সহজিয়া কড়চা-নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের ওপরে কি আদালত? by সৈয়দ আবুল মকসুদ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনে বিচিত্র রচনায় ও চিঠিপত্রে এমন সব কথা বলেছেন, যা এখন আমরা দিব্যি যেকোনো উপলক্ষে আওড়াতে পারি। উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ‘রাস্তাঘাটে ইংরেজরা আমাদের অপমান করে, বিচারালয়ে আমরা তার কোনো ন্যায়বিচার পাই না।
সুতরাং আমাদের উচিত ঘুষির বদলে ঘুষি দেওয়া।’
পরম রুচিমান, নীতিমান ও সংস্কৃতিমান রবীন্দ্রনাথের কথাটা ভালো লাগেনি। তিনি এক নিবন্ধে লিখলেন, ‘মুষ্টিযোগের [ঘুষির] মতো চিকিৎসা নাই,...কিন্তু সম্পাদকের উপদেশ সহসা’ মেনে নেওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বললেন, ‘কারো ঘুষার উত্তর ঘুষি দ্বারা’ দেওয়া ভারতীয় নৈতিকতা সমর্থন করে না। ‘বিধাতার ন্যায়দণ্ড’ হাতে নিয়ে যাঁরা বিচারকের আসনে বসে আছেন, তাঁদের দিকে ইঙ্গিত করে ‘ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত’ প্রবন্ধে বললেন, ‘...ভয়ের বিষয় এই যে, ধর্মকে বিস্মৃত হইয়া প্রবৃত্তির কাছে পাছে আত্মসমর্পণ করি, পরকে দণ্ড দিতে গিয়া পাছে আপনাকে কলুষিত করি, বিচারক হইতে গিয়া পাছে গুন্ডা হইয়া উঠি।’
বিচারকের কাজটা বড়ই কঠিন কাজ। পত্রিকার সম্পাদক, প্রতিবেদক বা কলাম-রচয়িতাদের চেয়ে তাঁদের কাজ হাজার গুণ শক্ত। যে কেউ ‘বাইচান্স’ সম্পাদক বা কলাম-রচয়িতা হতে পারেন, সে দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে ঢের রয়েছে, কিন্তু বিচারক হতে গেলে দীর্ঘ আইনি অভিজ্ঞতা তো থাকতেই হবে, আরও থাকতে হবে তাঁর মস্তিষ্ক ও হূদয়। কোন অপরাধের জন্য আইনের মোটা বইতে কী বিধান আছে, সেটা অবশ্যই বিবেচ্য, কিন্তু শাস্তিদাতার বিবেক ও অন্তর কী বলছে, তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
গত কয়েক দিনে বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে উচ্চ ও উচ্চতম আদালতে দুটি আদালত অবমাননার মামলার ফয়সালা হলো। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের আদালত অবমাননার মামলার রায় যেদিন দেওয়া হয়, সেই দিন এটিএন বাংলা সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে টক শোতে আমাকে ডাকে। ফোন পেয়ে আমি বলেছিলাম, আমি ভয় পাচ্ছি, কিসের মধ্যে কী বলি, আবার না আদালত অবমাননা করে বসি। তাতে যদি আমার শাস্তি ছয় মাসের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানা হয়, তাহলে জেলটা আমি সানন্দে খাটতে পারব, কিন্তু জরিমানার টাকাটা দিতে পারব না, আমার বন্ধু ও হিতার্থীদের চাঁদা তুলে জরিমানার টাকা দিতে হবে। অসচ্ছল বিখ্যাতদের অসুখবিসুখে যেমন চাঁদা তুলে চিকিৎসা হয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বহু আদালত অবমাননার অভিযুক্তদের জরিমানার টাকাও চাঁদা তুলেই পরিশোধ করতে হবে।
উপমহাদেশের প্রাচীনতম উচ্চ আদালত কলকাতা হাইকোর্ট। ঔপনিবেশিক আমলে এই হাইকোর্টে এমন সব ভারতীয় বিচারপতি ছিলেন যাঁদের যোগ্যতা ছিল বিশ্বমানের। কিন্তু যোগ্যতার বাইরে তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল দেবতার মতো। রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে যতখানি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া সম্ভব, তাঁরা তা-ই হতেন।
সৈয়দ আমীর আলীর নাম অনেকেই জানেন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত মুসলমানরা। বিচারপতি হিসেবে না হলেও ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে। তাঁর হিস্ট্রি অব দ্য সারাসিনস এবং স্পিরিট অব ইসলাম এককালে শিক্ষিত মুসলমানদের ঘরে ঘরে পঠিত হতে দেখেছি। আইনের ওপর, বিশেষ করে মুসলিম আইনের ওপর, তাঁর বইগুলো বিশ্বব্যাপী ব্যবহূত হয়েছে। তাঁর অসমাপ্ত স্মৃতিকথাটির বিশেষ পরিচিতি নেই, তবে জীর্ণ বইটি আমি মাঝে মাঝে পাঠ করি। অবসর গ্রহণের পর লন্ডনে যান এবং সম্রাটের প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত হন। ওই পদে তিনিই প্রথম ভারতীয়। প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হওয়া আমাদের ঢাকা সমিতি বা চট্টগ্রাম সমিতির সদস্য হওয়া নয়। সে এক বিরাট পদ। যেমন-তেমন যোগ্যতা ছাড়া ও-পদ পাওয়া যায় না।
