কালের আয়নায়-ড. ইউনূসের কাছে একটি খোলা চিঠি by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

ধরে নেওয়া যাক, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন! তাহলে এই তদন্তে আপনার আপত্তি জানাবার বা ভীত হওয়ার কারণ কী থাকতে পারে? তাহলে আপনার আপত্তি কি তদন্ত কমিশন সম্পর্কে? তাদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তে আপনি আস্থা রাখেন না? যে চারজন তদন্ত কমিশনের সদস্য হয়েছেন, তারা আপনার বিরোধী মহলের ব্যক্তি নন এবং তাদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার এখন পর্যন্ত


অবকাশ ঘটেনি শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু মানে, বিদ্যাবুদ্ধিতে এবং বিশ্বজোড়া খ্যাতিত্বে এত বড় যে, আপনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই চিঠিটা লেখা সমীচীন মনে করেছি। গত বৃহস্পতিবার ৩১ মে ঢাকার কাগজগুলোতে প্রকাশিত 'গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এবং আমার শঙ্কা' শীর্ষক লেখাটা আমি পড়েছি। আমাকে ক্ষমা করবেন, লেখাটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় ১৫ মে ২০১২ তারিখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত করে নানা বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য যে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছে, তাতে আপনি অসন্তুষ্ট ও শঙ্কিত।
এই তদন্ত হবে গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মকাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ যে সময়টা আপনি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি কি এই তদন্তের ব্যাপারে ভীত? আপনি ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনকালে কি এমন কোনো অনিয়ম করেছেন, যাতে কোনো প্রকার তদন্তে আপনি শঙ্কিত হতে পারেন?
আপনার প্রবন্ধেই আপনি প্রশ্নটি তুলেছেন। লিখেছেন, 'সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে বিশ্বস্বীকৃতি পেল, সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে? এ পর্যন্ত যত তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে সেগুলো বড় রকমের অঘটন ঘটার পর, মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগার কারণে সরকার তদন্ত কমিশন গঠন করে তার তদন্ত করেছে।'
এক কথায় আপনার প্রধান আপত্তি সরকার গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠন করায়। আপনার কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন, আপনার এই ঘোরতর আপত্তি কেন? আপনার গোটা প্রবন্ধটি 'ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না' গোছের লেখা। দীর্ঘ ৩৪ বছর (১৯৭৬-২০১০) গ্রামীণ ব্যাংকের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব সম্পন্ন প্রধান নির্বাহী থাকাকালে আপনি কি এমন কোনো অনিয়ম করেছেন, যাতে কোনো প্রকার তদন্তে আপনার এই আপত্তি এবং শঙ্কা? যদি কোনো প্রকার অনিয়ম না হয়ে থাকে, তাহলে সরকার যত তদন্তই করুক, আপনার তো আপত্তি করার কিছু নেই। তদন্ত হওয়ার পর যদি দেখা যায়, তদন্তটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নয়, তাহলে অবশ্যই আপনি আপত্তি জানাবেন এবং দেশের মানুষও জানবে তদন্তের উদ্দেশ্য শুভ ও সাধু ছিল না। আপনি এই তদন্ত কমিশনের সুপারিশ জানার জন্য অপেক্ষা করেননি, তার আগেই আপত্তি জানিয়েছেন এবং দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় শোরগোল তুলেছেন।
আপনার আপত্তি তদন্ত সম্পর্কে, না তদন্ত কমিশন সম্পর্কে? তদন্ত সম্পর্কে হলে বলতে পারি, আপনি ৩৪ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকে একচ্ছত্র ক্ষমতায় ছিলেন। কোনো রাষ্ট্রের স্থপতিও এত দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে পারেন না (যারা বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় থাকেন তাদের বেলায় অন্য কথা)। আপনার এই দীর্ঘ একচ্ছত্র রাজত্বকালে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে কি কোনো অনিয়মের অভিযোগই ওঠেনি? সুদের চড়া হার, ঋণ পরিশোধে অসক্ষমদের ওপর কাবুলি-নির্যাতন, ঋণগ্রহীতাদের কারও কারও আত্মহত্যা, শেয়ারহোল্ডারদের কোনো মুনাফার অংশ না দেওয়ার ব্যবস্থা, ঋণদাতা দেশগুলোর কাছ থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের নামে ঋণ নিয়ে তাদের অজ্ঞাতে সেই অর্থ নিজের অন্য প্রকল্পে নিয়োগ করা, গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ ও শক্তি এবং নোবেল পুরস্কারকে দেশে গণতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করা ইত্যাদি অসংখ্য অনিয়ম ও অব্যবস্থার অভিযোগগুলো কি গত কয়েক বছর ধরে অনবরত আপনার বিরুদ্ধে ওঠেনি? এই ধরনের অভিযোগ সম্পর্কে কোনো দেশের সরকারেরই কি চোখ মুদে থাকা সম্ভব?
