মূল রচনা-যে শহর চোরাবালি

আর দশটা সংস্থার মতো দান ও সাহায্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাটা পছন্দ নয় একমাত্রার তরুণদের। নিজেদের অর্থসংস্থান করে নিতে হবে নিজেদেরই। এই ইচ্ছে থেকে শুরু রসায়ন রেস্তোরাঁর। মিরপুর ১০-এর দিকে যেতে ইউসেপ স্কুলের পাশেই চোখে পড়বে চমৎকার এই রেস্তোরাঁটি।


খাবারে বৈচিত্র্য আর দারুণ এক আড্ডার পরিবেশের সুবাদে ইতিমধ্যেই অনেকের নজর কেড়েছে রসায়ন। কেবল খেতে বা খাওয়াতে নয়, এ শহরের অনেক স্বপ্নবান তরুণের তর্ক-বিতর্ক আর আড্ডার মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে রসায়ন। চাইলে ছুটির দিনের পাঠকেরা একবার ঘুরে আসতে পারেন সেখান থেকে। আর রসায়নের সব লভ্যাংশ ব্যয় করা হয় পিছিয়ে পড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পেছনে। এ ছাড়া আয় বাড়াতে নিজেদের সৃজনশীলতার ব্যবহার করছে একমাত্রা। নিজেদের অফিসে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্যচিত্র তৈরি করে রোজগার করছে। তৈরি করেছে পথশিশুদের জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র যে শহর চোরাবালি। ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে দেশে-বিদেশে। প্রতিদিন চতুর্দিক থেকে পিলপিল করে মানুষের স্রোত এসে মিশছে আমাদের এই ঢাকা শহরে। এখানে এসেই মানুষগুলো পড়ে যাচ্ছে চোরাবালির এক ঘূর্ণাবর্তে। এই শহর চোরাবালির মতোই অন্ধকার আর নিষ্পেষণের গভীরে টেনে নেয় গ্রামের মানুষগুলোকে, সেখান থেকে আর বেরোনো যায় না। এখানে পথের শিশুরা পকেট মারে, চুরি করে, মাদক ব্যবসার শিকার হয়, হরতালে পিকেটিং করে। আবার ফুল বেচে, রাস্তায় ব্যাট-বল খেলে, বাংলাদেশ জিতলে সাকিব সাকিব বলে আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চেঁচায়। বস্তির সর্দার, পুলিশ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী সবাই ব্যবহার করে তাদের। এই নিয়ে যে শহর চোরাবালির গল্প। আমাদের গল্পের ভেতরের গল্প। ‘কেবল ওরাই পাল্টাবে কেন’, হিরোকি ও তাঁর বন্ধুদের বক্তব্য, ‘পাল্টাতে হবে আমাদেরও। এই বৈষম্যের জন্য আসলে তো দায়ী আমরাই, ওরা নয়। ওপরতলার মাঝেরতলার মানুষেরা ভেতর থেকে আমূল না বদলালে কীভাবে নিচের তলার পরিবর্তন সম্ভব?’ তাই চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁরা দেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনী করেছেন। ফলাফল হয়েছে দারুণ। অনেক তরুণ প্রায় প্রতিটি জায়গায় ছবি দেখে নিজেরাই ছুটে এসেছে, ‘প্লিজ আমাদেরও কিছু করতে দিন। আমিও কিছু একটা করব।’ এভাবে এক বিশাল বন্ধুমহল গড়ে উঠেছে একমাত্রার। হাসতে হাসতে জানায় হিরোকি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন ছেলে উদ্বুদ্ধ হয়ে হালুয়াঘাটের একাডেমির জন্য মাটি কাটার কাজ পর্যন্ত করেছে। এসব তরুণের জন্য আমাদের উদাত্ত আহ্বান থাকে, যেখানে ইচ্ছে কাজে লেগে পড়তে পারে যে কেউ। খোলা আকাশের নিচে স্কুলে, আনন্দ শেল্টার হোম বা রসায়ন রেস্তোরাঁয়, কি ছবি বানানোর যজ্ঞে, যেখানে খুশি যেভাবে খুশি। ‘একমাত্রা কারও একার নয়,’ হিরোকি বিনীত অনুরোধ করে কথাটি বিশেষভাবে লেখার—একমাত্রা শুভর, নিলয়ের ও আরও সব বন্ধুর, যারা একমাত্রার জন্য কোনো না কোনোভাবে কাজ করে, যারা আমাদের ভালোবাসে, যারা পথশিশুদের পরিবর্তন চায়, একমাত্রা সবার। একমাত্রা দেশের সব স্বপ্নবাজ তরুণের।

No comments

Powered by Blogger.