প্রথম দিকের আর একজন বিচারপতির কথা মানুষ ভুলে গেলেও আমি তাঁকে স্মরণ করি তাঁর খাদ্যাভ্যাসের কারণে। যখন বঙ্গীয় সমাজে কোনো মজলিসে খেতে বসি এবং মানুষকে খেতে দেখি তখন আমার চোখে ভাসে বিচারপতি স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। সকালে চা-কাপের এক কাপ ভাত, আধা-চামচ গাওয়া ঘি, দু-এক টুকরা শিং বা মাগুর মাছের ঝোল, দুই চামচ দই খেয়ে দৌড় দিতেন হাইকোর্টে। তালপাতার সেপাই। তাঁর পেছনে পেছনে নথিপত্রের বান্ডিল নিয়ে ছয় ফুট লম্বা দেড় ফুট চওড়া অবাঙালি আর্দালি তকমা পরে ছুটতেন। বিহার থেকে ব্রহ্মদেশ বা মিয়ানমার পর্যন্ত গোটা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মামলা। উগ্রপন্থীদের উপদ্রব। ফাঁসি, যাবজ্জীবন বা দ্বীপান্তর দিলে সরকার খুশি হয়। সরকারকে খুশি করা তাঁর কাজ নয়। তিনি খুশি করতেন তাঁর বিবেককে। যখন এজলাসে গিয়ে বসতেন, আমাজন অরণ্যের নীরবতা নেমে আসত আদালতে। এমন রায় দিতেন, একজন ফাঁসির আসামিও মনে করতেন, উপযুক্ত শাস্তিই আমার হয়েছে।
কোর্ট থেকে ফিরে সন্ধ্যায় স্যার গুরুদাস খেতেন সিকি ছটাক ময়দার দু-একটি রুটি আর সবজির তরকারি। রাতের খাওয়া শেষ। কিন্তু কাজ শেষ নয়। নথিপত্র পাঠ করতেন এবং লেখালেখি করতেন। হিন্দু বিবাহ আইন নিয়ে তাঁর মূল্যবান কাজ রয়েছে। তবে, আমার মতো অধমের তাঁর জ্ঞান ও কর্ম এবং এ ফিউ থটস অন এডুকেশন বই দুটি নাড়াচাড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁদের বিচারক বললে ভুল হবে। তাঁরা ছিলেন সাধক। জাতির কল্যাণচিন্তা ছিল তাঁদের চৈতন্যজুড়ে।
সেই কলকাতা হাইকোর্টে এখনো বিচারপতি আছেন অনেকে—স্যার আমীর বা স্যার গুরুদাসের উত্তরসূরি। যেমন বিচারপতি সৌমিত্র সেন। ভারতীয় ইস্পাত কর্তৃপক্ষ এবং শিপিং করপোরেশনের মধ্যে কী এক বিরোধ বাধে। সৌমিত্রবাবুকে কোর্ট 'Receiver' নিযুক্ত করেন। বিবদমান পক্ষের ৩৭ লাখ টাকা তিনি আলাদা হিসাবে না রেখে নিজের নামে ফিক্সড ডিপোজিটে রাখেন। টাকাটা বাড়তে বাড়তে ৫৭ লাখে দাঁড়ায়। ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে গেলে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আর এন পাইন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন বিষয়টি তদন্তের জন্য। কমিটি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাঁকে ‘ইমপিচ’ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কে জি বালাকিষ্ণানের কাছে আবেদন করা হয়। প্রধান বিচারপতি সেনবাবুকে বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে সুপারিশ করেন। বিচারপতির চাকরিটি খোয়া যায়। এটি একালের অর্থাৎ মাত্র বছর দেড়েক আগের ঘটনা। কলকাতা হাইকোর্টেরই সাবেক বিচারপতির বাড়িতে পুলিশ ও আয়কর বিভাগের লোক হানা দিয়ে প্রায় এক কোটি রুপি ও বিপুল সোনাদানা পেয়েছেন। পেতেই পারেন। বিচারপতিও তো মানুষ। তাঁর স্ত্রীরও শখ হয় গয়না বানানোর, বাড়ি ও জায়গাজমি কেনার।
পেশাটি যত সহজই হোক, কোনো পেশার মানুষই লোভ-লালসা ও মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। সত্যি সত্যি কোনো দুর্বলতার কারণে যদি কেউ সমালোচিত হন, তাঁকে অবমাননা বলা যায় না। আদালতের কোনো ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাঁর মনোভাব বা মতামত তিনি প্রকাশ করতে পারেন। পূর্ণ গণতন্ত্রে পূর্ণ বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকে।
তবে, বাকস্বাধীনতারও একটি সীমা আছে। সেই সীমা যদি কেউ লঙ্ঘন করে, তার ফল তাকে ভোগ করতে হবে। তবে, যত অপ্রিয়ই হোক, কথাটি যদি সত্যি হয়, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা অন্যায়।
মোগল আমলে কেউ কাজীর বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাস্তি ভোগ করেছে—এমন কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাস বইতে নেই। ব্রিটিশ আমলে আদালত অবমাননার ঘটনা ঘটতে থাকে। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা ইংরেজ আদালতের বিচারকে অবিচার মনে করতেন। কোর্টে দাঁড়িয়েই জজের রায়কে তাচ্ছিল্য করতেন। ফলে বিদেশি সরকার কনটেমপ্ট অব কোর্টের বিধান জারি করে। সেই আইন এখনো আছে। কী কী কারণে আদালত অবমাননা হতে পারে? আমাদের মতো উম্মি মানুষ যেটুকু জানি তা হলো: কেউ যদি আদালতকে কলঙ্কিত করে, মিথ্যা অপবাদ দেয় বিচারক সম্পর্কে, আদালতের হুকুম অমান্য করে, যদি কেউ আদালতকে দেওয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং যদি কেউ আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
এ মাসে যে দুটি আদালত অবমাননার রায় হয়েছে, তার অভিযোগ ছিল দুই রকম: একটি লিখিত আর একটি মৌখিক। একজন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় মন্তব্যমূলক নিবন্ধ লিখে আদালতকে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য ভুল বলে স্বীকার করেননি। তিনি যে ভুল বলেননি, সেটাও আদালত প্রমাণ করার সুযোগ দেননি। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন।
একই সঙ্গে একটি সুয়োমোটো মামলায় আর একজন মাফ চেয়ে বেঁচে গেছেন। যাঁর গোস্তাকি মাফ করে দেওয়া হয়েছে তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। তাঁর আর একটি পরিচয় নজরুলসংগীতের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। টেলিভিশনে গান গেয়ে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। কিন্তু সংগীতশিল্পীর পরিচয়টি তাঁর কাছে পর্যাপ্ত মনে হয়নি। তিনি হতে চাইলেন বুদ্ধিজীবী, যেমন নোম চমস্কি। টিভি টক শোতে তাঁর ডাক পড়ল। সেখান থেকে গোলটেবিলে। কড়া তাঁর বক্তব্য। এক গোলটেবিল আলোচনায় জজদের সম্পর্কে কী বললেন, আদালত অবমাননার অভিযোগে তাঁর তলব হলো। গোলটেবিলে এক হাত দিয়ে চাপড় মেরে বক্তব্য দিয়েছিলেন, আদালতে গিয়ে দুই হাত জোড় করলেন। তাঁর গোস্তাকি মাফ হলো। আমরা শাবাশ দিতাম যদি তিনি কোর্টে দাঁড়িয়েও দুই হাত জোড় না করে উঁচু গলায় বলতেন, যা বলেছি ঠিক বলেছি। বুদ্ধিজীবী হওয়া সব মানুষকে মানায় না। অরুন্ধতী রায় আদালত অবমাননা করে এক বেলা জেল খেটেছেন। নিঃশর্তভাবে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনার পাত্রী তিনি নন। ক্ষমা চাওয়া গ্লানিকর। ক্ষমা না চাইতেই ক্ষমা করে দেওয়া মহানুভবতা।
গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবিভাজ্য। কিন্তু গণতন্ত্র আগে, না সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আগে? আমি বলব, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাই আগে প্রয়োজন। তার পরই শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। স্বাধীনতা দেওয়ার পর সম্পাদক বা সাংবাদিকদের ভুল হতে পারে। লেখার ভুলের জন্য ভর্ৎসনাই বড় শাস্তি। জেলের ভাতই খাওয়াতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সবচেয়ে মহৎ বিচারক তিনিই, যিনি গুরু অপরাধেও লঘু শাস্তি দেন।
বঙ্গীয় সমাজের মানুষ স্বভাবত কোন্দলপ্রিয়। অতি ছোট ব্যাপার নিয়েও বিবাদ বাধিয়ে দেয়। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর একটি তুর্কি টুপির মালিকানা নিয়ে ভাই ও বোনের মধ্যে বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, ভাইটি হাজতে গিয়েছেন—সেটা আমি নিজে জানি। একটি হাঁস, ছাগল, আমগাছ বা জমির সীমানা নিয়ে মাথা ফেটেছে অগণিত মানুষের। জীবন পর্যন্ত গেছে। সেসব নিয়ে মামলা হয়। নানা রকম অবিচারের সমাজে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতই সাধারণ মানুষের ভরসা। কিন্তু আমাদের বিচারপ্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘ। বিলম্বিত বিচার বিচার না পাওয়ারই নামান্তর।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে উচ্চ ও উচ্চতম আদালত এমন কিছু রায় দিয়েছেন, যাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও বলছেন ‘যুগান্তকারী’। শব্দ ব্যবহারে বাঙালি কখনোই সচেতন নয়। সে জন্য সাহিত্যটাও ভালো হচ্ছে না আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লেখকদের মতো। জাতিকে ‘কলঙ্কমুক্ত’ করার ব্রত নিয়েছেন আদালত। এত বেশি কলঙ্কমুক্তি মধ্য যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো দেশে ঘটেনি। জাতিকে কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিচ্ছেন আদালত, আর কেউ নয়—নির্বাহী বিভাগও নয়, পার্লামেন্টও নয়—একমাত্র আদালত। খটকাটা সেখানেই। একটি জিনিস আমাদের ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞরা’ ভাবছেন না যে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। চাঁদের তুলনায় বাংলাদেশ ছোট। কিছু কলঙ্ক তার থাকলে ক্ষতি কী? সোনায়ও খাদ থাকে। বাংলাদেশ তো মাটির তৈরি। কোনো দেশকে পুরোপুরি কলঙ্ক থেকে মুক্ত করলে তা আর রাষ্ট্র থাকে না, হয় বেহেস্তের বাগান। আমরা একটি সুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই—বেহেস্ত নয়।
যে সংবিধান শুধু তেরো-চৌদ্দজন ‘বিশেষজ্ঞ’ বোঝে, তা তেরো-চৌদ্দ কোটি মানুষের প্রয়োজন মেটাবে কীভাবে? বাহাত্তরে গৃহীত হওয়ার আগেই এই সংবিধানের পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে হয়, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া যে ব্যক্তি মোহাম্মদ নজিবর রহমানের গরীবের মেয়ে, জসীমউদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র পড়ে বোঝে; তার কাছে আমাদের সংবিধান পানির মতো সহজ। বাঙালকেই শুধু বারবার হাইকোর্ট দেখানো যায়—আর কোনো জাতিকে নয়। আমি ৬০ বছর ধরে সংবাদপত্র পাঠ করছি। আগে কোনো দিন ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞ’ পদবিটি কোথাও দেখিনি। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ আছেন, বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। আমরা সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞদের কথা জানি। পাকিস্তানে দেখেছি এ কে ব্রোহী, সৈয়দ শরিফুদ্দিন পীরজাদা প্রমুখ আইনবিদ। শিক্ষাবিদদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জি ডব্লিউ চৌধুরী প্রমুখ।
গত তিন মাসের কাগজ যদি ৫০ বছর পর কোনো পাঠকের বা গবেষকের হাতে পড়ে, তাঁরা আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বিখ্যাতদের পাগল ঠাওরাবেন। বলা হচ্ছে, সামরিক শাসন আসার পথ ‘চিরতরে’ বন্ধ হয়ে গেছে আদালতের রায়ে। বড় বড় রায় দেওয়ার আগে মহামান্য বিচারপতিরা এডওয়ার্ড লুটওয়াকের কু দে তা বইটি পড়ে দেখেছেন কি না জানি না। ১৯৫২ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অন্তত ৮০টি দেশে ২৫০ বার সামরিক শাসন এসেছে। ১৯৫২ সালে মিসরে ক্যু হয়। জামাল নাসেরের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর মতো গণতন্ত্রী, চৌ এন লাইয়ের মতো বিপ্লবী এবং সুকর্নর মতো জাতীয়তাবাদী কাজ করেছেন। সামরিক শাসন আসেনি কোথায়? তুরস্ক, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, মিয়ানমার, ইরাক, ঘানা—কোথায় নয়? ১৯৮২-এর ২৭ মার্চ যেদিন দশম রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেইন শপথ পাঠ করান, সেই আনন্দঘন অনুষ্ঠানে আমার কুশল বিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল আর দুই সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। তাঁরা হলেন আবু সাঈদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ উল্লাহ। আর কারা ছিলেন তাঁদের নাম বলা যাবে না। চক্ষুলজ্জা আমাদের সবারই আছে। সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে যদি বিচারকেরা পদত্যাগ করতেন, তাহলে বাংলাদেশে শুধু নয়, দুনিয়ার কোনো দেশেই সামরিক শাসন আসত না।
কয়েক মাস ধরে আমাদের আদালত প্রচুর কাজ করছেন। রিটের পর রিটের শুনানি হচ্ছে। ত্বরিত রায় দেওয়া হচ্ছে বা রুল জারি হচ্ছে। ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন: রাজধানীর যানজট নিরসনে অবহেলা ও অদক্ষতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে জবাব দিতে হবে। আমাদের পত্রিকা অনবরত লিখছে, মামলাজটের কারণে জনগণের ভোগান্তির শেষ নাই। আমি খুশি হব যদি আদালত তাঁর নিজের ওপর এমন একটি রুল জারি করেন: এত মামলাজটকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না। কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি ঢাকার যানজট দূর না হয়, তাহলে আমরা কী বুঝব? আমাদের সরকার ‘অদক্ষ’ ও ‘ব্যর্থ’? আদালতের হুকুমও?
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র আজ চলছে বিচার বিভাগের নির্দেশে, সরকারের দ্বারা নয়। গণতন্ত্র, সংবিধান প্রভৃতি বিচার বিভাগের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সংসদের হাতে নয়। শুধু তা-ই নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কী করা হবে, শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান হবে কি না—সব নির্দেশই আসছে আদালতের কাছ থেকে। নির্বাহী বিভাগ ও পার্লামেন্ট অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এসব ব্যাপারে যাঁদের কথা বলার কথা, তাঁরা বাতাসের আগে আগে চলছেন। বাতাসের বিপরীতে কোন বোকা যেতে চায়?
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারকেরা বিশেষ দায়িত্বে আছেন। প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক কর্মকর্তা আছেন, যেমন একজন সচিব, জেনারেল, রাষ্ট্রদূত। সবারই স্বাধীন দায়িত্ব রয়েছে, দায়বদ্ধতাও রয়েছে। রাষ্ট্রের এক বিভাগের সামনে আরেক বিভাগ কোমর বেঁধে ছড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়ালে তা যে ভালো দেখায় না তা-ই নয়, সম্মিলিতভাবে কাজ করার পথটা বন্ধ হয়ে যায়। একটি দেশে পার্লামেন্টই সর্বশক্তিমান, তা গোটা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদে প্রণীত আইন ও সিদ্ধান্ত সমুন্নত রয়েছে কি না, তা দেখবেন আদালত। তবে যত যা-ই বলি না কেন, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগই প্রধান। সব দায়দায়িত্ব, দোষগুণের ভাগীদার তারাই। কোনো কাজে অজনপ্রিয় ও ধিক্কৃত হলে তারাই হয়—উচ্চ আদালতের বিচারকেরা নন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পরম রুচিমান, নীতিমান ও সংস্কৃতিমান রবীন্দ্রনাথের কথাটা ভালো লাগেনি। তিনি এক নিবন্ধে লিখলেন, ‘মুষ্টিযোগের [ঘুষির] মতো চিকিৎসা নাই,...কিন্তু সম্পাদকের উপদেশ সহসা’ মেনে নেওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বললেন, ‘কারো ঘুষার উত্তর ঘুষি দ্বারা’ দেওয়া ভারতীয় নৈতিকতা সমর্থন করে না। ‘বিধাতার ন্যায়দণ্ড’ হাতে নিয়ে যাঁরা বিচারকের আসনে বসে আছেন, তাঁদের দিকে ইঙ্গিত করে ‘ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত’ প্রবন্ধে বললেন, ‘...ভয়ের বিষয় এই যে, ধর্মকে বিস্মৃত হইয়া প্রবৃত্তির কাছে পাছে আত্মসমর্পণ করি, পরকে দণ্ড দিতে গিয়া পাছে আপনাকে কলুষিত করি, বিচারক হইতে গিয়া পাছে গুন্ডা হইয়া উঠি।’
বিচারকের কাজটা বড়ই কঠিন কাজ। পত্রিকার সম্পাদক, প্রতিবেদক বা কলাম-রচয়িতাদের চেয়ে তাঁদের কাজ হাজার গুণ শক্ত। যে কেউ ‘বাইচান্স’ সম্পাদক বা কলাম-রচয়িতা হতে পারেন, সে দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে ঢের রয়েছে, কিন্তু বিচারক হতে গেলে দীর্ঘ আইনি অভিজ্ঞতা তো থাকতেই হবে, আরও থাকতে হবে তাঁর মস্তিষ্ক ও হূদয়। কোন অপরাধের জন্য আইনের মোটা বইতে কী বিধান আছে, সেটা অবশ্যই বিবেচ্য, কিন্তু শাস্তিদাতার বিবেক ও অন্তর কী বলছে, তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
গত কয়েক দিনে বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে উচ্চ ও উচ্চতম আদালতে দুটি আদালত অবমাননার মামলার ফয়সালা হলো। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের আদালত অবমাননার মামলার রায় যেদিন দেওয়া হয়, সেই দিন এটিএন বাংলা সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে টক শোতে আমাকে ডাকে। ফোন পেয়ে আমি বলেছিলাম, আমি ভয় পাচ্ছি, কিসের মধ্যে কী বলি, আবার না আদালত অবমাননা করে বসি। তাতে যদি আমার শাস্তি ছয় মাসের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানা হয়, তাহলে জেলটা আমি সানন্দে খাটতে পারব, কিন্তু জরিমানার টাকাটা দিতে পারব না, আমার বন্ধু ও হিতার্থীদের চাঁদা তুলে জরিমানার টাকা দিতে হবে। অসচ্ছল বিখ্যাতদের অসুখবিসুখে যেমন চাঁদা তুলে চিকিৎসা হয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বহু আদালত অবমাননার অভিযুক্তদের জরিমানার টাকাও চাঁদা তুলেই পরিশোধ করতে হবে।
উপমহাদেশের প্রাচীনতম উচ্চ আদালত কলকাতা হাইকোর্ট। ঔপনিবেশিক আমলে এই হাইকোর্টে এমন সব ভারতীয় বিচারপতি ছিলেন যাঁদের যোগ্যতা ছিল বিশ্বমানের। কিন্তু যোগ্যতার বাইরে তাঁদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল দেবতার মতো। রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে যতখানি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া সম্ভব, তাঁরা তা-ই হতেন।
সৈয়দ আমীর আলীর নাম অনেকেই জানেন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত মুসলমানরা। বিচারপতি হিসেবে না হলেও ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে। তাঁর হিস্ট্রি অব দ্য সারাসিনস এবং স্পিরিট অব ইসলাম এককালে শিক্ষিত মুসলমানদের ঘরে ঘরে পঠিত হতে দেখেছি। আইনের ওপর, বিশেষ করে মুসলিম আইনের ওপর, তাঁর বইগুলো বিশ্বব্যাপী ব্যবহূত হয়েছে। তাঁর অসমাপ্ত স্মৃতিকথাটির বিশেষ পরিচিতি নেই, তবে জীর্ণ বইটি আমি মাঝে মাঝে পাঠ করি। অবসর গ্রহণের পর লন্ডনে যান এবং সম্রাটের প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত হন। ওই পদে তিনিই প্রথম ভারতীয়। প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হওয়া আমাদের ঢাকা সমিতি বা চট্টগ্রাম সমিতির সদস্য হওয়া নয়। সে এক বিরাট পদ। যেমন-তেমন যোগ্যতা ছাড়া ও-পদ পাওয়া যায় না।
