বেশি হবে।
বাজেটে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের জন্য অনেকগুলো সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা আছে। সরকারের এই পদক্ষেপ উৎসাহব্যঞ্জক। সব মিল-কারখানার মালিককে শোধনাগার স্থাপনে বাধ্য করতে পারলে আমরা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রেহাই পাব।
এবারের বাজেটে আরেকটি ভালো পদক্ষেপ হলো, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়ে একটি মাস্টার ডেটাবেইস তৈরির কথাও বলা হয়েছে। এটি করা সম্ভব হলে এই কর্মসূচির দুর্নীতিও অনেকাংশে কমবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের পছন্দমতো লোককে সুবিধা দেন, নিজেরাও লুটপাট করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু মাস্টার ডেটাবেইস তৈরি করে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করলে জানা যাবে কে এই কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে, আর কে পাচ্ছে না।
আরেকটি ভালো উদ্যোগ হলো, পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে জানুয়ারি ২০১৩ থেকে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন বা পিএসআই তুলে দেওয়া। যে উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তা সফল হয়নি। বরং পিএসআইয়ের নামে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে গেছে, যার দায় ভোক্তাদেরই বহন করতে হয়।
বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ হলো ঘাটতি মেটানো। অর্থমন্ত্রী অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত ও অন্যান্য উৎস থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের কথা বলেছেন, বাকি ১৩ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে। জিডিপির আকারের তুলনায় এই অর্থ হয়তো বেশি নয়, কিন্তু এর নেতিবাচক দিক হলো, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ব্যাংকঋণ পেতে সমস্যা হতে পারে, যেমনটি এবার হয়েছে। তবে আমি মনে করি, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার চেয়েও তারল্যসংকটের বড় কারণ হলো খেলাপি ঋণ। পুনঃপুন তফসিলকরণের মাধ্যমে ঋণখেলাপিরা আইনের ফাঁক গলিয়ে পার পেলেও ব্যাংকিং খাতকে দারুণ ঝুঁকিতে ফেলেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় দুবার ঋণ পুনঃ তফসিলকরণের নিয়ম থাকলেও ফজলুর রহমানেরা ১৩ বার পর্যন্ত ঋণ পুনঃ তফসিল করিয়ে নিয়েছেন।
এখন ঋণখেলাপিরা নিজেরাই ব্যাংক করেছেন। ফলে নিজেদের ব্যাংক থেকে তাঁরা ইচ্ছামতো ঋণ নিচ্ছেন। এসব প্রতিরোধের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হলেও অজ্ঞাত কারণে তারা সেই দায়িত্ব পালন না করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ব্যাংকে তারল্য ঠিক রাখতে হলে সরকারের ঋণ কমানোর পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকার মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিলে সরকারের দেয় সুদের পরিমাণও বাড়বে। অতএব সরকারকে বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে।
আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। সুদ বাদ দিলে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বাজেটে যুক্ত হবে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে এখন যেসব সমস্যা চলছে, তা মিটিয়ে ফেলতে পারলে এই অর্থ পাওয়া কঠিন হবে না বলে মনে করি। তবে বিদেশি ঋণ ও অনুদান কমে যাওয়াকে আমি খারাপ মনে করি না। এতে প্রমাণিত হয়, আমাদের অর্থনীতি বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যনির্ভরতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
এই বাজেটে যেমন অর্থনীতিকে গতিশীল করতে বেশ কিছু সৎ অঙ্গীকার আছে, তেমনি কিছু দুর্বলতার কথাও অস্বীকার করা যাবে না। অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের জ্বালানি পরিকল্পনায় তার প্রতিফলন নেই। সরকার তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল প্রকল্প নিয়ে যত তৎপরতা দেখিয়েছে, ভর্তুকি দিয়েছে গ্যাস ও কয়লার ব্যবহার বাড়াতে, তাদের কার্যক্রম অত্যন্ত শ্লথ।
অর্থমন্ত্রী নবায়নযোগ্য সৌরবিদ্যুতে ২০২০ সাল নাগাদ ৫০০ মেগাওয়াট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি খুবই দূরবর্তী। এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র সোলার প্যানেল নির্মাণ শুল্কমুক্ত রাখা গেলে কেবল গ্রাম নয়, শহরেও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়বে।
একই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী এলপিজি সিলিন্ডার ক্রয়ে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখলে ভোক্তারা উপকৃত হতেন। গরিব মানুষকে শেষ পর্যন্ত সিলিন্ডারের গ্যাসই ব্যবহার করতে হবে। পাইপলাইনে নতুন করে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি শুল্কমুক্ত করা উচিত ছিল। এলপিজি সিলিন্ডারের সরকার নির্ধারিত দাম ৭৫০ টাকা হলেও ১৭০০-১৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এই অতি মুনাফার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন।
সবশেষে অর্থমন্ত্রী বাজেটে যে ৭ দশমিক ২ প্রবৃদ্ধি ধরেছেন, তা কতটা বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বার্থে অনেক সময় প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা রয়েছে। এই কুঅভ্যাস থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
এই সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে কৃষি খাতকে বিবেচনা করা হয়। সে ক্ষেত্রে এবার কৃষিতে ভর্তুকি কিছুটা কমানো হলেও গত বছরেরটা যোগ হলে নয় হাজার কোটি টাকার মতো হবে। তবে অর্থমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, আমরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে যতটা মনোযোগ দিয়েছি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতের উন্নয়নে তা দিইনি। সরকার গবাদিপশুর খাদ্য ও ফিশ ফিডে ভর্তুকি দিলে গবাদি পশু ও মৎস্য উৎপাদন অনেক বাড়বে।
সরকার স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে যে ২১ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে, যা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। রাজনৈতিক স্বার্থে গৃহীত প্রকল্পগুলোতে সাধারণ মানুষের চেয়ে দলীয় লোকজনই বেশি লাভবান হয়। তারচেয়ে বড় সমস্যা হলো যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া। এবার এডিপির ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে প্রথম ১০ মাসে। বাকি ৪৫ শতাংশ দুই মাসে বাস্তবায়ন করতে হলে চুরি ও অপচয় বাড়বেই। আগামী অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নে সরকার বিষয়টির দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে বলে আশা করি।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments