ইরানে পাশ্চাত্যবিরোধের অকার্যকারিতা by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য শক্তির বিভিন্ন মাত্রার অব্যাহত অবরোধ সত্ত্বেও ইরান তার দাবিকৃত শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার করেছে। গত ২৩ ও ২৪ মে অনুষ্ঠিত বাগদাদ সম্মেলনে ইরানের সঙ্গে 'পঞ্চশক্তি+এক'-এর ঐকমত্য না হওয়ায় এবং এর অব্যবহিত পর আরো দুটি পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণে ইরানের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমিত হচ্ছে, ইরানে সাম্রাজ্যবাদী নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হচ্ছে।
ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার তাঁবেদার ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীর অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইরানের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা এবং অবরোধ (embargo) আরোপ করে চলেছে।
গত বছরের শেষদিনে (৩১ ডিসেম্বর) এবং ২০১২ সালের প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের তেল বিক্রির অর্থের বেশির ভাগ আসে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এবং সে কারণে মার্কিনিরা মনে করছে, এ নিষেধাজ্ঞা ইরানকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ৩ জানুয়ারি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে এক কূটনীতিক জানান, ২৭ রাষ্ট্রের ইউরোপীয় জোট ইইউ (EU) ইরান থেকে তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইরান থেকে তেল আমদানি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবে চূড়ান্তভাবে সম্মত হয়েছে ইইউ দেশগুলো। ইইউ ভাবছে, ইরান যেহেতু তাদের কাছে মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ তেল বিক্রি করে, তাই এ নিষেধাজ্ঞা ইরানকে বিপর্যস্ত করবে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানের অর্থনীতির সমূহ ক্ষতিসাধন করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে ইরানকে শায়েস্তা করার কৌশল হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জোট একত্র হলেও ইরান সমূহ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার মানসিক, মনোজাগতিক ও বাস্তবিক সব প্রস্তুতি গ্রহণে আগে থেকেই সতর্ক বলে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে।
একদিকে উপসাগরে সামরিক উত্তেজনা, অন্যদিকে ইরানে ইসরায়েলের সম্ভাব্য আক্রমণ এবং এর বিরুদ্ধে ইরানের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীদের কাছে ইরান ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো : আরোপিত অবরোধ ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণে বিরত রাখতে সক্ষম হবে কি?
ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কৌশল কার্যকর করার পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা ইরানের তেল আমদানিকারী রাষ্ট্রগুলো যেমন- চীন, জাপান, ভারতসহ অন্যান্য দেশে ঘন ঘন সফর শুরু করেছেন। মার্কিন অর্থমন্ত্রী টিমোথি গেইদনার মধ্য-জানুয়ারিতে দূরপ্রাচ্যের চীন ও জাপান সফর করলেও তা তেমন কার্যকর হয়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
প্রথমত, গত ৪ জানুয়ারি চীন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে চীন। চীনের পাশাপাশি ভারতও ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি যুক্তরাষ্ট্রে দুই দিনের বাণিজ্য সফর শেষে এক ঘোষণায় বলেন, ভারতের তেল আমদানির যে ১২ শতাংশ ইরান থেকে আনা হয়, তা কখনো ভারত হ্রাস করবে না। উল্লেখ্য, তেল চাহিদার দিক থেকে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ দেশ এবং চীন ও জাপানের পর ভারত হলো ইরানি তেলের তৃতীয় বৃহৎ ক্রেতা।
দ্বিতীয়ত, ইরান থেকে দ্বিতীয় বৃহৎ তেল ক্রয়কারী দেশ জাপান যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও অত্যন্ত কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি পাশ কাটিয়ে গেছে। ইরান থেকে তেল ক্রয় হ্রাস করবে মর্মে ঘোষণা প্রদান করলেও কবে থেকে কত পরিমাণ হ্রাস করবে তার বিস্তারিত কিছু জাপান এ পর্যন্ত জানায়নি। জাপানের অর্থমন্ত্রী জুন আজমি যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব সচিব টিমথি গেগারের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইরান থেকে তেল আমদানি কমাতে জাপান বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেবে। তাঁর এ বক্তব্য থেকে পাশ্চাত্যের তেমন সফল কূটনৈতিক অর্জন মিলছে বলে অনুমিত হয় না।
তৃতীয়ত, ইইউ রাষ্ট্রগুলো ইরানে তেল অবরোধ আরোপ বিষয়ের মাত্রা, চরিত্র, প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ে বেশ মতপার্থক্যে নিমজ্জিত। যেমন- অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত গ্রিস ইরানের অবরোধের ফলে ভীষণ অর্থনৈতিক দুরবস্থার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। তেহরান থেকে বেশ সুবিধাপ্রাপ্ত গ্রিস এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প পাবে না বলে নিশ্চিত এবং সে কারণে আরোপিত অবরোধের ব্যাপারে তার বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। গত শুক্রবার ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্যারিস বৈঠকে কূটনীতিকদের সামনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি বলেন, ইরানে হস্তক্ষেপ চারদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প খোঁজার কারণ এটাই যে ইরানে অবরোধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে ইইউ এখনো নিশ্চিত নয়।
চতুর্থত, ইরান অবরোধের বিষয়টিকে অন্য দেশগুলোও সহজে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। অবরোধ আরোপের পর পরই বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। বাংলাদেশ সরকারও ইতিমধ্যে তেলের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে মনে করেন, ইরান অবরোধের ফলে শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশগুলো মারাত্মক অর্থ সংকটে নিপতিত হচ্ছে এবং এ কারণে ইরান অবরোধের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ছোট দেশগুলোকে শাস্তি দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। গত জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্কের বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে ফেব্রুয়ারিতে সরবরাহ হবে এমন তেলের দাম ৬১ সেন্টস বাড়ানোয় ব্যারেলপ্রতি দাম ১০১.৯২ ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং ব্রেন্ট নর্থ সি তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১১২.৭৯ ডলারে উন্নীত হয়েছে। উল্লিখিত কারণগুলোর আলোকে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে যে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে তা তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইইউ নেতাদের নানা তৎপরতা সত্ত্বেও ভারত ইরান থেকে তেল ক্রয়ে পিছপা হবে না মর্মে যে ঘোষণা দিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় মিত্রের এক বড় অসহযোগিতার উদাহরণ। পাকিস্তানসহ অত্রাঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোও ইরান অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য নীতি প্রচণ্ড প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী কূটনীতিক নিকোলাস বার্নস ইরান থেকে তেল ক্রয়ে ভারতীয় সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের গালে চড় মারার মতো ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা নিরাপত্তাকর্মীরা পর্যবেক্ষণ করছেন যে চীন ও তুরস্কের ব্যাংকিং খাতের সহায়তা নিয়ে ইরান প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছে এবং এভাবে দেশটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিতে সক্ষম হচ্ছে। তৃতীয়ত, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে চার দফা নিষেধাজ্ঞার পরও জাতিসংঘ ইরানকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়নি। প্রতীয়মান হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমানে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও ইরানকে বশ করতে সক্ষম হবে না। চতুর্থত, যেকোনো হুমকির মোকাবিলায় মনোকাঠামোগত দৃঢ়তা ও বাস্তব প্রস্তুতি কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। অবরোধের বিরুদ্ধে ইরানের সে প্রস্তুতি রয়েছে সর্বাংশে।
পঞ্চমত, পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বারবার ইরান তার প্রযুক্তিগত সাফল্য প্রদর্শন করছে। ইতিমধ্যে মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন বিমান ভূপাতিত করে ইরান তা কবজায় নিয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিপ্লবের ৩৩তম বার্ষিকীতে তেহরানের আজাদি স্কয়ারে হাজার হাজার জনতার সামনে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ঘোষণা করেন, পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সামনে ইরান কখনো মাথা নত করবে না। কেবল ইরানকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে গ্রহণযোগ্য আলোচনায় বসলে ইরান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে তিনি বটম লাইন চিহ্নিত করেন।
উল্লিখিত যুক্তি অবতারণার আলোকে এ কথা বলা যায় যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রচক্রের অব্যাহত অবরোধ পশ্চিমাদের একক স্বার্থ অর্জনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না। পশ্চিমারা আগামী জুলাইয়ের পর ইরান থেকে ইউরোপীয় তেল ক্রয় বন্ধ করার ঘোষণার অব্যবহিত পর ইউরোপে তেল বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইরান পাশ্চাত্যকে যে বেত্রাঘাত করেছে, তা পাশ্চাত্যের মনোকাঠামো ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ইরানের তেল মন্ত্রণালয় ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ইরানের তেলমন্ত্রী রোস্তাম কাশেমির মতে, ইউরোপে তেল বিক্রি বন্ধ ইরানের কোনো ক্ষতি করবে না। তাই সংগত কারণে ইইউ নিষেধাজ্ঞা কোনো কার্যকর ফলাফলও বয়ে আনবে না।
উল্লিখিত বিশ্লেষণের আলোকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইরান-পাশ্চাত্য পরমাণু আলোচনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধ সর্বাংশে অকৃতকার্য হচ্ছে। এমতাবস্থায় বর্তমান অচলাবস্থা দূর করতে ফলপ্রসূ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ অপরিহার্য, যার সফলতা নির্ভর করছে নিম্নে বর্ণিত বিষয়ের ওপর।
প্রথমেই লক্ষ করতে হবে, কোনো হুমকি-ধমকির সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের কাছে ইরানকে পরাস্ত করা যায় কি না। যেকোনো শান্তি আলোচনায় পারস্পরিক দাবির প্রতি যৌক্তিক সমর্থন জরুরি এবং পারস্পরিক সম্মান রক্ষা বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মীমাংসার পথে নিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি। ইরানের দাবি যদি সত্যিই সত্য হয়, পারমাণবিক কর্মসূচি যদি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে হয়, তা যদি আইএইএর নীতির আওতায় থাকে, তাহলে তার যৌক্তিক সমাধান বের করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ইরানের দাবি অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা দরকার। ইস্তাম্বুল ও বাগদাদ সম্মেলনে ছয় শক্তি অবরোধের ব্যাপারে যে অনমনীয়তা দেখিয়েছে, তা সমস্যাকে আরো গভীর করবে। তৃতীয়ত, ইরান ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা করছে, তা নস্যাৎ করার আগে এর উত্তমতর বিকল্প নির্ধারণ করা উচিত। চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি-সাম্যের প্রয়োজনে ইরানের মতো ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে পাশ্চাত্যের বজ্রকঠিন নীতি সময়ের দাবি। মধ্যপ্রাচ্যের আরব-বসন্তের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাস্তবতায় পাশ্চাত্যের শক্তি-সাম্যবিহীন নীতি অত্রাঞ্চলে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। পঞ্চমত, ইরানকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা না করে ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে ইরানের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও জাত্যাভিমান আন্তর্জাতিক সমমর্যাদার মাপকাঠিতে নিরূপণ করা জরুরি। পরিশেষে বাগদাদ সম্মেলন ব্যর্থ হলেও সেই ব্যর্থতা থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভূত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দূর করতে সংলাপের নতুন পথ রচনা অপরিহার্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mramin68@yahoo.com
গত বছরের শেষদিনে (৩১ ডিসেম্বর) এবং ২০১২ সালের প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের তেল বিক্রির অর্থের বেশির ভাগ আসে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এবং সে কারণে মার্কিনিরা মনে করছে, এ নিষেধাজ্ঞা ইরানকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ৩ জানুয়ারি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে এক কূটনীতিক জানান, ২৭ রাষ্ট্রের ইউরোপীয় জোট ইইউ (EU) ইরান থেকে তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে ইরান থেকে তেল আমদানি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবে চূড়ান্তভাবে সম্মত হয়েছে ইইউ দেশগুলো। ইইউ ভাবছে, ইরান যেহেতু তাদের কাছে মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশ তেল বিক্রি করে, তাই এ নিষেধাজ্ঞা ইরানকে বিপর্যস্ত করবে। একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানের অর্থনীতির সমূহ ক্ষতিসাধন করে সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে ইরানকে শায়েস্তা করার কৌশল হিসেবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি জোট একত্র হলেও ইরান সমূহ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার মানসিক, মনোজাগতিক ও বাস্তবিক সব প্রস্তুতি গ্রহণে আগে থেকেই সতর্ক বলে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে।
একদিকে উপসাগরে সামরিক উত্তেজনা, অন্যদিকে ইরানে ইসরায়েলের সম্ভাব্য আক্রমণ এবং এর বিরুদ্ধে ইরানের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীদের কাছে ইরান ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো : আরোপিত অবরোধ ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণে বিরত রাখতে সক্ষম হবে কি?
ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কৌশল কার্যকর করার পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা ইরানের তেল আমদানিকারী রাষ্ট্রগুলো যেমন- চীন, জাপান, ভারতসহ অন্যান্য দেশে ঘন ঘন সফর শুরু করেছেন। মার্কিন অর্থমন্ত্রী টিমোথি গেইদনার মধ্য-জানুয়ারিতে দূরপ্রাচ্যের চীন ও জাপান সফর করলেও তা তেমন কার্যকর হয়নি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
প্রথমত, গত ৪ জানুয়ারি চীন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে যে ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে চীন। চীনের পাশাপাশি ভারতও ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি যুক্তরাষ্ট্রে দুই দিনের বাণিজ্য সফর শেষে এক ঘোষণায় বলেন, ভারতের তেল আমদানির যে ১২ শতাংশ ইরান থেকে আনা হয়, তা কখনো ভারত হ্রাস করবে না। উল্লেখ্য, তেল চাহিদার দিক থেকে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ দেশ এবং চীন ও জাপানের পর ভারত হলো ইরানি তেলের তৃতীয় বৃহৎ ক্রেতা।
দ্বিতীয়ত, ইরান থেকে দ্বিতীয় বৃহৎ তেল ক্রয়কারী দেশ জাপান যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও অত্যন্ত কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি পাশ কাটিয়ে গেছে। ইরান থেকে তেল ক্রয় হ্রাস করবে মর্মে ঘোষণা প্রদান করলেও কবে থেকে কত পরিমাণ হ্রাস করবে তার বিস্তারিত কিছু জাপান এ পর্যন্ত জানায়নি। জাপানের অর্থমন্ত্রী জুন আজমি যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব সচিব টিমথি গেগারের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইরান থেকে তেল আমদানি কমাতে জাপান বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেবে। তাঁর এ বক্তব্য থেকে পাশ্চাত্যের তেমন সফল কূটনৈতিক অর্জন মিলছে বলে অনুমিত হয় না।
তৃতীয়ত, ইইউ রাষ্ট্রগুলো ইরানে তেল অবরোধ আরোপ বিষয়ের মাত্রা, চরিত্র, প্রকৃতি ও পরিধি নিয়ে বেশ মতপার্থক্যে নিমজ্জিত। যেমন- অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত গ্রিস ইরানের অবরোধের ফলে ভীষণ অর্থনৈতিক দুরবস্থার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। তেহরান থেকে বেশ সুবিধাপ্রাপ্ত গ্রিস এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প পাবে না বলে নিশ্চিত এবং সে কারণে আরোপিত অবরোধের ব্যাপারে তার বেশ মতপার্থক্য রয়েছে। গত শুক্রবার ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্যারিস বৈঠকে কূটনীতিকদের সামনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি বলেন, ইরানে হস্তক্ষেপ চারদিকে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেবে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিকল্প খোঁজার কারণ এটাই যে ইরানে অবরোধের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভে ইইউ এখনো নিশ্চিত নয়।
চতুর্থত, ইরান অবরোধের বিষয়টিকে অন্য দেশগুলোও সহজে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। অবরোধ আরোপের পর পরই বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। বাংলাদেশ সরকারও ইতিমধ্যে তেলের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে মনে করেন, ইরান অবরোধের ফলে শ্রীলঙ্কার মতো ছোট দেশগুলো মারাত্মক অর্থ সংকটে নিপতিত হচ্ছে এবং এ কারণে ইরান অবরোধের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ছোট দেশগুলোকে শাস্তি দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। গত জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্কের বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে ফেব্রুয়ারিতে সরবরাহ হবে এমন তেলের দাম ৬১ সেন্টস বাড়ানোয় ব্যারেলপ্রতি দাম ১০১.৯২ ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং ব্রেন্ট নর্থ সি তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১১২.৭৯ ডলারে উন্নীত হয়েছে। উল্লিখিত কারণগুলোর আলোকে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে যে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে তা তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইইউ নেতাদের নানা তৎপরতা সত্ত্বেও ভারত ইরান থেকে তেল ক্রয়ে পিছপা হবে না মর্মে যে ঘোষণা দিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় মিত্রের এক বড় অসহযোগিতার উদাহরণ। পাকিস্তানসহ অত্রাঞ্চলের অন্য রাষ্ট্রগুলোও ইরান অবরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য নীতি প্রচণ্ড প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সময় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী কূটনীতিক নিকোলাস বার্নস ইরান থেকে তেল ক্রয়ে ভারতীয় সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের গালে চড় মারার মতো ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা নিরাপত্তাকর্মীরা পর্যবেক্ষণ করছেন যে চীন ও তুরস্কের ব্যাংকিং খাতের সহায়তা নিয়ে ইরান প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছে এবং এভাবে দেশটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিতে সক্ষম হচ্ছে। তৃতীয়ত, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে চার দফা নিষেধাজ্ঞার পরও জাতিসংঘ ইরানকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়নি। প্রতীয়মান হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমানে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও ইরানকে বশ করতে সক্ষম হবে না। চতুর্থত, যেকোনো হুমকির মোকাবিলায় মনোকাঠামোগত দৃঢ়তা ও বাস্তব প্রস্তুতি কার্যকর প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। অবরোধের বিরুদ্ধে ইরানের সে প্রস্তুতি রয়েছে সর্বাংশে।
পঞ্চমত, পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বারবার ইরান তার প্রযুক্তিগত সাফল্য প্রদর্শন করছে। ইতিমধ্যে মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন বিমান ভূপাতিত করে ইরান তা কবজায় নিয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিপ্লবের ৩৩তম বার্ষিকীতে তেহরানের আজাদি স্কয়ারে হাজার হাজার জনতার সামনে প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ ঘোষণা করেন, পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সামনে ইরান কখনো মাথা নত করবে না। কেবল ইরানকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে গ্রহণযোগ্য আলোচনায় বসলে ইরান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে তিনি বটম লাইন চিহ্নিত করেন।
উল্লিখিত যুক্তি অবতারণার আলোকে এ কথা বলা যায় যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রচক্রের অব্যাহত অবরোধ পশ্চিমাদের একক স্বার্থ অর্জনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে না। পশ্চিমারা আগামী জুলাইয়ের পর ইরান থেকে ইউরোপীয় তেল ক্রয় বন্ধ করার ঘোষণার অব্যবহিত পর ইউরোপে তেল বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইরান পাশ্চাত্যকে যে বেত্রাঘাত করেছে, তা পাশ্চাত্যের মনোকাঠামো ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ইরানের তেল মন্ত্রণালয় ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। ইরানের তেলমন্ত্রী রোস্তাম কাশেমির মতে, ইউরোপে তেল বিক্রি বন্ধ ইরানের কোনো ক্ষতি করবে না। তাই সংগত কারণে ইইউ নিষেধাজ্ঞা কোনো কার্যকর ফলাফলও বয়ে আনবে না।
উল্লিখিত বিশ্লেষণের আলোকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইরান-পাশ্চাত্য পরমাণু আলোচনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধ সর্বাংশে অকৃতকার্য হচ্ছে। এমতাবস্থায় বর্তমান অচলাবস্থা দূর করতে ফলপ্রসূ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ অপরিহার্য, যার সফলতা নির্ভর করছে নিম্নে বর্ণিত বিষয়ের ওপর।
প্রথমেই লক্ষ করতে হবে, কোনো হুমকি-ধমকির সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের কাছে ইরানকে পরাস্ত করা যায় কি না। যেকোনো শান্তি আলোচনায় পারস্পরিক দাবির প্রতি যৌক্তিক সমর্থন জরুরি এবং পারস্পরিক সম্মান রক্ষা বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মীমাংসার পথে নিয়ে যাওয়ার মূল চালিকাশক্তি। ইরানের দাবি যদি সত্যিই সত্য হয়, পারমাণবিক কর্মসূচি যদি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে হয়, তা যদি আইএইএর নীতির আওতায় থাকে, তাহলে তার যৌক্তিক সমাধান বের করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ইরানের দাবি অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা দরকার। ইস্তাম্বুল ও বাগদাদ সম্মেলনে ছয় শক্তি অবরোধের ব্যাপারে যে অনমনীয়তা দেখিয়েছে, তা সমস্যাকে আরো গভীর করবে। তৃতীয়ত, ইরান ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা করছে, তা নস্যাৎ করার আগে এর উত্তমতর বিকল্প নির্ধারণ করা উচিত। চতুর্থত, মধ্যপ্রাচ্যের শক্তি-সাম্যের প্রয়োজনে ইরানের মতো ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে পাশ্চাত্যের বজ্রকঠিন নীতি সময়ের দাবি। মধ্যপ্রাচ্যের আরব-বসন্তের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাস্তবতায় পাশ্চাত্যের শক্তি-সাম্যবিহীন নীতি অত্রাঞ্চলে কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। পঞ্চমত, ইরানকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা না করে ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে ইরানের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও জাত্যাভিমান আন্তর্জাতিক সমমর্যাদার মাপকাঠিতে নিরূপণ করা জরুরি। পরিশেষে বাগদাদ সম্মেলন ব্যর্থ হলেও সেই ব্যর্থতা থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ভূত শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি দূর করতে সংলাপের নতুন পথ রচনা অপরিহার্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mramin68@yahoo.com
No comments