প্রথম দিকের আর একজন বিচারপতির কথা মানুষ ভুলে গেলেও আমি তাঁকে স্মরণ করি তাঁর খাদ্যাভ্যাসের কারণে। যখন বঙ্গীয় সমাজে কোনো মজলিসে খেতে বসি এবং মানুষকে খেতে দেখি তখন আমার চোখে ভাসে বিচারপতি স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। সকালে চা-কাপের এক কাপ ভাত, আধা-চামচ গাওয়া ঘি, দু-এক টুকরা শিং বা মাগুর মাছের ঝোল, দুই চামচ দই খেয়ে দৌড় দিতেন হাইকোর্টে। তালপাতার সেপাই। তাঁর পেছনে পেছনে নথিপত্রের বান্ডিল নিয়ে ছয় ফুট লম্বা দেড় ফুট চওড়া অবাঙালি আর্দালি তকমা পরে ছুটতেন। বিহার থেকে ব্রহ্মদেশ বা মিয়ানমার পর্যন্ত গোটা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মামলা। উগ্রপন্থীদের উপদ্রব। ফাঁসি, যাবজ্জীবন বা দ্বীপান্তর দিলে সরকার খুশি হয়। সরকারকে খুশি করা তাঁর কাজ নয়। তিনি খুশি করতেন তাঁর বিবেককে। যখন এজলাসে গিয়ে বসতেন, আমাজন অরণ্যের নীরবতা নেমে আসত আদালতে। এমন রায় দিতেন, একজন ফাঁসির আসামিও মনে করতেন, উপযুক্ত শাস্তিই আমার হয়েছে।
কোর্ট থেকে ফিরে সন্ধ্যায় স্যার গুরুদাস খেতেন সিকি ছটাক ময়দার দু-একটি রুটি আর সবজির তরকারি। রাতের খাওয়া শেষ। কিন্তু কাজ শেষ নয়। নথিপত্র পাঠ করতেন এবং লেখালেখি করতেন। হিন্দু বিবাহ আইন নিয়ে তাঁর মূল্যবান কাজ রয়েছে। তবে, আমার মতো অধমের তাঁর জ্ঞান ও কর্ম এবং এ ফিউ থটস অন এডুকেশন বই দুটি নাড়াচাড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁদের বিচারক বললে ভুল হবে। তাঁরা ছিলেন সাধক। জাতির কল্যাণচিন্তা ছিল তাঁদের চৈতন্যজুড়ে।
সেই কলকাতা হাইকোর্টে এখনো বিচারপতি আছেন অনেকে—স্যার আমীর বা স্যার গুরুদাসের উত্তরসূরি। যেমন বিচারপতি সৌমিত্র সেন। ভারতীয় ইস্পাত কর্তৃপক্ষ এবং শিপিং করপোরেশনের মধ্যে কী এক বিরোধ বাধে। সৌমিত্রবাবুকে কোর্ট 'Receiver' নিযুক্ত করেন। বিবদমান পক্ষের ৩৭ লাখ টাকা তিনি আলাদা হিসাবে না রেখে নিজের নামে ফিক্সড ডিপোজিটে রাখেন। টাকাটা বাড়তে বাড়তে ৫৭ লাখে দাঁড়ায়। ব্যাপারটি জানাজানি হয়ে গেলে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আর এন পাইন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন বিষয়টি তদন্তের জন্য। কমিটি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাঁকে ‘ইমপিচ’ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কে জি বালাকিষ্ণানের কাছে আবেদন করা হয়। প্রধান বিচারপতি সেনবাবুকে বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে সুপারিশ করেন। বিচারপতির চাকরিটি খোয়া যায়। এটি একালের অর্থাৎ মাত্র বছর দেড়েক আগের ঘটনা। কলকাতা হাইকোর্টেরই সাবেক বিচারপতির বাড়িতে পুলিশ ও আয়কর বিভাগের লোক হানা দিয়ে প্রায় এক কোটি রুপি ও বিপুল সোনাদানা পেয়েছেন। পেতেই পারেন। বিচারপতিও তো মানুষ। তাঁর স্ত্রীরও শখ হয় গয়না বানানোর, বাড়ি ও জায়গাজমি কেনার।
পেশাটি যত সহজই হোক, কোনো পেশার মানুষই লোভ-লালসা ও মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন না। সত্যি সত্যি কোনো দুর্বলতার কারণে যদি কেউ সমালোচিত হন, তাঁকে অবমাননা বলা যায় না। আদালতের কোনো ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাঁর মনোভাব বা মতামত তিনি প্রকাশ করতে পারেন। পূর্ণ গণতন্ত্রে পূর্ণ বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকে।
তবে, বাকস্বাধীনতারও একটি সীমা আছে। সেই সীমা যদি কেউ লঙ্ঘন করে, তার ফল তাকে ভোগ করতে হবে। তবে, যত অপ্রিয়ই হোক, কথাটি যদি সত্যি হয়, তাকে দোষী সাব্যস্ত করা অন্যায়।
মোগল আমলে কেউ কাজীর বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাস্তি ভোগ করেছে—এমন কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাস বইতে নেই। ব্রিটিশ আমলে আদালত অবমাননার ঘটনা ঘটতে থাকে। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা ইংরেজ আদালতের বিচারকে অবিচার মনে করতেন। কোর্টে দাঁড়িয়েই জজের রায়কে তাচ্ছিল্য করতেন। ফলে বিদেশি সরকার কনটেমপ্ট অব কোর্টের বিধান জারি করে। সেই আইন এখনো আছে। কী কী কারণে আদালত অবমাননা হতে পারে? আমাদের মতো উম্মি মানুষ যেটুকু জানি তা হলো: কেউ যদি আদালতকে কলঙ্কিত করে, মিথ্যা অপবাদ দেয় বিচারক সম্পর্কে, আদালতের হুকুম অমান্য করে, যদি কেউ আদালতকে দেওয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং যদি কেউ আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে।