ধরে নেওয়া যাক, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন! তাহলে এই তদন্তে আপনার আপত্তি জানাবার বা ভীত হওয়ার কারণ কী থাকতে পারে? তাহলে আপনার আপত্তি কি তদন্ত কমিশন সম্পর্কে? তাদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তে আপনি আস্থা রাখেন না? যে চারজন তদন্ত কমিশনের সদস্য হয়েছেন, তারা আপনার বিরোধী মহলের ব্যক্তি নন এবং তাদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার এখন পর্যন্ত অবকাশ ঘটেনি। তথাপি আপনি এই কমিশন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন এবং বলেছেন, 'আন্তর্জাতিক মানের অডিট ফার্মকে গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক লেনদেনের ইতিহস বের করতে দিলে তারা সব কথা বের করে নিয়ে আসবে। এর জন্য পুরোদস্তুর তদন্ত কমিশন বসানোর দরকার কী?
আপনাকেই বিনয়পুরসর জিজ্ঞাসা করি, কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের হিসাব খতিয়ে দেখা আর ৩৪ বছর ধরে চলা নানা অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করে সেই অনিয়ম দূর করার সুপারিশ জানানো কি এক কথা? গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার বিভিন্ন অনিয়ম ও এতকালের ব্যক্তিকেন্দ্রিক অব্যবস্থার কারণগুলো দূর করে ব্যাংকটির উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া কি সরকারের আরও আগে উচিত ছিল না? এখন সরকার সেই পদক্ষেপ নেওয়ায় আপনি কি ভাবছেন, 'কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে?'
এই তদন্ত ও তদন্ত কমিশন সম্পর্কে আপনি কতটা ভীত তার প্রমাণ মেলে আপনার লেখার একটি মন্তব্যে। আপনি লিখেছেন, 'এই তদন্ত কমিশনের সময়সীমা দেখে মনে হতে পারে ছুরি-কাঁচি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে কাজে নামা ছাড়া তাদের গতি নেই।' অর্থাৎ এই ছুরি-কাঁচি আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে বলে ভয় পাচ্ছেন। আপনার লেখার পরবর্তী মন্তব্যটি পড়লেই এই ভীতিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আপনি লিখেছেন, '... গ্রামীণ নামের কোম্পানিগুলো নিয়ে সরকারের অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো পড়লে মনে হয় হয়তো সরকারের ধারণা যে, কোম্পানিগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় সৃষ্টি হয়েছে, অথচ সেগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেই।' অর্থাৎ মালিকানা হস্তান্তর হয়েছে। এভাবে দাতা সংস্থাকে না জানিয়ে অন্য প্রকল্পে অর্থ সরানোর গুরুতর অভিযোগ কি একবার এক বিদেশি সাংবাদিক আপনার বিরুদ্ধে তোলেননি? আপনি অসাধারণ বুদ্ধি কৌশলে, নিজের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সুনাম ভাঙিয়ে সেই অভিযোগ সামাল দিয়েছিলেন। এখন আপনি চাচ্ছেন, এসব গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে যেন নতুন করে কোনো তদন্ত না হয়; কেবল ব্যাংকের হিসাবপত্র অডিট করার মধ্যে সব কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকে।
আপনার মতো একজন বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিতের লেখায় এত স্ববিরোধিতা আছে যে আমি বিস্মিত হয়েছি। যেমন আপনার লেখার এক স্থানে আপনি উল্লেখ করেছেন, 'আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের সঙ্গে আমি গ্রামীণ নাম ব্যবহার করে এসেছি।... আইন অনুসারে এদের কোনো মালিক নেই।... এগুলো থেকে কেউ মুনাফা পায় না। যেহেতু কারও এতে মালিকানা নেই।' আবার অন্যত্র বলেছেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই নিরক্ষর মহিলা।' গরিব মহিলাদের এই মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই সরকার সচেষ্ট বলেও আপনি অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, 'নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ করে গরিব মানুষের ক্ষমতায়নে যারা বিশ্বাসী, তাদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি আমার এই লেখাটি ছাপিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সকল শাখায় পাঠাচ্ছি, যাতে ঋণগ্রহীতা মালিকরা তাদের মালিকানা রক্ষা করার জন্য তারাও স্থানীয় গণ্যমান্যদের মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাতে পারেন।'
একবার বলা আপনার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ নামধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন অনুসারে কোনো মালিক নেই (মালিক আসলে আপনিই), তারপরই বলা গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের ৮০ ভাগই নিরক্ষর মহিলা_এটা যে কত বড় শুভঙ্করের ফাঁকি, আমি এ সম্পর্কে পরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস আপনাকে সকল আন্তরিকতা নিয়ে বলছি, ৩১ মে প্রকাশিত আপনার লেখাটিতে স্ববিরোধিতাপূর্ণ অনেক কথাবার্তা থাকা সত্ত্বেও এই লেখাটি নিয়ে আমার কোনো ধরনের আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু গত ২৬ মে লন্ডনের দি ইকোনমিস্টে প্রকাশিত 'পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক লেখাটিতে আপনার প্রসঙ্গ বারবার টেনে বাংলাদেশ সরকারের ওপর যেভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে এবং বাংলাদেশে ভারতকে হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আপনার ৩১ মের লেখাটি মিলিয়ে পড়ে আমার মনেও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আপনার শঙ্কা গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে। আমার শঙ্কা সারা বাংলাদেশ নিয়ে।
আমার এই শঙ্কা আরও বেড়েছে, এখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখে আবার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের অখণ্ডতা যেন রক্ষা পায় এবং এ সম্পর্কে তদন্ত কমিশনের তদন্তে যেন স্বচ্ছতা থাকে।
বিশ্বের একক সুপার পাওয়ারের প্রভাবশালী এক নেত্রীর উদ্বেগ বাংলাদেশ নিয়ে নয়, তার উদ্বেগ একটি বাংলাদেশি ব্যাংক সম্পর্কে এবং এই ব্যাংক সম্পর্কে সরকারি তদন্ত কমিশনের ভূমিকাতেও তিনি নাক গলাতে চান। এ ব্যাপারটির মহাআশঙ্কাজনক দিকটির কথা কি আপনি ভেবে দেখেছেন? এটা একটা স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পরাশক্তির ঔদ্ধত্যপূর্ণ হস্তক্ষেপ। আপনি এই একটি ব্যাপারে দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও আমল দেননি। দেশের তদন্ত কমিশনের সুপারিশ জানার জন্যও অপেক্ষা করতে চান না। বিদেশি মিডিয়া বিশেষ করে ইকোনমিস্টের গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার, হিলারি ক্লিনটন ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সীমা অতিক্রমকারী কথাবার্তা এসবের পেছনে আপনার কী সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে এবং গ্রামীণ ব্যাংকে আপনার কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আপনি বিদেশি হস্তক্ষেপও টেনে আনতে চান? আপনি যে আগুন নিয়ে খেলছেন, শুধু এই কথাটা আপনাকে বোঝানোর জন্যই আপনার কাছে আমার এই খোলা চিঠি লেখা। নিজেকে এবং নোবেল পুরস্কারটিও আপনি যেন আর বিতর্কিত না করেন।
লন্ডন, ৭ জুন ২০১২, বৃহস্পতিবার
 

No comments

Powered by Blogger.