চার দিক-আলো আরও আলো by গোলাম রসূল
আজ ৩ সেপ্টেম্বর। ৪৯ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৬১ সাুলের এই দিনে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয় গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রশিক্ষণরত শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিস টিচিংয়ের সুবিধার জন্যই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তত্কালীন অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ওসমান গণি স্কুলটি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উদ্বোধন করেছিলেন তত্কালীন জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক (ডিপিআই) মহম্মদ শামসুল হক। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়টি ছিল পাকিস্তানি শাসনামল আর সে শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির দুর্বার প্রতিরোধের কাল। ফলে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা এবং তার শিক্ষাদান পদ্ধতির সম্পূর্ণ দায়িত্বটি কেমন হবে—এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব সহজ ছিল না। এই কঠিন কাজটি সেদিন যাঁর নেতৃত্বে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পালিত হয়েছিল, তিনি বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক খান মুহম্মদ সালেক। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাকাল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পর, এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ১০ বছর আগে। বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী দিনে (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১) জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক মহম্মদ শামসুল হক, ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ওসমান গণি এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক খান মুহম্মদ সালেক বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, সে সময় সমগ্র বাঙালির যে স্বাধিকারমুখী স্রোত, নব্য প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টি তার বাইরে ছিল না; বরং প্রতিষ্ঠার সময়ই বিদ্যালয়ের মূল দিগ্দর্শন প্রতিফলিত হয়েছিল এই বাংলা ভাষণে। তিনজনের ভাষণেই যে কটি দিক তাত্পর্যময় হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ, যার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হবে দেশপ্রেমের চেতনা। এ লক্ষ্য কতটা বাস্তবায়িত হয়েছিল তা বোঝা যায় মাত্র ১০ বছর পর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের তিনজন ছাত্র শহীদ হওয়ায়। তাঁরা হলেন শহীদ আকরাম (১৯৭১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামানের ছেলে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাবার সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করে), শহীদ মুনির (১৯৭১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। বিজয়ের প্রাক্কালে শহীদ হন) এবং শহীদ মাজহার (২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে শহীদ হন)। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রকাশনা অনুশীলন ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও শহীদ শিক্ষার্থীদের মর্মগাথা। মুক্তিযুদ্ধকালে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের কী চিত্র ছিল তার খানিকটা উঠে আসে শহীদজননী জাহানারা ইমামের অনন্য গ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলিতে। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিনে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক খান মুহম্মদ সালেক যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা এ স্কুলের ইতিহাসে চিরদিন এক মহাসনদ হিসেবে পরিগণিত হবে। বিদ্যালয়ে বর্তমানে যে মনোগ্রামটি ব্যবহার করা হয়, তার মূল পরিকল্পনাকারী ও ডিজাইনার ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। মহাকবি গ্যেটের সর্বশেষ মেটাফোর ‘লাইট মোর লাইট’-এর বাংলা অনুবাদে ‘আলো আরও আলো’—এই শাশ্বত বাণীকে করা হয়েছে বিদ্যালয়ের আদর্শ। উদ্বোধনী সময়ে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে যে ১৪ জন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন: খান মুহম্মদ সালেক (প্রধান শিক্ষক), এ বি মফিজ উদ্দিন আহমেদ (সহকারী প্রধান শিক্ষক), সিরাজুল হক খান, মুহম্মদ জাফর আলী, আব্দুর রশীদ, মুহম্মদ জহিরুল হক, মুহম্মদ নুরুল ইসলাম, এ বি এম নুরুল ইসলাম, মুকসেদুর রহমান হাওলাদার, মুহম্মদ শরীফ উদ্দিন, খবীর উদ্দিন আহমেদ, মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, মুহম্মদ সা’দত আলী ও সুরঞ্জন দত্ত। মূল পরিকল্পনায় বিদ্যালয়ে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মোট আটটি শ্রেণী রাখার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু অধ্যক্ষ মুহম্মদ ওসমান গণি ও প্রধান শিক্ষক খান মুহম্মদ সালেকের বিশেষ আগ্রহে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী রাখার ব্যবস্থাও করা হয়। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো সরকারি বিদ্যালয়েই সর্বনিম্ন এ দুই শ্রেণীর ব্যবস্থা ছিল না।
আজ ৪৯ বছরের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অতীতের সেই ছবি কতটুকু স্পষ্ট হয়ে আছে, এ প্রশ্ন হয়তো উঠতে পারে। এ কথাও ঠিক, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ঐতিহ্যের স্বর্ণালি আলো খানিকটা হলেও ম্লান হয়েছে। এ মলিনতার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাও কিছু অংশে দায়ী। ৭৩ ব্যাচের ড. এম এ মোমেন তাঁর এক স্মৃতিকথায় জহিরুল হক স্যারের একটি কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মন্ত্রী আর আমলার নির্দেশে যদি ছাত্র ভর্তি করতে হয়, তাহলে দেশে আর সুশিক্ষা থাকবে না।’ এখন তো আর জহিরুল হক স্যার নেই, তাই হয়তো সুশিক্ষার কথাটা অনেকেরই নজরে আসে না। চোখ মেলে দেখে না—এ প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে একটি ইতিহাসের অমিয়ধারা।
আজ গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আনন্দ, উল্লাস, প্রিয় স্কুলকে প্রিয়তম সম্বোধনে ডেকে মন ভরিয়ে তোলা, স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে সব আয়োজন সাঙ্গ করে চোখ রাখব কালের আরশিতে। সেখান থেকে শার্ল বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদলের মতো ভেসে আসবে অনুপ্রেরণা—সেই অনুপ্রেরণায় আবার ফিরে আসবে আমার পুরোনো স্কুল নতুন উদ্দীপনায়। শুভ জন্মদিন, প্রিয় গবর্নমেন্ট ল্যাবরটেরি স্কুল।
grmaruf@gmail.com
আজ ৪৯ বছরের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অতীতের সেই ছবি কতটুকু স্পষ্ট হয়ে আছে, এ প্রশ্ন হয়তো উঠতে পারে। এ কথাও ঠিক, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ঐতিহ্যের স্বর্ণালি আলো খানিকটা হলেও ম্লান হয়েছে। এ মলিনতার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাও কিছু অংশে দায়ী। ৭৩ ব্যাচের ড. এম এ মোমেন তাঁর এক স্মৃতিকথায় জহিরুল হক স্যারের একটি কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মন্ত্রী আর আমলার নির্দেশে যদি ছাত্র ভর্তি করতে হয়, তাহলে দেশে আর সুশিক্ষা থাকবে না।’ এখন তো আর জহিরুল হক স্যার নেই, তাই হয়তো সুশিক্ষার কথাটা অনেকেরই নজরে আসে না। চোখ মেলে দেখে না—এ প্রতিষ্ঠানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে একটি ইতিহাসের অমিয়ধারা।
আজ গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আনন্দ, উল্লাস, প্রিয় স্কুলকে প্রিয়তম সম্বোধনে ডেকে মন ভরিয়ে তোলা, স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে সব আয়োজন সাঙ্গ করে চোখ রাখব কালের আরশিতে। সেখান থেকে শার্ল বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদলের মতো ভেসে আসবে অনুপ্রেরণা—সেই অনুপ্রেরণায় আবার ফিরে আসবে আমার পুরোনো স্কুল নতুন উদ্দীপনায়। শুভ জন্মদিন, প্রিয় গবর্নমেন্ট ল্যাবরটেরি স্কুল।
grmaruf@gmail.com
No comments