এ মাসে যে দুটি আদালত অবমাননার রায় হয়েছে, তার অভিযোগ ছিল দুই রকম: একটি লিখিত আর একটি মৌখিক। একজন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় মন্তব্যমূলক নিবন্ধ লিখে আদালতকে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তাঁর বক্তব্য ভুল বলে স্বীকার করেননি। তিনি যে ভুল বলেননি, সেটাও আদালত প্রমাণ করার সুযোগ দেননি। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছেন।
একই সঙ্গে একটি সুয়োমোটো মামলায় আর একজন মাফ চেয়ে বেঁচে গেছেন। যাঁর গোস্তাকি মাফ করে দেওয়া হয়েছে তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। তাঁর আর একটি পরিচয় নজরুলসংগীতের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। টেলিভিশনে গান গেয়ে তিনি সুনাম অর্জন করেছেন। কিন্তু সংগীতশিল্পীর পরিচয়টি তাঁর কাছে পর্যাপ্ত মনে হয়নি। তিনি হতে চাইলেন বুদ্ধিজীবী, যেমন নোম চমস্কি। টিভি টক শোতে তাঁর ডাক পড়ল। সেখান থেকে গোলটেবিলে। কড়া তাঁর বক্তব্য। এক গোলটেবিল আলোচনায় জজদের সম্পর্কে কী বললেন, আদালত অবমাননার অভিযোগে তাঁর তলব হলো। গোলটেবিলে এক হাত দিয়ে চাপড় মেরে বক্তব্য দিয়েছিলেন, আদালতে গিয়ে দুই হাত জোড় করলেন। তাঁর গোস্তাকি মাফ হলো। আমরা শাবাশ দিতাম যদি তিনি কোর্টে দাঁড়িয়েও দুই হাত জোড় না করে উঁচু গলায় বলতেন, যা বলেছি ঠিক বলেছি। বুদ্ধিজীবী হওয়া সব মানুষকে মানায় না। অরুন্ধতী রায় আদালত অবমাননা করে এক বেলা জেল খেটেছেন। নিঃশর্তভাবে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনার পাত্রী তিনি নন। ক্ষমা চাওয়া গ্লানিকর। ক্ষমা না চাইতেই ক্ষমা করে দেওয়া মহানুভবতা।
গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবিভাজ্য। কিন্তু গণতন্ত্র আগে, না সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আগে? আমি বলব, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাই আগে প্রয়োজন। তার পরই শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। স্বাধীনতা দেওয়ার পর সম্পাদক বা সাংবাদিকদের ভুল হতে পারে। লেখার ভুলের জন্য ভর্ৎসনাই বড় শাস্তি। জেলের ভাতই খাওয়াতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সবচেয়ে মহৎ বিচারক তিনিই, যিনি গুরু অপরাধেও লঘু শাস্তি দেন।
বঙ্গীয় সমাজের মানুষ স্বভাবত কোন্দলপ্রিয়। অতি ছোট ব্যাপার নিয়েও বিবাদ বাধিয়ে দেয়। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর একটি তুর্কি টুপির মালিকানা নিয়ে ভাই ও বোনের মধ্যে বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, ভাইটি হাজতে গিয়েছেন—সেটা আমি নিজে জানি। একটি হাঁস, ছাগল, আমগাছ বা জমির সীমানা নিয়ে মাথা ফেটেছে অগণিত মানুষের। জীবন পর্যন্ত গেছে। সেসব নিয়ে মামলা হয়। নানা রকম অবিচারের সমাজে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতই সাধারণ মানুষের ভরসা। কিন্তু আমাদের বিচারপ্রক্রিয়া খুবই দীর্ঘ। বিলম্বিত বিচার বিচার না পাওয়ারই নামান্তর।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে উচ্চ ও উচ্চতম আদালত এমন কিছু রায় দিয়েছেন, যাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও বলছেন ‘যুগান্তকারী’। শব্দ ব্যবহারে বাঙালি কখনোই সচেতন নয়। সে জন্য সাহিত্যটাও ভালো হচ্ছে না আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লেখকদের মতো। জাতিকে ‘কলঙ্কমুক্ত’ করার ব্রত নিয়েছেন আদালত। এত বেশি কলঙ্কমুক্তি মধ্য যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো দেশে ঘটেনি। জাতিকে কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিচ্ছেন আদালত, আর কেউ নয়—নির্বাহী বিভাগও নয়, পার্লামেন্টও নয়—একমাত্র আদালত। খটকাটা সেখানেই। একটি জিনিস আমাদের ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞরা’ ভাবছেন না যে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। চাঁদের তুলনায় বাংলাদেশ ছোট। কিছু কলঙ্ক তার থাকলে ক্ষতি কী? সোনায়ও খাদ থাকে। বাংলাদেশ তো মাটির তৈরি। কোনো দেশকে পুরোপুরি কলঙ্ক থেকে মুক্ত করলে তা আর রাষ্ট্র থাকে না, হয় বেহেস্তের বাগান। আমরা একটি সুস্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই—বেহেস্ত নয়।
যে সংবিধান শুধু তেরো-চৌদ্দজন ‘বিশেষজ্ঞ’ বোঝে, তা তেরো-চৌদ্দ কোটি মানুষের প্রয়োজন মেটাবে কীভাবে? বাহাত্তরে গৃহীত হওয়ার আগেই এই সংবিধানের পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার মনে হয়, পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া যে ব্যক্তি মোহাম্মদ নজিবর রহমানের গরীবের মেয়ে, জসীমউদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র পড়ে বোঝে; তার কাছে আমাদের সংবিধান পানির মতো সহজ। বাঙালকেই শুধু বারবার হাইকোর্ট দেখানো যায়—আর কোনো জাতিকে নয়। আমি ৬০ বছর ধরে সংবাদপত্র পাঠ করছি। আগে কোনো দিন ‘সংবিধান বিশেষজ্ঞ’ পদবিটি কোথাও দেখিনি। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ আছেন, বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন। আমরা সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞদের কথা জানি। পাকিস্তানে দেখেছি এ কে ব্রোহী, সৈয়দ শরিফুদ্দিন পীরজাদা প্রমুখ আইনবিদ। শিক্ষাবিদদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জি ডব্লিউ চৌধুরী প্রমুখ।
গত তিন মাসের কাগজ যদি ৫০ বছর পর কোনো পাঠকের বা গবেষকের হাতে পড়ে, তাঁরা আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বিখ্যাতদের পাগল ঠাওরাবেন। বলা হচ্ছে, সামরিক শাসন আসার পথ ‘চিরতরে’ বন্ধ হয়ে গেছে আদালতের রায়ে। বড় বড় রায় দেওয়ার আগে মহামান্য বিচারপতিরা এডওয়ার্ড লুটওয়াকের কু দে তা বইটি পড়ে দেখেছেন কি না জানি না। ১৯৫২ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অন্তত ৮০টি দেশে ২৫০ বার সামরিক শাসন এসেছে। ১৯৫২ সালে মিসরে ক্যু হয়। জামাল নাসেরের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর মতো গণতন্ত্রী, চৌ এন লাইয়ের মতো বিপ্লবী এবং সুকর্নর মতো জাতীয়তাবাদী কাজ করেছেন। সামরিক শাসন আসেনি কোথায়? তুরস্ক, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, মিয়ানমার, ইরাক, ঘানা—কোথায় নয়? ১৯৮২-এর ২৭ মার্চ যেদিন দশম রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেইন শপথ পাঠ করান, সেই আনন্দঘন অনুষ্ঠানে আমার কুশল বিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল আর দুই সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে। তাঁরা হলেন আবু সাঈদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ উল্লাহ। আর কারা ছিলেন তাঁদের নাম বলা যাবে না। চক্ষুলজ্জা আমাদের সবারই আছে। সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে যদি বিচারকেরা পদত্যাগ করতেন, তাহলে বাংলাদেশে শুধু নয়, দুনিয়ার কোনো দেশেই সামরিক শাসন আসত না।
কয়েক মাস ধরে আমাদের আদালত প্রচুর কাজ করছেন। রিটের পর রিটের শুনানি হচ্ছে। ত্বরিত রায় দেওয়া হচ্ছে বা রুল জারি হচ্ছে। ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট সরকারের প্রতি রুল জারি করেছেন: রাজধানীর যানজট নিরসনে অবহেলা ও অদক্ষতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, ছয় সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে জবাব দিতে হবে। আমাদের পত্রিকা অনবরত লিখছে, মামলাজটের কারণে জনগণের ভোগান্তির শেষ নাই। আমি খুশি হব যদি আদালত তাঁর নিজের ওপর এমন একটি রুল জারি করেন: এত মামলাজটকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না। কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি ঢাকার যানজট দূর না হয়, তাহলে আমরা কী বুঝব? আমাদের সরকার ‘অদক্ষ’ ও ‘ব্যর্থ’? আদালতের হুকুমও?
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র আজ চলছে বিচার বিভাগের নির্দেশে, সরকারের দ্বারা নয়। গণতন্ত্র, সংবিধান প্রভৃতি বিচার বিভাগের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সংসদের হাতে নয়। শুধু তা-ই নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কী করা হবে, শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান হবে কি না—সব নির্দেশই আসছে আদালতের কাছ থেকে। নির্বাহী বিভাগ ও পার্লামেন্ট অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এসব ব্যাপারে যাঁদের কথা বলার কথা, তাঁরা বাতাসের আগে আগে চলছেন। বাতাসের বিপরীতে কোন বোকা যেতে চায়?
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারকেরা বিশেষ দায়িত্বে আছেন। প্রজাতন্ত্রের বেতনভুক কর্মকর্তা আছেন, যেমন একজন সচিব, জেনারেল, রাষ্ট্রদূত। সবারই স্বাধীন দায়িত্ব রয়েছে, দায়বদ্ধতাও রয়েছে। রাষ্ট্রের এক বিভাগের সামনে আরেক বিভাগ কোমর বেঁধে ছড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়ালে তা যে ভালো দেখায় না তা-ই নয়, সম্মিলিতভাবে কাজ করার পথটা বন্ধ হয়ে যায়। একটি দেশে পার্লামেন্টই সর্বশক্তিমান, তা গোটা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। সংসদে প্রণীত আইন ও সিদ্ধান্ত সমুন্নত রয়েছে কি না, তা দেখবেন আদালত। তবে যত যা-ই বলি না কেন, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগই প্রধান। সব দায়দায়িত্ব, দোষগুণের ভাগীদার তারাই। কোনো কাজে অজনপ্রিয় ও ধিক্কৃত হলে তারাই হয়—উচ্চ আদালতের বিচারকেরা নন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments